নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্রিকেট আলো এবং শফিক

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:১৯

ট্রাফিক জ্যামের সাথে যুদ্ধ করে; মতিঝিল থেকে যখন বাস এসেছে এলিফেন্ট রোডে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে এক ও অদ্বিতীয় এই শহরে। এই প্রথম আমি আজকের খেলার খবর নিয়ে বাসে কথাবার্তা শুনি। দুইজন তরুণ বাটার সিগনাল থেকে বাসে উঠেছে। উঠেই চারপাশের মানুষজনকে সচকিত করে উচ্চস্বরে বাংলাদেশ – অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে আলাপ জুড়ে দিয়েছে।

‘তামিমের আউটটা দেখছিস? মেজাজ খারাপ হইছে দেইখা।’

‘আর কইস না। আমারও মেজাজ খারার হইছে। হালায় আবুলের মতো আউট হইছে। অফ স্ট্যাম্পের এতো বাইরের বল, ওয়াইড বলটারে এমনে মারতে গিয়া কেউ আউট হয়?’

‘এখন সাকিবই ভরসা। ওরে চল্লিশ ওভার পর্যন্ত টিকতে হইবো। তাইলে বাংলাদেশ খেলায় জিতবো।’

‘একলা সাকিবে পারবোনা। নাসিররেও ভালো খেলা লাগবো। অনেকদিন পরে দলে সুযোগ পাইছে। কাজে লাগানো উচিত।’

দুই তরুণের দেখাদেখি বাসের অন্যান্য যাত্রীরাও বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে সচেতন হয়।

আমি বাসে চুপচাপ বসে থেকে বাসযাত্রীদের ক্রিকেটালাপ শুনি। নিজস্ব এই প্যাসিভ অবস্থান আমাকে তাদের ক্রিকেটসম্পর্কিত ধ্যানধারণা সম্পর্কে অধিকতর স্বচ্ছতা প্রদান করে। এই সত্য থেকেও আমি বিস্মৃত হইনা যে বাসের অগ্রগতি চল্লিশ মিনিট হয়ে গেলো বাটা সিগনাল থেকে জহির এসি মার্কেট পর্যন্ত।

এলিফেন্ট রোড নব্বইয়ের দশকেও যেমন ছিলো দুই হাজারে এসে প্রথম দশক পার করেও অনেকটা একইরকম আছে। বিশেষ একটা বদলায়নি। শফিক- আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত ফয়সালায় আসা আমার বন্ধু এমনটাই বলতো। ক্রিকেট নিয়ে শফিকের মনোমুগ্ধকর ফ্যাসিনেশনের প্রভাবে আমি ক্রিকেটের ব্যাপারে আজীবনের জন্য ফ্যাসিনেটেড হই। এই সত্যটা শফিক জানতো। আরো অনেক রকমের সত্য শফিকের জানা ছিলো। যেমন এলিফেন্ট রোডের নিত্য অপরিবর্তিতার বিষয়টি। বেঁচে থাকতে আমৃত্যু স্বপ্ন দেখে গেছে কোন না কোনভাবে ক্রিকেটের সাথে যুক্ত থাকবে। সেই স্বপ্নকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার আগেই একগাদা ঘুমের ওষুধে মুক্তি খুঁজতে চাইলো। মুক্তি পেয়েছে কি না সেই উত্তর পাওয়া অসম্ভব। এলিফেন্ট রোডে আসলে; বিশেষত যখন তীব্র জ্যামে বাসে আটকে থাকি, তখন আমার প্রায়ই শফিকের কথা মনে পড়ে। আজীবন এলিফেন্ট রোডের পেছনের দিকে অনাকর্ষনীয় একটি গলিতে আজীবন পরিবারসহ বাস করে এসেছে শফিক। পুরনো গানের রেকর্ডের দোকানগুলো থেকে শুরু করে জহির এসি মার্কেট, মাল্টিপ্ল্যান, এমনকি বাটা সিগনালের কাছাকাছি জামাকাপড় বানাতে দেওয়া দোকানগুলোর হালহকিকত- এলিফেন্ট রোডের সাথে সম্পর্কিত এইসকল বিষয়ে শফিকের অগাধ জ্ঞান ছিলো। এই প্রভূত জ্ঞানও তাকে শান্তি দিতে ব্যর্থ হলো।

জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতে আসতে দুই তরুণের বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে সকল আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। সাকিব আউট হয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, নাসির সবাই আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে। লক্ষ্য করি বাসযাত্রীদের প্রায় সকলের চোখে মুখে বেদনার ছায়া। তা আন্তরিক কি কাস্টমারী সেটা পরখ করতে করতে ফাঁকা রাস্তার সুযোগে বাস অপ্রত্যাশিত দ্রুততায় শঙ্করে এসে পৌঁছায়।

আমি বাসযাত্রীদের বেদনার সংক্রান্ত বিষয়ে কোন গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে পৌঁছাবার পূর্বে বাস আমাকে শংকর বাসস্ট্যান্ডের সামনে উত্তরাধুনিক রেখে মোহাম্মদপুরের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলে। নভেম্বর মাসের তৃতীয় দিন। এমন সময়ে শীত অনুভূত হবার সম্ভাব্যতা সেই স্কুলপড়ুয়া সময়ে থাকতেই শেষ হয়ে গেছে। তবু অনুভব করি আমার হালকা শীত শীত অনুভূত হচ্ছে।

হেমন্তের এই মখমলি শীতের অনুভূতি নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাংলাদেশ ততোমধ্যে ম্যাচটা হেরে গেছে। প্রেজেন্টেশনে শামীম আশরাফ চৌধুরীর বেদনাবিধুর মুখ দেখতে দেখতে আমি ঘরে প্রবেশ করি। শফিকের মুখটা আমার চোখে ভেসে উঠে। বাংলাদেশ হেরে গেলেই শফিকের চোখমুখ শক্ত হয়ে যেতো। সেই সময়ে নিয়মিতভাবে হেরে যাওয়াটাই বাংলাদেশের অনিবার্য পরিণতি ছিলো। ২০০৩ সালের দিকে মনে পড়ে কোরবানীর ঈদের আগের রাতে- বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কানাডার কাছে বাজেভাবে হেরে যায়। তারিখটা আজও মনে পড়ে, ১১ ফেব্রুয়ারী। পরেরদিন এলিফেন্ট রোডে শফিকের সাথে দেখা হতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলেছিলো।

‘কিরে এতো কান্নার কি আছে? একটা ম্যাচই তো হারছে। তাই বলে ঈদের দিনটা মাটি করবি?’

শফিকের কোন জবাব পাওয়া যায়না। সে হু হু করে কাঁদতেই থাকি। আমার হাসি আসে। তবুও হাসতে পারিনা। শফিকের আবেগটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের। কিন্তু গতোকাল রাতটা আমারও তো কষ্টেই কেটেছে। কানাডার কাছে হেরে যাবে- কষ্টকল্পনাতেও এই ভাবনা ছিলোনা। তাই ঘটে গেলো। ঈদ উদযাপনের পরিবর্তে দেশের পরাজয়ে দুই বন্ধু শোকসন্তপ্ত।

দুই বছর হলো বাংলাদেশে কোন ক্রিকেট সিরিজ অনুষ্ঠিত হলে শফিকের কথা তখন নিয়মিত মনে পড়ে। সে আত্মহত্যা করেছে দুই বছর হলো। কাদম্বিনী মরে প্রমাণ করেছিলো সে মরেনি। শফিক আত্মহত্যা করে প্রমাণ করেছে যে মৃত্যুর পরেই তাকে কারো বেশী মনে পড়বে। এই সত্য স্বীকারে আপত্তি নেই আত্মহত্যার আগে শফিক আমার কাছে কখনো এতোটা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে উঠতে পারেনি।

বাংলাদেশ টানা হারতে থাকে। অস্ট্রেলিয়া বলতে গেলে বাংলাদেশকে কোন ম্যাচেই জয়ের সামান্যতম সুযোগ দেয়না। কম্প্রিহেনসিভ ডিফিট যাকে বলে। অনেকদিন হলো বাংলাদেশ টানা এতোগুলা ম্যাচ এতো বাজে খেলেনি। পত্রপত্রিকা, ফেসবুকে তামিম-সাকিবের বংশোদ্ধার করা হয়। দলের প্রতি মুশফিকুর রহিমের কমিটমেন্টের জায়গাটা আমার দেখা এই প্রথম প্রশ্নবিদ্ধ হতে আরম্ভ করে। চারিদিকে তুমুল হইচই- বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জঘন্য পারফরম্যান্স নিয়ে। ক্রিকেট খেলায় ব্যর্থতা- এর জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হওয়াটা মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে আমাদের অবস্থানকে সুনিশ্চিত করে।

আমি প্রতিদিন বাসে করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দীর্ঘসময়ের জন্য এলিফেন্ট রোডে এসে আটকে যাই। মোহে নয়। ভালোবাসায় নয়। নাগরিকের চিরন্তন সঙ্গী ট্রাফিক জ্যামের কাছে পরাজিত হয়ে। এলিফেন্ট রোড সন্ধ্যা নেমে আসতেই ঝলমলে হয়ে উঠে। যেনো কোন কর্পোরেট অফিসের সদ্য জয়েন করা রিসেপশনিস্ট। কৃত্রিম, দেখতে তাই বেশ লাগে- চোখে ঘোর জন্মে।

এইসব সাময়িক ঘোর সাময়িকতার মাঝেই ঘুরপাক খায়। একটা চাকরীর আমার খুবই প্রয়োজন। যতো না বেশী পেটের দায়ে তার চাইতে বেশী আইডেনটিটি ক্রাইসিসের প্রশমন। সেই কারণে প্রতিদিন মতিঝিলে পরিচিত অগ্রজের পত্রিকা অফিসে নিয়মিত তাকে ভজিয়ে যাচ্ছি। কবি এই যুগে বেঁচে থাকলে লিখতেন ভজাবেন, তবে তিনি মেলাবেন। তাছাড়া বন্ধুবান্ধব চাকরীবাকরী শুরু করে অনেকে বিয়েশাদী করে নিজস্ব পরিবারও গড়ে নিয়েছে। সেখানে আমি মৃত বন্ধুর প্রতি ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য জেগে উঠা স্মৃতি নিয়ে পীড়িত হচ্ছি- রাতেরবেলায় আয়নার সামনে দাঁড়ালে লজ্জায় পড়ে যাই। চের মৃত্যু সুনীল গাঙ্গুলীকে অপরাধী করতো। মৃত শফিকের ঘনঘন বাস্তব দৃশ্যপটে আগমন আমাকে লজ্জিত করে।

হেমন্ত পেরিয়ে শীত আসে। নিয়ম করে এখনো প্রায় প্রতিদিন মতিঝিলে যাই। জনৈক অগ্রজকে ধৈর্য ধরে ভজিয়ে যাচ্ছি। আমার অধ্যবসায়ে তিনি সন্তুষ্ট এমন আভাস পাই। তার চোখেমুখে তোষামোদি গ্রহণ করবার সেই সন্তুষ্টি খেলা করে। অস্ট্রেলিয়ার সাথে লেজেগোবরে হবার পর বাংলাদেশের বর্তমানে কোন সফর নেই। জনগণের মাঝে তাই ক্রিকেটচেতনা বিরাজ করেনা। তবুও শফিক আমার মনোজগতে বারবার হানা দেয়। যেনো সিঁদ কেটে চুরি করতে এসেছে।

‘তোর এখানে কি? যা ভাগ।’ স্মৃতির মাঝে শফিক চলে এলে আমি রাগত হই।

আমার সেই ভর্ৎসনায় শফিক বিব্রত হয়না। জোরে হেসে উঠে। তার প্রাণবন্ত হাসির কাছে আমার সমস্ত রাগ পরাভূত হয়। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি তার সাথে আমি দীর্ঘ কথোপকথন জুড়ে দিয়েছি। ঘুমের মাঝে কোলবালিশ নিয়ে মাটিতে পড়ে না গেলে যে কথোপকথনের ইতি ঘটেনা।

শীত পেরিয়ে বসন্তের মাঝেমাঝি সময়ে অবশেষে আমার চাকরীটা হয়। তেলমর্দনে আমিও দক্ষ এই সত্য আমার জীবনে অফুরন্ত স্বস্তি হয়ে ধরা দেয়। এখন বইমেলার মাস। অফিস শেষে একবার হলেও মেলার ভেতরে ঢুঁ মেরে যাই। পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হয়ে যায়। বন্ধু, বান্ধবী, প্রাক্তন প্রেমিকা- প্রথম দুই গোত্রের লোকজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলি। তৃতীয়পক্ষের মানুষরা সেই সদালাপে আগ্রহী নয়- সেই শরীরী ভাষা বুঝে নিয়ে তাদের কাছে একই বার্তা পৌঁছে দেই। চাকরীটা আমাকে অনেক জায়গায় স্থির করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে তীব্র আলোড়ন আমার আর হবেনা এ আমি বুঝে গেছি। এলিফেন্ট রোডে আসলে ঝলমলে আলো ছাড়া আর কিছুই আমাকে টানেনা। আলো, আলো- এই জগতে আলোই সত্য, আলোকিত সত্তাই পরম এমন এক ধারণায় ক্রমশ নিজেকে অভ্যস্ত করছি। চোখকান খোলা রাখি- কিন্তু তার মাঝে আলোর উপস্থিতি থাকে।

আত্মহত্যার সময়ে শফিকের চোখ দুইটা খোলা ছিলো; ছিলো কিছুর প্রতি নিবন্ধ, স্থির। তবে সেখানে কোন আলো ছিলোনা।




মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:৩৪

মহা সমন্বয় বলেছেন: নিউজল্যান্ডে বাংলাদেশের অবস্থা ভালা না, বৃষ্টি বিঘ্নিত প্রথম টেষ্ট ম্যাচ শুরুটা খুব একটা মন্দ হয়নি ৩০০ রান আশা করছি। দেখা যাক কি হয়? :)

২| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৫

মহা সমন্বয় বলেছেন: আহহ সাকিব, মুশি কি খেলাটাই না দেখাল, চোখ জুড়ানো সব অপূর্ব শর্টের ফুলঝুরি। নিউজল্যান্ডের মাটিতে ৩০০ রানই যেখানে অনেক সেখানে এখন ৬০০ রান হওয়ার পথে !:#P এ কি খেলা উপহার দিচ্ছে বাংলাদেশ এ রীতিমত অবিশ্বাস্য!!! :-<
সাবাশ বাংলাদেশ সবাশ সাকিব,মশফিক। B-)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.