নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চশমা

১৮ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০৫

বাড়ি থেকে বেরুবার আগে নিয়মের ব্যতিক্রম না করে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখেছিলো; কপালের উপরিভাগ থেকে শুরু করে পেটের মধ্যভাগ অবধি, আপাত কোন খুঁত চোখে ধরা পড়েনি, তৃপ্ত মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো জামান। বিয়ের পর থেকে গড়ে উঠা অভ্যাস; অভ্যস্ততাই শুধু নয়, নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে নিঁখুত আবিষ্কার করবার তৃপ্তি তার নিত্য আনন্দের সঙ্গী।

রিকশার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই তিনটা রিকশা ছুটে এলো; তার আগ্রহী বা হাতের তর্জনী মাথার উচ্চতায় উঠবার দৃশ্যে আকৃষ্ট হয়ে। কৌশলটা তার স্বকীয় নয়। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। জনকের মাধ্যমে। যার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকাটাই জামান নিরাপদ মনে করে এসেছে, সচেতন প্রয়াসে।

সন্ধ্যা নিভে এসেছে। বেশ লম্বা সময় হলো। আঁতকা বাতাসে কপালের সামনে এসে পড়া সুবিন্যস্ত চুলগুলোকে হাত দিয়ে বায়ে সরিয়ে দিয়ে জামান চারপাশে তাকালো। তাকিয়ে ক্ষান্ত দিলোনা, দেখলো। গতানুগতিক। বাতাস আছে, তবে অনুরণনহীন। এমন আবহাওয়ায় জামানের সহজে বিরক্তি চলে আসে। আজকে আসলোনা। শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে। জামান দেখতে পেলো যে রিকশাওয়ালা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখলো। সে কিছু বললোনা। আজকে সারাদিনে অফিসে তাকে প্রচুর কথা বলতে হয়েছে। দুইটা মিটিং, তার আগে একটা প্রেজেন্টেশন, তারও পূর্বে প্রস্তুতি- প্রেজেন্টেশনের, দুইটা মিটিঙের। মাঝে কোন সময় পায়নি। লাঞ্চব্রেকটা পর্যন্ত না।

স্ট্রিটবাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। ব্যস্ত সড়কে দুইটা রিকশার ঠোকাঠুকি অতঃপর রিকশাওয়ালাদের কলহ দেখে জামানের মনে পড়লো একটা সময়ে সংঘর্ষে যেতে বড্ড ভালোবাসতো সে। নিজের এলাকায়; পাড়ার ছোট-বড় মাস্তানদের সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করবার বিগত দিনগুলায়, দ্বন্দ্ব তার অত্যন্ত প্রিয় ছিলো। তবে পেশাগত জীবনে সেই অতীতের সবকিছুই সে বিস্মৃত রাখে; সন্তর্পণে, সচেতন খেয়ালে। কলেজে পড়ে তখন; এক স্থানীয় পাতি মাস্তানের ছোট ভাইকে চড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিলো, বিস্তর ঝামেলায় ভুগেছিলো পরবর্তী দুইটা সপ্তাহ। গেলো পরশু সেই ছেলের কাছে যেতে হয়েছিলো, পেশাগত প্রয়োজনে। দুইবার স্বাস্থ্যের খবর, তিনবার পরিবারের খবর, গোটা আষ্টেকবার জ্বী স্যার- তিন ঘন্টা বলতে গেলে পায়ের কাছেই পড়ে ছিলো সে। নির্বাণ, নির্বাণ- মনে মনে ক্লান্তিহীনভাবে জপে গিয়েছিলো শব্দটি। তা মিলেছিলো। উদ্দেশ্য সফল শেষে বাসায় ফিরেছিলো শব্দটি বিড়বিড় করতে করতে, যেভাবে ছেলেমানুষেরা বাবল ফোলায়।

ডানদিকে বিপদজনকভাবে কাত হয়ে পড়েছিলো সে; পেছন থেকে একটা রিকশা প্রবলগতিতে ধাক্কা দিয়ে না থাকলে টের পেতোনা, সম্বিত ফিরে পাবার আরোপিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সে সচেতন হলো। সামান্যতম ঝুঁকিতেও তার বড্ড অনীহা ইদানিং; স্ত্রী সাড়ে চার মাসের অন্তঃসত্তা, স্ত্রীর কথার কোন বরখেলাপ করেনা বলে দোর্দন্ড আক্রোশে মাঝেমাঝে চোয়াল ফাটিয়ে দেওয়ার দুর্দমনীয় ইচ্ছাকেও সে গোপন রাখতেই ভালোবাসছে। রিকশা চলে এসেছে শ্যামলীতে; বেশ দ্রুতই, এতোটা দ্রুততা জামান প্রত্যাশা করেনি। সন্ধ্যা শেষ হয়েছে সেই কখন, রাতেরও বুঝি বিদায় নেওয়ার সময় আসন্ন। আকাশে সাংসারিক কড়চার চাইতেও একঘেঁয়ে একটা চাঁদ; দুদন্ড তাকাতে চাইলোনা সে, তবু দৃষ্টি পড়ে গেলো। সাবিহাকে একটা এসএমএস করতে পারে। বাধা একটাই। রাস্তাটা বেশ রিস্কি আছে। বামে ডানে কয়েকবার করে টার্ন নিতে হবে রিকশাওয়ালার।

জামানের স্বেচ্ছায় আড়াল করা দুর্বিনীত সত্তা আচমকা জেগে উঠতে সে আবিষ্কার করলো মোবাইলের বাটনগুলো তার আঙ্গুলসমূহের ভারে অস্থির; একটু স্থিরতা, তাহলেই চাঁদমাখা কাঙ্খিত সেই এসএমএস পৌঁছে যাবে সাবিহার মোবাইলে। সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনাটা প্রধানত জামানের ছিলো; তার স্ত্রী নাবিলা যা জানেনা বলে সে পরিষ্কার জানে- তা হলো এই দূরদর্শী ভাবনার পেছনের অনুপ্রেরণা সাবিহা। এক মঞ্চ থেকে আরেক মঞ্চে মসৃণ সংকটহীন পদচারণাই জামানের বেঁচে থাকবার একটি মাত্র উদ্দেশ্য; যা সে কখনো গোপন করেনি, শুধুমাত্র নিজের কাছে। নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখেছে সে। অবিরাম। ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত যখন দিয়েছে বুঝেছে মুক্তির যা কিছু আনন্দ আছে; যতোটুকু আছে তার সবটুকুই এক মঞ্চ থেকে আরেক মঞ্চে, আর কিছুতেই নয়।

দোকানপাটের শাটার বন্ধ হয়ে যাবার শব্দ শুনলো সে, অন্যমনস্ক কানেও। এতোটা প্রবল সেই শব্দ। বাম দিকের মোড়ে আজাদ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে; মালিক যার সৌম্যকান্তি চেহারার, এদিকটায় এলে প্রায়ই আলাপ হয় ভদ্রলোকের সাথে। একটা বৃহৎ বট গাছের গন্ধ পায় জামান ভদ্রলোকের সাথে আড্ডা যখন দেয়। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চশমার ডানদিকের ফ্রেমে একবার নরম আলতো হাত বুলিয়েছে মাত্র; নিজেকেসহ জামানকে হকচকিত করে দিয়ে রিকশাওয়ালা রিকশাসহ পড়ে গেলো, আলো-অন্ধকারের হেঁয়ালীতে খেয়াল না করা সূক্ষ্ণ অথচ বড় একটা গর্তে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে। ছিটকে পড়ে সবার আগে হাতড়ে হাতড়ে নিজের চশমা খুঁজতে আরম্ভ করলো জামান; গবেট রিকশাওয়ালাকে কিছু বলতে যাওয়াটা এই মুহূর্তে বৃথা, কোমরের ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে হাড়হাভাতে স্কাউন্ড্রেলটা। ডান পাশের গালটা তরল ঠেকছে; কেটে গেছে নিশ্চিত, জিভে সেই নোনতা স্বাদটুকু অনুভব করলে জামান প্রাণপণে হাতড়ে হাতড়ে ছিটকে যাওয়া চশমা খোঁজে। আত্মগর্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.