নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মহত্যার পরে

২৪ শে মে, ২০১৭ রাত ২:৫৪

‘আজকে কি গরম পড়ছে, দেখছিস?’

বৈশাখের আঠারোতম দিবসে জন্মদাতা পিতার মুখ থেকে এই সাধারণ কথা শুনে কবরে শুয়ে থেকেও হাসি আসে আমার। এখন মাঘ মাস হলে শীতের তীব্রতা নিয়ে নিজের অসন্তোষের কথা জানাইতেন। বাপের এই অভ্যাসের সাথে পরিচয় কমসে কম হলেও বিশ বছরের। বিশেষ কোন কথা বলার প্রাক্কালে অতি সাধারণ কোন কথায় ভূমিকা শুরু করা। ধীরে ধীরে সেই গৌরচন্দ্রিকা মূল বিষয়ে রুপান্তরিত হতে হতে শ্রোতা বিহ্বলতার অতল গহ্বরে উপনীত হলে আমার পিতা নিজের কথার জাল গুটিয়ে আনেন। মাকেও অনেকবার তার স্বামীর এই প্রতিভার কথা বলতে শুনেছি। তাদের ঝগড়া হলে তৃতীয় ঘরটিতে(অতিথিদের ঘর) গিয়ে বসতেন। সাথে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে স্বগতোক্তি।

‘লোকটা কথার জাল এতো ভালো জানে। এই করেই আমাকে ফাঁসালো। এখনো পর্যন্ত জ্বলে পুড়ে মরছি।’

তখন মায়ের সাথে রসিকতায় ব্যাপৃত হতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হতোনা।

‘বলো কি মা? চটজলদি একটা ফরেনসিক রিপোর্ট করা দরকার। জ্বলজ্যান্ত পোড়া শরীরের একজন মৃত মানুষ আমাদের রেঁধেবেড়ে খাওয়াচ্ছে।’

মা রেগেমেগে ঘর ছেড়ে উঠে যেতে উদ্যত হলে আয়োজন করে সেই ঘরের বিছানায় উঠে বসি। এই উঠে বসা একহাজার একতমবারের মতো মায়ের মুখ থেকে তাদের বিয়ের গল্প শুনবার পূর্বপ্রস্তুতি। তখন স্বামীর যন্ত্রণায় জ্বলে পুড়ে মরতে থাকা মায়ের মুখে অভিযোগের রেশমাত্র থাকেনা।

কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখতে দেখতে পিতার প্রশ্ন শুনে কি উত্তর দেওয়া যায় ভেবে পাইনা।

‘রেফায়ার বিয়ে হয়ে গেছে শুনলাম। সেই ছেলের সাথেই। পরশুদিন বাসায় ফিরতেছি, সিরাজ এসে কথায় কথায় খবরটা জানাইলো।’

থট রিডিঙে আব্বা বরাবরই নাইভ। অন্তত আমি তাই মনে করি। এই যে এখন কথাগুলা বলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। তার কি ধারণা রেফায়ার অনিবার্য এই বিয়েই আমার আত্মহত্যার কারণ?

আত্মহত্যার প্রসঙ্গে বাপকে, মাকে আমার অনেক কিছুই বলার ছিলো। দুই পৃষ্ঠার এক চিঠিতে তার কীয়দংশও ব্যাখ্যা করা যায়না। আমার মনে আছে, চিঠিটা যখন দুই নাম্বার পৃষ্ঠায় চলে গিয়েছিলো, মনে মনে ভাবছিলাম এই চিঠি কেনো লিখে যাচ্ছি? কি হবে লিখে? কিছুই তো ঠিকঠাক বলে যেতে পারছিনা। ছিঁড়ে ফেলে দেবো ভেবেও ফেলতে পারিনি। শেষ স্মৃতিচিহ্ন অন্তত কিছু একটা থেকে যাক। কোন বার্তা না রেখেই একমাত্র সন্তানের আত্মহত্যা, পাথর হৃদয়ের অভিভাবকের পক্ষেও তো অন্তহীন বেদনার এই সুড়ঙ্গপথকে মেনে নেওয়া কষ্টকর।

রেফায়ার বিয়ের প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়াহীন থাকি বলেই কিনা কে জানে, আব্বা প্রসঙ্গান্তরে চলে যান।

‘তোর ক্রিকেট ব্যাট আর কিট রেহানকে দিয়ে দিছি। তোর মা খুব নিষেধ করছিলো। শুনিনাই। রেহান এতো করে বললো। বাচ্চা একটা ছেলে, এতোকিছু বুঝার বয়স তো ওর হয়নাই।’

আমার কবর থেকে পশ্চিম দিকে দুইটা ধূর্ত চোখের মানুষ ঘুরাঘুরি করছে। প্রতিদিনই করে। ছিনতাইয়ের ধান্ধা। আজকে আমার বাপ হতে পারে তাদের পটেনশিয়াল টার্গেট। তবুও বাপকে চলে যেতে বলিনা। মিথ্যা মামলায় বারো বছর আগে সরকারী চাকরী থেকে বরখাস্ত আমার পিতার কাছে বহনযোগ্য সহায়সম্বল কি থাকতে পারে তার খবর রাখি বলেই জানি, ছিনতাইকারীরা আমার বাপকে ধরতে এলে ঘেন্নায় নিজেদেরই থুতু দিয়ে বসতে পারে!

‘মায়ের কি খবর আব্বা? তার ওষুধ খাওয়ার দেখাশোনা করো ঠিকমতো?’

আব্বার মুখে হাসি ফুটে উঠে। আমাকে বিস্মিত করে দিতে পারেন সেই সক্ষমতার হাসি। একটা বাক্য উচ্চারণ না করলেও স্পষ্ট বুঝতে পারি কি বলতে চান। নিজের একমাত্র সন্তান তাকে আজীবন যতোটা আলাভোলা বলে মনে করে এসেছে, ততোটা তিনি নন। নানা রকমের অসুখবিসুখে ভোগা স্ত্রীর যত্নআত্তি করতে তিনি সক্ষম- বিনাবাক্যে এই বার্তাটুকু তিনি আমার আমার কাছে পৌঁছে দেন।

ছিনতাইকারীরা বিস্মিত চোখে বাপের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের ধারণা এইটা আমার বাপের মনোলগ। আমি আর আমার বাপে ছাড়া দুনিয়ার কেউই জানেনা, এইটা প্রকৃতার্থে পিতা-পুত্রের কথোপকথন। অন্য কারো অবশ্য তা জানবার দরকারও নাই।

‘আব্বা’

‘কি বল।’ আব্বার কন্ঠে একটু কি উষ্মা প্রকাশ পেলো?

আমি ধন্ধে পড়ে যাই। বহুদিন ধরে কথাগুলো বলবো বলবো ভাবছি। অনুভব করি, কথাগুলা বাপকে বলা আমার জন্য একান্তই জরুরী। আমার সাথে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে ব্যর্থ হয়ে যেই ক্রিকেট ক্লাবের পেছনে চৌদ্দ বছর ত্যাগ করলাম, সেই ক্লাবের প্রেসিডেন্টের ছেলের হাত ধরে রেফায়ার চলে যাওয়া দেখবার বেদনা আমার কাছে অনেক আগেই স্তিমিত হয়ে এসেছিলো। চাকরী থেকে বরখাস্ত আমার বাপ নিষ্কলুষ, এই বাস্তবতা আমি আর মা জানলেও দুনিয়া জানেনা। কিংবা জানলেও আমাদের তা জানাতে দিতে চায়না। সুযোগ পেলেই ঠারেঠুরে খোঁচা দিতে তারা বদ্ধপরিকর। বন্ধু থেকে আত্মীয়স্বজন- কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? একদিন খুব সকালে, ক্লাবের ম্যাচ আছে বলে বাসা থেকে বেরোবো- দেখি মা পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। কি মনে হতে আমিও পিছুপিছু গিয়ে আবিষ্কার করি কেরোসিনের টিনটা পুরোদস্তুর খালি করে নিজের শাড়িতে ঢেলে দিলেন। সেবার মাকে নিবৃত করা গেলেও ক্ষতটা তো আমরা কেউই মুছতে পারিনাই। আমিও না, মা তো নয়ই। পরে মায়ের কাছে শুনেছিলাম, ছোটখালা চিঠিতে যাচ্ছেতাই সব কথা লিখেছিলো। আমার সম্পর্কে, তোমার সম্পর্কে। মা আর নিতে পারেনাই। তাই সকাল সকাল রান্নাঘরে গিয়েছিলো। আগের রাতে তুমি অনেকসময় পর্যন্ত জেগে বারান্দায় বসে ছিলা, তাই কিচ্ছু টের পাওনাই। আজ পর্যন্ত তুমি সেই সকালের কথা জানোনা। যেই রাতে আমি আত্মহত্যা করলাম, সেই রাতে তুমি বা মা কারো কথা ভাবার অবস্থাতেই আমি ছিলাম না। জীবনে এই একটা মাত্র দিন গেছে আমার, যেদিন তোমাদের কথা বিন্দুবিসর্গ ভাবিনাই। তুমি, মা, রেফায়ার বিয়ে হয়ে যাওয়া, ক্রিকেট- কিছু নিয়েই সেদিন ভাবতে পারিনাই।

চারপাশকে চমকে দিয়ে বিশ্রী কায়দায় মুয়াজ্জিন মাগরিবের আজান শুরু করলে খেয়াল করি আব্বা নড়েচড়ে উঠেন।

‘আমি আজকে আসি রে। তোর মাকে বলে আসছিলাম যে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবো।’

মায়ের কাছে আব্বার ফিরে যাওয়ার তাড়না দেখে স্বস্তিবোধ করি। আমি ভালো করেই জানি যে কথাগুলো আব্বাকে বলবো বলবো করেও বলা হয়না, কোনদিন কথাগুলো যদি তাকে বলে ফেলি তবে বাদবাকি দুনিয়ার মতো আমিও, আমার কবরের কাছে এসে বাপের উচ্চারিত সাধারণ সব বাক্যকে মনোলগ বলে বিবেচনা করতে শুরু করবো। যতোদিন পর্যন্ত বাপকে কথাগুলো বলা আমার একান্তই দরকার, এই অনুভবের মাঝে সমগ্র বিষয়টাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারবো- ততোদিন পর্যন্ত পিতা-পুত্রের এই কথোপকথন বেঁচে থাকবে।

‘আব্বা, আজকে তাইলে আসো। সামনের আসার সময় মায়ের পুরনো কোন গয়না নিয়ে আইসো।’ কথাগুলো বলেই আমি কবরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেই। বাপের সাথে কথোপকথন শেষে সবসময়ই আমার সাউন্ড স্লিপ হয়, এমনটা লক্ষ্য করেছি।








মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে মে, ২০১৭ সকাল ৮:০২

সাদাত সায়েম বলেছেন: B:-/

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.