নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অতিক্রান্ত কোন সম্ভাবনা

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৩৯

কথাটা শোনেনি এমন নয়। অসংখ্যবার শুনেছে। তবে সরাসরি নয়। আকারে, ইঙ্গিতে, ইশারায়, প্রচ্ছন্ন শ্লেষে। একসময় ভাবতো উড়িয়ে দিতে পারবে। আমৃত্যু। আজীবন। এখন আর পারেনা। বাক্য ধারণ করতে পারে যতোটা হাতুড়ির আঘাত- তার চাইতেও অনেক বেশী দ্রিম দ্রিম শব্দে পথ চলতে চলতে খেই হারিয়ে যায় বারবার।

একটু বেখেয়াল হয়ে গিয়েছিলো। আরেকটু হলেই মাইক্রোর চাপা পড়তে পারতো। আমলে নিলোনা রিভু। তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুগঠিত। হাত হোক কিংবা পা। মুখাবয়ব তার এখনো কলেজগামী ছাত্রের ইনোসেন্সে পরিপূর্ণ। মনে পড়ে ক্লাস নাইনে যখন নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো অংকের শিক্ষক বিরেনবাবু তাকে বলেছিলেন ‘তুই ক্লাস নাইনে ভর্তি হলি কি করে বুঝলাম না। ডাবল প্রমোশন কয়টা পেয়েছিস?’ ছেলেমেয়েরা সবাই হেসে উঠেছিলো। তার মুখ চিবুকে এসে ঠেকে- অবনত হয়েছিলো সে এতোটাই।

অক্টোবরের শেষের সপ্তাহ। সন্ধ্যাবেলাতে লোকজন গিজগিজ করছে রাস্তায়। একটু বেসামাল হলেই কারো না কারো সাথে ধাক্কা লেগে যাচ্ছে। তবু ভ্রুক্ষেপহীন রইলো রিভু। আজকে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। চাকরী কিংবা পড়াশোনা কিছুর সাথেই তার যোগাযোগ নেই বলে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে বিশেষ কোন বাধা নেই। শুধু একটা বড় পাথরসমান কম্পন ব্যতীত। হাতুড়ির আঘাত- নিঃশব্দ।

‘তুমি এরকম কেনো হইলা রিভু? তোমাকে নিয়ে কতো স্বপ্ন, কতো আশা ছিলো। কম তো চেষ্টা করিনাই তোমার জন্য। প্রতিদিন তোমার জন্য বাসায়………. খুব শৈশবে থাকতে যখন কলোনীতে থাকতো চারপাশকে প্রকম্পিত করে এরোপ্লেনের আগমনী শব্দের প্রবলতায় মাঠ ছেড়ে পালিয়ে বাড়ির সামনের ছোট্ট খেলার জায়গাতে এসে দাঁড়াতো সে। সেই পলায়নপরতাকে এতোটা ভেতর থেকে সে বয়ে বেড়াচ্ছে এই সত্যটুকু তাকে এড়িয়ে গেলো কি করে ভাবতে ভাবতে রিভু হোঁচট খায়। নাকি সে নিজেই চোখ বুঁজে ছিলো এতোদিন? যাই হয়ে থাকুক বড্ড অন্যায় করে ফেলেছে সে। নিজের সাথে। আরো বেশী এক জোড়া সম্ভাবনাময় চোখের সাথে। গতোকাল সন্ধ্যায়; বিস্ফোরিত অনুভূতি নিয়ে যখন দাঁড়িয়ে ছিলো চেনা সেই ফুটপাথের ধারে, সে তীব্রভাবে জেনেছে তার বহন করা গভীর নিঃসঙ্গ অব্যক্ত অসুখের বীজ আরেকজনের শরীরে এসে বাসা বেঁধেছে। এমন নয় এই বাস্তবতা তার অজ্ঞাত ছিলো। কিন্তু তার আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গেলো এই প্রথম। অনেক, অনেক দেরী হয়ে গেছে। মাৎসন্যায় সমাজে বড় মাছ হওয়াটা শখের বিষয় নয়, নেসেসিটি। ভীরুতার জন্য, নিরাপদ আস্তানায় বসত গেড়ে রাজাউজির মেরে আসার প্রবণতার কারনে যেই বন্ধুকে সে অপছন্দ করে এসেছে সবসময়; কোন এক আপাত শান্ত প্রহরে, মিরপুরের আঁধো আলো আঁধো অন্ধকারে মুখোমুখি দাঁড়ানো সেই বন্ধুর মুখ থেকে কথাটি শুনে সাথে সাথে সহমত পোষণ করেছিলো। কিন্তু এখন, ঠিক এই মুহুর্তে রিভুর মনে হলো প্রকৃতপ্রস্তাবে কথাটি সে বুঝেছে গতোকাল। যখন বাড়ী ফিরছিলো; রিকশায় ডান দিকে কাত হয়ে, শূন্য চোখে যখন চারপাশকে দেখছিলো, দেখা না দেখার ফাঁরাক যখন নিতান্তই গৌণ।

বাসায় এসে পড়েছে। দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ করে কড়া নাড়লো। ভেতরে চলতে থাকা ধারাবাহিক ঝড়ের সামান্যতম আভাসও সে মুখে রাখতে চায়না। দরজা খুলে গেলো। ডানে ঢুকতেই দেখলো মাত্রই বাবা রাতের খাওয়া শেষ করে বারান্দায় গিয়ে বসেছেন। মা তার দিকে তাকাতেই; যেই দৃষ্টিতে রাতের খাবারের প্রশ্ন ঝুলছে, সাথে সাথে মাকে জানালো সে। খেয়ে এসেছে। একবার তার দিকে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে এঁটো থালাগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।

নির্বিকার চাহনীতে রিভু ঢুকে পড়লো নিজের ঘরে। তার ঘরে সে একলাই থাকে। পরিবার চালানোর প্রয়োজনীয়তা তার কখনো দেখা দেয়নি। দেখা দেবে এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ, সে নিশ্চিত মনে করে। ‘তোমার তো খাওয়াপরার চিন্তা নাই। তুমি আমার সমস্যা বুঝবা কি? আমাকে বাসায়…… রিভু নেশাগ্রস্তের মতো মাথা এদিকে-ওদিকে দোলাতে থাকে। আয়নায় চোখ পড়ে গেলে সে স্পষ্ট দেখতে পায় তার মুখের মাংসপেশী শক্ত হয়ে উঠছে, দৃষ্টি ক্রমশ হিংস্র, মুষ্টিবদ্ধ দুইটি হাত কোন স্কেপগোট খুঁজে ফিরছে, একবার কাউকে পেলেই- হঠাৎ কানে ভেসে আসলো তার নামটা উচ্চারিত হচ্ছে। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা- এর বাইরে আর কিছু হতেই পারেনা। রিভু কান আরো খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করে।

কান খাড়া না করেও সে অনেক কিছু শুনতে পারতো। বেশ আগেরকার সময় হবে। তখন কার্তিক এসে নেমেছে। একেকটি সন্ধ্যা হাওয়াও মিলিয়ে যেতে সময় লাগতোনা। রিভু এখনো প্রতিটা দিনের কথা স্মরণ করতে পারে। তুমি এতোটা দুর্বল হলে কেনো রিভু? ছন্নছাড়া জীবনই যদি কাটাবে তবে কেনো নিজেকে দূরেই রাখতে পারলেনা? নিজের অক্ষমতা, অনিশ্চয়তার প্রতি ভালোবাসা- এসবই তোমার জানা। তবে কেনো মন্ডপের কাছাকাছি এসে মুখ ফসকে কথাটি বলে ফেলেছিলে? তখন বাতাস শাসন করছিলো; বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছিলে, দুইজনের। কার্তিকে শুনতে পাওয়া অজস্র সঙ্গীত রুক্ষতা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনা। তোমার তো বোঝার কথা। এতো বুঝ, এতো জ্ঞান, প্রজ্ঞা- কিছুই কি তবে তোমার অন্তর্গত হয়ে উঠতে পারেনি? নিজস্বতার এতো অভাব তোমার, কার কাছে জবাব খুঁজতে যাবে- প্রশ্নটা অতর্কিত এসে রিভুর সমগ্রতা কেড়ে নেয়। হঠাৎ করে ঘরটিতে শীত বেড়ে যায়। রিভু জনকের কন্ঠ শুনতে পায়, ‘তাকে কিভাবে কি বলবো কিছুই বুঝতে পারিনা। খুব টেনশনে আছি। ওকে তো চিনিস। রিজিড। কমপ্লিটলী রিজিড। জোর করতে গেলে রিভোল্ট করে বসবে নিশ্চিত। তখন আরো অনেক ঝামেলা।’

পরেরদিন উথালপাথাল চাঁদ উঠে। বাতাসে ধুলোর স্বেচ্ছাচারীতা। রাতটাকে উজ্জ্বলতর দেখায়। রিভু হাঁটতে হাঁটতে সেই জায়গাটায় চলে আসে। অনেকদিন পরে। এখন মানুষজনের আনাগোনা কমে গেছে জায়গাটায়। আগে মানুষজনের ভিড়ে দাঁড়াবারই সুযোগ পাওয়া যেতোনা। এখন রাত বেজে আটটা হয়েছে কি হয়নি নিস্তব্ধতার প্রাবল্যে একটা কুকুরের ডূকরে উঠবার শব্দেও চমকে যেতে হয়। ব্রিজে এসে দাঁড়ালে ফিসফিস করে কিছু বাক্যালাপ শুনলো রিভু। পার্শ্ববর্তী কোথাওই হবে। এই সময়েও তবে কোন না কোন যুগল বসে আছে। মেয়েটির ফোঁপানী স্পষ্ট শুনতে পেলো। খুব সম্ভবত প্রেমিক বিয়ের কথায় বেঁকে বসেছে। রিভুর করোটি ঝপ করে পরশুদিনে ফিরে গেলো। ফুটপাথের ধারে; একজন রাগত, রিভু বিস্ফোরিত- না, আর কতো দুলতে থাকবে এভাবে? এতোটা অক্ষমতায় বেঁচে থাকা, অসম্ভব। চোখজোড়া তীক্ষ্ণ করে যখন উপরে তুললো দেখতে পেলো স্বপ্নের মাঝে উঁচু ছাদের থেকে সে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে; পড়ে যেতে যেতে মাথার ঘিলুর একেকটি টুকরা উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে হলুদ সেই মসজিদটায়, যেখান থেকে একজোড়া চোখকে সম্ভাবনাময় দেখে বাড়ি ফেরা হতো।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.