নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

উচ্চতা

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৫৯

প্রথম দেখছি এমন নয়; তবুও আমি, প্রথমবার দেখে যেমন ভয় পেয়েছিলাম সেই ভয়ের বিবর্তনহীন রুপেই ঘুম থেকে জেগে উঠি। আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।

দুঃস্বপ্নটা খুবই সরল, আড়ম্বরহীন। খুব উঁচু কোন জায়গা থেকে আমি পড়ে যাচ্ছি।

অনেক অনেক আগে থেকে আমি এই দুঃস্বপ্নের সাথে পরিচিত। কখনো কখনো এমন হয়েছে যে আমি খাট থেকে পড়ে গেছি। কোলবালিশ নিয়ে। যেহেতু আমার বিছানায় খাট নেই এবং তোষকটা উঁচু নয় তাই মাটিতে পড়ে গেলে কোন ব্যথা পাইনা। শুধু বুঝতে পারি যে আমি উঁচু কোথাও থেকে পড়ে যাচ্ছি এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে মাটিতে পড়ে গেছি। তখন চোখ খুলি। কোলবালিশ সমেত নিজেকে মাটি থেকে তুলে পুনরায় বিছানায় প্রতিস্থাপন করি। তারপরে আবারো ঘুমিয়ে পড়ি। তবে যেহেতু দুঃস্বপ্নটি এবারের জন্য দেখা শেষ হয়ে গেছে তাই এবারে স্বপ্নহীন-দুঃস্বপ্নহীন গাঢ় ঘুমে আবিষ্ট হতে পারি। আমি গাঢ় ঘুমে কাঁদা হয়ে পড়ি।

তারপর যখন পাকাপাকিভাবে উঠে পড়ি, বিছানা থেকে- দেখি দুপুরের অর্ধেকটা পার হয়ে গেছে। স্থির পর্দায় অবরুদ্ধ হয়ে থাকে আমার ঘরের জানালা- আমি পর্দা সরিয়ে দেই। বাইরের রোদ আমার ঘরে এসে পড়লে তার সাথে এক ধরণের মায়াও প্রবেশ করে। আমি তা অনুভব করি।

তখন আমি দেয়ালের দিকে চোখ রাখি। যেখান থেকে আমার জানালাটি বিপরীত। দেখি যে একটি অবসন্ন ছায়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আধো ঘুম আধো জাগরণে ভাবছে সে কি করবে। ছায়াটি একান্তই আমার।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে বাথরুমে প্রবেশ করি। চারপাশের উপরে ক্ষুব্ধ হই। প্রধানত নিজের উপরে হওয়া ক্ষোভ থেকে। সারাটাদিন নষ্ট করে ফেললাম। ঘুমের কারণে। নিজেরই দোষে।

একটা ঝলমলে দুপুরের অনেকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। আমার নিজেরই দোষে। এমনটা প্রায় প্রতিদিন ঘটে থাকে।

আমি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হবার পরেও শান্তি পাইনা। বুঝতে পারি শরীরে - এক অনাকাঙ্খিত জাড্যের উপস্থিতি দ্বারা আমি পর্যুদস্ত এবং নিয়ন্ত্রিত; যাকে আমি ঘৃণা করি, কিন্তু যাকে আমি এড়াবার শক্তিটুকু অর্জন করে উঠিনা।

আমি তখন গোসল করি। অনেক সময় নিয়ে। যখন বুঝতে পারি যে শারীরিকভাবে স্বস্তিবোধ করছি; তখন, আমি মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসি।

তখন সংকটের দ্বিতীয় ধাপে আমি প্রবেশ করি। শরীরকে অতিক্রম করা গেছে- কতোদিন এভাবে পারা যাবে; তা জানিনা, তবে পেরেছি এই বর্তমানে। এবারে আমার অপ্রকৃতিস্থ হবার পালা, মানসিকভাবে।

আজকে রাতে বাইরে ডিনার করবো। চাকরী থেকে অবসর নিয়ে ঘরে থাকা পিতাকে কথাটি জানাতে সে অসন্তুষ্ট হয় স্পষ্ট বুঝতে পারি। তাকে অসন্তোষে রেখে কখনোই কিছু অর্জন করিনি- কারণ তেমন কোন সংকল্প কি ইচ্ছা আমার কখনোই ছিলোনা। আমি চোখ নামিয়ে রেখে নির্লিপ্ত কন্ঠে তাকে সংবাদটি জানাই; তার সাথে আমার সম্পর্ক শীতল নয় তারপরেও, আমি নিস্পৃহ থাকি কেননা ভেতরে প্রতিনিয়ত ছোটাছুটি করতে থাকা অস্থিরতার খবর তাকে দিতে চাইনা বলে। ক্ল্যারিফিকেশনের জায়গাটা স্বচ্ছ রাখলে; যা প্রধানত আমার নিজের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি, হয়তো বা ক্রমবর্ধমান দুরত্বের জায়গাটি অনতিক্রম্য কোন পর্যায়ে পৌঁছাতো না।

আমার অবসরপ্রাপ্ত পিতার দিকে পিঠ দিয়ে আমি ঘর থেকে বের হই। শুনতে পাই সে অত্যন্ত ধীরে, যেন একটু শব্দ হলেই প্রলয়াংকারী কিছু ঘটে যাবে এমন নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করছে। আমার ভেতরকার বাষ্প তখন অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়।

সিনিকাল- এই শব্দে নিজেকে সেই মুহূর্তে সংজ্ঞায়িত করে আমি বাইরে বেরিয়ে পড়ি।

অভিনব নৈসর্গিক কোন দৃশ্য চিরচেনা পথগুলাতে পাওয়া যায়না। অন্তত আমি পেয়ে থাকিনা। প্রকৃতির সাথে আমার সম্পর্কটা বিশেষ কোন বৈরীতা ব্যতিরেকেই বরফশীতল এমনটা আমি বরাবরই লক্ষ্য করে আসছি। সেই থেকে আমার উপলব্ধি হলো প্রকৃতির কাছে কেউ নিজেকে আন্তরিকভাবে সমর্পণ করে না থাকলে সে নিজেও সেই মানুষের কাছে ধরা দেয়না। প্রকৃতি বড্ড আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। যথাযথ বিচারক। তাই গাছের পাতার সাথে কিংবা রাস্তার একটুকু ধুলার সাথে আমার সখ্যতা হয়না। আমরা একে অপরের থেকে দূরে দূরে থাকি।

বাইরে বেরুলেই আপাদমস্তক রাজনৈতিক এক পরিবেশে মন মাঝেমাঝে বিষিয়ে উঠে। এ তার দিকে চোখ রাঙ্গাচ্ছে। সে তার দিকে তাকিয়ে ভাবছে কিভাবে কিছু বাগিয়ে নেওয়া যায়- সর্বত্রই এমনটা দেখি। রাজনীতির বাইরে মানুষকে দেখবার বাসনা না থেকে থাকলেও সর্বক্ষণ এই বাস্তবতায় পারিপার্শ্বিকের সাথে সাথে নিজেকে আবিষ্কার করাটা বেদনাদায়ক। আমার মনে হতে থাকে আমাদের প্রত্যেককে অর্ধবিকশিত রেখে দেওয়ার যেই খেলাটা চলতে থাকে অবিরাম- এই খেলায় কে জেতে তা বলাটা মুশকিল হলেও হেরে যাওয়াদের দলে আমরা কম বেশী সবাই ই আছি। ভাবনাটা অন্যত্র ঘুরিয়ে দেই, সন্তর্পণে।

একজন রিকশাওয়ালা ঠিক করি- যে আমাকে সত্তর টাকা ভাড়ার বিনিময়ে টিএসসি পৌঁছে দেবে। আমি রিকশায় উঠে বসি। যেহেতু আমার কোন তাড়া নেই তাই রিকশাওয়ালাকে দ্রুত চালাবার কোন ইনস্ট্রাকশন দেইনা। সে তার মনের খুশীতে যতোটা সম্ভব ধীরে রিকশা চালায়। আমি কানে হেডফোন লাগিয়েও চারপাশের কুৎসিত কোলাহল থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে পারিনা। তার সাথে সমঝোতা করে আমি গান শুনতে থাকি- অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন, শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন।

আমি এক গান শুনতে শুরু করলে অনেক সময় ধরে সেই একই গান শুনে থাকি। অনেকবার করে।

সায়েন্সল্যাব দিয়ে যেহেতু যাওয়ার উপায় নেই; যেহেতু সড়ক নিয়ন্ত্রণকারীরা সাধারণের বুঝের অতীতে সড়ক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাই রিকশা প্রবেশ করে গ্রীণ রোড দিয়ে। সেখানের অলিগলি দিয়ে রিকশাওয়ালা অনবদ্য দক্ষতায় রিকশা নিয়ে ঢুকে পড়ে। আমাদের মাথার উপরে তখন অনন্ত অসীম অননুকরণযোগ্য আকাশ।

রিকশা অলিগলি পেরিয়ে হাতিরপুলে প্রবেশ করে। আমি এবারে সচেতন দৃষ্টিতে তাকাই। মাংসের দোকানের পাশে একটা পুরনো শ্যাওলা ধরা বাড়ি আছে- আমার অত্যন্ত পছন্দের। একটা সরু সিঁড়ি আছে সেই বাড়িতে- যা দিয়ে বাড়ির একমাত্র ঘরে প্রবেশ করা যায়। মাঝেমাঝে আমার ইচ্ছা করে ঘরটিতে প্রবেশ করি; যখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মানুষের কোলাহল যখন সেই রাস্তাটিতে স্তিমিত হয়ে আসে- যখন যানবাহনের যান্ত্রিকতা মানুষের মানবিক ভরসা হারানো দৃষ্টিকে পরাভূত করে।

পরিবাগ পেরিয়ে শাহবাগ মোড় অতিক্রম করে যখন রিকশা টিএসসির উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাবে- আমি ঠিক সেই মুহূর্তেই রিকশাওয়ালাকে থেমে যেতে বলি। বাকি পথটুকু হেঁটেই যাবো; আমি সিদ্ধান্ত নেই। শান্তভাবে ভাড়া মিটিয়ে জাদুঘরের সামনে থেকে হাঁটতে শুরু করি।

আশেপাশে অনেক পরিচিত- যাদের নামের আগে প্রগতিশীল শব্দটি যোগ করা আবশ্যক; তাদের দেখি। বিশেষ কোন বিতৃষ্ণা আমার নেই, তাদের প্রতি। তবুও তাদের সাথে কুশলে যেতে না হয়- এই আকাঙ্খায় আমি দ্রুত হেঁটে জায়গাটি অতিক্রম করি।

হাঁটতে হাঁটতে যখন টিএসসিতে পৌঁছাই তখন মাত্রই সন্ধ্যা নেমে আসলো- শহরের বুকে, নিসর্গের বুকে, মানুষের বুকে। আজানের শব্দ কখনোই তেমন একটা গাঢ় নয়, এখানে। আমি এবারে হাঁটবার গতি শ্লথ করে টিএসসির ভেতরে প্রবেশ করি। চারপাশটাকে পরখ করে দেখি- অপরিসীম শ্লথ গতিতে।

মানুষে মানুষে চারপাশ পূর্ণ, তবুও বেদনাদায়কভাবে আবদ্ধ। আমার উপলব্ধি হয়। সকলেই কথা বলছে। সবাইকে গতিশীল দেখাচ্ছে। ব্যস্ত। সচল। তবে প্রত্যেকের ভেতরকার অবসন্নতা, মন্থরতা – এসব অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণই আমাকে বরাবর বেশী টানে। আমি এক কাপ চায়ের কথা বলি। বলে দাঁড়িয়ে থাকি।

এখানেও পরিচিত মানুষ অনেককেই দেখি। সমবয়সী, অগ্রজ, অনুজ- কারো সাথেই নিজে থেকে কথা বলতে ইচ্ছা করেনা। ইগো তাড়িত কিছু নয়, নিজের প্রতি অনাগ্রহটা প্রবল বলে।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। প্রথম চুমুক দেওয়ার পরে আমার মুখে ভাবান্তর নেই- আমি তা বুঝতে পারি। চায়ে স্বাদ পাচ্ছি কি পাচ্ছিনা – এই নিয়ে ভাবিত হইনা। আমি ধীরে ধীরে চা খেতে থাকি। এদিকে সন্ধ্যা ক্রমশ ঘন হতে শুরু করে। একটু সামনেই দেখি রাজীব সবে আসলো, প্রেমিকা সাথে। আমি দ্রুত চা শেষ করি। রাজীব আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ছিলো। পাস্ট টেন্স যেহেতু- তাই তার সাথে নতুন কোন বর্তমান নির্মাণে আমার আগ্রহ নাই।

রাজীবের দিকে আরেকবার তাকাই। শান্ত সৌম্য সজ্জন মুখে সে প্রেমিকার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষকে বিকশিত হতে দেখাটা মন্দ নয়- কথাটা মাথায় আসতেই আমি মনে মনে একবার হাসলাম। মেথোডিকাল সিস্টেমে বিকশিত মনুষ্যকুল অনেক কিছুকেই থামিয়ে রাখে- শাহবাগ কি প্রেসক্লাবের সমাবেশওয়ালাদের সাথে একদিন এই নিয়ে আলাপ করা গেলে মন্দ হতোনা। এই ভেবে আমি আবারো দ্রুত হাঁটতে থাকি।

কোথায় যাওয়া যায়- প্রশ্নটা আমার কাছে চলে আসে, উত্তরের প্রত্যাশা ব্যতিরেকে।

খুব উঁচু কোথাও থেকে পড়ে যাচ্ছি- এবারে আমি তাকে সহজভাবে নিতে পারি। যেহেতু বাইরে আছি, কুশলে আছি, নিরাপদ আছি।

শুধুমাত্র নিজের ঘরটিতেই এখনো আমার নিরাপদ থাকা হলোনা। এদিকে রাত আসতে শুরু করে। আকাশের দিকে তাকাই- স্বপ্নহীন। নিশ্চয়ই সে কখনো নিচে পড়ে যাবেনা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.