নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পহীন

৩০ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৮:৪৩

অনিশ্চয়তা, ভয়, শংকা, অনিরাপদ একটি মতিঝিলের রাতে শাপলা চত্ত্বরের সামনে দাঁড়াই। সারাটা বিকাল জুড়ে বৃষ্টি হয়েছে। কাঁদায় থিকথিক করছে রাস্তা। একটু সন্তর্পণে পা না ফেললে কাঁদার পানিতে প্যান্ট নোংরা হবে। শাপলা চত্ত্বরের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। নতুন কিছু নয়। যেদিনই ইত্তেফাকের মোড় থেকে হেঁটে হেঁটে শাপলা চত্ত্বরে আসি, মনে হয় আমার চোখ তার উজ্জ্বলতা বুঝি হারিয়েছে। তখন আমাকে ভয় গ্রাস করে নেয়। চোখের দৃষ্টি হারাবার ভীতি নয়, কখনো চোখ ধাঁধিয়ে গেলে আমার ছেলেমানুষী অস্থিরতা দেখে শাহানা যেভাবে হেসে উঠে তা আর কখনো ঘটবেনা এই দুশ্চিন্তা আমাকে বর্তমান থেকে বিচ্যুত করে। তুমি খুব বেশী হতাশায় ভোগো, আমারও এই জন্য অনেক সাফার করতে হয়- শাহানার সাথে ঝগড়া হলে কোন না কোন এক সময়ে তার এই অনুযোগে আমাকে ঝগড়ায় ক্ষান্ত দিতে হবেই। বাসে উঠে পড়ি। গন্তব্য কাকরাইল। আজকে শহরজুড়ে আতংক। অনেকেই বিকালবেলায় ঘরে ফিরে গেছে। ভয়, আতংক, দুশ্চিন্তা- এই অনুভূতিত্রয়ের অহিংস সন্ত্রাস আমাদের অন্তর্গত করে নেয় সীমাহীন ক্ষিপ্রতায়; যার মুখোমুখি আমরা কখনো হতে চাইনি, যা থেকে বেরিয়ে পড়বার স্পর্ধা দেখাতে আমাদের বাঁধো বাঁধো ঠেকে আজীবন। মসজিদে জুম্মার নামাজের ভিড়ে শুক্রবারের রোদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের মনে হয় এমন হবার কথা ছিলোনা। একসময় দুপুরবেলাটা ছিলো গরুর মাংস, ঝোল, আলু আর সাদা ঝরঝরে ভাতের। খাওয়া শেষে আমাদের স্ত্রীর চোখে সন্তানদের পেটপুরে ভাত-মাংস খেতে পারবার আনন্দ ঝলমল করে উঠতো। সেই আনন্দে অবগাহন করতে করতে আমরা উল্লসিত হয়ে উঠতাম। বারান্দা দিয়ে বাতাস বইতো ক্লান্তিহীন। গোল হয়ে আড্ডা, টিভি সেটের সামনে। বিটিভি নাকি স্টার স্পোর্টস? জি সিনেমা নাকি স্টার মুভিজ? তখন রাস্তায় বেরুলে দেখা যেতো পাড়ার পরিচিত ভিক্ষুক অবিরাম দোয়া প্রার্থনা করে চলেছে তাকে দুই টাকা পাঁচ টাকা ভিক্ষা দেওয়া পথচারীদের জন্য। ভিক্ষুকের সেই দোয়া প্রার্থনার ধ্বনি সঙ্গীতের মূর্ছনা হয়ে ছড়িয়ে পড়তো খেলার মাঠ জুড়ে। খাওয়া শেষে ঘুমে চোখ একটু নেমে আসতেই গা ঝাড়া দিয়ে খেলার মাঠে চলে যেতো কিশোর তরুণরা। একেকটি বিকাল রান, ওভার, চার-ছক্কা, উইকেট, নো বল, ওয়াইড বল- এইসব শব্দে মুখরিত হয়ে উঠতো। ঝালমুড়িওয়ালা চোখে পানি এনে দেওয়া মরিচ দিয়ে চানাচুর বানাতে বানাতে ক্রিকেট খেলা দেখতো। ‘ছক্কা’- ঝালমুড়িওয়ালার কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা নিখাদ আবেগে ঝাল চানাচুরের ঠোঙ্গা মাটিতে পড়ে যেতে যেতেও আমাদের বিস্মিত করে, তার হাতেই আটকে থাকতো। বাসে মানুষজনের ফিসফিস হঠাৎ জোরালো হয়। তারা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা নিয়ে নিজেদের দুশ্চিন্তার কথা বলে যায়। খবরদার, রাস্তাঘাটে বা বাসে রাজনৈতিক বিষয়ে মানুষজনের সাথে একেবারে কথা বলবানা- শাহানার নিষেধাজ্ঞাকে ভালো চোখে না দেখলেও মেনে নিয়েছি। আজকে বিকালে তার ঘাড়ের কাছে একটা ছোট্ট দাগ দেখেছিলাম। জিজ্ঞেস করতে অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলো। তারপরে যখন বলতে শুরু করলো তার আগেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম কি ঘটেছে। আমার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। মুষ্টিবদ্ধ হাত বিফল মনোরথে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বুকের ভেতরে ক্রন্দন এবং ক্রোধের এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আমি স্পষ্ট বুঝি শাহানার লম্পট দুলাভাই গতোকাল রাতেও নিশ্চয়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তার উপরে। গতো দুই বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। শাহানার বোনের অগোচরে। শাহানার দিকে তাকানোটা একেবারেই ঠিক হবেনা- তবুও তার দিকে স্পষ্ট চোখে তাকাই। নাহ, দুলাভাইয়ের ম্যাসোকিজমে এখনো সে সাড়া দেয়নি। না শারীরিকভাবে। না মানসিকভাবে। নিজেকে ধাতস্থ করে সে আমাকে বলে এবারেও তার দুলাভাই আকাঙ্খা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেছে। আপার টাকায় সংসার চলে তো, তাই দুলাভাই গালাগাল দেওয়া ছাড়া কিছু করতে পারেনা। নাইলে আমাকে রাস্তায় নেমে যেতে হতো, কিংবা দেখতে একদিন মগবাজারে……শাহানাকে থামিয়ে দিতে যাবো, তার আগে সে নিজেই থেমে যায়। তখন আমরা একটি পাখির স্বপ্ন দেখি। বৈশাখ মাসের কোন এক মেঘলা বিকালে, কাঠগোলাপের তীব্র গন্ধ আমাকে এবং শাহানাকে অভিভূত করে রেখেছিলো। আমরা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের হতাশা, বেদনা, অনিশ্চয়তাকে ছুটি দিয়ে নৈসর্গিক হয়ে উঠেছিলাম। আমরা হাঁটছিলাম তো হাঁটছিলাম, যেনো পৃথিবীতে কোন আগামীকাল নেই। তখন আকাশে একটি পাখিকে উড়তে দেখেছিলাম। শাহানা বলছিলো, দেখেছো পাখিটার কি স্বাধীনতা? আমি সাথে সাথে জবাব দিয়েছিলাম- নিজের তৈরী করা অনুশাসনে পাখিটি বন্দী। আমার উত্তরে শাহানা নিভে যেতে যেতে ঝলসে উঠেছিলো। তোমাকে নিয়ে আর পারিনা, তুমি এই জীবনে কোনকিছুতেই ভালো কিছু খুঁজে পাবানা- তখন আমি শাহানার হাত নিজের বুকের ভেতরে রেখেছিলাম। দশ সেকেন্ডের মতো। শাহানা বরাবরই সপ্রতিভ মেয়ে। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠি। তারপর আমরা আরো অনেকক্ষণ কাঠগোলাপের ঘ্রাণ শরীরে মেখে বাদাম খেতে খেতে সমাজের বিরুদ্ধে নিজেদের সকল ক্ষোভ উগরে দেই। চাকরীর জন্য হাজারো জায়গায় মাথা নিচু করে থাকা, পরিচিতদের অপমান সবই আমাদের মুখের তুবড়িতে ভেসে যায়। শাহানার পরিচিত এক আপার বেদনাবহ জীবনের গল্প শুনি। শুনতে শুনতে অচেনা সেই ভদ্রমহিলার প্রতি হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠে। তখন আমি নিজের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। ‘কাকরাইল, কাকরাইল, যারা কাকরাইল নামবেন……আমি বেশ পেছনের সিটে বসেছি। নেমে যেতে যেতে যাত্রীদের মুখের দিকে তাকাই। প্রত্যেকের চোখেই দ্রুত বাড়ি ফিরবার তাড়া। প্রত্যেকের হৃদয়েই ‘আমার যদি আজ কিছু একটা হয়ে যায়’ ভয় ক্রিয়াশীল। আমার কেনো এই বোধ কাজ করছেনা? মনোলগে ব্যাপৃত হই। কাকরাইলের রাস্তাটা রাতে বেশ রহস্যময় দেখায়। কতোদিন দেখেছি পথচারীরা চারপাশে সতর্ক চোখে তাকাতে তাকাতে রাস্তা পার হচ্ছে। স্বল্প আলোতেই আজকের ট্রাফিক পুলিশকে বেশ নিশ্চিন্ত দেখায়। সে পান চিবাতে চিবাতে নিশ্চয়ই প্রার্থনা করছে যেন প্রতিটা দিন এই শহর জনমনে আতংকের বীজ বপন করে চলে। তাহলে এই বৃষ্টির রাতে সড়ক পরিচালনা করাটা তার জন্য আরামের। সেই আনন্দেই কিনা কে জানে তার মুখ থেকে পানের কষ বেরিয়ে মাটিতে পড়ে। হাফিজকে চটিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবেনা- আমি বাস্তবে ফিরে আসি। হাফিজ আমার বাল্যবন্ধু। একটা চাকরীর জোর সম্ভাবনা আছে। তার রেফারেন্স খুবই জরুরী। হাফিজদের তিন পুরুষের ব্যবসা। সমাজের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তার কোন কষ্ট হয়নি। স্কুলে থাকতে; ক্লাস এইট হবে তখন, একদিন ছুটির পরে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে নিরীহ ছেলে রোহানকে কাঁদতে দেখি। হাফিজের উচাটন উরুসন্ধির কারণে রোহানের ধবধবে সাদা প্যান্টের পেছনটা লাল রঙে ভেসে যাচ্ছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রোহানকে অঝোরে কাঁদতে দেখছিলাম। সে ব্যথায় হাঁটতে পারছিলোনা। টিফিনের সময়ে হাফিজ আমাকে সিঙ্গারা, কোক এসব খাওয়াতো। তাই ধর্ষিত রোহানের গল্প নিজের কাছেও চেপে গিয়েছিলাম। স্যার তো বাসায় নাই। গাড়ি নিয়া মাত্র বাইর হইয়া গেলো। কই জানি পার্টি আছে- হাফিজের বাড়ির দারোয়ানের কথা শুনে বিস্ময়কে অন্তর্গত করে ফের হাঁটতে শুরু করি। হাফিজ নিজেই আমাকে তার বাসায় আসতে বলেছিলো। ঠিক সময়েই তার বাসায় এসেছি। শাহানার সঙ্গ ছেড়ে। উপলব্ধি করলাম হাফিজ এতোটুকু বদলায়নি। রাতে মেসে ফিরে বাবাকে স্বপ্নে দেখি। সকালবেলায় বাংলা অনুবাদে কোরআন পড়ছেন, তুমি আমার কোন নেয়ামত অস্বীকার করিবে? – তোমার মতো সোজাসরল মানুষের ঘর করে করে আমি পড়েছি বিপদে। মায়ের প্রাত্যহিক অনুযোগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বাবা প্রীতির নিদর্শন হিসাবেই দেখতেন আর হো হো করে হাসতেন। তখন আমার এবং পারুলের ঘরে রোদ ছড়িয়ে পড়তো। পারুল বয়সে আমার চাইতে পাঁচ বছরের বড় ছিলো। বাপসোহাগী কন্যা। আমি ছিলাম মাতৃভক্ত। প্রতি শুক্রবারে দুপুরবেলায় খাওয়াদাওয়ার পরে আমরা সবাই টিভি সেটের সামনে গোল হয়ে আড্ডা দিতে বসতাম। তখন তীব্র বাতাসে দুই একটি আমপাতা বারান্দায় আছড়ে পড়তো। বাবা তার হাজারবার বলে ফেলা শৈশবের গল্পের ঝুলি নিয়ে বসলে আমরা সবাই হাসতে হাসতে তাকে থামিয়ে দিতাম। কিন্তু রেগে যাওয়ার পরিবর্তে আমাদের সোজাসরল বাবা নিজেও হাসাহাসিতে যোগ দিতেন। তখন মা তার নিজের বাড়ির গল্প শুরু করলে পারুল এবং আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেইসব গল্প শুনতাম। মায়ের বাচনভঙ্গির চাইতেও আমাদের বেশী আকর্ষণ করতো আমাদের নানাজান। তার প্রবাদতুল্য খেয়ালী স্বভাব নিয়ে গ্রামের মানুষজন নানাজানের মৃত্যুর পরেও গল্প করতে ভালোবাসতো। আমরা অদেখা নানাজানের গল্প শুনে শুনে তাকে ভালোবেসে ফেলি। তার প্রতি আমার চাইতেও পারুলের ভালোবাসা অনেক গাঢ় ছিলো তা উপলব্ধি করি অনেক বছর পরে। আমাদের পাড়ায় কুখ্যাত মাস্তান ছিলো জুয়েল ভাই। এডভোকেট করিম সাহেবের বিগড়ে যাওয়া ছোট ছেলে। বখে যাবার কারণে জুয়েল ভাইয়ের বাপ তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। জুয়েল ভাই বাসা ছেড়ে একটি সস্তা মেসে গিয়ে উঠে। এরই মাঝে ঠিক কবে কিছু শিউলী ফুল এবং ভুল বানানে ভর্তি একটি চিঠিতে সে পারুলের বুকের ভেতরে অন্তর্গত বেদনাকে মূর্ত করে তুলেছিলো তা জানতে পারিনি। সেইদিনের কথা মনে আছে, মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তীব্র পানির পিপাসা পায়। পানি খেতে ডাইনিং রুমে যেতে যেতে পারুলের চাপা কান্নার শব্দে চমকে উঠলেও তখন আমি তার ক্রন্দনকে ব্যহত করিনা। পানি খেতে খেতে পারুলের কান্না আরো তীক্ষ্ণ হয়। আমার সদাজাগ্রত মায়ের চোখকে পর্যন্ত ফাঁকি দেয় সেই কান্না। পরদিন পারুল ক্লাস করতে চলে গেলে তার ঘরে প্রবেশ করি। পারুলের ঘর সবসময় অগোছালো থাকে। তার ব্যক্তিগত কোন জিনিস আমি কিংবা বাবা দূরে থাক মা পর্যন্ত স্পর্শ করতোনা। কিন্তু সেদিন আমি সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাই। পারুলের ঘর যতোটা সাবধানে সম্ভব তন্নতন্ন করে খুঁজি। যদি গতোরাতে তার কান্নার উৎস পেয়ে যাই। আলমারীর একেবারে পেছনে জুয়েল ভাইয়ের, আবেগে থরথর করে কাঁপতে থাকা একটি চিঠি পেয়ে যাই। আমি চিঠিটি পড়ে ফেলি। তারপর মনস্থির করি কাউকে কিছু জানাবোনা। তাৎক্ষণিক অনুভূতি দ্বারা তাড়িত আমার মনে হয়েছিলো এই গল্প আমার কাছেই থাকুক। তখন চারিদিকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। এই প্রথম এক অদ্ভুত ব্যথায় আমার গলা আটকে আসে। আমি সেই ভাষাহীন শূন্যতাকে অনুভব করি। সেই নিঃস্বতাকে স্পর্শ করে দৌড়ে নিজের ঘরে ছুটে যাই। অবশেষে একদিন পারুলের টানটান হস্তাক্ষরের একটি চিঠিতে আমাদের সদাসন্তুষ্ট অল্পতেই খুশী পরিবার প্রথমবারের মতো ব্যথাতুর হয়ে কুঁকড়ে যায়। জুয়েল ভাইয়ের সাথে পারুল পালিয়ে গেছে। পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ সেই চিঠিতে পারুলের অন্তর্গত বেদনাকে আমি আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলেও প্রথমবারের মতো নিজের কোন সন্তানকে নিয়ে আমাদের সোজাসরল বাবাকে হতাশায় বিপর্যস্ত হতে দেখি। ক্রমেই পাড়ার সকলে বখা জুয়েল ভাইয়ের সাথে পারুলের অন্তর্ধানের বিষয়টি জেনে যায়। আমার বাবা প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়ে মাথা নিচু করে বাসায় ফেরেন। হঠাৎ করেই আমি এবং মা পর্যবেক্ষণ করি বাবার শারীরিক ও মানসিক উভয় বয়সই বেড়ে গেছে। বাবার কন্ঠ উত্তাপহীন। প্রেশার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাবার সামনে মা যতোটা সম্ভব শক্ত থাকলেও প্রায়ই আমার যখন ঘুম ভেঙ্গে যায়, পারুলের ঘরে শাড়ির আচল চেপে মায়ের কান্নার শব্দে কানে বালিশ চেপে রাখি। অনেকক্ষণ আমার ঘুম আসেনা। তখন বাতাসে চারপাশ চঞ্চল হয়ে উঠলে তাতে আমার সাড়া দেওয়া হয়ে উঠেনা। বাবা ক্রমশ বুড়ো হয়ে যেতে থাকেন। মা এবং আমি শুক্রবার এলে চেষ্টা করি হাসিতামাশায় বাসাটা মাতিয়ে রাখতে। কিন্তু দুজনেই বুঝি দুপুরবেলায় খেয়ে আড্ডা দেওয়ার পরিবর্তে তখন বিছানাটাই আমাদের বেশী আকর্ষণ করে। পারুলবিহীন সেই শুক্রবারগুলো আমাদের ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে কাটে। বিকালবেলায় বাবা সামনের মাঠটায় কিছু সময়ের জন্য চুপচাপ বসে থাকেন। কি দেখেন, কি ভাবেন তার কিছুই মা কিংবা আমার জিজ্ঞেস করা হয়না। আমরা ততোদিনে বুঝে গেছি বাবা এখন অনেক প্রশ্নেরই জবাব দেন না। নিজেকে গুটিয়ে রাখাতেই তার স্বাচ্ছন্দ্য। এদিকে মায়ের শরীর দ্রুত রুগ্ন হতে শুরু করে। বাবার সামনে যতোই শক্ত থাকবার চেষ্টা করুক, প্রথম সন্তানের সাথে বিচ্ছেদে তার শরীরে মনে হাজারো স্মৃতি এসে দাগ বসিয়ে দিয়ে যায় প্রতিদিন- এই সত্যের সাথে অভ্যস্ত হতে হতে আমি ক্রমশ সিনিকাল হয়ে উঠি। কিভাবে কলেজ পাশ করেছিলাম জানিনা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য প্রাণপণ খেটেছিলাম। পড়বার সুযোগ পেয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবাকে আরো বিষণ্ণ করে, মাকে বিপন্ন করে স্বার্থপরের মতো একা একা ঢাকা চলে এলাম। প্রথম দুই বছর কেটে গেলো পলিটিক্স করে আর বন্ধুদের সাথে চা-বিড়ি-বিরিয়ানী খেয়ে নিজের সংকটগুলো থেকে দূরে থাকতে থাকতে। শাহানার হাত যেদিন প্রথম ধরেছিলাম আমার হাতে বিদ্যুৎ চলে এসেছিলো। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজের কাছে, সব ছেড়ে দেবো। সন্ধ্যা হতেই লাইব্রেরীতে চলে যেতাম। পড়াশোনা করবার জন্য সেখানে লাইন লেগে থাকে। আগে যেতে না পারলে সুযোগ পাওয়া যায়না। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলাম। আত্মিক কোন বেদনা অনুভব করিনি। এমনটাই হবার কথা ছিলো। এসবের মধ্যে একদিন খবর আসে- সাডেন স্ট্রোকে আমার বাবা পরলোকগত। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে গিয়েও উঠিনা। হলে এই প্রয়োজন নিছক বিলাসিতা। পাঁচদিন পরে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। টিউশনী করে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। যেনো মা ধরতে না পারে, তাই নিরাসক্ত গলায় তাকে ফোন করে বাড়ি আসবার অপারগতা জানিয়ে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে অভিশাপ দিয়ে মা যখন ফোন রেখেছিলো, ইচ্ছা হয়েছিলো পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেই। কিন্তু আমার পা জোড়া সবসময়েই টলমল করে। এবারেও তাই হলো। আমি নিজেকে ভুলে থেকে পরীক্ষা দেই। তারপরে আরো দুইটি বছর কেটে যায়। আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে আশা বলি কি স্বপ্ন বলি, একটাই আছে- শাহানা। প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, চাকরী পাবার পরে শাহানাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে যাবো। মায়ের চোখেমুখে তখন কোন স্মৃতির আভা খেলা করবে দেখবার খুব ইচ্ছা। একদিন ঘাসের পরে পা মাড়িয়ে খুব নরম সুরে শাহানাকে নিজের ইচ্ছার কথা জানাই। সে স্মিত হাসিতে নিজের সম্মতির কথা জানায়। তখন আমি কিছু কচি ঘাস তুলে নেই। শাহানার দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে থাকি। আমার দৃষ্টিতে দৃঢ় জেদী শাহানা চোখ নামিয়ে নেয়। সারাদিন মেঘলা ছিলো। আচমকা একফালি রোদ এসে ঝলমল করে। আমরা অনুভব করি আমাদের তৃষ্ণা পেয়েছে। রাস্তায় আখের রস কোথায় আছে খুঁজ়ে বেড়াতে আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে তৃষ্ণা বেড়ে যায়। মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে উঠে। শাহানা আমাকে চমকে দিয়ে বলে উঠে, ‘জানো দুলাভাই প্রথম যেদিন আমার ঘরে আসে সেদিন বাইরে তুমুল ঝড় হচ্ছিলো। যখন সে আমার কাছাকাছি আসে তার শরীরে আমি সুরমার গন্ধ পাইছিলাম।’ আমি শাহানার এই তিক্ত স্মৃতি রোমন্থনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করি। শাহানাকে জানতে না দিয়ে। সেই দুপুরে পারুলের চিঠিটি পড়বার পরে যে অনুভূতি হয়েছিলো, টের পেলাম তা ফিরে এসেছে। সেদিন কাউকে কিছু না বলে ছুটে গিয়েছিলাম নিজের ঘরে। আজকে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি চাইনা। আমি গলায় স্পষ্টতা এনে ‘শাহানা, তুমি কি আমাকে আরো কিছু বলতে চাও?’ প্রশ্নটা করলে শাহানার মুখ পাংশুটে হয়ে যায়। আমি অনুভব করি স্মৃতি রোমন্থনের সময়ে শাহানার কন্ঠের চাপা বিষাদ আমার সংবেদন এড়িয়ে গেছে। আশেপাশে কোথাও রঙ করা হচ্ছে। আমার খুবই পছন্দের গন্ধ। সেই ঘ্রাণে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বিশ গজ সামনে একটি আখের রসের দোকান পেয়ে গেলে আমরা একটি বাক্য বিনিময় না করে পরস্পরের হাত শক্ত করে ধরে সেই দিকে এগোই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.