নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

টিকটিকি

৩১ শে মে, ২০১৭ রাত ৯:৪৪

সকাল থেকে সারাদিনে অনেক দৌড়ঝাপ করেছে। মতিঝিলের এবি ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে কল্যাণপুরের একমি অফিস পর্যন্ত কোথায় তাকে যেতে হয়নি? হন্তদন্ত হয়ে প্রতিটি জায়গায় গিয়েছে। সাধ্যমত নিজের করনীয়টুকু করে গেছে। বন্ধুমহলে স্মার্ট বলে বরাবরই সে বিবেচিত। তবুও ভাগ্যে তার শিকে ছিঁড়ছে কই?

সেগুনবাগিচায় প্রাক্তন শিক্ষকের ফ্ল্যাটের মখমলি সোফায় বসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে রাসেলের মগজে কথাগুলো বারবার বাড়ি খায়। ভাবতে ভাবতে তার মাথা উষ্ণতর হতে থাকে। এরকম দৌড়াদৌড়ি কম দিন তো হলো করছেনা। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। বেক্সিমকো গ্রুপে ইন্টারভিউটা অসাধারণ দিয়েছিলো। বারেক ভাই খুব করে আশ্বাস দিয়েছিলো যে এবারে তার কিছু একটা না হয়েই পারেনা। আড়াই বছর যাবত এদিক – ওদিক দৌড়াদৌড়ি, নিজেকে সর্বাঙ্গীন সক্ষম করে তোলার জন্য কি প্রাণান্তকর পরিশ্রমটাই না সে করেছে সেই খবর রাসেল বাদে আর কেউ জেনে থাকলে শুধু আল্লাহই জেনে থাকবেন। কিন্তু বারেক ভাইয়ের এতো নিশ্চয়তাও শেষমেষ কোন কাজে লাগলোনা। ইন্টারভিউয়ের দিন পনেরো পরে হবে দেখা হয়ে গেলে তার মুখোমুখিই হতে চাইছিলোনা হারামীটা। পরে তার মুখ থেকে টেনে কথা বের করিয়ে ছেড়েছিলো রাসেল। জানতে পেরেছিলো আর বারোজনের মতো তার ইন্টারভিউটাও স্রেফ আইওয়াশ ছিলো। ক্যান্ডিডেট আগে থেকেই সিলেক্ট করা ছিলো। যথাসময়েই এপয়েন্টেড হয়ে দিব্যি পঁচিশ হাজার টাকা স্যালারীর চাকরী শুরু করে ফেলেছে। বারেক ভাই অবশ্য পরে অনেকবার নিজ মুখে সরি বলেছে। মুখের রেখাগুলো তো অপ্রস্তুতই দেখাচ্ছিলো তখন। নাহ গালি দেওয়াটা বোধহয় বাড়াবাড়িই হয়ে গেলো। অগ্রজের সেই বিব্রত মুখাবয়ব স্মরণ করে রাসেল লজ্জার ক্ষুদ্র কাঁটা হৃদয়ে অনুভব করে।

“কি খবর রাসেল? টাইমে এসে গেছো দেখতেছি।” ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামাতে উজ্জ্বল দেখানো গিয়াসউদ্দীন প্রাক্তন ছাত্রের দিকে তাকাতে তাকাতে হৃষ্টচিত্তে সোফায় এসে বসলে লজ্জা , সংকোচ ইত্যাদি শব্দের ভার থেকে রাসেল মুক্ত হতে পারে। প্রাক্তন শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র ছিলো সে। তবুও শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে একটুকু অপ্রতিভ হাসি ব্যতীত অন্য কোনভাবে সে ইতিবাচক হতে পারলোনা।

“তোমাকে অনেক টায়ার্ড লাগতেছে। দাঁড়াও শরবতের কথা বলে আসি। এই গরমে বেলের শরবত খাইলে আরাম পাবা।” রাসেলকে দ্বিতীয় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গিয়াসউদ্দীন পুনরায় ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরের শেষ প্রান্তে বাদামী রঙের পর্দা ঝোলানো। ঘরের মালিক ঘর থেকে বেরোলে তার শরীরের স্পর্শে সেই পর্দা পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। ঘরটির দিকে রাসেল এই প্রথমবার মন দিয়ে তাকিয়ে দেখে। ছোটোখাটো এক লাইব্রেরীই বলতে হবে ঘরটাকে। বইয়ের শেলফ নিঁখুতভাবে সাজানো। তার কাছে গেলেও দেখা যাবে যে একটুকু ধুলোও সেখানে স্থান পায়নি। শেলফে মোট পাঁচটি তাক। প্রতিটি তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বইপত্র নিঁখুতভাবে সজ্জিত। বইগুলার প্রায় নব্বই শতাংশই ইংরেজীর। মোটা মোটা আকৃতির সব বই। যতো ভালো মানেরই হোক না কেন বাংলা বইয়ের ব্যাপারে স্যারের এক ধরণের অলিখিত অরুচি কাজ করে এই বিষয়টা তার ছাত্রছাত্রীরা সকলেই মোটামুটি জানে। শুধুমাত্র এখানেই শেষ নয়। এক বিষয়ের বই শুধুমাত্র সেই তাকেই থাকবে। ইতিহাসের বই সাহিত্যের তাকে থাকবে এমন কোন বাস্তবতা গিয়াসউদ্দীন স্যারের বেলাতে অকল্পনীয়। রাসেল খুব কম করে হলেও ছয় বছর ধরে তার প্রিয় শিক্ষককে দেখে আসছে। বরাবরই স্যার অত্যন্ত গোছানো স্বভাবের। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও স্যারের যেই ঘর সেখানেও বইপত্র থেকে শুরু করে এমনকি পেপারওয়েটটা পর্যন্ত কখনো স্থানচ্যুত হয়নি। বসার ঘরটিও একই রকম। মাথার উপরে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেও সেই একই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পবিত্র, সৌম্যকান্তি এক ধরণের ভাব এসে উদয় হয়। যেন প্রতিদিনই ছোট মইতে করে কেউ না কেউ ফ্যানের ব্লেডগুলোর ধুলা পরিষ্কার করে রাখে। সবুজ রঙের কুশনগুলোর সাথে সোফার রঙের দারুণ এক কম্বিনেশন। দুইটা সোফা থেকে একটু পিছনে কিছু শো পিস ছোট একটা রাউন্ড টেবিলের উপরে ত্রুটিহীনভাবে সাজানো। যেন পানির মতো ঝকঝকে রাউন্ড টেবিল ব্যতীত অন্যকোনখানেই শো পিসগুলোকে মানাতোনা। বেয়াল্লিশ ইঞ্চির টিভি সেটটার উপরে যেই সাদা কাভারটি দেখা যাচ্ছে সেটাকেও বসার জায়গা থেকে সদ্যই কেনা এমন পরিষ্কার বলে মনে হয়। পারফেক্ট, রাসেলের বন্ধু তূর্য সুন্দর কিছু দেখলেই গদগদ গলায় শব্দটি উচ্চারণ করে আরো কিছু সময় নিজস্ব মুগ্ধতার রেশ ধরে রাখে। এই ঘর দেখলে তার কি প্রতিক্রিয়া হতো ভাবতে ভাবতে সদ্যই ডিসটেম্পার করা শাদা দেয়ালের দিকে রাসেলের চোখ যায়। তার বসার স্থান থেকে ডানে চোখ রাখলে হালকা নীল রঙের গ্রিলগুলোকে অতিক্রম করে দৈনন্দিন বাহ্যিক নৈসর্গিক চিত্র দেখা যায় যা কোলাহলে পরিপূর্ণ। সামনে এগিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যাবে কিছু দূরত্বে আরেকটি এপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটের বারান্দা এই ঘরের জানালার মুখোমুখি হয়ে আছে যেই বারান্দা থেকে সবুজ রঙের একটি তোয়ালে, কালো রঙের একটি ফুল শার্ট, গোটা দুয়েক চেক লুঙ্গি এবং একটি লাল রঙের ব্রা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। গ্রিলগুলো থেকে একটু উপরে তাকিয়ে রাসেল একটু বিস্মিত হয়। তার শিক্ষক এতোটাই গোছানো এবং পারফেকশনিস্ট যে নিজের ফ্ল্যাটের বসার ঘরে ছিমছাম শরীরের হলেও একটি টিকটিকিকে স্বাধীনভাবে বীরদর্পে বিচরণ করতে দেখাটা মনের ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তির সৃষ্টি করে। সমগ্র ঘরটিতে এই একটা জিনিসই বড্ড বেমানান লাগছে। “এই নাও তোমার বেলের শরবত।” টিকটিকি থেকে রাসেল সরাসরি বেলের শরবতে মনোনিবেশ করে। নাহ, স্যার বরাবরের মতোই ঠিক বলেছে। জিনিসটা যেই বানিয়ে থাকুক বানিয়েছে অসাধারণ। নিশ্চয়ই ব্লেন্ডারে বানিয়েছে। সেগুনবাগিচা থেকে জিগাতলায় চলে যাও। না আছে ব্লেন্ডার, না বানানো হবে বেলের শরবত।

“এইবার বলো রাসেল। কি করতেছো আজকাল? কোন পজিটিভ নিউজ?”

টিকটিকিটা এখনো বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাধাবিপত্তিহীনভাবে। তার মনোযোগ সমগ্র দেয়ালের উপরের অংশেই। একবার জানালার দিকে তো আরেকবার উল্টাদিকে টিভি সেটের উপরের দেয়ালে। বিচরণকারীর দিকে চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতে রাসেল নেতিবাচক মাথা নাড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়। চেষ্টাচরিত্র তো কম করছেনা। ভাগ্য যদি সাথে না থাকে তাইলে সোনার হরিণের দেখা পাবে কিভাবে? নওশীনটাও কি যে বিরক্ত করতে শুরু করেছে। তারা দেখা করলে কিছু না কিছু নিয়ে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে। করবেই। কখনো স্টার সিনেপ্লেক্সে কোন মুভি দেখবে সেই নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে তারপরে পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করে বাড়ি ফিরে যাবে তো কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রিকশায় যেতে যেতে আজকাল রাসেল তাদের জন্য গুরুত্ববহ কোন তারিখের কথাই স্মরণ করতে পারেনা এই নিয়ে সেন্টিমেন্টের তুমুল প্রদর্শনী। রাসেল এতো পেরে উঠবে কিভাবে? এদিকে নওশীনের বাসাতেও বিয়ে নিয়ে চাপ আসতে শুরু করেছে। যখন পরিস্থিতি হয় এরকম সেই সময়ে কিভাবে সবকিছু সামাল দেবে তা বুঝে উঠতে পারাটাও কঠিন। “হাসিব কয়েকদিন আগে আমার কাছে আসছিলো। তোমার সাথে তার দেখা হইছে এর মধ্যে?” শিক্ষকের প্রশ্ন নির্দোষ, কিন্তু রাসেলের ভেতরে আগুন ধরে যায়। শালার, এই সময়ে আর কারো কথা বলা যেতোনা? ঠিক সেই কালপ্রিটটার কথাই তুলতে হবে? দুইদিকে জোর মাথা নাড়িয়ে পুনরায় নেতিবাচক উত্তর দিতে দিতে রাসেলের মস্তিষ্ক ফের ঝুটঝামেলার কাছে ফিরে যায়। নওশীন ইদানিং উঠতে বসতে হাসিবের সাথে তুলনা করে রাসেলকে খোঁটা দিচ্ছে। হাসিব এক বছর হলো এক আইটি ফার্মে চাকরী করছে। তার কথাবার্তা, চলনবলন আমূল পাল্টে গেছে চাকরীটা পাবার পর থেকে। হাসিবের প্রেমিকা সুমাইয়া নওশীনের বান্ধবী হওয়ার কারনে হাসিবের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রসঙ্গটা তাদের দুইজনের মধ্যে আরো বেশী করে চলে আসে। “আরে ধুর রাখো তোমার পেয়ারের হাসিবের কথা। শালায় ভালো চাকরী করতেছে তো কি হইছে? লাক, বুঝলা লাক এই কারনেই হাসিব চাকরী পায় আর আমারে বইসা থাকতে হইতেছে। ভার্সিটিতে থাকতে একলগে ক্লাস করছিনা দুইজনে? হাসিব আমার ধারেকাছে আইতে পারেনাই কোনকালে। রেজাল্ট কও কি কথাবার্তা , চলাফেরা বলো আমার সাথে হাসিবের কোন তুলনাই চলতোনা। আমাদের আর বন্ধুবান্ধব নাই? যারেই জিজ্ঞেস করবা একই কথা বলবে।” এই কথাগুলা রাসেল কতোবার নওশীনকে বলেছে। হাজারবার তো হবেই। প্রতিবারই মনে মনে। মাঝেমাঝেই তার সন্দেহ হয় বান্ধবীর প্রেমিক হলেও হাসিবের ব্যাপারে নওশীনের এরকম উদাত্ত প্রশংসা সম্ভবত অন্য কিছুই ইঙ্গিত করে। রাসেল কতোবার ভেবেছে নওশীনকে কথাটা সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলবে। কিন্তু সেই সাধ্য আজ়ও তার হলো কোথায়? হলে তো ……… তীব্র আর্তচিৎকারে রাসেলের কল্পনার জাল ছিঁড়ে যায়। কন্ঠটা হাই পিচের। নারী কন্ঠ। জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে চিৎকার তেমন কোন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। সেই তীক্ষ্ণ আর্তনাদে সমগ্র ঘর কেঁপে উঠবার সাথে সাথে গিয়াসউদ্দীন নিজের মোটা মোটা গাবদা পাগুলো দ্রুত চালনা করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ফের পর্দার মধ্যে আটকে যায়। দৃশ্যটা যথেষ্টই হাস্যকর কিন্তু তীব্র চিৎকারের কারনে রাসেল এতোটাই উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে যে সেই চিত্রটি থেকে কোন প্রকারের হাস্যরস আবিষ্কার করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনা। ভিকটিমের চিৎকার করার কারণ কি হতে পারে? গরম পাতিল পায়ে পড়ে গেছে? বাথরুমে পা পিছলে জোরে মাটিতে পড়ে গেছে? ছুরি বা ধারালো কিছুতে হাত-পা কেটে গেছে? সম্ভাব্য উত্তর অন্বেষণের এই অন্তবর্তীকালীন সময়ের মাঝেই গিয়াসউদ্দীন পুনরায় ঘরে প্রবেশ করে। তার মুখের দিকে তাকালে কোন প্রকারের দুশ্চিন্তা কিংবা উদ্বেগের রেখা ফুটে উঠেনা। রাসেল উৎসুক চোখে নির্বাক তাকিয়ে থাকলে গিয়াসউদ্দীন সলজ্জ হাসি হেসে বলে “খুব সিলি ব্যাপার। বুঝলা রাসেল? আমার মেয়েটা এতো বড় হইছে। এক বছর পরে ইন্টার পরীক্ষা দিবে। কিন্তু এখনো টিকটিকি দেখলেই ভয়ে প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে যায়। ব্যাপারটা আর কিছু না। ঘুমাচ্ছিলো। ঘুম থেকে উঠে চুল আঁচড়াইতে আঁচড়াইতে দেখে তার ঘরের উপরে একটা টিকটিকি। ব্যাস, আমার মেয়ে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো। এখনো কি রকম ছেলেমানুষ আছে চিন্তা করে দেখো একবার। টিকটিকি দেখেই ভয়ে অস্থির হয়ে যায়। মেয়েটাকে এই নিয়ে এতো বকছি তারপরেও কোন কাজ হয়না। ওর মা তো এই স্কুলে থাকতেও চড়থাপ্পড় পর্যন্ত দিতো। মেয়ে যদি শোধরাইছে। যাই হোক তোমাকে যা বলতে যাইতেছিলাম………” গিয়াসউদ্দীন রাসেলের কানের কাছে অজস্র কথা বলে যায়। রাসেল শিক্ষকের পরামর্শে মনোনিবেশ করতে করতে দেয়ালের উপরের দিকে তাকায়। নাহ, এখন সেই টিকটিকিটাকে দেখা যাচ্ছেনা। একটু আগেই গোটা বাড়িটায় যেই মৃদু প্রলয়ের মতো ঘটে গেলো তার জন্য কালপ্রিট বীরদর্পে সমগ্র বাড়িতে ঘোরাঘুরি করা সেই টিকটিকিটাই হবে।

স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাসেলের বেশ ভালো লাগে। সারাদিনে প্রচুর দৌড়াদৌড়ি করে শারীরিক মানসিক উভয় দিক থেকেই খুব ক্লান্তবোধ করছিলো। সেই ক্লান্তির কিছুটা কেটেছে স্যারের কথা শুনে। রাসেল আগেও দেখেছে স্যারের সাথে সময় কাটাবার পরে সে বেশ ভালো অনুভব করে। শরীরে হোক কি মনে এক ধরণের চনমনে ভাব জাগে। নওশীনের সাথে প্রেমের প্রথম প্রথম দিকে এরকমটা অনুভব করতো। কিন্তু এখন কোথায় গেছে সেইসব দিন। রিকশা করে শাহবাগে যেতে যেতে একবার আকাশের দিকে তাকালো। রাত হয়ে এসেছে। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। এতোটুকু অস্পষ্টতাও নেই। তবে আজকে আর্দ্রতা বেশী। এই কারনে সারা শরীর এখন চটচট করতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক বন্ধু ছিলো সিরাজ। গ্রামের ছেলে ছিলো। মুখে কিছু আটকাতো না।এরকম গরমে তাকে বাইরে বেরুতে হলে বাপ-মা তুলে আবহাওয়ার উদ্দেশ্যে গালাগালির সমুদ্র বইয়ে দিতো।শুধু কি আবহাওয়া নিয়ে তার অসন্তোষ? পথেঘাটে মানুষজনের সাথেও কতশতবার ঝগড়াকাজিয়া, এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত করতে গেছে তার হিসাব নেই।একবার তো লোকাল বাসের এক যাত্রীর সাথে খুনোখুনি হয়ে যায় এমন অবস্থা। রাসেল সেবার না সামলালে কি এই সময়ে ব্যবসা করে সিরাজ লালে লাল হতে পারে? বন্ধুর কৃতিত্বে নিজের সামান্য পরোক্ষ অবদানের কথা ভেবে রাসেল আমোদিত অনুভব করে। কি হয় একবার বন্ধুর কাছে নিজের প্রয়োজনে গেলে? বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আঞ্চলিক টানের উচ্চারণের জন্য সবাই সিরাজকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। সবচেয়ে বেশী তামাশা করতো আতিকুল। সিরাজের রগচটা স্বভাবের কারণে সেইসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আড়ালেই হতো। কিন্তু রাসেল সামনাসামনি দূরের কথা, আড়ালেও কখনো সিরাজকে নিয়ে তামাশা করতে যায়নি। সে বরাবরই মানুষ ভালো চেনে। আঞ্চলিক টানে কথা বলা গ্রাম্য ধরণের ছেলেটার ভেতরে কোন বারুদ লুকিয়ে আছে তার খবর অন্যরা রাখবে কিভাবে? রাসেলের মতো এতো বোধবুদ্ধি তাদের কারো ছিলো? এই যে আতিকুল, এতো হাসিতামাশা করতো সিরাজ ছেলেটাকে নিয়ে- এখন ফ্যা ফ্যা করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখা হলেই দার্শনিক আলাপে নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল রাখতে সচেষ্ট হয়। এইসব ফাঁপা দর্শনের ধানাইপানাইয়ের উৎস রাসেল বিলক্ষণ বোঝে। আর কিছুই না, হীনমন্যতাকে সরিয়ে রাখতে চায়। তা সিরাজের কাছে গেলে হয় একবার। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুধুমাত্র রাসেলই তার সাথে কথাবার্তা বলতো নিয়মিত। পুরনো সেই সৌহার্দ্যতার কথা কি সিরাজ ভুলে যাবে? নিশ্চয়ই না। একটু মাথাগরম ছেলে ছিলো, কিন্তু দিলটা ছিলো পরিষ্কার। তার স্বভাবে রাসেল কখনো আর যাই হোক ছোটলোকি দেখেনি। কি খবর বন্ধু? আছো কেমন? আর থাকা বন্ধু, চাকরীবাকরীর পিছনে দৌড়াইতেছি, কিছু তো হইতেছেনা। আরে কি বলো বন্ধু, তোমার মতো ছেলের চাকরী আটকায় কেমনে? তা তুমি তো বন্ধু ব্যবসা করে লালে লাল হয়ে গেলা। পুরান বন্ধুর জন্য চাকরীবাকরীর খোঁজ যদি একটু দেখে দিতে পারো। আরে দূর, আমারে লজ্জা দিলা বন্ধু। মুখ ফুটে তোমার এইসব কথা বলা লাগে, কই যাই বলো তো? তোমারে টায়ার্ড দেখাইতেছে। চা দিতে বলি? না না, শুধু চায়ে চলবোনা। বন্ধুর অফিসে আইছো, একেবারে খায়া যাও আমার লগে। দুই বন্ধু একলগে বিরানী খাবো নে। সামনে বক্কর মিয়া নামে এক লোক আছে। দারুণ টেস্টি বিরানী বানায়। খায়া মজা পাইবা। তারপরে দুই বন্ধু মিলে হেব্বি গল্পগুজব হবে। বিরানী খেতে খেতে বাদবাকী বন্ধুবান্ধবদের দুর্দশা নিয়ে জোর হাসিতামাশাও করবে তারা দুইজন। আতিকুলের চালবাজী দার্শনিক ভাবসাব নিয়ে সিরাজকে একটু আপডেট দিলে সিরাজ নিশ্চয়ই রাসেলের চাকরীর ব্যাপারে আসলেই আন্তরিক হয়ে উঠবে। এইসব গ্রামের ছেলে, ব্যবসা করে যতোই লালে লাল হোক পুরনো তুচ্ছ ক্ষত সহজে ভোলেনা। রাসেল এমন অনেক দেখেছে। আতিকুলকে নিয়ে একচোট হাসিতামাশা করে তারপরে রাসেল হাসিবের পুরনোদিনের নির্বুদ্ধিতার কথা তুলে সিরাজের সাথে হাসাহাসি করবে। হাসিবের সাম্প্রতিক সাফল্যের কারণে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে হলে অতীতেই ফিরে যেতে হবে। নওশীন তো সেসবের কিছুই জানেনা। তারা তখন দ্বিতীয় বছরে পড়তো। মার্কেটিঙ ডিপার্টমেন্টে, তাদের ব্যাচমেট ছিলো সিনথিয়া। হাসিব তার প্রেমে পড়ে কি কি ছ্যাবলামী করেছিলো তার বিস্তর ইতিহাস রাসেল জানে। ভুল বানানে ইংরেজীতে চিঠি লেখা থেকে শুরু করে রোকেয়া হলের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা- শেষমেষ একদিন কলাভবনে তাদের সবার সামনে কুৎসিত ভাষায় হাসিবকে বিরক্ত না করবার জন্য শাঁসিয়ে গেলে গোটা একটা সপ্তাহ হাসিব ক্লাসে আসেনি। এইসব ইতিহাস নওশীনকে জানাতে পারলে শালীর হাসিবপ্রেম কর্পুরের মতো উবে যাবে। রাসেল নিজেও তখন একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে। সিরাজের সাথে কাল্পনিক কথোপকথনের অন্তহীন দিগন্তে বিভোর হতে হতে রিকশা হাইকোর্ট চলে আসলে বিপত্তি ঘটে। রাসেলের রিকশার চালক তার এক সহকর্মীর প্রতি অতিরিক্ত মমতা দেখাতে গিয়ে এক মাইক্রোর সাথে লাগিয়ে দেয়। পেছনে বসে থাকা মালিকের ইশারায় সম্মতি খুঁজে পেয়ে মাইক্রোর চালক গাড়ি থেকেই বেরিয়েই চড়াও হয় চালকের উপরে। সংঘর্ষটা মাইনর। মাইক্রোর বলতে গেলে কোন ক্ষতিই হয়নি। ড্রাইভার বাড়াবাড়িই করছে সত্যি বলতে। যাত্রী হিসাবে তার হস্তক্ষেপ করা উচিত। ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকিয়ে রাসেলের প্রাণপণে ইচ্ছা হয় গোটা দুয়েক ঘা বসিয়ে দিতে। চামারের মতো দেখতে। ঘাড়গর্দানে মানুষের বাচ্চা বলে চেনার উপায় নেই। শালার গাড়ির মালিককে দেখো। কেমন বসে বসে টেইলর সুইফটের রোমান্টিক গান শুনছে। তার যদি এরকম সৌভাগ্য হতো! “রাসেল, তুমি যেই সময়ের মধ্যে দিয়ে যাইতেছো সেই সময়ে কোন কন্ট্রোভার্সি ক্রিয়েট কইরোনা। কোন জায়গাতেই এই কাজটা কইরোনা। তোমাকে সাজেশনটা দিতেছি কারণ আমি নিজেও তোমার বয়সটা অতিক্রম করছি। এই সময়ে ইয়াং ছেলেপুলেরা খুবই ফ্রাস্ট্রেটেড থাকে। অকারনেই ভায়োলেন্ট হয়। এইটা এভয়েড করবা। টেম্পার লুজ করা যাবেই না।” বাসা থেকে বের হবার আগে গিয়াসউদ্দীন পইপই করে বলে দিয়েছিলো প্রাক্তন ছাত্রকে। স্যারের বাসার টিকটিকিটার মতো মুক্তভাবে বিচরণ করবার রিস্ক রাসেল এই মুহূর্তে নিতে পারেনা। এমন পরিস্থিতিতে নিজের আক্রান্ত রিকশাওয়ালার উপরে মাঝরাস্তায় ব্রেক করবার তুচ্ছ দোষ চাপানো ছাড়া রাসেলের আর কি করার থাকতে পারে?

মন্তব্য -১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (-১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মে, ২০১৭ রাত ১১:২৭

রাজীব নুর বলেছেন: রাসেল আর আমার অবস্থা একই রকম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.