নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

দর্শনপ্রকল্প

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:১৮

ইশতিয়াককে বিদায় করে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন রেজাউল ইসলাম- সদ্য প্রফেসর পদে প্রমোটেড হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষক তখন আকাশ থেকে চাঁদ মুছে যাবে যাবে। বাতাস একটু আধটু শরীরকে দোলা দেয়। নারিকেল গাছের পাতার কাঁপুনী স্পষ্ট দেখা যায়- অন্ধকার নেমে আসা পরিপূর্ণ এই রাতে।

ইশতিয়াক ছেলেটা তার বিভাগেরই ছাত্র। তৃতীয় বর্ষে পড়ে। দেখতে শুনতে এভারেজ, কথাবার্তা চালচলনে এখনো পুরাপুরি কেতাদুরস্ত হতে পারেনি। রেজাউল ইসলামের স্বস্তির জায়গাটা এখানেই। এইসব ছেলেপেলেরা যতোদিন পর্যন্ত চালু হয়ে যায়না ততোদিন তাদের দরকার হয়; রেজাউল ইসলামের মতো কাউকে না কাউকে। শুধুমাত্র ছাত্র পড়িয়েই রেজাউল ইসলাম তার দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন না। এই কারণে নিজে ইনিশিয়েটিভ নিয়ে তার বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের ছেলেপেলেদের প্রয়োজন হলে তিনি কাউন্সিলিং করে থাকেন। রেজাউল ইসলাম বিয়ে করেননি। তাই হাতে থাকা অঢেল সময় শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় করতে কোন কার্পণ্য করেননা। কল্যাণমুখী চিন্তার থেকেও সময়টা কাটিয়ে দেওয়া তার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এই বাস্তবতার গুরুত্ব তার কাছে অনেক বেশী বলে সত্যটিকে নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে দিয়েছেন। এই যে ইশতিয়াক ছেলেটা তার কাছে আসলো এমনি এমনি তো আর আসেনি। ছেলেটা প্রেমের সম্পর্কে সিরিয়াস ঝামেলায় পড়ে মাঝেমাঝে। তখন প্রিয় শিক্ষক হিসাবে তার কাছে ছুটে আসে। আজকেও এসেছে। এবারের ঘটনা বেশী গুরুতর। ভালোবাসায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইশতিয়াকের প্রেমিকা প্রেগনেন্ট। ইশতিয়াক দিশেহারা।

রাগ করতে গিয়েও করতে পারেননা রেজাউল ইসলাম- এটা তার দীর্ঘদিনের সাধনার ফলাফল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণেই তার আনন্দ। তিনি লক্ষ্য করেছেন এই প্রবণতা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তিনি তরতর করে উপরে উঠেছেন। ক্রমেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন- অন্তত তার মেধার সাপেক্ষে। সবই সম্ভব হয়েছে এই একটি মাত্র গুণের কারণে- রাগের কারণ থাকলেও রাগ না করা। ইশতিয়াককে তাই কি করিতে হইবে তা ঠান্ডা মাথায় ধাপের পর ধাপ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ইশতিয়াক নির্ভার হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এটাই তো রেজাউল ইসলাম আকাঙ্খা করেন। তার বাসায় শিক্ষার্থীরা আসবে ভীত সন্ত্রস্ত হলে। বেরুবে চোখেমুখে স্বস্তি নিয়ে। এই শিক্ষার্থীরা ছাড়া তার আর আছেই বা কে?

রেজাউল ইসলাম অনুভব করেন তার তৃষ্ণা লাগছে। শীতকালে মানুষের ঘনঘন জলবিয়োগ করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই প্রয়োজনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি দেরী করলেন না। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে তারপর গেলেন বাথরুমে। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবার প্রবণতা তার বহু পরনো। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুই তিনটা দাগ ছাড়া তার মুখ পরিষ্কার। দুই তিনটা চুল পাকা। শরীর নির্মেদ। তার বহুদিনের স্বাস্থ্যচর্চা- না হয়ে যাবে কিভাবে? নিজের শারীরিক সুস্থ্যতা তাকে বরাবরই সন্তুষ্ট করে। অফিসে বাদবাকিদের নিজের চোখে দেখে সেই তৃপ্তি তার আরো বেশী। হাফিজ সাহেব- এতো জাঁদরেল একজন শিক্ষক, একটু পথ হাঁটলেই মুখ হা করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে হয়। সাব্বির সাহেব- কতো সুন্দর করে কথা বলেন, ছাত্রছাত্রীরা মুগ্ধ হয়ে শোনে তিনি কথা বলতে শুরু করলে; প্রায়ই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ক্লাস মিস দেন। তাদের কেউই রেজাউল ইসলামের পছন্দের লোক না। কর্মস্থলের রেষারেষি তাদের শারীরিক বিড়ম্বনার বিষয়টিকে তার কাছে আরো বেশী আনন্দবহ করে তোলে।

রেজাউল ইসলাম মনে আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে যান। পরদিন সকালে উঠে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ক্লাস নেওয়ার সময়ে ইশতিয়াকের মুখের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেন। ছেলেটার দৃষ্টি এখনো ভরসা হারানো; তার মনে হয়। মনে মনে আনন্দ তার বেড়ে যায়। দৃষ্টি যতো ভরসা হারানো ততো বেশী সহজ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা। রেজাউল ইসলামের কাছে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রছাত্রীরা তেমন কেউ আসেনি। এই ছেলেটাকে হাতে রাখতে হবে। ভাবতে ভাবতেই রেজাউল ইসলাম নিঁখুতভাবে ক্লাস নেওয়া শেষ করেন।

পনেরোদিন কেটে গেলো। ইশতিয়াকের কোন খবর নেই। প্রথমে চিন্তায় পরে রাগে রেজাউল ইসলামের সময় কাটতেই চায়না। তার ছাত্ররা তাকে পেয়েছে কি? সমস্যার কথা বলতেই শুধু রেজাউল স্যার রেজাউল স্যার। অন্য কোন সময়ে তাদের পাত্তাই পাওয়া যায়না। তিনি অনেকবার লক্ষ্য করেছেন ছাত্রছাত্রীদের যতো সখ্যতা সব হাফিজ সাহেব আর সাব্বির সাহেবের সাথেই। তার কাছে নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলতে যতোই ছুটে আসুক তিনি তাদের মনে বিশেষ কোন জায়গা দখল করতে পারেননি। এনএসইউর ছেলেপেলেরাই বরং তার সাথে বেশী আন্তরিক। ওদের পড়িয়েও আনন্দ আছে। অহেতুক প্রশ্ন করেনা। রেজাউল ইসলাম যাই সাজেস্ট করেন, যতোদূর পড়তে বলেন ততোদূর পর্যন্তই পড়াশোনা নিয়ে তাদের আগ্রহ। যদিও তাদের পরীক্ষার খাতা দেখতে বসলে রেজাউল ইসলামের মাথার চুল ছিঁড়বার বাসনা প্রবল হয়ে উঠে কিন্তু তারপরেও ছেলেমেয়েগুলা ভালো। শিক্ষকের মর্যাদা বুঝে। বারান্দায় আরাম করে বসবার জন্য যেই চেয়ারটি সম্প্রতি কিনেছেন সেই চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে রেজাউল ইসলামের শরীরে বাতাস দোলা দেয়।

এক মাস কেটে গেলো। শুকনো মুখে ক্লাস নেওয়া- কারণে অকারণে সুযোগ পেলেই ছাত্রছাত্রীদের সাথে রাগারাগি করার প্রবণতা থাকে পেয়ে বসে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের চেনা শিক্ষকের নতুন এই রুপের সাথে পরিচিত হয়ে বিস্মিত হয়ে পড়ে। বিপর্যস্ত রেজাউল ইসলাম মনস্থির করেন ছাত্রছাত্রীদের কাউন্সিলিঙের পিন্ডি চটকে তিনি নিজে পড়াশোনায় মন দেবেন। হাফিজ সাহেব আর সাব্বির সাহেবের কথাবার্তা বেশী সময় ধরে শুনলেই তার বুক জ্বালা করে উঠে। কতো কি সম্পর্কে আপডেটেড থাকেন তারা। কথা যখন বলেন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতে বাধ্য। রেজাউল ইসলাম নিজেও কি মুগ্ধ হন না? নিজের কাছে তো আর মিথ্যা বলা যায়না। নিজের কাছে সৎ থাকতে থাকতে রেজাউল ইসলাম সিদ্ধান্ত নেন দর্শন দিয়েই পড়াশোনার যাত্রা নতুন করে শুরু করবেন। গ্রীক দর্শন দিয়েই শুরু করাটা ভালো। তারপর ধাপে ধাপে জার্মান দর্শন, ভারতীয় দর্শন এসবে চলে যাবেন। তাহলে পরের সেমিস্টারে ষষ্ঠ ব্যাচের একটা কোর্স নেওয়া তার জন্য কঠিন কিছু হবেনা। চেয়ারম্যান স্যার সারওয়ার সাহেবকে কনভিন্স করবার ব্যাপারে নিজের উপর তার আত্মবিশ্বাস অঢেল।

দিন বিশেক পরে এক সন্ধ্যায় ইশতিয়াক বাড়িতে আসে। সেই সময় প্লেটো সম্পর্কে পড়াশোনা করছিলেন রেজাউল ইসলাম। আজকে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে এক ধরণের ভেজা ভেজা গন্ধ। চা নাস্তার কথা বলে ইশতিয়াকের মুখের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করেন। খুব সম্ভবত নিজের থেকেই বলবে।

তিনি যা ভেবেছিলেন তাই হয়। ইশতিয়াক নিজে থেকেই মুখ খোলে। চা খেতে খেতে তিনি মনোযোগ দিয়ে সব শোনেন। তার ভ্রু একবার সংকুচিত হয়ে পরেই সোজা হয়। তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন,

‘তোমাকে না বলছিলাম এইটা না করতে? কেনো করলা?’

ইশতিয়াক নিরুত্তর।

রেজাউল ইসলামের প্রচন্ড রাগ হয়। ইদানিং যা নিয়ন্ত্রণ করাটা তার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এবারে তিনি সচেতন। ইশতিয়াক যা যা তাকে মাত্র বলেছে তাতে এই বিষয়টা স্পষ্ট এবারে সে পুরাপুরি আশাহত। নিজে থেকে কিছু করবার ক্ষমতা তার এই মুহূর্তে অবশিষ্ট নেই। তখন পরিচিত রাগ না করার বৈশিষ্ট্যটিকে নিঁখুত দক্ষতার সাথে কাজে লাগান রেজাউল ইসলাম। ধীরে ধীরে নিচু গলায় পুনরায় নিজের ছাত্রকে কি করিতে হইবে সেই পথ বাতলে দেন। তিনি কথা শেষ করে স্পষ্ট বুঝতে পারেন এবারে ইশতিয়াক সম্পূর্ণভাবে তার কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। এবারে ঘনঘন ছেলেটাকে স্যারের বাসায় আসতে হবে।

ইশতিয়াকের সাথে কথাবার্তা শেষে সে চলে যাবার পরে রেজাউল ইসলাম রাস্তায় নামেন। দুই প্যাকেট সিগারেট কিনবেন। তাছাড়া ঠান্ডা স্নিগ্ধ বাতাসে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করতেও তার বেশ ভালো লাগে। রেজাউল ইসলাম রাস্তায় নেমে অভিভূত হন। প্রথম সিগারেটে প্রথম টান দিতে লক্ষ্য করেন চারপাশে লোকজন বলতে গেলে নেই। বেশ নির্জন রাস্তা। উপরে তার বারান্দার দিকে চোখ চলে যায়। চেয়ারটিতে বই রেখে এসেছেন। প্লেটো সম্পর্কে পড়ছিলেন। স্যার সরদার ফজলুল করিমের অনবদ্য অনুবাদ।

বইটি যখন একবার পড়া শুরু করেছেন তখন তাড়াহুড়া কিসের- সামনে আরো বহু সময় পড়ে আছে। পরের সেমিস্টার চলে আসতে আসতে ইউরোপিয়ান দর্শনের অনেকটাই তার আয়ত্তে এসে যাবে। ষষ্ঠ ব্যাচের ছেলেপেলেদের তাক লাগিয়ে দেওয়াটা কঠিন কিছু হবেনা।

সিগারেটে যখন তৃতীয় টান দিয়েছেন- ঠিক তখন রেজাউল ইসলামের মাথার উপরে কিছু নক্ষত্র দূরে সরে যেতে শুরু করে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:০১

তারুবীর বলেছেন: সিগারেটের শেষ টান ! আহা !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.