নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাউন্সার

০৬ ই মে, ২০১৭ সকাল ১০:৩৮

১৪ ওভারের শেষ বলটা মিড উইকেট দিয়ে বাউন্ডারী হয়ে গেলো। সাদেককে বলেছিলো নিয়ামুল, শর্ট পিচ ডেলিভারী না দিতে। শুনলোনা। সেট ব্যাটসম্যান রাজন এমন সুযোগ ছাড়বে কেনো? পেছনের পায়ে সমস্ত ভর নিয়ে কবজির অসাধারণ ব্যালেন্সে পুল করে বলটা বাউন্ডারীর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলো। আর ছয় ওভার অবশিষ্ট আছে। সানরাইজের ম্যাচ জিতে যেতে প্রয়োজন সাতচল্লিশ রান। হাতে পাঁচ উইকেট।

নিয়ামুল কপালের ঘাম মুছে পিচের মধ্যখান বরাবর এসে দাঁড়ালো। জুয়েল আজকে বেধড়ক মার খেয়েছে। এই পাটা পিচে সুইং বলতে কিচ্ছু নেই। ভ্যারিয়েশন আর বলের লেংথের উপরে দখল ভালো না থাকলে ফাস্ট বোলারেরা কুলিয়ে উঠতে পারেনা। বিপক্ষ দলের ছয় ফিট লম্বা ফাস্ট বোলার দেবাশীষকেও তারা প্রথম ইনিংসের শেষদিকে হেব্বি ঠেঙ্গিয়েছিলো। নাইলে ধানমন্ডি চ্যালেঞ্জার্সের রান বিশ ওভার শেষে একশো বাষট্টিতে গিয়ে ঠেকতো? প্রথম ছয় ওভারের মধ্যেই তো চার উইকেট চলে গিয়েছিলো। রানও বেশী ছিলোনা। আটত্রিশ। নিয়ামুল, টিপু আর নয় নম্বরে নেমে মুশতাক বারো বলে উনত্রিশ রানের একটা ক্যামিও খেলে দিলো বলেই না রানটা ভদ্রস্থ দেখিয়েছে। কিন্তু ফিল্ডিঙে আজ বেশ কিছু রান খসে গেছে। তারা ক্যাচ ছেড়েছে গোটা দুয়েক। নিয়ামুলের প্রথম ওভারেই আশিক একটা রেগুলেশন ক্যাচ ছাড়লো। সাদেকের দ্বিতীয় ওভারে বিপক্ষ দলের ইনফর্ম ব্যাটসম্যান হুমায়ূনের ক্যাচটা স্কোয়ার লেগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফেলে দিলো মুকুল। কোন অর্থ হয় এসবের?

‘পিচের মাঝখানে দাঁড়ায়ে কি বিড়বিড় করতেছো নিয়ামুল ভাই?’

আশিকের ডাকে নিয়ামুল সচেতন হয়ে উঠলো। তার এ এক বিশ্রী অভ্যাস। বিজয় স্যার এই নিয়ে অসংখ্যবার তাকে ধমকেছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। ড্রিঙ্কস ব্রেকের মাঝখানে সে আচমকা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। নিয়ামুল দ্রুত ম্যাচের প্রয়োজনীয় সমীকরণে ফিরে গেলো। জুয়েলকে দিয়ে তার কোটার বাকি দুই ওভার শেষ করাতে পারলে চিন্তা ছিলোনা। কিন্তু যে মারটা খেয়েছে ইনিংসের শুরুতে রাজনের হাতে! তাছাড়া নিয়ামুল লক্ষ্য করেছে আজকে বডি ল্যাঙ্গুয়েজটাই জুয়েলের ফাংশন করছেনা। ফাইন লেগে ফিল্ডিং করতে দাঁড়িয়েছে। দুইবার ফাম্বল করলো। একবার খামাখাই একটা নন-এক্সিস্টেন্ট রান আউট এটেম্পট করতে গিয়ে ওভার থ্রোতে পাঁচ রান গচ্চা দিলো। জুয়েলের বড় পারিবারিক গন্ডগোল চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সেসব খবর সবই জানে সে। তাই বিশেষ একটা ঘাঁটায়নি। কেবল কোমল চাহনীতে একবার ফোকাস করতে বলে পিঠ চাপড়ে সাবাশি দিয়েছে।

নিয়ামুলের নিজের বাকি আছে দুই ওভার। সচরাচর নিজের কোটার পুরো চার ওভার বল সে করেনা। কিন্তু আজকে কোটা ফিল আপ না করে তার উপায় নেই। লেংথ ব্যালেন্সড রেখে স্লোয়ারটা ঠিকঠাক দিতে পারলে রাজন ফ্লাইট মিস করে ক্যাচ আউট হয়েও যেতে পারে। সেট অবস্থাতে উইকেট ছেড়ে দিয়ে ম্যাচ কনসিড করবার রেকর্ড রাজনের বহু আছে। ন্যাশনাল লীগে এখনো যে সিলেকটেড হতে পারেনি তার কারণ এই ল্যাক অব টেম্পারমেন্ট।

‘আশিক এই ওভারটা তুই করবি। দেখিস, বেশী জোরে করতে যাসনা। রাজন যতোদূর বুঝতেছি স্কুপ আর ডিপ মিড উইকেটে বিগ শট এটেম্পট করবে। তুই চেষ্টা করিস অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল রাখতে, আবার ওয়াইড যেনো না হয়। পারবিনা?’

কাপ্তানকে আশ্বস্ত করে মাথা নেড়ে হ্যা বললেও বাস্তবিক দেখা গেলো যে আশিক কথা রাখতে সফল হলোনা। দুইটা বল করে ফেলেছিলো লেগ সাইড বরাবর। একটায় রাজন স্কুপ করে চার মারলো। ঠিক যেমনটা নিয়ামুল ধারণা করেছিলো। আরেকটায় বল আছড়ে ফেললো লং অন বরাবর। আশিকের ওভার থেকে চৌদ্দ রান এলো। ইকোয়েশন এখন পাঁচ ওভারে তেত্রিশ রান। আম্পায়ারের কাছ থেকে টুপি রিসিভ করতে করতে আশিকের মাথায় হাত। নিয়ামুল সেই বিব্রত চাহনী দেখেও না দেখবার ভান করলো। এখন এসবে মনোযোগ দেওয়ার সময় নয়।

একটু দেনোমনা করেও টুপিটা আম্পায়ারের কাছে দিয়েই আসলো নিয়ামুল। মুশতাককে দিয়ে এই ওভারটি করিয়ে সতেরো আর বিশ নম্বর ওভারটি সে নিজে করবে, মনে মনে এমন হিসাব কষছিলো বেশ আগে থেকে। কিন্তু রাজন ভয়ংকর পর্যায়ের সেট হয়ে গেছে। কিছু একটা করতে হলে তাকেই করতে হবে।

তৃতীয় বলটায় এসে রাজন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দিলো। নিয়ামুল যেভাবে প্ল্যান করেছিলো সেভাবেই ওয়ার্ক আউট করলো ব্যাপারটা। ডেলিভারীর জন্য শেষ জাম্পটা দেবার আগেই লেগ স্ট্যাম্প ছেড়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো রাজন। নিশ্চিত তাকে আনসেটেল করতে। নিয়ামুল অফস্ট্যাম্পের ওয়াইডের সাদা দাগ বরাবর স্লোয়ারটা রাখতে পারলে রাজনের তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ব্যাটের আগায় লেগে বলটা ব্যাকওয়ার্ড লেগের দিকে উপরে উঠে গেলে মুকুলের এবারে ক্যাচটা ধরতে কোন কষ্ট হলোনা। কিন্তু রাজন প্যাভিলিয়নের উদ্দেশ্যে চলে যেতে যেতে যাকে নিয়ামুল ক্রিজে আসতে দেখলো, পুরনো সেই একরোখা জেদের প্রত্যাবর্তনকেও সে অনুভব করলো ভেতরে ভেতরে।

মুশতাকের ওভার শেষ হতে ম্যাচের ইকোয়েশন দাঁড়ালো বারো বলে সতেরো রান। হাতে তিন উইকেট। খেলার পেনাল্টিমেট ওভার। এরকম পরিস্থিতিতে অন্য কারো উপরে দায়িত্ব অর্পণ করবার কথা ভাবতেই পারেনা নিয়ামুল। ডিপ ফাইন লেগ থেকে সাদেক দৌড়ে আসছিলো। ভেবেছিলো বুঝি তাকেই বল করতে ডাকা হবে। কিন্তু নিয়ামুলের ইশারা বুঝে নিয়ে ফের একই পজিশনে দাঁড়ালো।

বল হাতে নিতেই নিয়ামুল অনুভব করলো মাথার ভেতরে গনগন করে ফুটতে থাকা সেই পাগলাটে জেদ বুঝি এবারে সশরীরে আছড়ে পড়বে বাইশ গজ জুড়ে। লিকলিকে, তীক্ষ্ণ চোখের সেই শরীরের উপরে। নিজেকে সামলাতে দুইবার বড় বড় নিঃশ্বাস ফেললো নিয়ামুল। এইসব ছেলেমানুষী সেন্টিমেন্টের কাছে একটা ম্যাচ গচ্চা দিয়ে চলে আসা যায়না। কোনভাবেই না। রান আপ শুরু করতে করতে ইগল চোখে তাকে লক্ষ্য করলো নিয়ামুল। বিজয় স্যারের কাছ থেকে জীবনে প্রথম যেই কথাটা শিখেছিলো তা অনুসরণ করতে চাইলো। ব্যাটসম্যানের বডি মুভমেন্ট লক্ষ্য করবার উপরে যদি ভালো দখল আসে তবে তাকে রিড করা যায়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যাটসম্যানের দিকে লক্ষ্য স্থির রেখে তবেই বলটা ছুঁড়লো নিয়ামুল। সফল হলো। ব্যাটসম্যান ভেবেছিলো ইয়র্কার আসবে। কিন্তু গুড লেংথ বরাবর স্লোয়ার। ভ্যাবাচ্যাকা খেতে খেতে দেখলো বল সামান্যর জন্য মিডল স্ট্যাম্প অতিক্রম করে দুই ড্রপে উইকেট কিপারের গ্লাভসে। ডট বল। এগারো বলে সতেরো।

তৃতীয় বলে একটা উইকেট পেয়ে গেলো। তবে নিয়ামুল সর্বান্তঃকরণে যারটা চাইছে তারটা পেলোনা। অফ স্ট্যাম্প বরাবর স্লোয়ার ইয়র্কার দিয়েছিলো। ব্যাটে বল লাগাতেই না পারা নয় নাম্বার ব্যাটসম্যান এক্সট্রা কভারে লোপ্পা ক্যাচ দিয়ে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছে- এই প্রথম জুয়েলকে চনমনে হতে দেখলো নিয়ামুল। ম্যাচ এখন অনেকটা তাদের আয়ত্ত্বে। নয় বলে ষোলো।

পঞ্চম বলটা হাত থেকে শেষ মুহূর্তে ফসকে গেলো নিয়ামুলের। রান আপ শেষ হতেই পেছনে পিঠ দিয়ে ফিরে গেলো। না দেখেই নিয়ামুল বলে দিতে পারে বল লং অফ বাউন্ডারীতে গিয়ে পড়েছে। মুশতাক, জুয়েল, সাদেক, আশিক- প্রত্যেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ম্যাচের ক্রুশিয়াল পয়েন্টে এসে প্রিয় নিয়ামুল ভাইয়ের এরকম কোন ভুল তারা আগে কখনো দেখেনি। রান আপের জন্য বল হাতে পাবার সময়ে, নিয়ামুলের সবচেয়ে নিকটে দাঁড়ানো মুকুলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো।

‘নিয়ামুল ভাই’

ব্যাস, এই একটা সম্বোধনই যথেষ্ট। আর বেশী কিছু যে তার উদ্দেশ্যে এই মুহূর্তে মুকুল বলেনি দেখে, সে কৃতজ্ঞতা ও স্বস্তির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত অনুভূতির মুখোমুখি হলো। এরা কেউই জানেনা গতো চার ওভার ধরে তাদের নিয়ামুল ভাই একটি ক্রিকেট ম্যাচের ভেতরে দুইটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলছে। একটির পরিসর বাইশ গজের বাইরে। এতোটাই প্রাতিস্বিক সেই ক্রিকেট ম্যাচ, যার আন্দাজ করাটাও এদের কারো সাধ্যের অতীত। বছর দুই আগে মাকে খালার বাসায় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো নিয়ামুল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নভেম্বর মাসের হালকা শীত শীত আমেজ। সলিমুল্লাহ রোডের কাছাকাছি রিকশায় নাহারকে একঝলক দেখেছিলো। বিদ্যুৎদৃষ্টিতে নিয়ামুল স্পষ্ট দেখেছিলো একটি লিকলিকে পাতলা শরীরের রুগ্ন ডান হাত হুড খোলা রেখেই নাহারের কোমর জড়িয়ে আছে। নাহারের মুখ হাসিহাসি। নিয়ামুলের কান লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো। পরদিন দেখা করবার কথা বলে নাহারকে ডেকেছিলো। কিছুক্ষণ পরেই কথা কাটাকাটি চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছালে নাহারের বলিষ্ঠ স্বীকারোক্তি। চালচুলোহীন, কুয়াশাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের নিয়ামুলে নিজের গন্তব্য খুঁজে নিতে আর রাজি নয় নাহার। এই যে ডেলিভারীর জন্য দৌড়াতে শুরু করেছে নিয়ামুল, তার মুখোমুখি ব্যাট হাতে যে দাঁড়িয়ে আছে সেও জানেনা ভেতরের এতো গল্প। তার জানবার প্রয়োজনও নেই। শুধু এই বলটায় তাকে বধ করতে পারলে ম্যাচের সাথে সাথে নাহারকে বুঝি বধ করা যাবে। কোন ডেলিভারী দেবে নিয়ামুল? তার ব্রহ্মাস্ত্র হলো স্লোয়ার। হ্যা তাই দেবে। নিজের সেরা অস্ত্রে নিরীহ অজ্ঞাত এই প্রতিপক্ষবধে কিছুটা হলেও বুঝি নাহারকে আহত দেখবার বাসনাটা পূরণ হবে। নিয়ামুল ডেলিভারীর জন্য শেষ জাম্পটা দিলো।

ডিপ স্কোয়ার লেগের বাউন্ডারী থেকে বলটা কুড়িয়ে আনতে আনতে সাদেক যখন ভাবছিলো তার নিয়ামুল ভাইয়ের হঠাৎ এ কি হলো- সে সময়ে আশিক, মুশতাক, মুকুল, জুয়েল সকলের বিস্মিত দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে বিমূঢ়, পাথরশূন্য অনুভূতিতে নিয়ামুল উপলব্ধি করলো; শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা করা বাউন্সারে ম্যাচের সাথে সাথে নিজস্ব কিছু বোধ তার থেকে দূরে চলে গেছে।


মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই মে, ২০১৭ সকাল ১০:৪৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: ক্রিকেটিয় স্বাদে ভালবাসার গল্প :)

ভাল লাগল

+++

২| ০৬ ই মে, ২০১৭ দুপুর ১২:১৮

নাগরিক কবি বলেছেন: প্রমের ভিতর ছক্কা হয়েছে B-) । সুন্দর

৩| ০৬ ই মে, ২০১৭ রাত ১০:৩৪

সমুদ্রচারী বলেছেন: ভালোই ,অন্য রকম গল্প ।গতানুগতিক নায়ককে জিতিয়ে দেন নি :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.