নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

পলিটিকাল

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৫৭

রাতেরবেলা ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া ছিলো। সকাল নয়টার। তারপরে শুয়ে পড়েছিলো। তবুও, নাবিলার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হচ্ছে- স্বপ্নদোষবিহীন এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে বেলা এগারোটা বেজে গেলো তপুর। আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে যখন দেখলো মেলা দেরী হয়ে গেছে তখন প্রথমে নাবিলার উপরে , তারপর নিজের উপরে অতঃপর মায়ের উপরে তার খুব রাগ হলো। গতোকাল সন্ধ্যায় বাসায় এসে মাকে এতো করে জানিয়েছিলো আজকে সকালে শাহবাগে বেরুবে। সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখেও তাকে মা ডেকে দিলোনা। কাদের মোল্লার ফাঁসীর দাবীতে গোটা শাহবাগ উত্তাল। তার পরিচিত বন্ধুবান্ধব, ছোট-বড় ভাইবেরাদর প্রত্যেকেই শাহবাগে শ্লোগান দিতে দিতে এতোক্ষণে কিছু সময়ের জন্য জিরিয়ে নিয়ে পরস্পরের সাথে আড্ডায় মশগুল। একটু বিরতি নিয়ে আবারো শ্লোগানে শ্লোগানে গলা কাঁপিয়ে দেবে। সেখানে সে এখন বাথরুমে যেতে যেতে স্বপ্নের বিহ্বলতা কাটিয়ে পড়িমরি করে শাহবাগের উদ্দেশ্যে ছুটবে। কোন মানে হয়?

গোসল, ফ্রেশ হওয়া, পোশাক পাল্টে চুল আঁচড়ে নেওয়া- এইসব কাজ সারতে পনেরো মিনিটের বেশী সময় নিলোনা তপু। ঘর থেকে বেরুবার সময়ে মনে পড়লো সানগ্লাস নিতে ভুলে গেছে। ফেব্রুয়ারী মাস হলে কি হবে মিষ্টি রোদ দুপুরে ঠিকই চড়া হবে। তাছাড়া আন্দোলন-বিক্ষোভ এইসব করবার সময়ে কেতাদুরস্ত থাকা যাবেনা এমন কোন আইন আছে নাকি? ডাইনিং টেবিলেও নাস্তা খেতে বসে তপু উশখুশ করছিলো। সময়টা যতো সম্ভব কম নষ্ট করতে চায়। পুত্রের এই ছটফটে ভাব দেখে নিজের চাপা অসন্তোষ আর চাপা দিয়ে রাখতে পারলেন না বদরুন্নেসা। ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন,

‘এতো তাড়াহুড়ার কি আছে? কি রাজকার্যে শাহবাগে ছুটে যাচ্ছিস? রুটিটা ভালোভাবে খা। গলায় আটকাবে তো।’

ধুরো, এখন মায়ের এইসব আদিখ্যেতায় গুরুত্ব দেওয়ার কোন মানে হয়না। তপু বরাবরই লক্ষ্য করেছে ভদ্রমহিলা সবসময় তার আর্জেন্ট সময়গুলোতে অনর্থক কথা বলে। এবং তার ভেতরকার টেনশন বিরক্তি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু এখন উত্তেজিত হওয়া চলবেনা। ভাজি আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। রুটিটা নির্বিঘ্নে শেষ করে চেয়ার আগের জায়গায় স্থির করে দিয়ে বাইরে যাবে এমন সময় পেছন থেকে বদরুন্নেসা আসল কথাটুকু পাড়লেন।

‘তোর শাহবাগে কেনো যাইতেই হবে? যদি পরে কিছু হয়ে যায়? এখন সবাই মিলে তাল দিচ্ছে। পরে যখন বিপদ শুরু হবে তখন সবাই যার যার সুবিধামতো ভেগে যাবে। তুই কই যাবি? রাজনীতিতে কখন কি হয়ে যায় তার কোন ঠিক আছে?’

উফ, তপু কপাল চাপড়াতে গিয়েও নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করে। তার ক্লাস এইট পাশ করা মায়ের কাছ থেকে এখন রাজনীতির পাঠ নিতে হবে? এটা কি ধরণের কথা? মাকে নিয়ে তপু আর পেরে উঠলোনা। সবকিছুতে শুধু টেনশন আর টেনশন। দূরদর্শীতা বলতে কিছুই নেই। তপু হাজারো চেষ্টা করেও মাকে আজ পর্যন্ত বোঝাতে পারলোনা- ভবিষ্যতের কথাও মানুষকে ভাবতে হয়, তার জন্য কাজ করতে হয়। এই যে সে এতো তাড়াহুড়া করে শাহবাগ ছুটে যাচ্ছে- বিনা কারণে তো যাচ্ছেনা। তার বন্ধুবান্ধব সকলে ইতোমধ্যে শাহবাগে চলে গেছে। তার পরিচিত ইনফ্লুয়েনশিয়াল মানুষজনও শাহবাগে পৌঁছে গেছে। সেখানে সে একা এবসেন্ট থাকলে ব্যাপারটা কি ভালো দেখায়? তাছাড়া সে তো পিকেটিং করতে যাচ্ছেনা। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর ইস্যু একটা বার্নিং ইস্যু। দেশের জন্য রাস্তাঘাটে বসে আন্দোলন করবার সুযোগ পেলে তপু তাকে কাজে লাগাবেনা? মায়ের কথায় ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরে বসে থাকবে? প্রশ্নই উঠেনা। দেশের জন্য কল্যাণকর কিছু তপু সবসময়ই করতে চেয়েছে। তাছাড়া কে বলতে পারে শাহবাগে পরিচিত সবার সাথে বসে শ্লোগান দিতে দিতে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়? ক্যারিয়ারের চিন্তাও তো করতে হবে। তার ভালোমন্দ কিছু একটা শাহবাগে আন্দোলন করতে গিয়েও তো হতে পারে। কখন কার ভাগ্য কোথায় শিকে ছেঁড়ে তার খবর মানুষ তো জানেনা কিছু। জানেন শুধু আল্লাহতায়ালা।

বাড়ি থেকে বের হয়ে তপুর মেজাজ আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। কি অবস্থা চারিদিকের একবার দেখো। কাঁচাবাজারের সামনের আধাপাকা রাস্তায় কাঁদাপানি। মানুষজন পা টিপে টিপে সেই রাস্তা পেরুচ্ছে। দক্ষিণ দিকে সোলায়মান রেস্তোরা থেকে পঁচা তেলে পরোটা ভাজা হচ্ছে। সেই জিনিসের সাথে কড়া ঝালের ভাজি দিয়ে লোকজন নাস্তা সেরে তৃপ্ত মুখে রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে ভুড়ি নাচিয়ে দেখছে। সামনের গার্লস স্কুলে মর্নিং শিফটের ছুটি হলো একটু আগে। ছুটি হবার পরে মেয়েরা দলবেঁধে বাড়ি ফেরে। তবুও বখাটেদের দুই তিনটা শিষ আর সাইড কমেন্ট থেকে তাদের নিস্তার মেলেনা। স্থানীয় পাড়ার মাথা সুলতান সাহেব ছেলেগুলোকে পয়সা দিয়ে পুষেন বলে এলাকায় এই নিয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস করেনা। শাকসবজি বিক্রেতা সোবহান- তপু ব্যক্তিগতভাবে চেনে, বেশ ঘোড়েল লোকটা; সবজি ফ্রেশ রাখতে নোংরা পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। তপুর গা গুলিয়ে উঠে। সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে এসে ছেলেপেলেগুলো মনের আনন্দে বেরুচ্ছে। কাছাকাছি আরেকটা গার্লস স্কুল আছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেবে আর ডে শিফট শুরু হতে হতে মেয়েগুলো যখন আসতে থাকবে তখন তাদের উদ্দেশ্যে অবধারিতভাবে শিষ এবং সাইড কমেন্ট ছুঁড়ে দেবে। শাহবাগে কি চলছে, কি মস্তবড় কান্ড ঘটে যাচ্ছে- তার কোন খবর এইসব আনকালচার্ডরা রাখবে সেই প্রত্যাশা করাটাই নিরেট বোকামী।

বাস কাউন্টারের সামনে যেতে যেতে তপুর দেখা হয়ে গেলো বাড়িওয়ালা আব্বাসউদ্দীনের সাথে। ষাটের উপরে বয়স হবে, পাঁচওয়াক্ত নামাজী মানুষ। এখনো কোন যুবতী মেয়ের সাথে কথা বলার সময়ে বুক থেকে নিজের চোখ সরিয়ে কথা বলতে পারেন না। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে মর্নিংওয়াক, চা নাস্তা খাওয়া এবং সমবয়সী বুড়োদের সাথে দেশের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হতে বাড়ি থেকে বের হন। ফেরেন দুপুরের ঠিক আগে আগে। তপুকে দেখেই ভদ্রলোকের নীরবতা ভাঙ্গে।

‘কই যাও?’

সবাইকে জানাবার কি প্রয়োজন যে সে শাহবাগে যাচ্ছে? আবার পুরোদস্তুর মিথ্যা কথা বলতেও তপুর বাঁধো বাঁধো ঠেকে। তাই সে হাসিমুখে জবাব দিলো ‘চাচা, ভার্সিটি যাই।’

আব্বাসউদ্দীনের মুখ কি একটু কুটিল আকার ধারণ করলো? তপু দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। তাকে আপাদমস্তক পরখ করে নিয়ে আব্বাসউদ্দীন সম্ভবত আশ্বস্তই হন। ‘যাও ভার্সিটি যাও। তবে শাহবাগে যাইয়োনা। ভবিষ্যত নষ্ট কইরোনা। সেখানে যা হইতেছে সব ভারতের চক্রান্ত। তোমরা যুবক বয়সের ছেলেপুলে। রাজনীতির চাল এখনো অতশত বুঝোনা। এক জীবনে কতো কি দেখলাম। প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই নিজেই তো রাজাকার। তারে ধরে লটকায় না কেনো? এইসব নিয়া চিন্তাভাবনা করো। তাইলেই বুঝবা শাহবাগে কি হইতেছে।’

তপুকে কি সকলে নির্বোধ মনে করে? বাসায় তার মা, বাইরে বেরুলেও শান্তি নেই। এখানে বাড়িওয়ালা বকবক করে যাচ্ছে। সে তো কচিখোকা নয়। তাকে নিয়ে সকলের এতো টেনশন, কিন্তু কাজের সময়ে এদের খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এক মাস আগেই তো হবে, হঠাৎ করে তপুদের বাসায় পানি লিক করলো। বাড়িওয়ালাকে গিয়ে সে নিজেই জানিয়েছিলো। তিনি করছি, করবো করতে করতে তাদের বাসায় পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার অবস্থা। এই লোক এখন এসেছে তাকে রাজনীতির শিক্ষা দিতে। বিরক্তি চেপে রেখে মুখে নন কমিটাল হাসি ছড়িয়ে তপু দ্রুত শাহবাগগামী টিকেট কেটে বাসে উঠে পড়ে।

বাসে উঠলে তপু সবসময় জানালার পাশের কোন সিট খোঁজে। কবিতা, গল্প- এইসব তাকে কখনোই তেমন একটা টানেনা। মানুষজন কেনো যে গল্প, উপন্যাস পড়ে এতো সময় নষ্ট করে এই প্রশ্ন তার অনেকদিনের। তবে এই বসন্ত আসি আসি করছে সময়ে জানালার পাশে একটা সিটে বসে মিষ্টি রোদের সান্নিধ্য উপভোগ করতে তপুর কি যে ভালো লাগে! খুঁজেপেতে সেরকম একটা সিট দেখে বসে তপু চারপাশ মন দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলো।

শাহবাগে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। প্রায় লাখখানিক মানুষ তো সেখানে জমায়েত হবেই। জন্মের পর তপু আর কখনো এক জায়গায় এতো মানুষ দেখেনি। এর প্রভাব শাহবাগে যায়নি এমন মানুষজনের উপরে পড়বেনা? তাছাড়া গতোকাল সন্ধ্যায় বাসায় আসবার পর মনে এক নতুন ভাবনা এসে বসত গেড়েছে। বিদেশে গিয়ে সেটেলড হবার ইচ্ছাটা তার বহুদিনের। আজকাল কানাডায় এতো মানুষ যাচ্ছে। তার বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই তো চলে গেলো। শিহাব, তমাল, রাসেল সবাই। মেরিটে তার চাইতে প্রত্যেকে কতোটা পিছিয়ে সেই কথা তপু খুব ভালো করেই জানে। একটা ভালো জায়গা থেকে পাবলিশড হওয়া রিসার্চ পেপার সিভিতে এড করতে পারলে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তপুর বাড়বে বই কমবেনা। রিসার্চ টপিক হিসাবে শাহবাগের আন্দোলন কতো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে গতোকাল বিকালে সেই নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো হৃদয়ের সাথে। এই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করতে হলে কাঁচামাল হিসাবে শাহবাগ নিয়ে চারপাশে কে কি ভাবছে, কিভাবে দেখছে বিষয়টিকে সবই তো তপু জানা থাকতে হবে। আশেপাশের লোকজনকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য না করলে তাদের মনোভাব আঁচ করবে কিভাবে?

বাসে লোকভর্তি হতে হতে তপুর চাওয়াটা ধীরে ধীরে পূরণ হতে শুরু করে। ডানদিক থেকে পঞ্চম সিটে একজন কাঁচাপাকা চুলের মাঝবয়সী ভদ্রলোক প্রথমে শাহবাগ নিয়ে কি একটা কথা বলতেই গোটা বাস সেই বক্তব্য নিয়ে হামলে পড়লো। কেউ কেউ বলছে পুরোটাই আইওয়াশ, কেউ কেউ বলছে এতো বিপুল পরিমাণে জনসমাগম ঘটেছে-এমনি এমনি তো এরকম ঘটেনা। নিশ্চয়ই এই আন্দোলনে ভালো কিছু আছে। কেউ কেউ আন্দোলনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানালেও পিজি বারডেমের পথ রুদ্ধ করে আন্দোলন করার কান্ডজ্ঞানহীনতা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে দ্বিতীয়বার ভাবলোনা। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে স্বপ্নভঙ্গ এবং দেশদ্রোহীদের ক্ষমতার মসনদে বসা নিয়েও তুমুল ক্ষোভ প্রকাশ করলো কেউ কেউ। ক্রমশই আলাপটা জোরালো হতে হতে জমে উঠে। তপুর খুব অস্থির অস্থির লাগে। তার কি প্রচন্ড ইচ্ছাই না হচ্ছে আলাপে অংশগ্রহণ করতে! কিন্তু সেটা করতে গেলে মানুষজনদের দিকে তো ভালোভাবে লক্ষ্য করাটা কঠিন। রিসার্চ টপিক হিসাবে শাহবাগ আন্দোলনও আর শক্তিশালী থাকতে পারবেনা। তাছাড়া যতো হইহল্লাই উঠুক, কে বলতে পারে মানুষজন নিজেদের আসল মনোভাব লুকিয়ে না রেখে যা বলার বলে যাচ্ছে? এই সময়ে পরিচিত মানুষকেই সহজে বিশ্বাস করা চলেনা। সেখানে অপরিচিত মানুষের সাথে সরল বিশ্বাসে নিজের রাজনৈতিক মতামত স্পষ্টভাবে জানানো- বড্ড বেশী রিস্কি। তাই সে এই আলাপ থেকে ক্রমশ বাদানুবাদে পরিণত হওয়া পরিস্থিতিতে নীরব থাকবার সিদ্ধান্ত নেয়।

আজকে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রণা বলতে গেলে একেবারেই নেই। তপু কল্যাণপুর থেকে বাসে উঠেছিলো। পঁচিশ মিনিটের মধ্যে কি সুন্দর বাস এসে পৌঁছালো সায়েন্সল্যাবে। যতোটা দেরী হয়ে যাবে ভেবেছিলো শাহবাগ পৌঁছাতে পৌঁছাতে, ততো দেরী হয়নি। সাতাশ নাম্বারে থাকতে রাতুলের কল আসলে তাকে বলেছিলো আর বিশ মিনিটের মতো লাগবে শাহবাগ পৌঁছাতে। কথা বলতে বলতে শাহবাগ থেকে মানুষদের শ্লোগানমুখর কন্ঠ শুনে শরীরে কি এক যে থ্রিল হয়েছে তপুর- আজীবন ভুলবেনা। সায়েন্সল্যাবে এসে নতুন লোকজন নিতে বাসটা কি একটু বেশীই দেরী করছেনা? তপু উশখুশ করে উঠে। কি স্মুথলী এতোটা দীর্ঘ পথ চলে আসলো। এখন যদি দেরী করে- তাহলে কেমনে কি? আর কোন স্টপেজে তো ড্রাইভার এতো সময় ধরে প্যাসেঞ্জার নেয়নি।

বাস কাটাবন মোড়ে এসে পৌঁছালে তপুর মনে পড়ে বাকি পথটা হেঁটে যেতে হবে। কাটাবন মোড়ের সামনে একগাদা ব্যারিকেড। তার সামনে সুসজ্জিত পুলিশবাহিনী তর্জনীর ইশারায় প্রতিটি বাসকে থামতে আদেশ দিলে বাসগুলো থেকে শাহবাগগামী মানুষজন নেমে যায়। কাটাবন থেকে শাহবাগ- একেবারে কম দূরত্ব নয় বলে তপু মনে করে। সে কখনোই হাঁটতে ভালোবাসেনা। আকাশের উপরে স্থির সূর্য ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে, ফেব্রুয়ারীর শরীর দোলানো মিষ্টি রোদটা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। এই সময়ে রাস্তায় হাঁটবার কাজটা বেশ কষ্টসাধ্য। মুখে বিরক্তির একটা রেখা ফুটে উঠতে নেবে এমন সময়ে তপুর মনে পড়ে যায় সে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবীতে আন্দোলন করতে এসেছে। আন্দোলন সংগ্রাম এসব ছেলেখেলা তো নয়। বাসে মানুষজনের দিকে গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করে যা দেখলো তাতে তপু বেশ সন্তুষ্ট। রিসার্চ পেপারের ইনিশিয়াল র ম্যাটেরিয়াল হিসাবে বাসের এই অভিজ্ঞতা তার খুব কাজে দেবে সন্দেহ নেই। মোবাইল বেজে উঠলে তপু কলার লিস্টে নাবিলার নাম দেখে। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বান্ধবীদের সাথে শাহবাগে এসে শ্লোগান দিচ্ছে। তপু শাহবাগ পৌঁছালে তার দেরী করা নিয়ে ঠাট্টাতামাশা শুরু করবে। তা করুক না, এতো অলস স্বভাবের হবার পরেও শাহবাগে এসে রাজাকারের ফাঁসীর দাবীতে সে শ্লোগান দিচ্ছে, আন্দোলন সংগ্রাম করছে- প্রেমিকাকে এই কথা পাল্টা শুনিয়ে দিতে সে ছাড়বে নাকি?

শাহবাগের কাছাকাছি এসে তপু দেখে চারপাশ লোকে লোকারন্য। দুপুরের ঝাঁঝিয়ে উঠা রোদেও মানুষজন শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। জাদুঘর বরাবর ফুটপাথটি মানুষজনে ভর্তি হয়ে আছে। ভিড় ঠেলে চারুকলার সামনে এগোতে বেশ কষ্ট হলেও তপু হাসিমুখে এগোয়। বন্ধুবান্ধবরা সেখানে সার্কেল করে বসে পড়বে এমনটাই কথা আছে। কড়া রোদ- সানগ্লাসটা চোখে গলিয়ে দিতে দিতে তপু নাবিলাকে দেখতে পায়। প্রেমিকাকে দেখে সকালবেলায় দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেলে তপুর শ্যামলা মুখ লাল হয়ে উঠে। তার আশেপাশে শত শত মানুষ ক্লান্তিহীন শ্লোগান দিচ্ছে- ক তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার। নাবিলার কাছাকাছি এসে ফাঁকা জায়গা খুঁজে পেয়ে বসতে বসতে তপু মুষ্টিবদ্ধ হাতে শ্লোগান দিতে উদ্যত হলে বোঝে গলাটা শুকিয়ে এসেছে। এক ঢোঁক পানি খেতে পারলে শ্লোগানে শ্লোগানে কাদের মোল্লার ফাঁসীর দাবীটা বজ্রকন্ঠে জানাতে পারতো।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:২১

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: তপুতো আমিই।। আর তার গন্ডীটাও যে আমার চিরচেনা।।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.