নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল আস্থায় পথ চলা

রুবেল ১৯৮৪

প্রমাণ্যচিত্র নির্মাতা

রুবেল ১৯৮৪ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ পর্ব ৪

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৪০



মিরপুর : আরেক সাম্রাজ্য
কাজী রোজী

তারপরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। ২৫ শে মার্চ রাতে সারাদেশে আগুন জ্বলে উঠলো। মিরপুরে শুরু হলো মানুষ কাটাকাটি। নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠলো অবাঙ্গলীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা লুটতরাজ ও আগুন লাগানোর কার্যক্রম নিল। দেখে দেখে বেছে বেছে বাঙালি বাড়িতে ওরা শুরু করলো ওদের কার্যক্রম। মাথায় লাল পট্টি বেধে ওরা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলো। মিরপুরের প্রতিটি পরিবারকে ওরা আক্রমণের শিকারে পরিণত করলো। এদিকে বাঙালিরা জান নিয়ে পালালো কেউ কেউ -- কেউ তাও পারলোনা। জল্লাদদের হাতে ধরা পড়লো। আর যারাই ওদের হাতে ধরা পড়েছে ওরা তাদেরকে চাক চাক করে কেটেছে।
১৯৬৮ সাল। মনে পড়ে সেদিনের কথা। ২১/১ আরামবাগের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে উঠে এলাম মিরপুরে ৬ – সি, ৪/৮ নাম্বারের বাসায়। নিজেদের বাড়িতে। মা - বাবা আর আমরা ছয়টি ভাই বোন। বাবা চাকরী করেন। মা গৃহ পরিচর্যা এবং আমরা ছাত্র। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অন্যেরা কেউ কলেজের কেউবা বিদ্যালয়ে। এইতো আমরা কাজন। মাঝে মাঝে ফুপাত ভাই কবি সিকান্দার আবু জাফর এসে জমাতেন দাবা অথবা তাসের আসর –চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আমাদের অনেক আগেই, সম্ভবত বছর দুই আগে মিরপুর ১০ নম্বর সেকশানে এসেছিলেন খন্দকার আবু তালেব। আমার খালু। বাবার মতো তাঁরও পেশা ছিল সাংবাদিকতা। এসেছিলেন বজলুর রহমান। তিনিও সাংবাদিক। অনেকটা এঁদের উৎসাহেই আমরা মিরপুরে বাড়ি করতে সাহসী হয়েছিলাম। সাহসী কথাটা এই জন্যেই এলো মিরপুরের বাসিন্দা তখন মোটামুটিভাবে শতকরা ৯০ জনই অবাঙালি। আরামরাগ ছেড়ে যখন মিরপুরে আমরা চলে যাচ্ছিলাম, আমাদের বাড়িওয়ালী বলেছিলেন — ‘ বিহারী পট্টিতে ’ যাচ্ছে। যাও বুঝতে পারবে একদিন।
সত্যিই বুঝতে পেরেছিলাম। এলাকাটি বিশেষভাবে অবাঙালিদের রাজত্ব হওয়ায় সেই ৬৮ থেকেই বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতাম। শুধু নিজেদের বাড়ি বিধায় বাবা অনেক কিছুর পরও একটা আত্মতৃপ্তি বোধ করতেন। আর সেই তৃপ্তিতে শরীক হতাম আমরা। শরীক হতেন কবিও— কবি সিকান্দার আবু জাফর।
ধীরে ধীরে অনেক বাঙালি পরিবারই আশে পাশে চলে এলেন। অনেকের সাথেই আলাপ —পরিচয় হলো। ঘনিষ্টতা হলো। ঘনিষ্টতা হলো কিছু অবাঙালি পরিবারের সাথেও। আমাদের পাশের বাড়ির অবাঙালি পরিবারটির সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিকভাবে গড়ে উঠেছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সকলে মিলে একসাথে সুন্দরভাবে বসবাস করা। চেষ্টাও করলাম আপ্রাণ। '৬৯ সালে দেশে গণ আন্দোলন শুরু হলো। সে আন্দোলনের দোলা এসে মিরপুরেও লাগলো। রাজনৈতিক তৎপরতা দানা বেঁধে উঠলো। কলেজ জীবন থেকেই আমি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলাম। লেখালিখিতে হাত ছিল বলে ছিলাম কলেজের সাহিত্য সম্পাদক। জনপ্রিয়তাও ছিল খানিকটা। রাজনৈতিক সচেতনতা ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই নীরব থাকতে পারলাম না। আলাপ করলাম স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে।
ততদিনে বেশ জোরালো ভাবেই আমার ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রচার হয়ে গেছে। প্রচার হয়ে গেছে আমার লেখনীর ক্ষমতা বিশেষের খবরও।
’৭০ সালে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো মিরপুরের বাঙালিরা বেশ সচেতন হয়ে উঠলো। মোঃ জিয়ারত, শুকুর মিয়া, ডঃ মোশাররফ হোসেন, হারুন চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় কিছু বিশিষ্ট ছাত্রকর্মীদের ( যাদের অনেকের নাম আজ মনে করতে পারছি না বলে আন্তরিক দুঃখিত) নিয়ে আমরা একটি মিটিং করলাম ডঃ হায়দারের বাসায় ( বর্তমানে সিভিল সার্জন পঞ্চগড় উপজেলা)। সেই - ই শুরু। আস্তে আস্তে আমাদের আন্দোলন জোরালো হলো। আমরা এ্যাকশন কমিটি গঠন করলাম। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধি, ছাত্রনেতা সেই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হলো। আমরা নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিলাম।
তারিখটা আজ স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে কার্যক্রমগুলো ভুলিনি। ঠিক — মনে আছে। আমিন বাজার, বাগবাড়ি সেনপাড়া, কাজীপাড়া, শ্যাওড়া পাড়া, কালাপানি, পার্বতী, দ্বিগু পল্লবী, কচুক্ষেত, কাফরুল ইত্যাদি এলাকা থেকে ছাত্র প্রতিনিধি আমাদের এই কমিটিতে যোগ দিলেন। ওরা সবাই আমাকেই এই কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে যোগসাজশেই আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করলাম। বর্তমানে মিরপুর স্টেডিয়ামের জন্যে সম্ভবতঃ ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে নির্ধারিত খালি জায়গায় আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সহায়তায় বিশাল জনসভার আয়োজন করলাম। এরমূল কারণ ছিল — প্রচলিত ভাষায় ‘ বাঙালি বিহারী ’ বিরোধের নিষ্পত্তি করণ। দেশব্যাপী আন্দোলনের মুখে অবাঙালিদের ধারনা জন্মেছিল — আমাদের সর্বপ্রকারের মিটিং — মিছিল ওদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিষয়টি সত্য ছিলনা। আমরা প্রতিটি মিটিংয়েই ওদের আহবান জানাতাম — ওদের সহযোগীতা কামনা করতাম।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সেদিনের সেই বিশাল জনসভাতে আমিই ছিলাম সভাপতি। কেন্দ্ৰ থেকে এসেছিলেন, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রউফ, পংকজ ভট্টাচার্য, সাইফুদ্দিন মানিকসহ আরো অনেকে। মনে পড়ছে ফটোগ্রাফার ও কয়েকজন সাংবাদিকদের কথা। অনেকের কথাই আজ সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না। মিরপুরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেক ছাত্রনেতা সহ ডঃ মোশাররফ হোসেন, হারুন চেয়ারম্যান, নাসিমুল জামাল (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্সের অধ্যাপক), নুরুল ইসলাম, সোহরাব, সেকান্দার ( বর্তমানে নির্বাহী প্রকৌশলী — মীরপুর হাউজিং – এণ্ড সেটেলমেন্ট), আজিজ, ওসমান, কবি মেহেরুন্নেসা, রফিক এবং আরো অনেকে। যাদের নাম আজ মনে করতে পারলাম না তারা আমায় ক্ষমা করবেন।
মনে পড়ে, সেদিনের সেই জনসভাতে বাঙালি বিহারী এক পতাকাতলে নির্বিঘ্নে যাতে আমরা মিরপুরে বসবাস করতে পারি সেই অঙ্গীকার করেছিলাম। কিন্তু সে অঙ্গীকার আমরা রাখতে পারিনি। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় এরপর যতদিনই খণ্ড খণ্ড মিটিং করেছি কোন না কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। ১ নং সেকশানের বেঙ্গলী মিডিয়াম স্কুলে মিটিং করতে গিয়ে আমাকে ছুরি মারার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা সাহসের সাথে সেই অপ্রীতিকর ঘটনাকে মোকাবেলা করেছিলাম। শহীদ ( মুক্তিযোদ্ধা মামা হিসেবে পরিচিত) সেদিন প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে আমাকে রক্ষা করেছিল।
সে দিনের পর থেকে বুঝতে পারলাম মিরপুরের অবাঙালিরা ( দু - চারজন ব্যাতিক্রম ছাড়া) কখনোই আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবে না। ওরা ভিন্ন ধরনের কার্যক্রম নিল গোপনে গোপনে। লক্ষ্য করলাম বেশ কিছু উচ্চপদস্থ অবাঙালি কর্মকর্তাদের বাড়ির ছাদে ওয়্যারলেস ফিট করা হলো। সেনা ছাউনীর সাথে ওরা সরাসরি যোগাযোগ করতো। গোটাদেশ যখন সরকারী কার্যক্রমের বিরোধীতা করছে, ওরা তখন সেই স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর দোসর হয়ে উঠলো। মিরপুরে ছিলো ওরা সংখ্যাগরিষ্টতা। তাই এখানে ওরা বহু দুঃসাহসিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কেন্দ্রস্থল নির্মাণ করলো।
আমরাও বসে থাকিনি। '৭০ সালে আন্দোলন আরো ঘনীভূত হলো। তীব্র হলো। দেশের ছাত্র, শ্রমিক, রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষও এ আন্দোলনে যোগ দিল। আমরা স্থানীয় ভাবে মিরপুরে এ আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুললাম। এলাকায় এলাকায় মিটিং - মিছিল এবং সমাবেশের মাধ্যমে জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করতে শুরু করলাম।
জানুয়ারীর প্রথম থেকেই মিরপুরের বাজারে জিনিষপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। মূল কারণ হলো অবাঙালিরা মাছ - মাংস, তরি - তরকারি এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আমরা জনমত গঠন করলাম এবং কয়েকটি বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিছুদিন স্বাভাবিক ভাবেই চললো। কিন্তু ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষনের পর থেকে অবাঙালি তৎপরতা প্রচণ্ডভাবে ভিন্ন আকার ধারণ করলো। ঘরে ঘরে তার প্রত্যেকে নিজেদের সক্রিয় করে তুললো। তখন আমরা ওদের সাথে আপোষে আসার চেষ্টা করলাম। কেন্দ্র থেকে অবশ্য নির্দেশ ছিল অন্যরকম। কিন্তু আমরা স্থানীয়ভাবে সহযোগিতারই সিদ্ধান্ত নিলাম এবং সেই মর্মে আব্বাস চেয়ারম্যান ( অবাঙালি) এর বাড়িতে মিটিং করলাম। ঠিক হলো, শত্রু নয় বন্ধুভাবাপন্ন হয়েই আমরা স্বৈরাচারী শাসকের মোকাবিলা করবো।
২৩ মার্চ কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী বেশ কয়েকটি বাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ান হলো। অবশ্য মিরপুরের বেশীর ভাগ বাড়িতেই তৎকালীন পাকিস্তানের পতাকাই ওড়ান হয়েছিল। এই পতাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে ২৩ মার্চ গভীররাতে আচম্বিতে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো। রাত প্রায় ১ টা। আমরা মিরপুরের বেশীর ভাগ বাঙালিরাই ঘুমিয়ে গেছি। হঠাৎ করে ' নারায়ে তকবীর ' আল্লাহ আকবর ধ্বনিটি প্রথমে নীচুম্বর থেকে ক্রমাগত চড়াস্বরে আমাদের কানে এলো। ধীরে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ ধ্বনির মতো ওই শব্দ ভয়াবহ আকার ধারণ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম অবাঙালিরা প্রায় সকলেই একজোট হয়ে বাঙালি নিধনে নেমেছে। ওদের হাতে হাতুড়ি, শাবল, রামদা, বর্শা, ছোরা, বল্লম ইত্যাদি। প্রায় এক ঘন্টা ধরে মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে অনেক ঘটনা ঘটলো। সারারাত কেউ - ই ঘুমাতে পারলাম না। কারো সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব হলো না।
পরদিন ২৪ শে মার্চ সকালে কবি মেহেরুন্নেসা, রফিক, ওসমান, শহীদ ( মুক্তিযোদ্ধা মামা নামে পরিচিত) এবং আরো অনেকে এলো আমার বাসায়। আমরা এখান থেকেই ঠিক করলাম শেখ সাহেবের বাসায় যাব। বেলা ১১ টার দিকে শেখ সাহেবের বাসায় গেলাম। শেষ হাসিনা আমার সহপাঠি এবং ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হওয়ায় ও বাড়িতে আমার অবাধ গতি ছিল। যাহোক সব খবর যখন তাঁদের অবহিত করলাম, উনি আমাদেরকে ফিরে খাবার নির্দেশ দিলেন। তবে সতর্ক থাকবারও আভাস দিলেন।
শেখ সাহেবের বাড়ি থেকে ফেরার পর বিকেলে আমরা আবার একটি মিটিং - এ বসলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম যোগনে নিজেরা প্রচণ্ড সচেতনতা অবলম্বন করবো। তবে অবাঙালিদের আর বিশ্বাস করা নয়। অবশ্য প্রকাশ্যে সেটা প্রকাশ না করারও সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘরে ফিরে দেখি কবি সিকান্দার আবু জাফর যথারীতি বাসায় বসে দাবা খেলছেন। বললেন : সময়টা খারাপ, কাজ খুব সচেতনভাবে করতে হবে।
ইতিপূর্বেও তাঁর অনেক পরামর্শ নিয়ে আমি কাজ করেছি। আজও তাঁর ইচ্ছেতে অনেক সচেতন হলাম। কিন্তু ২৪ মার্চেও মিরপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় বাঙালি - বিহারী বিবাদ বিসংবাদের ঘটনা ঘটলো। ২৫ মার্চ সকালে তাই সকলে ঠিক করলাম আব্বাস চেয়ারম্যানের বাড়িতে আবার মিটিং করার। প্রায় দু ঘণ্টা মিটিং - এর পরও কোন মীমাংসায় পৌছাতে পারলাম না।
আসলে, ওদের কাছে খবর ছিল —২৫ মার্চের রাতে আক্রমন হবে। তাই আমরা আপোষ করতে চাইলেও ওরা রাজী হতে চাইলো না। কিন্তু দুঃখ জনক বিষয়টি এই, কেন্দ্র থেকে আমাদের কাছে এ ধরণের কোন সংবাদ জানান হয়নি। ফলে আমরা সচেতন থাকলেও ওদের মতো ততটা সজাগ হতে পারিনি।
দুপুরে আমি খেতে বসেছি। তখন আব্বাস চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে তৌহিদ ( অবাঙালি — কিন্তু আমাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতো) দৌড়ে এসে জানাল, আমাদের বাসা ওরা ঘেরাও করবে। আমি বাড়িতে থাকলে আমার উপর নির্যাতনও করতে পারে।
তৌহিদের কথায় বিশ্বস্ততার ছাপ ছিল। আমার ক্ষতি সংক্রান্ত অজানা আশংকায় ওর বুক কেঁপে উঠেছিল। আমি ওর চোখে করুণ আর্তি দেখেছিলাম। বলেছিল: রোজী বুজি, আপনি চলে যান। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি কয়েকজনকে বিষয়টি জানালাম। কবি সিকান্দার আবু জাফর নিজেই আমার খোঁজ নিলেন। জানালাম কবি মেহেরুন্নেসাকেও। বল্লাম ঃ আমার সাথে চলো। এখান থেকে আপাতত : চলে যাই। মেহের জানাল : কি করে। আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন ঢাকার দিকে নেই। কোথায় যাবো। তাছাড়া বিধবা মা ও দুটি ভাইকে আমি কোথায় ফেলে যাবো। বল্লাম : দরকার হলে ওদের নিয়ে চলো। ওর পরিষ্কার জবাব : এমনতো কোন অন্যায় করিনি রোজী। কেন যেতে হবে। তুমি কমিটির প্রেসিডেন্ট। তোমার যাওয়া উচিৎ। তুমি যাও। আমরা আল্লার নামে রইলাম। ২৫ মার্চ বিকেলে কবির হাত ধরে আমি মিরপুর ছেড়ে গেলাম। সেদিন আমি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমাদের বাড়ি ওরা ঘেরাও করেছিল। আমার বাবা জানিয়ে দিয়েছিলেন — আমি বাড়ি নেই। শেখ সাহেবের বাড়িতে গিয়েছি।
তারপরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। ২৫ মার্চ রাতে সারাদেশে আগুন জ্বলে উঠলো। মিরপুরে শুরু হলো মানুষ কাটাকাটি। নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠলো অবাঙালিরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা লুটতরাজ ও আগুন লাগানোর কার্যক্রম নিল। দেখে দেখে বেছে বেছে বাঙালি বাড়িতে ওরা শুরু করলো ওদের কার্যক্রম। মাথায় লাল পট্টি বেধে ওরা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলো। মিরপুরের প্রতিটি বাঙালি পরিবারকে ওরা আক্রমনের শিকারে পরিণত করলো। এদিকে বাঙালিরা — জান নিয়ে পালালো কেউ কেউ — কেউ তাও পারলো না জল্লাদদের হাতে ধরা পড়লো। আর যারাই ওদের হাতে ধরা পড়েছে ওরা তাদেরকে চাক চাক করে কেটেছে। জিনিষপত্র লুট করেছে, বাড়ি - ঘরে আগুন জ্বালিয়েছে। তারপর উল্লাস করেছে কাটা মুণ্ড আর খণ্ড দেহ নিয়ে।
আমার খালু খন্দকার আবু তালেবকে ওরা চাক চাক করেছে। আমার বন্ধু কবি মেহেরুন্নেসা ও তার পরিবারের সকলকে ওরা টুকরো টুকরো করেছে। শুনেছি মেহের বুকে কোরান শরীফ চেপে কলেমা পড়তে পড়তে বলেছিল — ‘ আমাকে মার — তবে আমার মা আর ছোট দুটি ভাইকে তোমরা ছেড়ে দাও। ' জল্লাদের দল ওদেরও রক্ষা করেনি। বরং খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে ওদের মেরেছে। আমাদের বাড়িতেও আক্রমণ করেছিল। কিন্তু পাশের অবাঙালি পরিবারেরা ওদের বাঁচিয়ে কলাবাগানে খালাদের বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলো।
৭ মার্চের পর অসহযোগ আন্দোলন যখন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লো তখন একদিন আকস্মিকভাবে মিরপুর দশ নম্বর সেকশনের একজন শিক্ষক জনাব আবদুল কাইয়ুমকে ওরা ছুরিকাঘাত করে। কাইয়ুম সাহেবের রক্তক্ষরণ দেখে আমার খালা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সেদিনই আমার খালু খন্দকার আবু তালেব বলেছিলেন : রোজী, তুই কাদের সাথে আপোষ করতে চাস। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে আজ কাইয়ুম সাহেবকে নির্যাতিত হতে হলো — রক্ত দিতে হলো। কাল তোকে পরশু সবাইকে দিতে হবে। রক্তের খেলা শুরু হয়ে গেলরে। এরা অন্য জাত — স্বৈরাচারী জাত এদের সাথে কোন দিনই তুই কোন সমঝোতায় আসতে পারবি না।
আজ মনে হয়, খালুর কথাগুলো সর্বৈব সত্য। আসলেই ওরা অন্য জাত। মিরপুরটাকে ওরা ওদের নিজস্ব এলাকা বলে মনে করতো। যা খুশী তাই করতো সেখানে। হয়তো সে কারণেই '৬৯ -এর গণ আন্দোলন, '৭০ -এর অসহযোগ আন্দোলন কিংবা '৭১ -এর স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কখনোই মিরপুরে কোন হরতাল হতো না। সারাদেশে ধর্মঘট চলছে। কিন্তু মিরপুরে কোন ধর্মঘট নেই। কেউ ধর্মঘটে সমর্থন প্রকাশ করলে সে বাধাপ্রাপ্ত হতো। যেন এটি অন্য একটি রাষ্ট্র –এ রাষ্ট্র চলে তার বিদেশী অধিবাসীদের নিজস্ব নিয়মে।
এরপর শুরু হলো পালিয়ে বাঁচা। কেননা আমার নাম ও ভূমিকা যে ভাবে বিরোধী শিবিরে প্রচারিত হচ্ছিল তাতে এছাড়া আর আমার পথ ছিল না। পথ ছিল না আরো এক জনের তিনি কবি সিকান্দার আবু জাফর। কেননা তার ' অভিযোগ ' শীর্ষক পুস্তিকাবানির পর সেনা দপ্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। মিলিটারীরা তাকে খুঁজছে। অর্থাৎ তাকেও আত্মগোপন করতে হবে। সেদিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৩ আগস্ট। আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে আছি। উনি সোজা আমার বাসায় চলে এলেন এবং দু ' দিন পালিয়ে থেকে ২৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭ টার দিকে অন্যত্র চলে গেলেন। তারপর কয়েকদিন এভাবে কাটার পর ২৯ আগস্ট ঢাকা ছাড়লাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে। উপঙ্কও নামে স্বামীবাগের এক তরুণ মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে পথ প্রদর্শক হিসেবে নিয়ে আমি, কবি আর আমার ছোট ভাই জাকারিয়া বেবী ট্যাক্সি যোগে ডেমরা গিয়ে নৌকায় চেপে বসি। মনে পড়ে রাস্তায় পাকিস্তানী সেনারা পথ রোধ করলে কবি সিকান্দার আবু জাফর দিব্যি চোস্ত উর্দুতে বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে পার পেয়ে গেলেন। তখনো আমার হাতে বেশ কিছু ‘ অভিযোগ ’ নামার কপি সংরক্ষিত ছিল।
১ সেপ্টেম্বর আগরতলা পৌঁছানোর আগে ২৯ আগস্ট সন্ধ্যায় আমরা একটি গ্রামে নৌকা ভিড়ালাম। ইচ্ছে : রাত পোহালেই আবার যাত্রা শুরু করবো। দলে দলে গ্রামবাসী ছুটে এল। কেউ মুড়ি, কেউ চিড়ে আবার কেউবা গুড় নিয়ে। ওরা অদ্ভুত ভাবে চেয়ে রইলো সিকান্দার আবু জাফরের পানে। প্রথমটায় আমিও কিছু ঠাহর করতে পারিনি। একটু পরে একজন মহিলা আমার বললেন — উনিই তো শেখ সাহেব, তাই না। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আকৃতিগত দিক থেকে শেখ সাহেবের সাথে তাঁর একটা মিল থাকায় এই বিপত্তি। শুনলাম ওরা বলাবলি করছে ‘ উনার ( শেখ সাহেব) লাইগা আমরা আল্লার কাছে মোনাজাত করছি। উনি যেন ভাল থাকে।
আমার প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে গেল। থমকে গেলাম আমি। অবাক হলাম শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে জনগণের নীরব ভালবাসার প্রকাশ দেখে। গ্রাম ভেঙে লোক ছুটে এল একনজর দেখার জন্যে। এ দৃশ্যে কবিও বিমোহিত হলেন। বল্লেন : ' মানুষকে আপন করার কি অপরিসীম ক্ষমতা শেখ সাহেবের, বুঝতে পারছো।ত্ব নিজের চোখে না দেখলে আসলে বিষয়টি বিশ্বাসই করা যায় না। মনের চোখ খুলে গেল আমার। নতুন করে বুঝলাম গ্রামের মানুষের স্বাধীনতা প্রিয়তার বিষয়। গ্রাম্য সরল মানুষেরা কি অসাধারণ সাহসের সাথে মুক্তি যোদ্ধার শপথ বাণী উচ্চারণ করেছে, সেদিন টের পেলাম।
এবারে ওরা কয়েকজন বন্দুক ও গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের নৌকায় ঠাই নিল, আগরতলা যাবার জন্যে। পথে অনেক প্রতিকূলতা পেরোতে হলো। আশৈশব লালিত কবির ‘ এ্যাজমা ' ভীষণ বেড়ে গেল। তিনি বললেন : চলার পথে যদি পিছিয়ে পড়ি, তুমি আমায় এগিয়ে নিয়ে একটি উঁচু জায়গায় বসিয়ে দিও, হাতে দিও একটি রিভলবার। আমি যেন মরতে মরতেও ওদেরকে মেরে যেতে পারি।
আমি ভয় না পেয়ে আরো সাহসী হয়ে উঠলাম। শক্ত হাতে তার হাতখানি ধরে আরো অনেকের সাথে রাতের অন্ধকার চিরে চিরে পথ চলাম। কোথাও হাঁটু পানি। কোথাও বুক পানি, আবার কোথাও বা পা ডুবে যাওয়া কাদার ভেতর দিয়ে আমরা অন্ধকার অতিক্রম করছিলাম। এরিয়াটি শত্রু সেনাদের কড়া নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাই পথে জিরিয়ে নেয়ার কোন সুযোগ ছিল না। চলা আর চলা। চাদের আলোয় পথ চিনে চিনে কেবলি এগিয়ে চলা।
১ লা সেপ্টেম্বর আগরতলা কলেজ টিলায় যখন পৌঁছলাম তখন রাত নেমে গেছে। দেখলাম মাটিতে কাগজ বিছিয়ে ইঁটের উপর মাথা রেখে দিব্যি শুয়ে আছেন আসম আবদুর নব। ( আজকের রবের সাথে যার এতটুকু মিল নেই)। আরো অনেকের সাথেই দেখা হলো তখন। ভীষণ ভাল লাগলো স্বার্থত্যাগের সেই অদ্ভূত নিদর্শন। মনে হলো, এ যেন নিজের জন্যে নয় শুধু দেশের জন্যে বেঁচে থাকা।
৬ সেপ্টেম্বর আগরতলা ছেড়ে কলকাতার জীবন শুরু করলাম। উঠলাম প্রথমে সিলটন হোটেলে। তারপর ২৮ অক্টোবর ৮৪/৯ রিপন স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। তখনো আমরা কোলকাতায়। এর মধ্যে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গল্প, কবিতা, গান ইত্যাদি লেখা ও প্রচার এবং জয়বাংলা, দাবানল ইত্যাদি পত্রিকায়ম লেখালিখি অব্যাহত রাখলাম। কবির উল্লেখযোগ্য গান সজনতার সংগ্রাম চলবেই। তখন দিবা - নিশি প্রচারিত হচ্ছে। এসময় বিশিষ্ট চলচ্চিত্র কাহিনীকার উদয়ন চৌধুরী প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। যোগাযোগ করতেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যক শিল্পীবৃন্দ। কবি আলমাহমুদ, নির্মলেন্দুগুণ মহাদেব সাহা, মাহবুব তালুকদার আরো অনেকেই যোগাযোগ করতেন।
স্বাধীন বাংলার মাটিতে আবার ফিরে এলাম ২৩ জানুয়ারী ১৯৭২ সাল। এসেই মিরপুরের কথা, মনে হলো। মনে হলো, বাবার বাড়িটা নিশ্চয়ই অক্ষত নেই। আগেই শুনেছিলাম সমস্ত মালামাল ওরা লুট করে নিয়েছিল। লুটে নিয়েছিল জালি লাউয়ের মাচা, সদ্য ফোটা কবুতরের ছানা — ওরা যে উড়তে পারে না তাই। মনে পড়লো দাউ দাউ করে জ্বলা মিরপুর অঞ্চলের বাঙালি ঘরগুলো। মনে পড়লো তালের খালুর অকাল মৃত্যুর কথা। মেহেরের মৃত্যুর কথা।
বড় সাধ হলো বাড়ি ঘরের ধ্বংসাবশেষ চোখে দেখার। মনে হলো, মেহেরদের মৃত আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৯৭২ সালের ঠিক সেই ২৫ মার্চ আমি আবার মিরপুরের বাড়িতে এলাম। দেখলাম, বাবার বাড়ির ভিটেমাটি টুকু ছাড়া সবই ওরা ধ্বংস করেছে, নষ্ট করেছে। সেখানে শুধু লেগে আছে আমার মায়ের পঁচিশ বছরের সংসারের ছাপ। মনে হলো এক পঁচিশের বিকেল থেকে আরেক পঁচিশের বিকেল — মাঝখানে শুধু এক নদী রক্ত ও একটি স্বাধীনতার গল্প।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ভোর ৬:৫৭

গরল বলেছেন: এইসব বিহারীদের বিএনপি নাগরিকত্ব দিয়েছে কারণ জানে যে তারা বিএনপিকেই ভোট দিবে।

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১০:৩৮

রুবেল ১৯৮৪ বলেছেন: জি। আপনার কথার সাথে সহমত

২| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৩:১২

রাজীব নুর বলেছেন: ভয়াবহ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.