নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রবণতা

০৮ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ২:০৩

ঢাকা ছেড়ে নিজের বাড়িতে চলে না আসলে আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারতোনা, জুয়েলের। দুলে দুলে বাতাস দিচ্ছে জানালা দিয়ে, আকাশে ‘বৃষ্টি এসে পড়বে’ মেঘ উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে- কল্যাণপুরের স্যাঁতস্যাঁতে সেই মেসে এসবের দেখা কই পাবে? আরাম করে জয়েস কি কাফকা পড়তে গেলেও হাজারো রকমের ফ্যাকড়া, প্রকৃতির মনোরম স্পর্শের দেখা সেখানে কই পায়?

দুপুরে খেয়ে নেবার পরে বেশ আরাম করে ঘুমিয়েছে। ঢাকায় সেই সুযোগের প্রশ্নই আসেনা। ক্লাস সেরে যখন দুপুরবেলায় মেসে ফেরে; গোসল-খাওয়া সেরে তারপর বই নিয়ে বসে যায়। দস্তয়ভস্কি, জয়েস, কাফকা, ক্যামু- জুয়েল খুব মন দিয়ে পড়বার চেষ্টা করে এদের। প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠে, তবু নিজের উপরে অত্যাচার না করে সাহিত্যপাঠে ক্ষান্ত দিতে তার মনে সায় দেয়না। তিন বছর হয়ে গেলো তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের, স্পষ্ট বুঝেছে নিহিলিস্ট হতে না পারলে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় ঠিক জুত করে উঠতে পারা যায়না। আজকাল এতো আপডেটেড সকলে, কাহাঁতক আর ইনফরমেশন মুখস্থ বলে আসর মাত করে দেওয়া সম্ভব? তাছাড়া আজকাল সুন্দর সুন্দর সব মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। মহিমা বড্ড ট্রাবল দিচ্ছে ইদানিং। পরশুদিন তাকে মেসে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো জুয়েল। মেসমেটদের দুইজন গেছে নিজেদের বাড়িতে, বাকি দুইজন আগে থেকেই বলে রেখেছিলো যে, ফিরতে রাত হবে। রোদহীন, বৃষ্টিহীন কি সুন্দর মখমলি আবহাওয়া ছিলো! মহিমা একটু কো-অপারেট করলে শূন্য মেসে দিনটাকে তারা দুজনে মিলে মহিমান্বিত করতে পারতো। জুয়েল বরাবরই লক্ষ্য করে দেখেছে, মেয়েটা একটু গেঁয়ো ধরণের। ক্রমশ সংশোধনের অযোগ্য হয়ে উঠছে, এমনটা সে মনে করে। মেসটা ফাঁকা হতেই কিংবা শোভনের ফ্ল্যাট খালি হলে জুয়েলের বুকের কাছে দলা পাকিয়ে উঠে- মহিমাকে কতোবার বলেছে, শোনেনি, বোঝেনি কিছুই।

জুয়েলের ঘরটা সবসময়েই গোছানো থাকে। তার মাতৃদেবীর অবদান। নয় মাসে ছয় মাসে একবার দুবার বাড়ী আসে- কিন্তু প্রতিবারই এসে নিজের ঘর দেখে টিপটপ। মেহমানরা বাড়ি আসলে এ ঘরে এসে কেউ থাকেনা। টেবিলের উপরে সারিবদ্ধ্বভাবে বইখাতা সাজানো, শুধু উপরে ক্লাস টেনের কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা খোলা- তার ছোটবোন রুনুর। লাল রঙের কভারওয়ালা কোলবালিশ, ধবধবে সাদা রঙের বিছানার চাদর- এতোটা ফর্সা যে মনে হবে গতোকালকেই কেনা হয়েছে। সবুজ রঙের দেয়াল, একটা কালো দাগ পর্যন্ত দেখা যায়না। সন্ধ্যা হতে হালকা নীল রঙের বাতি জ্বলে উঠে, ঘরটিকে আরো মৃদু দেখায়। আলমারি না দেখেই জুয়েল বলে দিতে পারে, তার পরনের পোশাকআশাক সব বিন্যস্ত। শুধু কর্তার শরীরে কখন ফিট করবে তারই অপেক্ষায়। হালকা ঘিয়া রঙের পর্দায় বাইরের মানুষের থেকে জুয়েল এবং তার এই ঘর আবৃত থাকতে পারে। মেঝেটাও পরিষ্কার। কিন্তু আলমারির পাশে এক কোনায় সবুজ রঙের জায়নামাজ দেখে জুয়েলের হালকা অস্বস্তি হলো। ঢাকায় থাকতে নামাজকালামের ধারকাছ দিয়ে যাওয়া হয়না। বলা ভালো যাওয়া যায়না। একবার খবরটা চাউর হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে নিয়ে হাসাহাসির বন্যা বয়ে যাবে। মাশফিকটা আদ্যন্ত স্যাডিস্ট- হুজুর বলে তাকে টিপ্পনী কেটে যাবে দেখা হতেই আর হো হো করে হেসে বাকিদেরও যুক্ত করবে। তবে বাড়ি আসলে জুয়েলের এই নিয়ে কোন টেনশন নেই। বিশেষ করে ওজু করতে গিয়ে বাপের সামনে পড়ে গেলে, জুয়েল লক্ষ্য করেছে- ছেলে আমার এখনো মানুষ আছে; এরকম অভিব্যক্তির একটা হাসি ফুটে উঠে বাপের মুখে।

ধর্মকর্ম সেরে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। বাতাসটা এতো ফুরফুরে- শহরের রাস্তাঘাট প্রায় পুরোটাই পাকা হয়ে গেছে। জুয়েল ঘড়িতে সময় দেখে নেয়, চারটার মতো বাজে। জসিম মিয়ার টঙের দোকানে গেলে হাফিজ, রাব্বি আর আশফাকের দেখা পেয়ে যাবে নিশ্চিত। ভাগ্য ভালো থাকলে আশফাকের ছোট বোন ঝুমুরের সাথেও দেখা হয়ে যেতে পারে। মেয়েটা চলাফেরায় জবরদস্ত স্মার্ট, বাড়তি প্রণোদনা হিসাবে হাসলে গালে ফুটে উঠা টোল- কখনো নিভৃতে তার সাথে সময় কাটালে শিল্পসাহিত্য নিয়ে দারুণ এক লেকচার দিয়ে মেয়েটার মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে, এই আস্থা নিজের উপরে তার আছে।

জুয়েল হতাশ হলো। কেউই নেই দোকানে। জসিম মিয়া লোক মন্দ নয়, কিন্তু তাকে একটু সুযোগ দিলেই লোকটা পলিটিকাল হয়ে উঠে। দেশ-জাতি উদ্ধার করা শুরু করে দেয়। পলিটিক্সে জুয়েলের বরাবরই বিতৃষ্ণা। এইসব মারামারি, কাটাকাটি নিয়ে সে একদন্ডও ভাবতে চায়না। শিল্প-সাহিত্যে আগ্রহী মানুষজনের এর মাঝে নাক গলানো কেনো বাপু? জয়েসের এক ইউলিসিস উপন্যাসটা শেষ করতেই তো জীবন পার হয়ে যাবে বলে সে মনে করে- এতোকিছু সামলে রাজনীতির মতো নোংরা, কুৎসিত বিষয়আষয়; না না জুয়েল নিজের বেলায় এমনটা ভাবতে পারেনা। জসিম মিয়াকে সুযোগ না দিয়েই চা শেষ করে সে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

কালভার্টের রাস্তাটা পাকা হয়ে হাঁটতে খুব সুবিধা হয়েছে। আগে পার হতে খুব কষ্ট হতো সকলের। পায়ে হাঁটাই হোক কিংবা রিকশায়- কষ্টকর ঠেকতো খুব। অনেকদিন পরে বাড়ি ফিরে আসলে জুয়েলের খুবই ভালো লাগে। সবকিছু নতুন করে চিনছে এমন অনুভূতি হয়। এই যে তাকিয়ে দেখো আকাশের দিকে- ঢাকায় থাকলে এই মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আচ্ছন্ন হবার সময়টাই হাতে থাকেনা। প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ততার ফাঁকে প্রকৃতিকে চেনার সুযোগ কোথায়? জুয়েল উৎফুল্লবোধ করে। মহিমাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারলে বেশ হতো। তাকে এই নিবিড়, অকৃত্রিম ছায়াঘেরা মফস্বলে নিজের আকুতির কথা বলা যেতো গুছিয়ে। এতো এতো কথা জমে থাকে জুয়েলের হৃদয়ে, মহিমাকে নরম সুরে বললে সে কি শুনবেনা? জুয়েলের ‘ভাড়াক্রান্ত’ হার্টবিট বেড়ে যেতে লাগলো। নাহ, তিনদিন পর এবারে যখন সে ঢাকায় ফিরে যাবে- গিয়েই মহিমার সাথে কথা বলে নেবে অনেক সময় ধরে। কিছু একটা, কি- জুয়েল ঠিক গুছিয়ে বলতে পারেনা, তার হৃদয়ে খেলা করে চলেছে অবিরাম। মহিমার সাথে শেষবারের আগেরবার যখন ঝগড়া চলছিলো তুমুল, তাকে লুকিয়ে মৌলিকে সেই খেলার কথা বলতে ব্যাকুল হয়েছিলো সে- পাত্তাই দেয়নি মেয়েটা। খানকি, গালটা দিয়েই জিভে কামড় দিলো। না না, মেয়েদের বেলায় এমনটা সে ভাবতে পারেনা। সংস্কৃতিবান হয়ে উঠেছে, এখনো এভাবে ব্যাপারটাকে দেখলে কিভাবে হবে?

ঘন্টা তিনেক খুব হেঁটে বেড়ালো। চারপাশ কি নিস্তব্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা হতেই। জুয়েলের বুক ধুকপুক করে। ঢাকায় এই দৃশ্য অকল্পনীয়। তাড়াহুড়ো করে এসেছে এবার, সাথে বইপত্র নিয়ে আসলে চমৎকার হতো। শিপলুকে কথা দিয়েছিলো বাড়ি আসলে ক্যামুর মিথ অব সিসিফাস সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। ভুলে গিয়েছে। দেখা হলে শালা খিস্তি করবে নিশ্চিত। একটা কুকুর ডেকে উঠে। জুয়েল চমকে উঠে। এতোটাই জোরালো নিস্তব্ধতার সেই ভাষা। কি সুন্দর কোমর দুলিয়ে জয়নাল স্যারের বাড়ি থেকে মেয়েরা একের পর এক বেরিয়ে যাচ্ছে। জয়নাল স্যার এই শহরের বিখ্যাত অংকের শিক্ষক। তখন ক্লাস এইট হবে, শিউলীকে জয়নাল স্যারের বাড়ির সামনে থেকে ডেকে নিয়ে কাঁচা হাতে লেখা প্রেমপত্র গুঁজে দিয়েছিলো সে। মেয়েটা কোন জবাবই দেয়নি। মনে হতে জুয়েলের বুক শিরশির করে উঠে। কি আস্ত গবেটই না ছিলো সে! সাহিত্যের ধারেকাছে ছিলোনা তখন। তাহলে কি এই দুর্গতি হয়? নিদেনপক্ষে রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎচন্দ্র পড়া থাকলেও শিউলীর হাতে বেঘোরে এমনভাবে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়না।

বাড়ি ফিরে সবার সাথে দুই ঘন্টা জমিয়ে আড্ডা হলো। তার বাবা কম কথার মানুষ, রাশভারী স্বভাবের। পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, রাজনীতিতে না জড়ানো- এসবের বাইরে বলার মতো বিষয় তার নিতান্তই অপ্রতুল। রুনুর সাথে দারুণ আড্ডা জমে। ঘরদোরের কাজকর্ম সেরে আসতে পারলে মায়ের সাথেও। তবে আজকে যোগ দিলো সবাই। গম্ভীর বাবাও ছাত্রজীবনের দুই একটা রসিকতার ঘটনা বলে তাদের হাসিয়ে দিলো। খাওয়াদাওয়া শেষ হতে ঘরে ফিরে এলো জুয়েল। হালকা নীল আলোতে মৃদু ঘরকে আরো মৃদু বলে মনে হচ্ছে। বড় দেয়ালঘড়ির পাশ দিয়ে দুইটি টিকটিকি হেঁটে যায়। সবুজ রঙের দেয়ালের দিকে তাকালে চোখে ঘোর লেগে তাকে চিনতে পারা যায়না। চারপাশে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঢাকায় থাকলে একটা, না না আজকাল রাত দুইটা হবে বাতিগুলো নিভে যায়। অপরঘর থেকে জুয়েল তাস খেলার উল্লাসমুখর শব্দ শুনতে পেতো এ সময়ে। আচ্ছা, মহিমা ঝগড়ার সময়ে শেষ কি বলেছিলো? যে সে অভিনেতা? এতো বড় কথা? তাকে এই কথা বলবার মতো অডাসিটি, মহিমার মতো মেয়ের- করোটিতে ভাবনাটা গেঁড়ে বসলে জুয়েলের রগ ফুলে উঠে। মাথার পেছনে ঘিয়া রঙের পর্দা ঝোলে, তাকে দুই হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে জুয়েল জানালাটা খুলে দেয়। না নেই, কোন মানুষকে দেখা যাচ্ছেনা রাস্তায়। তবে নিচের দিকে তাকালে একটা কুকুরকে ল্যাম্পপোস্ট বরাবর মুততে দেখতে পায় আবছা। এমন সব রাতে জীবনানন্দ দাশ হলে ঠিকঠাক জমে। মৌলির সাথে প্রেমটা করতে পারলে জুয়েলের আর কোন চিন্তা ছিলোনা। ঢাকার রাতগুলো নির্বিঘ্নে কেটে যেতে পারতো। হাতে একটা বইও নেই, এই মফস্বলে এমন তীব্র নীরবতার সাথে পাল্লা দেয় সেই সাধ্য কার? ঢাকায় ফিরে গেলে, আর নয় মহিমার সাথে- সাহিত্য আর নতুন একজন প্রেমিকা জুটিয়ে নেওয়াটা মাস্ট।

তখন কোন শব্দ শোনা গেলোনা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.