নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

লেখক

২০ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৮

বিহ্বলতা কাটিয়ে সুমন বল নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো। ব্যাটসম্যান নির্ণিমেষ চোখে তার হাতের দিকে তাকিয়ে। মাঠে উপস্থিত প্রত্যেকে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে এই বলে কি ঘটবে। সুমনের হাত থেকে বল ছিটকে বেরুলো। বল পিচে ড্রপ খাওয়া মাত্রই অপেক্ষারত ব্যাটসম্যানের বুকের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। …………

বাহ, বসতে না বসতেই লেখা তরতর করে এগিয়ে গেছে। শুরুটাই আসলে সমস্যা। একবার সেই স্টেজ পার করে আসতে পারলে আর বেশী ভাবতে হয়না। বয়স সাইত্রিশ ছুঁইছুঁই, ক্লিন শেভড ফরসা গালে দৃশ্যমান নীলচে আভায় হাত বুলাতে বুলাতে নাইমুর হৃষ্টচিত্তে লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। এক মাস ধরে লেখাটা নিয়ে বসবে বসবে করেও নানা ঝুটঝামেলায় বসতে পারলোনা। আসছে ঈদে সময়ের কন্ঠস্বর পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য তার কাছে উপন্যাস চাওয়া হয়েছে। বিষয়বস্তুও বাঁধাধরা। ক্রিকেট নিয়ে উন্মাতাল আমপাবলিক আজকাল সাহিত্যেও বাইশ গজের ইতিবৃত্তান্তের গল্প শুনতে চায়। সেদিন সম্পাদক কলিম সাহেবের কাছেও নাইমুর একই কথা শুনেছিলো। ক্রিকেট আজকাল সবচেয়ে মার্কেটেবল কমোডিটির একটা। এই নিয়ে সাহিত্যে কাজ বলতে গেলে একেবারেই নেই। পশ্চিমবঙ্গের কথা আলাদা। মতি নন্দী তো বটেই এমনকি সমরেশ মজুমদার পর্যন্ত এককালে ক্রিকেটকে উপজীব্য করে নিটোল মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পূর্ববঙ্গের মানুষজন খেলাধুলা নিয়ে কম অবসেশনে ভোগে? বিশেষত ক্রিকেট নিয়ে? গতো দশ বছরে ক্রিকেট নিয়ে এই অঞ্চলের বাঙ্গালীদের আগ্রহ, উদ্দীপনা দিনকে দিন বেড়েছে। সাহিত্যেও তার প্রতিফলন থাকা চাই। সেদিন চা-সমুচার আরামদায়ক কোম্পানীতে কথাগুলো নাইমুরের কানে বড্ড মিষ্টি এবং উদ্দীপনামূলক হিসাবে পৌঁছেছিলো। কিন্তু পরে সে বুঝেছে বাস্তবতা এতো সহজ নয়। ঝক্কিঝামেলা মেলা আছে। ক্রিকেটে নাইমুরের আগ্রহ বরাবরই কম। টেকনিকাল বিষয়াদি বুঝবার ব্যাপারে তো নিখাদ ক-অক্ষর গোমাংস। শাহবাগ থেকে ক্রিকেটের উপরে কিছু আনিয়ে নেওয়ার পরেও যখন বুঝলো বিশেষ একটা লাভ হয়নি তখন থেকে ইউটিউবে নিয়মিত ক্রিকেট খেলার নিয়মকানুনের সাথে সম্পর্কিত ভিডিও দেখতে শুরু করলো। প্রাণান্তকর সেই পরিশ্রমের পরে এখন একটু সড়গড় হয়ে তবেই উপন্যাসটা লিখতে বসেছে।

‘শুনো, ঘরে কর্ণফ্লেক্স নাই, সেমাই নাই। একটু নিয়ে আসো তো। অনেকক্ষণ তো লিখলা।’

শারমিন কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পেলোনা! এমন তো হয়না সচরাচর। কথাগুলা কি একটু বেশীই তীক্ষ্ণ শোনালো? নাকি স্ত্রীর প্রতি নাইমুরের সাম্প্রতিক বিরাগের কারণেই স্বাভাবিক কথাগুলোকেও অন্যরকম মনে হচ্ছে? তাদের প্রথম সন্তান সারা হয়েছে আট মাস হলো। নাইমুর লক্ষ্য করেছে বাচ্চা হবার পর থেকেই প্রত্যাশিত খিটখিটে স্বভাবের সাথে সাথে সেক্সের প্রতি শারমিনের আগ্রহ একেবারে শূন্যের কোঠায়। আট কি দশদিন আগে হবে; একদিন রাতে খুব ফ্রেশ মুড নিয়ে নাইমুর স্ত্রীর নিকটবর্তী হতে গিয়েছিলো- তার মুখের উপরে না বলে দিয়ে শারমিন পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যপালনে নাইমুর পারতপক্ষে গাফিলতি করেনা। কিন্তু শারমিনের রিফিউজালের সেই ধরণটা তার একেবারেই ভালো লাগেনি। সেই রাতের পর থেকেই স্ত্রীর সাথে বেশ দূরত্ব রেখে সে কথা বলছে। তাতেও শারমিনের কোন হোলদোল নেই। অবশ্য কলিম সাহেবের অফিসের রিসেপশনিস্ট দিশার সাথে নাইমুর দিব্যি জমিয়ে ফেলেছে কয়েক মাসের ভেতরেই। লিখতে না পারলে কিংবা কোন কারণে জীবনকে খুব বেশী অর্থহীন মনে হলে এসএমএস এক্সচেঞ্জ করে দিশার কাছে মনের অনুভূতিও অনায়াসে ব্যক্ত করা যায়। সেই কারণে রাতেরবেলায় ইন্টারনেটের শরণাপন্ন না হয়েও বাসনার কাছে নাইমুর পরাভূত নয়। দিশা মেয়েটা কথাও বলে খুব সুন্দর করে। কলিম সাহেবের অফিসে যে নাইমুর ইদানিং একটু বেশীই ঘনঘন যায় তা দিশার কারণেই। নয়তো কাহাঁতক আর কলিম সাহেবকে সহ্য করা যায়? লোকটা মানুষ যে খারাপ তা নয়। কিন্তু বড্ড বেশী বকে। বেশী বকতে বকতে একসময় খেই রাখতে পারেনা। এই দুই মাস আগেই তো রাশেদকে এক পর্যায়ে বাংলা গদ্যের ইতিহাস নিয়ে শিশুসুলভ এক লেকচার দিয়ে বসেছিলো। পারলে দুইজনের হাতাহাতি হয়ে যায় আর কি। নাইমুর সেখানে উপস্থিত না থাকলে বড় ধরণের কোন কেলেঙ্কারী হতে পারতো। অবশ্য এই কথাও ঠিক যে রাশেদ বেশ ট্র্যাশ লেখা লিখছে আজকাল। আগে একসময় রাশেদের প্রতি সে এক ধরণের ঈর্ষা অনুভব করতো। তার প্রথম উপন্যাস ‘সেই রাতে আমি ফিরে এসেছিলাম’ একটা মারভেলাস উপন্যাস ছিলো। এই কথা রাশেদের শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য। সেই উপন্যাসের কারণে রাশেদ ‘হাইওয়ে’ ব্যাঙ্ক থেকে পুরষ্কার পেলে তাকে নিয়ে বেশ একটা হইচই পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু গতো দুই বছরে ব্যক্তিগত জীবনের বেসামাল অবস্থা আর লেখালেখিতে ফোকাস করতে না পারার কারণে সাহিত্যাঙ্গনে রাশেদকে নিয়ে আলোচনা অনেক কমে এসেছে। নাইমুরের বলতে দ্বিধা নেই যে ঔপন্যাসিক হিসাবে রাশেদের গ্রহণযোগ্যতার অবনতি লেখক হিসাবে তাকে আরো বেশী আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আজকাল তার কাছে বিভিন্ন পত্রিকা থেকে উপন্যাসের আহ্বান আসে যা দুই বছর আগেও রাশেদের কাছে অকল্পনীয় ছিলো। সেই সময়টা অনুবাদের পেছনেই সে ব্যয় করতো। কিন্তু সময় বদলেছে। সময় এখন তার অনুকূলে।

কিন্তু অনুকূল সময় নিয়ে বেশী ভাবতে গেলে শারমিন ঝাঁঝিয়ে উঠবে নিশ্চিত। নাইমুরের পরিকল্পনা আছে দিশার সাথে আরো জমিয়ে তুলতে পারলে স্ত্রীর এইসব নখরামী সহ্য করতে হবেনা এমন কোন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দিকেই সে অগ্রসর হবে। সেই ক্ষেত্রে সারার কাস্টডি নিয়ে অবশ্য বেশ ঝঞ্ঝাট পোহাতে হবে। কিন্তু সে ঠিকই গুছিয়ে নিতে পারবে। শারমিনের তুলনায় তার সোশাল স্ট্যাটাসের ওজন অনেক বেশী। প্রেমিকা, নিজের সোশাল স্ট্যাটাসের মাহাত্ম্য, লেখক হিসাবে ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাস- সবমিলিয়ে এই মুহূর্তে সাংসারিক প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়াই যায়।

রাস্তায় বেরিয়ে নাইমুর মুগ্ধ হয়ে গেলো। লেখালেখি করার সময়ে সে ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখে বলে ধবধবে ফরসা পর্দাগুলো সেই সময়ে জানালা থেকে সরেনা। ফলে সেই সময়ে আকাশ দেখবার সম্ভাবনা শূন্য। কিন্তু আজকে ঢাকা শহরে এ কোন রঙের আকাশ? অদ্ভুত সুন্দর কমলা রঙে ছেয়ে গেছে। হাতিরপুলের ছোট ছোট গলির এবড়োথেবড়ো রাস্তার দিকে তাকিয়ে নাইমুর বুঝলো যে বেশ একচোট বৃষ্টি হয়েছে। যেসব রাস্তা উঁচুনিচু সেখানে কাঁদার কারণে সাবধানে পা ফেলতে হয়। তাছাড়া একটু বৃষ্টিতেই রাস্তা স্লিপারী হয়ে উঠে। বৃষ্টি হবার পরে যা হয় আর কি- ট্রাফিক জ্যাম বেড়ে যায়। ছোট ছোট গলিগুলোতে তখন হাঁটতে পারাটাই দায়। রিকশায় রিকশায় তুমুল ঝগড়াঝাটি চলে। শ্যাওলা ধরা পুরনো এক বাড়ির সামনের মাংসের দোকানে কসাইরা নিষ্পৃহভঙ্গিতে মাংস কেটে যায়। সামনে এগোলে ছোট ছোট দোকানের সামনে মানুষজনদের ভিড়, হল্লাগল্লায় এলাকা গমগমে থাকে। নাইমুর ভাবলো রিকশা ডাকবে কিনা। কিন্তু হাতিরপুল কাঁচাবাজারের সামনে চলে আসতেই বুঝতে পারলো রিকশা ডেকে লাভ নেই বিশেষ। সমগ্র কাঁচাবাজারের রাস্তা যানবাহনে ব্লকড। প্রাইভেট কার, রিকশা, সাইকেলআরোহী- এই ত্রিমুখী যাত্রাদ্বন্দ্বে কৃষ্ণবর্ণের, ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা ট্রাফিক পুলিশ হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা এতোটাও সহজ নয়। কাঁচাবাজার থেকে সোজা যেই রাস্তাটি চলে যায় বসুন্ধরা সিটির দিকে, সেদিক থেকে আসা রিকশাগুলোকে সামলাতে ট্রাফিক পুলিশকে পরপর চারবার হুঁইসেল বাজাতে হলো। রিকশাগুলো সামান্য সুযোগ পেলেই সিগনাল ব্রেক করে যদি পরিবাগ কিংবা হাতিরপুলের ভেতরের দিকে চলে যাবার উপক্রম করে তবে দুই ঘন্টার আগে এই ট্রাফিক জ্যাম দূর করবার সাধ্য ট্রাফিক পুলিশের দাদার বাপেরও নেই। ট্রাফিক জ্যামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নাইমুর প্যান্ট গোড়ালী থেকে সামান্য ফোল্ড করে হেঁটে হেঁটেই ফলের দোকানের সামনে চলে এসে কমলার গন্ধে মোহিত হলে ধারণা করতে পারে এখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে কাটাবন মসজিদের সামনে একবার পৌঁছে গেলে এলিফেন্ট রোডের শেষ মাথায়, ইস্টার্ন মল্লিকা শপিংমলের জন্য রিকশা পেতে বেগ পোহাতে হবেনা।

হায়রে! ইস্টার্ন মল্লিকার সামনেও দেখা যাচ্ছে একই অবস্থা। নাইমুর রিকশাভাড়া মিটিয়ে চারপাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইলেকট্রিক খাম্বাগুলো অবিন্যস্তভাবে সাজানো। একটু হলে পথচারীদের মাথার সাথে জড়িয়ে যাবে। ইস্টার্ন মল্লিকার সামনে পথচারীদের হাঁটবার সামান্য সুযোগও দিচ্ছেনা থেমে থাকা রিকশাগুলো। আশেপাশের ছোট ছোট দোকানগুলোর একটা থেকে জনপ্রিয় চটুল হিন্দি গানের সুর ভেসে আসছে। তবু নাইমুর এই পরিস্থিতি অবলোকন করতে করতে আশাবাদী হয়ে উঠে। কলিম সাহেব প্রায়ই বলে থাকেন যে আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা থাকা আবশ্যক। পাঠককে এক ধরণের ঘোরের মধ্যে রাখতে না পারলে তারা সাহিত্যপাঠে আগ্রহবোধ করেনা। খুবই ঠিক কথা। অন্তত নাইমুর কলিম সাহেবের এই মতামতের সাথে পুরাপুরি একমত। কতো লেখকের লেখাই তো সে পড়ে নিয়মিত। মানে তাকে পড়তে হয় আর কি। কি নিষ্প্রাণ ম্যাড়ম্যাড়ে গদ্য! সেগুলো পড়লে মনে হয় হৃদয়ে কালি ঢেলে লেখক লিখতে বসেছে। কেবল বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে লেখা। কোন সৌন্দর্য নেই, পাঠককে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেওয়ার চৌকস প্রচেষ্টা নেই। এই যে নাইমুর যেই পত্রিকার জন্য ক্রিকেটকে উপজীব্য করে উপন্যাস লিখতে আরম্ভ করেছে- সেই পত্রিকায় আরো কে কে লিখবে তা তো তার জানা। নাসরীন নামের কুৎসিত দেখতে, নামকরা এক প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর উপন্যাস ছাপা হবে। স্বামীর পদমর্যাদার কারণে সেই ট্র্যাশ পাঠকদের অনেককে কীয়দংশ হলেও গিলতে হবে। আরো থাকবে পাঁচ বছর আগেও নাইমুরদের পত্রিকা অফিসে গল্পের পর গল্প পাঠিয়ে প্রতিবার রিজেকটেড হওয়া আয়মান চৌধুরীর সর্বশেষ উপন্যাস। গেলো বছর রোহিঙ্গাদের নিয়ে কি এক উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়ে গেলো। পত্রিকাগুলোর এখন তার উপন্যাস না পেলে চলছেই না। ন্যাকামী যতোসব। তবে তার নিজের লেখারও তো যথেষ্টই চাহিদা আছে পত্রিকাগুলোর কাছে। পত্রিকাআলাদেরই বা দোষ দিয়ে কি লাভ? এই যুগে চাহিদা-যোগানের হিসাবনিকাশ ছাড়া কোন পত্রিকা এতোটুকুও এগোতে পারে? উপন্যাসটা নিয়ে তার সিরিয়াসলী ভাবতে হবে। এক মাস আগে শুরু করতে পারলে এতো ভাবতে হতোনা। কিন্তু এখন হাতে সময় কম। কাটাছেঁড়া করবার সাথে সাথে তরতর করে লিখে যেতে হবে। যেহেতু ক্রিকেটকেন্দ্রিক উপন্যাস তাই মাঠের প্রচুর বিবরণ থাকবে। চরিত্রগুলোকে গেঁথে নিয়ে আসতে হবে। একবার তা করতে পারলে উপন্যাসে সুরিয়ালিজম বলো কি ম্যাজিক রিয়েলিজম- এসব তুলে আনতে তার বেগ পেতে হবেনা। ইউটিউবে ক্রিকেটের ভিডিও দেখে দেখে নাইমুর বুঝেছে- একটু কৌশলী হতে পারলে ক্রিকেট ম্যাচের বর্ণনায় অনায়াসে ম্যাজিক রিয়েলিজম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অন্তত দশ পাতা জুড়ে একটি ক্রিকেট ম্যাচের বর্ণনায় ম্যাজিক রিয়েলিজমকে ফুটিয়ে তুলতে পারলে এই উপন্যাস নন্দিত না হয়ে পারেই না। ইদানিং বাজারে তার সম্পর্কে বেশ কিছু নেতিবাচক কানাঘুঁষার খবর নাইমুর শুনেছে। তার লেখা নাকি ফুরিয়ে গেছে, আজকাল সে যা যা লিখছে সেসব লেখা আরোপিত। এইসব সমালোচনার দাঁতভাঙ্গা একটা জবাব দেওয়া যাবে উপন্যাসটা সে লিখে শেষ করতে পারলে।


সেমাই, কর্ণফ্লেক্সসহ টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফিরতে ফিরতে নয়টা বাজিয়ে ফেললো নাইমুর। বাড়ি ফেরায় এই কালক্ষেপণ তার ইচ্ছাকৃত। সে লক্ষ্য করেছে শারমিন ইদানিং রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে ডিনার সেরে নিয়ে দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ছে। আজকেও যদি তাই হয় তবে নাইমুর নির্বিঘ্নে গোটা রাত জুড়ে একটানে উপন্যাসের অনেকাংশ নামিয়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া আজকাল তার এক অদ্ভুত নেশার মতো হয়ে গেছে রাত হলেই দিশার সাথে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও কথা বলবার। সচরাচর অন্যান্য দিনগুলোতে অতীব প্রয়োজনীয় এই কাজটা বাইরে থাকতেই করে। কিন্তু আজকে সেই সুযোগ মেলেনি। তাছাড়া তার উপন্যাসটাতে সুরিয়ালিজম এবং ম্যাজিক রিয়েলিজম কিভাবে প্রতিষ্ঠা করবে সে সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ধারণা নিয়ে নাইমুর রাতেরবেলায় উপন্যাস লেখার কাজে বসতে পারবে।

রাত সাড়ে দশটা বাজতে ডাইনিং রুমসহ বাকি ঘরগুলোর বাতি নিভে গেলো। কন্যা সারাকে নিয়ে শারমিন পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে হয়তো এর মধ্যে স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে। দিশাকে এখন একটা ফোন দেওয়া যায়। মিষ্টি করে হেসেহেসে কয়েকটা কথা বলবে। সেসব মধুর বাক্যাবলি শুনে নাইমুর উপন্যাসটা লিখতে বসবে। কিভাবে উপন্যাসটা সাজাবে তা সে মাথায় গেঁথে নিয়েছে। একবার শুধু দিশার সাথে বাক্যালাপ শেষ হলে মানসিক যে রসদ সেটা পেয়ে যাবে। দিশার নাম্বার ডায়াল করে নাইমুর ফোনের স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিজি। নেশাগ্রস্তের মতো আরো সাতবার ডায়াল করেও একই প্রত্যুত্তর পেলে হালকা চাপা অসন্তোষের ধ্বনিতে নাইমুর পিসিতে বসে যায়। দিশা এমন কি মহা গুরুত্বপূর্ণ যে তার জন্য নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সে করতে সক্ষম হবেনা? তাছাড়া নাইমুর আগেই সন্দেহ করেছিলো দিশা একইসাথে চার থেকে পাঁচজনের সাথে সাইমালটেনিয়াসলী মাখোমাখো প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে। তার মতো উচ্চাভিলাষী আর অস্থিরমতি মেয়ে নাইমুর আজ পর্যন্ত দেখেনি। এমনকি কলিম সাহেবের অফিসের অন্য কলিগদের মুখেও মাঝেমাঝে দিশার নামে অনেক উটকো কথা সে শুনেছে। লোকজন তো আর হাওয়া থেকে কথাবার্তা বলতে পারেনা তাই না? যা রটে তার কিছুটা হলেও তো ঘটে। এমনকি নাইমুর লক্ষ্য করেছে দিশার প্রতি কলিম সাহেবের চাহনীটাও খুব একটা স্বাস্থ্যকর কিছু নয়। পাঁচ বছর হলো কলিম সাহেব বিপত্নীক হয়েছেন। কাজেই দিশার সাথে তার সম্পর্কের ইকোয়েশনটা তরল হলে তাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। নাহ, উপন্যাসটার দিকে মনোযোগ ফেরানো দরকার। নাইমুর বড় করে একবার নিঃশ্বাস নিয়ে চারিদিকে তাকালো। এই ঘোর অন্ধকারে সাদা পর্দাগুলো আবছা দেখানো ছাড়া আর কিছু দেখা সম্ভব নয়। উপন্যাসে ক্রিকেট ম্যাচটা বেশ জমে উঠেছে। প্রধান যে চরিত্র সুমন তার অসুস্থ বাবাকে মাঠে নিয়ে আসলে কি ব্যাপারটা মেলোড্রামাটিক হয়ে যাবে? নাইমুর একবার ভেবে পরক্ষণেই সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়। অসুস্থ হলে কি মানুষ খেলার মাঠে আসা বাদ দিয়ে দেয় নাকি? সুমনের হাত থেকে বলটা ছেড়ে দিলো নাইমুর। পিচে ড্রপ খাবার আগে সম্ভাব্য কি ফলাফল হতে পারে তা একবার ভেবে নেওয়ার দরকার। আখ্যানটাও গুরুত্বপূর্ণ। নাইমুরের লেখা তরতর করে এগিয়ে চলে। এর মধ্যেই লেখায় বেশ একটা সুরিয়ালিজমের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। দিশাকে যদি একবার লেখাটা পড়ানো যেতো- দিশা সেলফোনে অন্য কারো সাথে প্রেম করে যাচ্ছে সম্ভাবনাটা মাথায় পুনরায় আবির্ভূত হলে দিশাকে লেখাটা পড়তে দেওয়ার বাসনাকে নাইমুর জলাঞ্জলি দেয়। দূর দূর, রিসেপশনিস্ট একটা মেয়ে। গুছিয়ে যতো কথাই বলতে পারুক সাহিত্যের গভীরে যাবার বাসনা তার কই? তার নিজেরই আসলে মাথা খারাপ। বাচ্চা হয়ে গেছে- নাইলে এই রাতে শারমিনকেই অনায়াসে নিজের লেখা পড়তে দিয়ে তার মতামত জিজ্ঞেস করা যেতো। বিয়ের পরে যতোই খিটিমিটি বাঁধুক তাদের দুইজনের, শারমিনের সাহিত্যবোধের প্রতি নাইমুরের আস্থা নিরঙ্কুশ।। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে শারমিনের উৎসাহেই তো সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক তৈরী হয়েছিলো। এক সন্ধ্যায় শারমিনের কন্ঠে শহীদ কাদরীর ‘সঙ্গতি’ কবিতাটি শুনেই তো নাইমুর ঝটপট মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। ‘বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা, মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ। কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা, ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ। প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই, কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না’…… আহা, কে ভেবেছিলো বিয়ের পরে এই তীক্ষ্ণ মেধার মেয়েটা এতোটা আটপৌরে হয়ে যাবে? শারমিন নিজেকে একটু ধারাবাহিক রাখতে পারলে কি দিশার ফাঁদে পা দিয়ে নাইমুরের এই সর্বনাশা দশা হয়? ‘লোকজনের ভিড়ের অরণ্যের মাঝে সুমনের চোখজোড়া একজনকে খুঁজতে লাগলো। যাকে এতোকাল কাছে থেকেও কখনো মন দিয়ে সে দেখেনি। এবারে তার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠছে। কোথায়, কোথায় সেই ভাবলেশহীন চোখজোড়া? সুমন খুঁজছে, খুঁজে ফিরছে। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে কই?’ - এইতো, এইতো উপন্যাসটা এগিয়ে যাচ্ছে। সেন্টিমেন্টাল এই ন্যারেটিভে পাঠকদের হৃদয়ে আবেগাক্রান্ত না হয়ে যাবে কোথায়? উপন্যাসটাকে আরো দীর্ঘ করা প্রয়োজন। দরকার হলে অফিস থেকে নাইমুর এক সপ্তাহের ছুটি নেবে। এমনিতেই ছুটি সে খুব একটা নেয়না বলে পাওনা ছুটির সংখ্যা তার অনেক। লেখার সাবলীল ফ্লো যেভাবে এসে গেছে তাতে এই অবস্থায় লেখা থামিয়ে দেওয়া আর লটারী জিতে সুইসাইড করা একই কথা। কিন্তু আচমকা এই মধ্যরাতে বাচ্চার কান্নার শব্দে চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়। এইভাবে লেখালেখি করা সম্ভব? সারা কেঁদেই চলেছে তো কেঁদেই চলেছে। নিশ্চয়ই মেয়েটার কাঁচা ঘুম ভেঙ্গেছে। কারণ ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন কিছু নয়। শারমিনের বিশ্রী এক স্বভাব আছে। ঘুমের মধ্যে অপরের গায়ের উপরে পড়ে যাওয়া। এখনো বুঝি তাই করেছে। দেখো কান্ড, মেয়েটা সে কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে- থামছেই না। মা হয়ে তাহলে শারমিন কি করে? সামান্য একটা কান্না থামাতে পারেনা। নাকি মেয়ের কান্না না থামানোটা ইচ্ছাকৃত? যেনো নাইমুর লিখতে না পারে? শারমিন ভালো করেই জানে হইচই কি কোলাহলের মাঝে সে লিখতে পারেনা। নাইমুর অসংখ্যবার লক্ষ্য করেছে যে তার উপরে কোন বিষয়ে নিজের অসন্তোষ কি রাগ ঢেলে দিতে হলে শারমিন খুব কৌশলে কাজটা করে। নাইমুর প্রায় নিশ্চিত এখনো সেই একই ঘটনা। কিন্তু তাকে তো লেখাটা থামালে চলবেনা। ‘নাইমুর ভাই, অনেকদিন হইলো আপনার লেখা পাইতেছিনা। কিছু কি হইছে আপনার?’ দিন দশেক আগে বন্ধুস্ত্রী মনিকা কথাটি বলেছিলো। তা নাইমুর কি জবাব দিতে পারে? ঘরে এরকম বিশ্রী পরিবেশের কথা যে কাউকে তো বলা যায়না। তাই হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলো। মনিকার স্বামী, মানে তার বন্ধু শোয়েব প্রায়ই বিদেশে অফিশিয়াল ট্যুরে যাতায়াত করে। তা নাইমুর চাইলে নিজের দুঃখের কথা মনিকাকে শোনাতে সম্পর্কটা আরো গাঢ় করতেই পারে। তেমন ইঙ্গিত তো মনিকা কতোবারই দিয়েছে। দিশার মতো লোভী, সংবেদনহীন মেয়ের পেছনে এতোটা সময় না দিয়ে মনিকার সাথেও তো সময় কাটানো যেতে পারে। স্বামী বিদেশে একা একা ঘোরে। শোয়েবকে তো কলেজ থেকেই সে চেনে। নিজের বাইরে দ্বিতীয় কারো দিকে তার খেয়াল নেই। অপ্রত্যাশিত কিছু নয় যে মনিকার মতো গভীর মনের একজন শোয়েবের সাথে সুখী হতে পারবেনা। সেই ভ্যাক্যুয়াম নাইমুর চাইলেই পূরণ করতে পারে। প্রথমে একটু নিয়মিত যোগাযোগ। তারপরে ‘আমার আসলে কোথাও শান্তি নাই। না ঘরে না বাইরে।’ জবাবে মনিকার কৌতূহলী জিজ্ঞাসা ‘কেনো নাইমুর ভাই। আপনার কি হয়েছে? এইসব কথা তো আমার বলার কথা।’ এভাবে ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়তে বাড়তে একদিন নাইমুর শারমিনের এইসব ছোটখাটো নোংরামীর কথা মনিকার সাথে শেয়ার করতেই পারে। তখন মনিকাও কি সাড়া দেবেনা? এভাবে রাত গভীর হবার সাথে সাথে বন্ধুপত্নীর আশ্রয় নিয়ে নিজের শিশুকন্যার ধারাবাহিক কান্নাকে বাইপাস করে নাইমুরের উপন্যাস সুরিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়েলিজমের সহায়তায় তরতর করে এগোতে থাকে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৪

বিজন রয় বলেছেন: এত এত পরকীয়া!!

২| ২১ শে জুন, ২০১৭ রাত ১:১৭

নদীর মোহনা বলেছেন: জঠিল এক কাহিনী অবতারনা। দ্বিধা দব্দ্বে ফেলে দেয়।
ভাল লাগল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.