নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।
ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রথম যে প্রশ্নটা আসে, ‘স্যার, এগুলো পড়ে লাভ কী?’ প্রশ্নটা অমূলক নয় এবং আমি এই ধরনের প্রশ্ন করাকে উৎসাহিত করি। আসলে যে কোন কিছু পড়ার আগেই আমাদের এমন কিছু প্রশ্ন জাগা উচিত। আমি যদি না জানি যে আমি কী খুঁজছি তবে কিছুই পাব না। তাই এ প্রশ্ন যৌক্তিক। এ প্রশ্নের দু’রকম উত্তর। প্রথম উত্তরটি হলো, একাডেমি যেহেতু এটাকে পাঠ্যসূচিতে রেখেছে, সেহেতু রেজাল্টের স্বার্থেই এটা পড়তে হবে। একটু ভালো করে পড়লে ভালো নম্বর আসবে। আর দ্বিতীয় উত্তরটি হলো, আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি, তার একটা সৌন্দর্য আছে, সেই সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য এগুলো পড়া প্রয়োজন। তাছাড়া নিজের ভাষা সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা জরুরি। সে জন্যও ব্যাকরণ পড়া উচিত। এসব বলার পরও কিছু শিক্ষার্থী আমাকে আটকে দিবে এই বলে যে, ‘কিন্তু গাইডে হাজার হাজার বহুনির্বাচনি প্রশ্ন আছে। সেগুলো ভালো করে মুখস্ত করলেই তো হলো, এত বিস্তারিত পড়ার তো প্রয়োজন নেই।’ তাদের কথাও উড়িয়ে দেয়ার মতো না। কিন্তু সেটা হচ্ছে রেজাল্টসর্বস্ব পড়াশুনার জন্য। এই মুখস্ত বিদ্যা ভালো নম্বর এনে দিতে পারলেও ব্যক্তিকে স্বশিক্ষিত করে তুলতে পারবে না। শিক্ষা কেবল পরীক্ষানির্ভর কিছু নয় বরং জীবননির্ভর একটা বড় বিষয়। সেক্ষেত্রে জেনেবুঝে পড়াই উত্তম। যাহোক, এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। আজকে লিখব সমাস নিয়ে। ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাস।
সমাস মানে সংক্ষেপ, মিলন, একাধিক পদের [পদ: বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দকে এক একটি পদ বলে।] একপদীকরণ। অর্থাৎ অনেকগুলো পদকে একটি পদ তৈরি করে ফেলা। বোঝাই যাচ্ছে এর উদ্দেশ্য বাক্যে অনেকগুলো পদ না ব্যবহার করে সহজে বাক্য বলার জন্য এই ব্যবস্থা। তবে যেখান থেকে খুশি, সেখান থেকে কয়েকটি শব্দ নিয়ে একটি শব্দ বানিয়ে ফেললেই তা সমাস হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় ‘অর্থসম্বন্ধ’ অর্থাৎ যে সকল শব্দগুলোকে সমাসে রূপান্তরের জন্য নেয়া হবে সেগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকতে হবে। সুতরাং সমাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায়- ‘অর্থসম্বন্ধ আছে এমন একাধিক শব্দের একসঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি বড় শব্দ গঠনের প্রক্রিয়াকে সমাস বলে।’
সমাস বোঝার আগে কয়েকটি বিষয় বুঝে নিতে হয়। সেগুলো হলো:
সমস্ত পদ, সমস্যমান পদ, পূর্বপদ, পরপদ, ব্যাসবাক্য।
সমস্ত পদ: একাধিক শব্দকে তো একটি শব্দ করার প্রক্রিয়াকে সমাস বলে। এখানে এই যে সমাস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যে একটি শব্দ পাওয়া যায় তাকে সমস্ত পদ বলে। যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন। এখানে সিংহাসন শব্দটি সমস্ত পদ।
সমস্যমান পদ: সমস্তপদটির অন্তর্ভুক্ত পদগুলোকে সমস্যমান পদ বলে। যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন। এখানে সিংহ, আসন শব্দগুলো এক একটি সমস্যমান পদ।
ব্যাসবাক্য: সমস্ত পদ ভেঙে যে বাক্যাংশটুকু পাওয়া যায় তাকে ব্যাসবাক্য বলে। অর্থাৎ যে একাধিক শব্দগুলোকে প্রক্রিয়া করে সমস্তপদ তৈরি করা হয় সেই একাধিক শব্দগুলো নিয়ে যে বাক্যাংশ গঠিত, তাকে ব্যাসবাক্য বলে। যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন। এখানে ‘সিংহ চিহ্নিত আসন’ বাক্যাংশটুকুই ব্যাসবাক্য। ব্যাসবাক্যের অন্য নাম সমাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য।
পূর্বপদ: ব্যাসবাক্যের প্রথম অংশের শব্দ/পদটিকে পূর্বপদ বলে। যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন। এখানে সিংহ শব্দটি পূর্বপদ।
পরপদ: ব্যাসবাক্যের প্রথম অংশের পরের অংশের পদটিকে পরপদ বলে। যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন। এখানে আসন শব্দটি পরপদ। পরপদের অন্য নাম উত্তরপদ।
এগুলো বোঝার সঙ্গে ব্যাকরণের আরো কিছু বিষয় বুঝে নিতে হবে। যেমনÑ
প্রকৃতি-প্রত্যয়, বিভক্তি।
প্রকৃতি: যে শব্দকে বা কোনো শব্দের যে অংশকে আর কোনো ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা যায় না, তাকে প্রকৃতি বলে। যেমন: হাত, ফুল, মুখ, চল্, জম্ ইত্যাদি।
প্রকৃতি দু’প্রকার। যথাÑ নাম প্রকৃতি ও ক্রিয়া প্রকৃতি।
নাম প্রকৃতি: যে প্রকৃতি কোন কিছুর নামকে নির্দেশ করে তাকে নাম প্রকৃতি বলে। যেমনÑ হাত, ফুল ইত্যাদি।
ক্রিয়া প্রকৃতি: যে প্রকৃতি ক্রিয়াকে নির্দেশ করে অর্থাৎ যেগুলো ক্রিয়ার মূল অংশ (ক্রিয়ামূল), সেগুলোকে ক্রিয়া প্রকৃতি বলে। এর অন্য নাম ধাতু।
প্রত্যয়: শব্দগঠনের উদ্দেশ্য শব্দের শেষে যে বর্ণ বা শব্দাংশযুক্ত হয় তাকে প্রত্যয় বলে। যেমন: হাত এর পরে ল যুক্ত হলে হয় হাতল। এখানে ‘ল’ একটি প্রত্যয়।
প্রত্যয় দু’প্রকার। যথাÑ তদ্ধিত প্রত্যয় ও কৃৎ প্রত্যয়।
তদ্ধিত প্রত্যয়: নাম প্রকৃতির সঙ্গে যে প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে তদ্ধিত প্রত্যয় বলে। যেমনÑ হাত এর পরে ল যুক্ত হলে হয় হাতল। এখানে হাত নাম প্রকৃতি সুতরাং ‘ল’ তদ্ধিত প্রত্যয়।
কৃৎ প্রত্যয়: ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সঙ্গে (ক্রিয়া প্রকৃতি) যে প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে কৃৎ প্রত্যয় বলে। যেমন- √চল্+অন্ত = চলন্ত। এখানে চল্ যেহেতু ক্রিয়া প্রকৃতি অর্থাৎ ধাতু সেহেতু ‘অন্ত’ কৃৎ প্রত্যয়। [√ এই চিহ্নটি ধাতুকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।]
বিভক্তি: শব্দগুলোকে বাক্যে ব্যবহার করার সময়ে একটি শব্দের সঙ্গে অন্য একটি শব্দের অন্বয় সাধনের জন্য শব্দের সঙ্গে যে সকল বর্ণযুক্ত করা হয় তাকে বিভক্তি বলে। যেমন: আমি বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশুনা করি।- বাক্যটিতে ‘বিদ্যালয়ে’ শব্দটি আসলে বিদ্যালয়+এ। এই যে বিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘এ’ বর্ণটি যুক্ত হলো, তাকেই বিভক্তি বলে।
বিভক্তি সাত প্রকার। যথাÑ প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী ও সপ্তমী।
একবচন ও বহুবচন ভেদে বিভক্তিগুলোর আকৃতিগত পাথর্ক্য দেখা যায়। সেগুলো নিচে একটি ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো। এর সঙ্গে কোনগুলো কোন বিভক্তি তাও শেখা যাবে।
বিভক্তির নাম একবচন বহুবচন
প্রথমা ০, অ, এ, (য়), তে, এতে। রা, এরা, গুলি (গুলো), গণ।
দ্বিতীয়া ০, অ, কে, রে (এরে), এ, য়, তে। দিগে, দিগকে, দিগেরে, দের।
তৃতীয়া ০, অ, এ, তে, দ্বারা, দিয়া (দিয়ে), কর্তৃক। দিগের দিয়া, দের দিয়া, দিগকে দ্বারা, দিগ কর্তৃক, গুলির দ্বারা, গুলিকে দিয়ে, গুলো দিয়ে, গুলি কর্তৃক, দের দিয়ে।
চতুর্থী দ্বিতীয়ার মতো। দ্বিতীয়ার মতো।
পঞ্চমী এ (য়ে, য়), হইতে, থেকে, চেয়ে, হতে। দিগ হইতে, দের হইতে, দিগের চেয়ে, গুলি হইতে, গুলির চেয়ে, দের হতে, দের থেকে, দের চেয়ে।
ষষ্ঠী ও, এর। দিগের, দের, গুলির, গণের, গুলোর।
সপ্তমী এ, (য়), য়, তে, এতে। দিগে, দিগেতে, গুলিতে, গণে, গুলির মধ্যে, গুলোতে, গুলোর মধ্যে।
এবার মূল প্রসঙ্গে অর্থাৎ আজকের আলোচনায় আসা যায়। উপরিউক্ত বিষয়গুলো না বুঝে সমাস পড়তে গেলে আসলে অনেক সমস্যার পড়তে হয় বলেই এত কথা বলা।
সমাস ছয় প্রকার। যথা:Ñ দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, দিগু ও অব্যয়ীভাব সমাস। [অনেক ব্যাকরণবিদ দ্বিগু সমাসকে কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভুক্ত ধরেন। কেউ কেউ আবার কর্মধারয় সমাসকে তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করেন। সেভাবে দেখলে সমাস মূলত চার প্রকার। যথা: দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, অব্যয়ীভাব সমাস।]
এছাড়া কিছু অপ্রধান সমাস রয়েছে। যেমনÑ প্রাদি, নিত্য, অলুক ইত্যাদি সমাস।
দ্বন্দ্ব সমাস
যে সমাসে প্রত্যেকটি সমস্যমান পদের অর্থের প্রাধান্য থাকে, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। অর্থাৎ পূর্বপদ ও পরপদ দুটোরই অর্থের প্রাধান্য দিয়ে যে সমস্তপদ গঠিত হয়, সেটা দ্বন্দ্ব সমাস। যেমনÑ চা ও বিস্কুট = চা-বিস্কুট। এখানে পূর্বপদ ‘চা’ এবং পরপদ ‘বিস্কুট’ দুটোরই অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে।
* পূর্বপদ ও পরপদের সম্বন্ধ বোঝাতে এক্ষেত্রে ব্যাসবাক্যে এবং, ও , আর এই তিন অব্যয় ব্যবহৃত হয়।
* দ্বন্দ্ব সমাস কয়েক প্রকারে সাধিত হতে পারে। যেমন- মিলনার্থক শব্দযোগে, বিরোধার্থক, বিপরীতার্থক, অঙ্গবাচক, সংখ্যাবাচক, সমার্থক, দুটি সর্বনাম, দুটি ক্রিয়া, দুটি ক্রিয়া বিশেষণ, দুটি বিশেষণ বাচক শব্দ যোগে।
* অলুক দ্বন্দ্ব সমাস: যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদের বিভক্তি লোপ পায় না তাকে অলুক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমনÑ হাতে-কলমে, দেশে-বিদেশে।
* বহুপদী দ্বন্দ্ব সমাস: তিন বা তার বেশি পদে যে দ্বন্দ্ব সমাস হয় তাকে বহুপদী দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমনÑ সাহেব-বিবি-গোলাম।
দ্বিগু সমাস
সমাহার (সমষ্টি) বা মিলন অর্থে সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয়, তাকে দ্বিগু সমাস বলে। অর্থাৎ পূর্বপদ সংখ্যাবাচক শব্দ ও পরপদ বিশেষ্য হয়ে কোন সমষ্টি বা সমাহার বোঝালে তাকে দ্বিগু সমাস বলে। যেমনÑ তিন মাথার সমাহার=তেমাথা ।
* দ্বিগু সমাস নিষ্পন্ন পদটি অর্থাৎ সমস্তপদটি বিশেষ্য পদ হয়ে থাকে।
* সাধারণত ব্যাসবাক্যে সমাহার শব্দটি থাকে।
অব্যয়ীভাব সমাস
পূর্বপদে অব্যয়যোগে নিষ্পন্ন সমাসে যদি অব্যয়েরই অর্থের প্রাধান্য থাকে, তবে তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। যেমনÑ মরণ পর্যন্ত = আমরণ। এখানে ‘আ’ যোগ হওয়ার কারণে মরণ শব্দটি নতুন যে অর্থটি লাভ করেছে সেটিই প্রধান। অর্থাৎ এখানে ‘আ’-ই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিভিন্ন অব্যয় যোগে অব্যয়ীভাব সমাস হয় এবং সেগুলো বিভিন্ন অর্থ সাক্ষেপে হয়ে থাকে।
কর্মধারয় সমাস
যেখানে বিশেষণ বা বিশেষণভাবাপন্ন পদের সাথে বিশেষ্য বা বিশেষ্যভাবাপন্ন পদের সমাস হয় এবং পরপদের অর্থই প্রধান রূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। যেমনÑ নীল যে পদ্ম= নীলপদ্ম।
একটু সহজ করে বোঝার জন্যÑ
কর্মধারয় সমাস অনেক ভাবে হতে পারে। যেমনÑ
* দুইটি বিশেষণ পদে একটি বিশেষ্য বোঝালে। যেমনÑ যে চালাক সেই চতুর= চালক-চতুর।
* দুইটি বিশেষ্য পদে একই ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝালে। যেমনÑ যিনি জজ তিনিই সাহেব= জজ-সাহেব।
* কার্যে পরম্পরা বোঝাতে দুটি কৃদন্ত বিশেষণ পদ হলে। যেমনÑ আগে ধোয়া পরে মোছা= ধোয়ামোছা।
* পূর্বপদে স্ত্রীবাচক বিশেষণ থাকলে তা পুরুষবাচক হয়। যেমনÑ সুন্দরী যে লতা= সুন্দরলতা।
* পূর্বপদটি ‘মহান’ বা ‘মহৎ’ শব্দ হলে, সেটা ‘মহা’ হয়। যেমনÑ মহান যে নবি= মহানবি।
* পূর্বপদটি ‘কু’ হলে এবং পরপদের প্রথমে স্বরধ্বনি থাকলে ‘কু’ বদলে ‘কৎ’ হয়। যেমনÑ কু যে আচার= কদাচার।
* পরপদটি ‘রাজা’ হলে তা বদলে ‘রাজ’ হয়। যেমনÑ মহান যে রাজা= মহারাজ।
* বিশেষণ ও বিশেষ্য যোগ হলে কখনো কখনো বিশেষ্য আগে আসে এবং বিশেষণ পরে যায়। যেমনÑ সিদ্ধ যে আলু= আলুসিদ্ধ।
কর্মধারয় সমাস বেশ কয়েক প্রকারের হতে পারে। তবে প্রধাণত চার প্রকার। যথাÑ মধ্যপদলোপী, উপমান, উপমিত, রূপক কর্মধারয়।
মধ্যপদলোপী কর্মধারয়: যে কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্যের মধ্যপদ লোপ পায় তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় বলে। যেমনÑ সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন। এখানে ‘চিহ্নিত’ শব্দটি লোপ পেয়েছে।
উপমান, উপমিত ও রূপক কর্মধারয় সমাস বোঝার পূর্বে কয়েকটি বিষয়টি ঠিকমতো বুঝে নেয়া জরুরি।
উপমান: উপমান অর্থ তুলনীয় বস্তু। প্রত্যক্ষ কোনো বস্তুর সঙ্গে পরোক্ষ কোনো বস্তুর তুলনা করা হলে প্রত্যক্ষ বস্তুকে উপমেয় বলে এবং যার সঙ্গে তুলনা করা হয় তাকে উপমান বলে। যেমনÑ ভ্রমরের ন্যায় কৃষ্ণ কেশ= ভ্রমরকৃষ্ণকেশ। এখানে ভ্রমর = উপমান এবং কেশ = উপমান।
সাধারণ ধর্ম: এই যে তুলনা করা হয় এর একটা কারণ থাকে অর্থাৎ একটা তুলনীয় বিষয় থাকে, সেটাকে সাধারণ ধর্ম বলে। যেমনÑ ভ্রমরের ন্যায় কৃষ্ণ কেশ= ভ্রমরকৃষ্ণকেশ। এখানে ভ্রমর = উপমান এবং কেশ = উপমান। এই দুটির সাধারণ ধর্ম হলো কৃষ্ণত্ব। ভ্রমরের রঙ কালো, কেশের (চুলের) রঙ কালো। এই কালোকে উপলক্ষ করেই এই তুলনা।
এটুকু বুঝলে বাকিটা সহজে বোঝা সম্ভব।
উপমান কর্মধারয়: সাধারণ ধর্মবাচক পদের সঙ্গে উপমানবাচক পদের যে সমাস হয় তাকে উপমান কর্মধারয় বলে। যেমনÑ তুষারের ন্যায় শুভ্র= তুষারশুভ্র। [এখানে শুভ্র= সাধারণ ধর্ম এবং তুষার= উপমান।]
উপমিত কর্মধারয়: সাধারণ ধর্মের উল্লেখ না করে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের যে সমাস হয় তাকে উপমিত সমাস বলে। যেমনÑ মুখ চন্দ্রের ন্যায়= চন্দ্রমুখ। [এখানে মুখ= উপমেয়, চন্দ্র = উপমান। সাধারণ ধর্মটি নেই।]
রূপক কর্মধারয়: উপমান ও উপমেয় পদের মধ্যে অভিন্নতা কল্পনা করা হলে রূপক কর্মধারয় সমাস হয়। যেমনÑ বিষাদ রূপ সিন্ধু= বিষাদসিন্ধু। [এখানে বিষাদ= উপমেয় এবং সিন্ধু= উপমান কে একত্রে বিবেচনা করা হয়েছে।]
* আরো কয়েক ধরনের কর্মধারয় সমাস হয়ে থাকে। যেমনÑ অব্যয় যোগে, সংখ্যাবাচক শব্দ যোগে, উপসর্গ যোগে। কিন্তু সেগুলো অল্পসংখ্যক বিধায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয় না।
তৎপুরুষ সমাস
পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায় এবং পরপদের অর্থ প্রধানভাবে বোঝায় এমন সমাসকে তৎপুরুষ সমাস বলে। তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে দ্বিতীয়া থেকে সপ্তমী পর্যন্ত যে কোনো বিভক্তি থাকতে পারে, সেই বিভক্তির নাম অনুসারেই তৎপুরুষ সমাসগুলোর নাম হয়ে থাকে।
তৎপুরুষ সমাস নয় প্রকার। যথাÑ
দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস: পূর্বপদে দ্বিতীয়া বিভক্তি থাকবে এবং তা লোপ পাবে। পরপদের প্রাধান্য থাকবে। যেমনÑ দুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত। [দ্বিতীয়া বিভক্তি ‘কে’ লোপ পেয়েছে এবং প্রাপ্তি কথাটাই এখানে প্রধান।]
* ব্যাপ্তি অর্থে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমনÑ চিরকাল ব্যাপিয়া সুখী= চিরসুখী।
তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস: মন দিয়ে গড়া = মনগড়া, মধু দিয়ে মাখা= মধুমাখা।
* পরপদে ঊন, হীন, শূন্য থাকলে তৃতীয় তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমনÑ বিদ্যা দ্বারা হীন = বিদ্যাহীন।
চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস: গুরুকে ভক্তি =গুরুভক্তি, আরামের জন্য কেদারা= আরামকেদারা।
পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস: খাঁচা থেকে ছাড়া= খাঁচাছাড়া, বিলাত থেকে ফেরত= বিলাতফেরত।
* সাধারণত চ্যুত, আগত, ভীত, গৃহীত, বিরত, মুক্ত, উত্তীর্ণ, পালানো, ভ্রষ্ট ইত্যাদি পরপদের সঙ্গে যুক্ত হলে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমনÑ জেল থেকে মুক্ত = জেলমুক্ত, স্কুল থেকে পালানো= স্কুলপালানো।
ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস: চায়ের বাগান= চা-বাগান, রাজার পুত্র= রাজপুত্র।
* অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ: এক্ষেত্রে বিভক্তি লোপ পায় না। যেমনÑ ঘোড়ার ডিম, মাটির মানুষ ইত্যাদি।
সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস: গাছে পাকা= গাছপাকা, দিবায় নিদ্রা= দিবানিদ্রা।
* কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাসবাক্যের পরপদটি আগে আসে। যেমনÑ পূর্বে ভূত= ভূতপূর্ব।
নঞ্ তৎপুরুষ সমাস: না বাচক নঞ্ অব্যয় (না, নেই, নাই, নয়) পূর্বে বসে যে তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে নঞ্ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমনÑ ন আচার = অনাচার, ন সুর = অসুর।
* খাঁটি বাংলা শব্দের ক্ষেত্রে অ, আ, না কিংবা অনা হয়।
উপপদ তৎপুরুষ সমাস: যে পদের পরবর্তী ক্রিয়ামূলের সঙ্গে কৃৎ-প্রত্যয় যুক্ত হয়, তাকে উপপদ বলে। কৃদন্ত পদের সঙ্গে উপপদের যে সমাস হয় তাকে উপপদ তৎপুরুষ বলে। যেমনÑ জল দেয় যে= জলদ, পঙ্কে জন্মে যা= পঙ্কজ।
অলুক তৎপুরুষ সমাস: যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায় না তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন- গায়ে পড়া= গায়েপড়া, কলের গান= কলেরগান।
বহুব্রীহি সমাস
যে সমাসে সমস্যমান পদগুলোর কোনোটির অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কোনো পদকে বোঝায় তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমনÑ নীল বসন যার = নীলবসনা। এখানে নীল বা বসন কোনটাকেই না বুঝিয়ে নীলবসনাকে বোঝানো হয়েছে।
* বহুব্রীহি সমাসে সাধারণত ব্যাসবাক্যে যার, যাতে ইত্যাদি শব্দ থাকে।
* ‘সহ’ ‘সহিত’ শব্দ থাকলে ‘স’ হয়। যেমনÑ বান্ধবসহ বর্তমান= সবান্ধব।
* পরপদে মাতৃ, পতœী, পুত্র, স্ত্রী থাকলে শব্দগুলোর সঙ্গে ‘ক’ যুক্ত হয়। যেমনÑ নদী মাতা (মাতৃ) যার= নদীমাতৃক।
* ‘অক্ষি’ থাকলে ‘অক্ষ’ এবং ‘নাভি’ থাকলে ‘নাভ’ হয়। যেমনÑ কমলের ন্যায় অক্ষি যার= কমলাক্ষ।
* পরপদে ‘জায়া’ থাকলে ‘জানি’ হয় এবং পূর্বপদ কিছুটা বদলায়। যেমনÑ যুবতী জায়া যার= যুবজানি।
* ‘চূড়া’ থাকলে ‘চূড়’ এবং ‘কর্ম’ থাকলে ‘কর্মা’ হয়। যেমনÑ বিচিত্র কর্ম যার= বিচিত্রকর্মা।
* ‘সমান’ থাকলে ‘স’ বা ‘সহ’ হয়। যেমন- সমান কর্মী যে= সহকর্মী।
* ‘গন্ধ’ থাকলে ‘গন্ধি’ বা ‘গন্ধা’ হয়। যেমনÑ সুগন্ধ যার= সুগন্ধি।
বহুব্রীহি সমাস প্রধানত আট প্রকার। যথাÑ
সমানাধিকরণ বহুব্রীহি: পূর্বপদ বিশেষণ ও পরপর বিশেষ্য হলে তাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমনÑ হত হয়েছে শ্রী যার= হতশ্রী, খোশ মেজাজ যার= খোশমেজাজ।
ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি: পূর্বপদ ও পরপদ কোনটিই যদি বিশেষণ না হয় তবে তাকে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি বলে। যেমনÑ কথা সর্বস্ব যার= কথাসর্বস্ব।
* পরপদ কৃদন্ত বিশেষণ হলেও ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি হয়। যেমনÑ দুই কান কাটা যার= দু কানকাটা।
ব্যতিহার বহুব্রীহি: ক্রিয়ার পারস্পরিক অর্থে যে বহুব্রীহি সমাস হয় তাকে ব্যতিহার বহুব্রীহি বলে। যেমনÑ হাতে হাতে যে যুদ্ধ= হাতাহাতি। [এক্ষেত্রে, পূর্বপদে ‘আ’ এবং পরপদে ‘ই’ যুক্ত হয়।]
নঞ্ বহুব্রীহি: বিশেষ্য পূর্বপদের আগে নঞ্ অব্যয় (না, নেই, নাই, নয়) যোগ করে যে বহুব্রীহি সমাস হয় তাকে নঞ্ বহুব্রীহি বলা হয়। যেমনÑ ন (নাই) জ্ঞান যার= অজ্ঞান। [নঞ্ বহুব্রীহি সমাসে সমস্ত পদটি বিশেষণ হয়।]
মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি: বহুব্রীহি সমাসের ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহৃত বাক্যাংশের কোনো অংশ যদি সমস্তপদে লোপ পায় তবে তাকে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি বলে। যেমনÑ হাতে খড়ি দেয়ার জন্য যে অনুষ্ঠান= হাতেখড়ি।
প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি: যে বহুব্রীহি সমাসের সমস্তপদে আ, এ, ও ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি বলে। যেমনÑ একদিকে চোখ (দৃষ্টি) যার= একচোখা। [এখানে চোখ+আ= চোখা হয়েছে।]
অলুক বহুব্রীহি: যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ ও পরপদের কোনো পরিবর্র্তন হয় না, তাকে অলুক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমনÑ মাথায় পাগড়ি যার= মাথায়পাগড়ি। [অলুক বহুব্রীহি সমাসে সমস্তপদটি বিশেষণ হয়।]
সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি: পূর্বপদ সংখ্যাবাচক, পরপর বিশেষ্য এবং সমস্তপদটি বিশেষণ হলে তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি বলে। যেমনÑ দশ গজ পরিমাণ যার= দশগজি। [এ সমাসে সমস্তপদে আ, ই, ঈ যুক্ত হয়।]
এই প্রধান প্রধান সমাসগুলো ছাড়াও যে অপ্রধান সমাসগুলো রয়েছে। তা নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রাদি সমাস: প্র, প্রতি, অনু ইত্যাদি অব্যয়ের সঙ্গে যদি কৃৎ প্রত্যয় সাধিত বিশেষ্যের সমাস হয় তবে তাকে প্রাদি সমাস বলে। যেমনÑ প্র (প্রকৃষ্ট) যে বচন= প্রবচন। এখানে প্র অব্যয় সঙ্গে বচন (এটি কৃৎ প্রত্যয় সাধিত বিশেষ্য) যুক্ত হয়েছে।
নিত্য সমাস: যে সমাসে সমস্যমান পদগুলো নিত্য সমাসবদ্ধ থাকে, ব্যাসবাক্যের প্রয়োজন হয় না, তাকে নিত্য সমাস বলে।
আলোচনার শেষ দিকে এসে বলতে হয় সমাস পড়ার সময় সাধারণ নিয়মগুলো প্রথমে শিখেই ব্যতিক্রমগুলো ভালো করে লক্ষ করতে হয়। ব্যাকরণের আলোচনার সবগুলো বিষয়েই কিছু ব্যতিক্রম থাকে যা নিয়ম মেনে চলা না, সেগুলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ম তৈরি করেও কিছু কিছু বিষয়কে কোনো নিয়মের আওতায় আনা যায় না। তা সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। ব্যাকরণের ক্ষেত্রে এটা একটা সীমাবদ্ধতা মনে হলেও ভাষার ক্ষেত্রে এটি একটি সৌন্দর্য। পাবলিক সকল ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ব্যাকরণে সমাস অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ। তাই সংক্ষেপে এই আলোচনাটি করা হলো। এবার নিচে সমাস সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হলোÑ
সমাসের রীতি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে কিন্তু কিছু খাঁটি বাংলা অনেক সমাস রয়েছে যা সংস্কৃতের নিয়মে চলে না।
কু যে কর্ম= কুকর্ম এটি অব্যয়বাচক কর্মধারয় সমাস।
এক যে জন= একজন এটি সংখ্যাবাচক কর্মধারয় সমাস।
ভ্রাতার পুত্র= ভ্রাতুষ্পুত্র এটি নিপাতনে সিদ্ধ সমাস।
‘গায়ে পড়া’ যদি অলুক তৎপুরুষ হয় তবে তো ‘গায়ে হলুদ’ও অলুক তৎপুরুষ হওয়ার কথা কিন্তু এটি অলুক বহুব্রীহি কারণ, এখানে ‘গায়ে হলুদ’ গায়ে হলুদ দেয়া বোঝাচ্ছে না বরং গায়ে হলুদ দেয়ার অনুষ্ঠানকে বোঝাচ্ছে।
নিপাতনে সিদ্ধ বহুব্রীহির উদাহরণ হলোÑ দু দিকে অপ যার = দ্বীপ, নরাকারের পশু যে= নরপশু।, জীবিত থেকেও যে মৃত= জীবন্মৃত।
সুব্রত দত্ত
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, সাহিত্যের মজলিশ।
সহকারী শিক্ষক, হায়দরাবাদ আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
বি.এ (অর্নাস), এম.এ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আগস্ট ২৫, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ।
©somewhere in net ltd.