নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিশ্রমকে সঙ্গী করে কত মানুষ উর্ধ্বে গেলো, আকাশের ঐ তারার দলে/ চিরদিনই অলস আমি, আছি পড়ে অনন্তকাল এই ধরনীর গাছের তলে।
একজন ব্যক্তির বেড়ে ওঠার সঙ্গে নিঃসন্দেহে অসংখ্য মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। ব্যক্তির আচার-আচরণ, চলাফেরা, নীতি-আদর্শ, রুচি ও মূল্যবোধ তার চারপাশের পরিবেশ, ব্যক্তিবর্গের সাহচর্যে বিকাশ লাভ করে। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনে বিশেষ বিশেষ কারো উপস্থিতি ব্যাপক রদবদল অথবা নতুন মোড়ে জীবনকে নিয়ে যায়। ব্যক্তি আমার জীবনে তেমনি একজন মানুষ, বন্ধুপ্রতিম বড় ভাই, মোঃ মিজানুর রহমান। বর্তমানে সোনালি ব্যাংক লিমিটেডের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ শাখার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
সময়টা ২০০৭। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পেয়েছি বেশ বড় একটা অবসর। সাহিত্যকে ভালোবাসলেও, টুকটাক গল্প-কবিতা লিখলেও তখনও পাঠ অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। নিজে থেকেই উদ্যোগ নিয়ে পড়া শুরু করি উইলিয়াম শেক্সপীয়র-এর রচনাবলির বাংলা অনুবাদটা। বুঝে না-বুঝে একে একে পড়তে থাকি ম্যাকবেথ, ওথেলো, এ্যাজ ইউ লাইক ইট সহ অনেকগুলো নাটক। তবে বিকেলটা কাটাই বাইরে। আমি যে বাসায় ভাড়া থাকতাম তার পাশেই মনির নামের এক ভাইদের বাসা ছিল। ঐ বাসায় ভাড়া থাকত বন্ধু ইয়াসিররা। বিকেল হলেই সবাই বের হতাম। মনির ভাইদের বাসার সামনের ছোট্ট উঠানে খেলতাম ক্রিকেট। উঠানের পরেই বাউন্ডারি আর বাউন্ডারির পেছনে নীলাচল প্রজেক্টের জায়গা যেখানে সুন্দর একটা দীঘি বসে রয়েছে কত না সুদীর্ঘ সময় ধরে! দীঘির চারপাশে খালি জায়গা, ঠিক মাঠ না সম্ভবত প্লট কিন্তু কোনো কারণে সেখানে বাড়ি নির্মাণ বন্ধ ছিল অনেক অনেক বছর। শুনেছিলাম কোনো একটা মামলা আছে আর দীঘিকে নাকি ভরাট করা যায় না। যতই পানি ওঠানো হোক আবার পানি এসে পড়ত অজানা থেকে। এসব অবশ্য সব শোনা কথা। আমার ভালো লাগত দীঘির পাড়ের চমৎকার রৌদ্র উজ্জ্বল বিকেলগুলো। তবে ক্রিকেট খেলার সময় দীঘিকে খানিকটা অবজ্ঞাতে রেখেই খেলে চলতাম মজা করে। দেখতাম কোনো একটা ছেলে বাউন্ডারি যে অংশটা খানিকটা ভেঙে খাটো হয়ে মনির ভাইদের বাড়ির দিকে হা করে তাকিয়ে রয়েছে তার উপর বসে আমাদের খেলে দেখে প্রতিদিন। বয়সে আমাদের থেকে খানিকটা বড় হবে। কোথায় থাকে, কী পরিচয়- কিছুই জানি না। এই খেলা দেখতে দেখতেই একসময় আমাদের খেলার সাথী হয়ে সে। পরিচয় হয়। মিজান তার নাম। বড় ভাই। সুতরাং মিজান ভাই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়েন। প্রথম ব্যাচের ছাত্র তিনি। ব্যস্ খেলতে খেলতে পরিচয়। তারপর কলেজে ভর্তির পালা আসে। যে যার মতো কলেজে ভর্তি হই। খেলা আপনাতেই যায় বন্ধ হয়ে। ব্যস্ততা বাড়ে। তবু মাঝে মাঝে দীঘির পাড়ে ঘুরতে যাওয়া হয়। অনেকদিন পর একদিন আবার দেখা হয় ভাইয়ের সাথে। ছোট ভাই বিজ্ঞানকে নিয়ে ঘুরছিলেন। কথা হয়। পরিচয়টা এবার ঠিকঠাক মতো হয়। ততদিনে ২০০৮ এসে গেছে, দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। সামনেই এইচএসসি পরীক্ষা। ব্যস্ততা যেনো কমেই না। তবু হঠাৎ হঠাৎ ভাইয়ের সঙ্গে দীঘির পাড়ে কিছুটা সময় কাটে। ভাইয়ের ফোন নম্বর নেই। আমাদের গল্পের টপিক হয়ে ওঠে সাহিত্য। তিনি সাহিত্যের ছাত্র আর আমি সাহিত্যপ্রেমী। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিজ হাতে বই পড়ার রুচি তৈরি করে দেয়। বই পড়ি ভাইয়ের সঙ্গে তা নিয়ে গল্প করি। ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প বলেন। সময়ের প্রবহমানতায় আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে নিজেকে পুরোটা তুলে ধরেন আমার কাছে। অদ্ভুত রকমের মানুষ তিনি। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে, আলাপে মনে হবে অনেকটাই আটপৌরে জীবন তার। বৈষয়িক ব্যাপারে তিনি যেন খুব সচেতন। বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর বিপরীতে কোনো ঐশ্বরিক এমনকি ধর্মীয় প্রসঙ্গেও তার অনাগ্রহ। অথচ ভেতরটায় প্রবেশ করতে পারলে ধীরে ধীরে জানা যাবে কতটা শৈল্পিক তিনি, কতটা কল্পনাচারি তার হৃদয়, কত রোমান্টিক তার ভাবনা! জানি না তার এই অন্তঃসত্তাকে কজন চিনেছে, জেনেছে তবে আমার সৌভাগ্য আমি তাকে পেয়েছি হৃদয়মাঝে। ঘটনাবহুল, বৈচিত্রময় জীবনের অধিকারী এই লোকটা তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা এমন নিখুঁতভাবে গল্পে গল্পে বয়ান করতেন যে আমি টঙ্গীর বনমালা রেললাইন ধরে হেঁটে পৌঁছে যেতাম সিলেট, সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, মধ্যনগর। সত্যি বলতে একবার কেবল অল্পসময়ের জন্য সুনামগঞ্জ যাওয়া হয়েছিল এছাড়া ভাইয়ের বর্ণিত স্থানগুলো দেখাই হয়নি এখনও অথচ ঐ বর্ণনার জাদুতে আমার স্মৃতিপটে স্থানগুলো উজ্জ্বল স্থিরচিত্র হয়ে রয়েছে। প্রকৃতির বর্ণনায় তার পারঙ্গমতা আমাকে বারবার জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দিত। অথচ দুঃখের কথা ভাই এখনও উপন্যাস লেখা শুরু করেননি। চরিত্র চিত্রণেও তার পারদর্শিতা অতুলনীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার বর্ণনা, স্নেহময়ী মায়ের বর্ণনা এবং জীবন কাহিনি, সহপাঠিনীর প্রতি মুগ্ধতার, অনুভূতির ব্যাখ্যা তিনি এতই চমৎকারভাবে দিতেন যে আমাদের বিকেলে দীঘির পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনে পৌঁছানোর আগেই রচিত হয়ে যেত চমৎকার সব উপন্যাস। ভাই বলেছিলেন ‘পুতুলের বিয়ে’ নামে একটা উপন্যাস লিখবেন। আশা করি সে ভাবনা থেকে তিনি সরে যাননি এখনো। আমার জীবন বৈচিত্র্যহীন। তবু আমার কথাও তিনি শুনতেন মন দিয়ে। আমার জীবন দর্শন, সাহিত্য-ভাবনা এবং হৃদয়ের গোপনসব কথাগুলো আমি অকপটে তাকে বলে দিতাম। ততদিনে ঈশ্বরে কৃপায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে সাহিত্যের ছাত্র হয়ে উঠেছি। দু’জনের পরিচয়ে একটা মিল এসেছে তখন। এমনিতে আমাদের মধ্যে ফারাকটাই বেশি।
২০১৪ পর্যন্ত জীবনের একটা বড় সময়ে এবং বিশেষত তাৎপর্যময় সময়ে ভাইকে সবসময় পাশে পেয়েছি। আমরা ঘুরতে যেতাম হায়দরাবাদ হয়ে অজানা সব গ্রামগুলোতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটতাম রেললাইন ধরে আবার কখনো গ্রামের পথ ধরে। কখনো কখনো আমরা পশ্চিমে যেতাম। মানে দত্তপাড়ার বিপরীতে কলেজগেটের রোড ধরে দেওড়া কিংবা অমন কোনো এলাকায়। যেতে যেতে খুঁজতাম গ্রামকে। আমরা দুজনেই অসম্ভবভাবে গ্রামকে ভালোবাসি। নদীর তীরে বসতে কিংবা কোনো গাছের ছায়ায় শরীর এলিয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে গল্প করতে আমাদের পরম শান্তি লাগে। রমযানের দিনগুলো আমরা দুজনে মিলে দীঘির পাড়ে বসে ইফতার করতাম। সন্ধ্যার ঐ চমৎকার সময় ও অমন একজন মানুষের সান্নিধ্য আমাকে ভেতর থেকে রোমান্টিক করে তুলত।
জীবন কখনোই একই লয়ে, একই তালে, একই স্থানে আটকে থাকে না। সেটা থাকাও উচিত না। জীবনে মিলনের যেমন তাৎপর্য আছে, বিচ্ছেদও তেমন জরুরি। জীবনে পাওয়ার হিসেব কষে কতটা সুখী বা অসুখী, তা নির্ণয় করাটা বোকামি। জীবনে না-পাওয়াটাও বড় পাওয়া হয়ে উঠতে পারে। বিচ্ছেদ-বেদনা আর না-পাওয়ার যন্ত্রণাও জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। মিজান ভাইয়ের চাকরি হয়। একটা চাকরি জন্য তখন তার ব্যাকুল অবস্থা। সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতি আমাদের মতো মধ্যবিত্তের জীবনে। পোস্টিং হয় সিলেটে। ভাইকে বিদায় জানাতে হয়। ভাইয়ের বিয়েটাও হয়ে যায়। আমার শেষ হয় অনার্স। চাকরির অফার পেতেই লুফে নেই। কর্মজীবনের সূচনা হয় ২০১৫-এর একেবারে শুরুতেই। ব্যস্ আমাদের দুজনার জীবনের বড় একটা মোড় বদল আসে। তারপর কিছুতেই আর সেটাকে আগের মতো করে ওঠা হয় না। ভাইয়ের পোস্টিং বদলে ঢাকায় হয়। উত্তরার এয়ারপোর্ট শাখায় কাজ করেন অনেক দিন। কিন্তু দেখা করতে যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয় না। তা-ও ২০১৯-এ একদিন ম্যানেজ করে ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাই তার-ই কর্মক্ষেত্রে। আগেকার চিরচেনা সেই মিজান ভাই। বন্ধুপ্রতিম বড় ভাই আমার। এখন ২০২০। ফোনে অনেক দিন পর পর একটু কথা হয় যা। এখনও বিশ্বাস করি একদিন সুযোগ হবে। আমাদের অবসর হবে আর আমরা আমাদের ঐ গল্পের দুনিয়াতে আবার যেতে পারবো। ততদিনে ভাইও লিখে ফেলবেন উপন্যাস, গল্প আর কিছু অনবদ্য কবিতা।
ভাইয়ের কয়েকটা কবিতা আজও মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। উপন্যাসের প্লটগুলো মনে গেঁথে আছে। মাঝেমাঝে মনে হয় আমিই লিখতে বসি। তবে যার উপন্যাস জগতে তাকেই সেটা লিখতে হয়। আশা করি তিনি লিখবেন। এই ব্যক্তিও এক নিভৃতচারী মানুষ। নিজেকে সামনে আনতেই চান না। নিজের সাহিত্য ভাবনা, জীবন-দর্শন নিয়ে হুটহাট গল্প শুরু করেন না। সঙ্গোপনে রেখে দেন।
ভাই আমার একটা নাম দিয়েছিলেন। আমারও একটা দেওয়ার কথা ছিল। আমি দিতে পারিনি। তিনি দিয়েছেন। তার বাসার সবাই আমাকে সে নামেই ডাকে। নামটা খুব কমন কিন্তু ভাইয়ের বর্ণনায় সেটা আমার জন্য অতুলনীয় হয়ে উঠেছে। আমি নামটা অন্যত্র ব্যবহার করি না। লেখায় কিংবা কোথাও দেই না। ওটা কেবল মিজান ভাইয়ের জন্য বরাদ্দ। উনি আমাকে যতটা গভীরে নিয়েছেন আমি ততটা গভীরের কিনা জানি না। এখন যদি ফোন করি কিংবা তার বাসায় যাই আমি সিওর সবাই আমাকে ‘প্রশান্ত’ বলেই ডাকবে।
ভাইয়ের জন্য, ভাইয়ের নিভৃত সাহিত্য চর্চার জন্য, ভাইয়ের পরিবার এবং ফুটফুটে মেয়ের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা জানাই।
সুব্রত দত্ত
উত্তরখান, উত্তরা, ঢাকা
জুন ২৬, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।
০২ রা ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৪৫
সুব্রত দত্ত বলেছেন: আচ্ছা। ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৪
রাজীব নুর বলেছেন: ওকে।
জানলাম।