নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

দাম্পত্যক্রিকেট

১৩ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:১৯

‘Straight down the ground, wonderful shot. All the way for six, what a player!’

শারজার ধুলিঝড়ে ব্যাটিং তান্ডবে উন্মত্ত শচীনের প্রশংসায় টনি গ্রেগের উত্তেজিত কন্ঠ আমার স্বপ্নে এসে জানান দেয়। আমি স্বপ্নের মধ্যেই দেখি শচীনের ব্যাট থেকে বল সাইটস্ক্রিণ পেরিয়ে সোজা বোলারের মাথার উপর দিয়ে বাউন্ডারী পেরিয়ে যাচ্ছে। সাইটস্ক্রিণ থেকে বল কুড়িয়ে আনলে শচীন যখন পরবর্তী বলের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত তখন আমি বিছানা ছেড়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে ভাবছি আজকের দিনটাকে কিভাবে তাৎপর্য্যময় করে তুলবো।

ঘুম ছেড়ে বাথরুমে যখন যাই, সময়টা আমার অন্যমনস্ক কাটে। যেনো টেস্ট ম্যাচের মর্নিং সেশনে ফুটওয়ার্ক ভালো না থাকা ওপেনিং ব্যাটসম্যান একের পর এক অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে বিট হচ্ছে। আমি অন্যমনস্কতায় ক্রমাগত বিট হতে থাকি, আমাকে ফাঁকি দিয়ে সময়, অনেকটুকু সময় আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মেডেন ওভারের আনন্দে চলে যেতে, হালকা হতাশা নিয়ে আমি বাথরুম থেকে বের হই।

আট মাস হলো ফারহানার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আড়াই বছরের কোর্টশিপ, তারপরে বিয়ে। এখনো ক্রিকেটের কাছে স্বামীর প্রতিনিয়ত অধীনতার বিষয়টিকে মানতে তার কষ্ট হয়ে যায়। স্বাভাবিক সময়ে বাথরুমে আমার অন্যমনস্কতা নিয়ে খুনসুটি পর্যন্তই। কিন্তু যখনই কাস্টমারী দাম্পত্যকলহ বাড়াবাড়ির দিকে চলে যায়, স্বামীর ক্রিকেটপ্রিয়তাকে কটাক্ষ করবার বাউন্সারে, আত্মসম্মান নামক হেলমেটে আমাকে আঘাত করবার বাসনায় তার কমতি দেখা যায়না। প্রথম প্রথম খুব রেগে যেতাম। কন্ঠস্বর উঁচু করে তাকে বাউন্সারের পরিবর্তে তাকে বীমার ছুঁড়ে বসতাম। ফারহানার প্রাক্তনপ্রেমিক সজলকে নিয়ে।

‘এতোই যখন এলার্জি, সজলকে বিয়ে করলেই পারতা। তাইলে বুঝতাম তোমার অওকাদ কতোদূর!’

‘কি্! আমাকে তুমি এই কথা বলতে পারলা। তোমার মুখে আটকাইলো না?’ বীমারে পর্যুদস্ত হয়ে ফারহানা ততোমধ্যে অশ্রুর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

প্রতিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করেও আমার ইগো স্যাটিসফাইড হয়না। বীমারে পর্যুদস্ত হয়ে ব্যাটসম্যানের শরীর থেকে রক্তই যদি না ঝরলো তবে আনন্দ কিসের? আমি তখন চিবিয়ে চিবিয়ে বলি,

‘কই, খুব তো আমাকে গালমন্দ করতেছিলা। সজলের কথা বলতেই চুপসায়া গেলা। জ্বলতেছে না খুব? এবারে বুঝো আমার কেমন লাগে।’

এই ওষুধে সবসময় কাজ হয়। ফারহানা তেরোশো স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের সবচেয়ে বড় ঘরটায় গলা ছেড়ে কাঁদতে বসে। একবিংশ শতাব্দী, বিশ্বসুন্দরীও যদি কাঁদতে বসে তবে তা শুনতে পাবার মতো সংবেদনশীল প্রতিবেশী কোথায় পাওয়া যাবে? তবে এইসব আঘাত-পাল্টা আঘাতের ঝগড়ার মীমাংসা হতে বেশী সময় লাগেনা। একবার সরি, দুইবার তোমাকে আরো বেশী করে ভালোবাসবো এরপর থেকে দেইখো, তিনবার হালকা সবুজ শাড়িটা পরলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়- ব্যাস হয়ে যায়। আর যদি বিপরীতটা ঘটে তবে একবার এই রাগ করলা? রাগারাগি করে যাই বলি তোমাকে ছাড়া তো থাকতে পারবোনা, দুইবার হালকা নীল রঙের স্ট্রাইপ শার্টটা পরে কখনো আমার বান্ধবীদের সাথে দেখা করবানা। তাদের প্রশংসায় আমার কান ঝালাপালা হয়ে যায় আর তিনবার এই আগামীকালকে আগে আগে অফিস থেকে বের হবো, তুমিও চলে আইসো। অনেকদিন হইলো আমরা দুপুরবেলাতে করিনা- আমার মন ততোক্ষণে হেডিংলীর পিচের মতো ভেজা। রাতে প্রেমঘন অবস্থায় কখনো ইডেন গার্ডেনস তো কখনো পার্থের ওয়াকা গ্রাউন্ড তো আবার ডারবান। এই উত্থানপতনে জীবন নামক চক্রে মনোটোনাস মধ্যবিত্ত যাপন টসে হেরে গেলেও স্কোর ভালোই করে।


পরিচিতমহলে ফারহানা- আমার জুটি রীতিমত ঈর্ষনীয়। যাকে বলে ম্যাচ মেইড ইন হেভেন আর কি। হেইন্স-গ্রীনিজ, শচীন-গাঙ্গুলী আর কি। আমাদের ঝগড়াঝাটির খবর কখনো তাদের কানে যায়না বিষয়টা এমন না। কিন্তু দিনের শেষে, যেসকল গেট টুগেদার আমার এবং ফারহানা উভয়ের কাছেই আনএভয়েডেবল সেখানে আমরা গেলেই প্রশংসায় স্নাত হই। যেনো গুটিকয়েক টনি গ্রেগ আমাদের শচীন ভেবে নিজেদের আবেগ ঢেলে দিচ্ছে। সেসব রাতে বাসায় ফেরার পরে ফারহানা মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে আর আমি তখন দেশজাতির সারাদিনের খবরের উপর চোখ বুলাতে বুলাতে হাসাহাসি করি।


‘নাবিলা যখন আজকে তোমার প্রশংসা করতেছিলো তখন ওর চোখের দিকে তাকাইছিলা?’

‘চোখের থেকেও ওর আকর্ষনীয় ফিচার আরো কিছু আছে। সেদিকেই তো তাকাইতে পারলাম না ঠিকমতো।’ আমার আউটসুইঙে ফারহানা আমার পাশে এসে কবজিতে জোরে ঘুষি দিতে দিতে হেসে ফেলে।

‘যাই বলোনা কেন, ওরা কিন্তু আমাদের বিষয়ে জেলাস। নাবিলার কনজুগাল লাইফের ভিতরের খবরাখবর তো সব রাখি। আসিফ ওর উপরে খুবই মেন্টাল প্রেশার দেয়। মাঝেমধ্যে নাকি মারধরও করে শুনছি।’

ফারহানার বেদনাভরা কন্ঠে আমি অনুভব করি, এক ধরণের চাপা সুখ বিরাজ করে। যেনো নাইন্টিনাইন রানে আমার দলে এক ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলে কি হবে, আমি তো হানড্রেড করেছি- এই গোপন নিভৃত আনন্দে আত্মহারা কোন আত্মকেন্দ্রিক খেলোয়াড়।

কিন্তু ফারহানাকে সরাসরি এই কথা বলার প্রশ্নই আসেনা। আমার নিজেরও কি নেই নিজস্ব কিছু দুসরা? যার খবর কাকপক্ষী তো দূর কি বাত ফারহানা পর্যন্ত জানেনা। তার জানবার কোন প্রয়োজনও নেই। সে একবার জেনে গেলে সর্বনাশ। তখন আমাদের পার্টনারশীপের দি এন্ড অবশ্যম্ভাবী। এ এমন এক পার্টনারশীপ যার সাফল্য হানড্রেড, ডাবল হানড্রেড, ট্রিপল হানড্রেড কিছুতেই পরিমাপ করা যায়না। একবিংশ শতাব্দীর অগ্রসর পৃথিবী এখনো এই পার্টনারশীপের সাফল্য বলতে বোঝে টিল ডেথ ডু আস পার্ট। ব্যাকডেটেডের চাইতে ব্যাকডেটেড ভাবনা সন্দেহ নেই। কিন্তু কি আর করা? তাই স্ত্রী-বান্ধবীর দাম্পত্যজটিলতার খবরে, শুনে দুঃখ পেলাম অনুভূতি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখবো মনস্থির করি।


একদিন, অফিস থেকে ফারহানার দ্রুত বাসায় ফিরবার কথা। পরশুদিন ঝগড়া হয়েছে- ফারহানার ফর্মুলা অনুযায়ী আজকে দুপুরে আমাদের ‘করবার’ কথা। আমি গভীর রাত জেগে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল দেখেছি বলে ডে অফ নিয়েছি। ফারহানা গতোকাল রাতে পোলাও আর গরুর মাংস রান্না করে গিয়েছিলো। ওভেনে গরম করে খেয়ে নিতে নিতে আবারো স্বীকার করতে বাধ্য হলাম ফারহানার রান্না কোহলীর ফ্লিক শটের চেয়েও বেশী অসাধারণ। প্লেট ধুতে ধুতে মোবাইলে এসএমএস আসে। ফারহানার। হঠাৎ অফিসে আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছে। দুপুরে তো আসতে পারবেই না বরং ফিরতে রাত আটটা কি নয়টার মতো বাজবে। আমার শরীর, মন উভয়ই খুব চাঙ্গা ছিলো। মিইয়ে গেলো এসএমএসটা রিসিভ করে। যেনো ফ্লাইংস্টার্টের পরে ঝটপট কয়টা উইকেট পড়ে গেছে। টেলিভিশনে বিশেষ কিছু নেই দেখবার। ফারহানার স্বামী হবার পর ছোটখাটো কিছু স্বাধীনতার মধ্যে পর্ন মুভি দেখাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই সেটাও সঙ্গতকারণে টানছেনা। বারান্দায় এসে দাঁড়াই। টানা কয়েকদিন বৃষ্টির পরে আজকে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। রাস্তাঘাটে বৃষ্টির পানি শুকিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে র্যা ন্ডম যে কোন স্থানে একলা বেরিয়ে পড়বার জন্য বন্ধুমহলে বিখ্যাত ছিলাম। পুরনো অভ্যাসকে ঝালাই করে নেবো ঠিক করলাম।

রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই কোথায় যাওয়া যায়- এই প্রশ্ন আমাকে কিছু সময়ের জন্য আচ্ছন্ন করে রাখে। অনেকদিনের অনভ্যাসে র্যা ন্ডম বেরিয়ে পড়বার কাজটা কঠিন মনে হচ্ছে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। অনেকদিন যাবত দলের বাইরে থাকা খেলোয়াড় প্রত্যাবর্তন ম্যাচ খেলবার সময়ে যেমনটা অনুভব করে আর কি। স্টার সিনেপ্লেক্সে ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস মুভিটার লেটেস্ট ভারশন এসেছে। ফারহানা ইংলিশ মুভি পছন্দ করেনা বলে বিশেষ একটা দেখা হয়না। যাওয়া যাক বসুন্ধরা সিটিতেই, গন্তব্য নির্ধারণ করে রিকশায় উঠি।


বসুন্ধরা সিটিতে এসে পৌঁছাই। চারপাশে মানুষজন গিজগিজ করছে। সবসময়েই করে। কিন্তু আজকের ভিড়টা একটু বেশীই মনে হচ্ছে। সিনেপ্লেক্সে ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াসের আগমনই কি এর সম্ভাব্য কারণ? হবে হয়তো বা। এনট্রান্স গেট খুঁজে প্রবেশ করতে যাবো, থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হালকা সবুজ শাড়ি, চোখে বাহারী রোদচশমায় চল্লিশ কি পঞ্চাশ গজ দূরত্বে হাসতে হাসতে যেই নারী প্রবেশ করতে যাচ্ছে সবচেয়ে ডানের এনট্রান্স গেটে, সে কি ফারহানা নয়? সঙ্গে তার সদাউৎফুল্ল কলিগ বাহার সাহেব, মধ্যচল্লিশেও রমনীমোহন চেহারা। অনুমান করি নারীপটানো ইনসুইঙে আর কেউ হোক না হোক ফারহানা ক্লিন বোল্ড। তাই তো তার অফিসের আর্জেন্ট কাজটা বসুন্ধরা শপিংমলে পড়ে গেলো।

রাগে অঙ্গার হয়ে শরীর জ্বালা করবার কথা- কিন্তু আমার হাসি পেয়ে গেলো। ফারহানা, তুমি এখনো জানতেই পারলেনা প্রতিদিন কতোরকমের ইনসুইং, আউটসুইং, গুগলী, দুসরাতে আমরা বোকা হয়ে কাটিয়ে দেই একটা জীবন। ঝগড়াঝাটির সময়ে তোমার ছুঁড়ে দেওয়া বাউন্সার কিংবা আজকের এই গুগলীতে আমি আহত হয়েছি সামান্যই। তোমার সাথে সম্পর্কের ছয় মাসের মধ্যে এক গোপন সন্ধ্যায় লুবনার সাথে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমাদের বেবিটা এবোর্ট করাতে। চার মাস পরেই লুবনার বিয়ে, আমিও তোমার সাথে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি দিব্যি- সেখানে শিশু নামক সাডেন রেইনের উপস্থিতিতে ডাকওয়ার্থ লুইস সিস্টেমে ব্যাট করতে কেই বা চায় বলো? এই যে প্রতিদিন অফিস সেরে হাসিমুখে বাসায় ফিরি, দরজা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি চুমু খাও- সদ্য অফিস জয়েন করা সাবরিনার মুখ আমি তোমার জায়গায় বসিয়ে নেই। এমনকি রাতে যখন আরো ঘনিষ্ঠ হই তখন সাবরিনার সমগ্র শরীর তোমাকে প্রতিস্থাপন করে। সাবরিনা, আমার একটা সামান্য ইঙ্গিতের অপেক্ষায় মাত্র- আগামীকাল অফিসে গিয়েই তাকে যখন সিগন্যাল দিয়ে দেবো তারপরে তোমার কাছে এতোদিন যাবত গোপন রাখা দুসরা আরো একটি বাড়বে। বাহার সাহেব শুধুমাত্র টি-টুয়েন্টি বোঝা মানুষ। তার সাথেই কিনা তুমি ওয়ানডে ম্যাচের স্বপ্ন দেখলে ফারহানা? ফিলিং পিটি ফর ইউ।


মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:২৭

ফরিদ আহমদ চৌধুরী বলেছেন: নজর বুলিয়ে গেলাম।

২| ১৩ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:১৯

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নিলয় বলেছেন: :)

৩| ১৪ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৩৬

সিলেক্টিভলি সোশ্যাল বলেছেন: ভয়ানক ভন্ডামীতে ভরপুর। তথাপি ক্রিকেটময় রঙ্গরস এবং ব্যাঙ্গরস উপভোগ্য হয়েছে :)

৪| ১৪ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১:১২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: মানুষের জীবনে এতো এতো গুগলি থাকে যে ওদের ফেস করাটা কঠিন হয়ে যায়।
গল্পটা ভাল লেগেছে। নির্লিপ্তিটা অসহ্য। তবে কমনীয় লেগেছে শেষে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.