নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চিত্রার্পিত

০১ লা মার্চ, ২০১৭ রাত ৩:২৫

সাত কি আট গজ দূরত্বে; যেখান থেকে আলোর প্রাবল্যে অনুভূত হয়, জায়গাটিকে এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব- একটি কুকুর পড়ে আছে, মৃত। দেখে শিউরে উঠতে গিয়েও শিউরে উঠলোনা, নাজমুল। প্রথমে দেখে চোখ বন্ধ করে পরমুহূর্তেই তা খুলে ফেললো, কেনো আমি চোখ বন্ধ করে থাকবো; এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পেয়ে।

পাতাঝরা বসন্তের রাত; স্বপ্ন, বেদনা, হতাশা, আনন্দ- সবকিছুকে ছাপিয়ে নৈসর্গিক বিমর্ষতাই যখন হৃদয়ে মূর্ত হয়ে উঠে, নাজমুল চেয়েছিলো এমন একটি রাতে সে এখানে আসবে, অবশেষে এলো। কিন্তু হৃদয়ের কোন বিন্দুটিতে দাগ; রোমন্থনের, বসে, তাকে চঞ্চল করে তুলবে বুঝতে সে ব্যর্থ। কিন্তু এমনটা সে আশা করেনি। যেদিনটায় মনস্থির করেছিলো; ফিরে আসবে সে, নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে- ভেবেছিলো চঞ্চলতার সাথে হবে তার সাক্ষাৎ, হৃৎপিন্ড মৌমাছির মতো দুলবে এদিক-ওদিক, কিন্তু হলো কই?

দুইপাশে সারি সারি ফলমূলের দোকান। বেশীরভাগ দোকানেই সবার আগে উজ্জ্বল সব কমলালেবু দেখা যায়। দোকানদারেরা তার উপর থেকে মাছি তাড়াতে ব্যস্ত। একটা ঈষৎ বেগুনী রঙের ঘুড়ি মাটিতে পড়ে থেকে পথযাত্রীদের পায়ে পিষ্ট হচ্ছে, অন্তহীন সময় ধরে- নগন্য এই দৃশ্যে নাজমুলের বুক কাঁপতে লাগলো। ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন, পাশের বাড়ির রিনার ঘুড়ি কেটে দিয়েছিলো একদিন বিকালে ছাদে উঠে; কমলা পোশাকে রিনা তখন ঘুড়িকে আকাশের চারিদিকে সাঁতরে নিতে ব্যাকুল, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলো। তারপরে অনেকদিন হলো নাজমুলের সাথে কথা বলেনি। পাড়া ছেড়ে চলে যাবার আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে ডেকে নিয়েছিলো। নাজমুল গিয়েছিলো, স্থির দাঁড়িয়ে থেকেছিলো দেড় ঘন্টা; একটা শিউলী ফুল হাতে নিয়ে খুব সংগোপনে, যেনো কেউ দেখে ফেললে ফুলটির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী; বাড়ি ফিরে এসেছিলো সজল নয়নে। ফলের দোকানদারের খিস্তিতে শিউলী ফুল নাজমুলের স্মৃতি থেকে পালিয়ে গেলো। একটা রিকশা গলিটি পেরিয়ে যাচ্ছে, আরেকটু হলেই ঠেলাগাড়ির সাথে সংঘর্ষে রিকশাটি পড়ে যেতে পারতো, কিন্তু গেলোনা।

রিকশাওয়ালা চমৎকারভাবে শেষ মুহূর্তে কাটিয়ে নিয়ে গেলো। নাজমুল সামনে এগোতে থাকে। পিচঢালা পথ; তার যাপনের কালে আধাপাকা ছিলো অনেকদিন। তার বাবা প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসেই বড় বড় করে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিতেন আর রাস্তাটিকে শাপশাপান্ত করতেন। তাকে অনেকদূর হাঁটতে হতো; কখনো হাতে সাপ্তাহিক বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে একা হেঁটে বাড়ি ফিরে আসবার পরেও দেখা যেতো গালমন্দ করবার সময়তেও তার পিতার চোখেমুখে সন্তুষ্টির নীরব মৃদু আভা খেলা করছে।

গেলো বছরের কার্তিক; হ্যা কার্তিকই হবে- নাজমুল ঠিকঠাক মনে করতে পারলো, মনস্থির করেছিলো আসবে। নিজের কাছে তার ফেরা দরকার, অনুভব করতে পারছিলো। সেইদিন বিকালে অফিস থেকে বের হবার পরে ভাবনাটা মাথায় এলে শরীর চনমনে হয়ে উঠেছিলো। তখনো চায়ে পর্যন্ত চুমুক দেয়নি, কিন্তু পুরনো সিঙ্গারার স্বাদে জিভ সেই পরিকল্পনায় সায় দিতে আরম্ভ করেছিলো। বেশী কিছু নাজমুল এই অবধি জীবনে চায়নি। তরতর করে সমাজে উঠে যাবার লোভনীয় সিঁড়ি, সাফল্য, একজন রক্তমাংসের নিকটজন, আরো কিছু- নাহ, সে এতোটা দুঃসাহস করেনি কখনো। মানুষের এন্তার কৌতূহল, অস্থিরতা, প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যান প্রত্যক্ষ করেও কুকুরের মতো পড়ে থাকা- ছিঃ! নাজমুলের অনুমোদনে এতোকিছুর স্থান সংকুলান হয়নি কখনো, হয়না।

মৃত কুকুরটার চারপাশে যাবার সময় মানুষজন একবার হলেও তার দিকে তাকাচ্ছে। কি ভেবে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? নিজের বেঁচে থাকবার আনন্দ ঝালিয়ে নেওয়ার সুখ? মানুষ তো মানুষ, মৃত কুকুর পর্যন্ত ঈর্ষার ছোবল থেকে মুক্ত নয়। একবার দেখতে পেলে হতো; শোভন, এই দৃশ্য। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মানুষের অন্তহীন সংকীর্ণতা নিয়ে নিজের বজ্রকঠিন মতামত জানিয়ে দিতো, চারপাশের সকলকে সচকিত করে। নাজমুল আলতো দীর্ঘশ্বাস ফেললো, যেনো রোড এক্সিডেন্টে মৃত শোভনের কথা কেউ টের পেলে, ইতোমধ্যেই নশ্বর সেই সত্তা আরেকটিবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে মেতে উঠবে সীমাহীন পরিহাসপূর্ণ সেই অনিবার্য খেলায়। জীবন সম্পর্কে শোভনের দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো এতো চাঁচাছোলা, তীর্যক- মাঝেমাঝেই নাজমুল বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠতো তার উপরে। তখন লক্ষ্য করতো শোভনের চোখে তার প্রতি এক আশ্চর্য স্নিগ্ধ কোমল সিক্ত মমতা ফুটে উঠেছে। যেনো অবুঝ কোন শিশুকে অমোঘ সত্য বলতে না পারবার বেদনা নিজেকে মায়ায় রুপান্তরিত করেছে। এক পানওয়ালা গলার শিরা ফুরিয়ে এক সিগারেটওয়ালার সাথে ঝগড়া করছে গার্লস স্কুলটার সামনে- নাজমুল ভাবে সিগারেট খায়না অনেকক্ষণ হলো। সিগারেট একটা কিনে প্রথম টানটা দিতেই চোখের সামনে জগত উদ্ভাসিত হয়েছে; এমন এক আশ্চর্য অনুভূতিতে তার মনে হলো, সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।

কতোকাল হলো মাঠটির ভেতরে সে ঢোকেনা- গেট পার হতে ঢুকলেই ধুলোতে তার মুখ ভরে গেলো, স্মৃতি আছড়ে পড়লো পুরনো দিনের অবগাহনে। ওই যে, তাদের বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড়ময় জায়গাটা; জীবনে প্রথম সিগারেট খেতে শিখেছিলো এখানে দাঁড়িয়ে সবার চোখকে লুকিয়ে- খুব রাতেরবেলায় বাড়ি থেকে পা টিপে টিপে সারাদিন ধরে চা আর সিগারেট বিক্রি করা ছগির মিয়ার দোকানে চলে যেতো। গেটে ঢুকতে ঢুকতে লক্ষ্য করেছিলো ছগির মিয়ার সেই দোকানটি আর নেই- পরিবর্তে একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ধুন্ধুমার হিন্দি গান চলছে। নাজমুল মাঠের পশ্চিম দিকে হেঁটে এগিয়ে যেতে মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনিতে একটু স্থির দাঁড়িয়ে পড়লো। ধর্মের সাথে সংযোগহীন বিস্মৃতকাল হতে, তবু এখনো আজানের ধ্বনি কানে এলে থমকে যায়। চারিদিকের রাস্তা শুনশান, রাত নয়টাও বাজেনি। নাজমুলের বুক শিরশির করে উঠলো, দুঃসহ নিস্তব্ধতা সমগ্র মাঠজুড়ে; তার রোমন্থিত ইন্দ্রপুরী চিত্রার্পিত, অন্তর্গত সকল বিষাদকে ধারণ করে।

মাঠ পেরোতেই গাড়ির ধুলো আছড়ানো আওয়াজ পেলো নাজমুল। এখন বেশ অন্ধকার, চোখজোড়া সজাগ না থাকলে ধুলোময় রাস্তাতেই ঠোক্কর খেতে হয়। তবু নিজের নিকষ কালো অন্ধকার চোখেই দেখতে পেলো; চারপাশকে হতবিহ্বল করে, নাজমুলের স্মৃতিকোষের আনাচেকানাচে ছিন্নভিন্ন করে, ধুলোয় নিজেদের আড়ম্বর ঘোষণায় একটি র‌্যাবের গাড়ি মাঠ পেরিয়ে উত্তর দিক বরাবর ছুটে যাচ্ছে। নাজমুল; স্পন্দনহীন, অনালোড়িত মুখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো শক্ত মাটির উপরে- স্বগতোক্তি করলো, ‘এবার’ ?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.