![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আসরের নামাজের পর বসেছি জ্যাঠার সাথে। আমাদের গ্রামের মসজিদে। এই কদিন আগে টিনের ঘর ছিল। এখন ছাদ-ঢালাই পাকা বিল্ডিং, ফ্লোর আর দেয়াল টাইলস করা।
জ্যাঠা তাবলিগের একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন।
"ময়মনসিং ছিলাম, চিল্লার জামাতে। পরথম দিন ওইহানের এক সাথীর সাথে পরিচয় অইলো। আনিসুজ্জামান। সে কয়, তার এক ভিন ধর্মের বন্দু আচে। আমগোরে এক জামাত গিয়া যেন দাওয়াত দেই।
সেই সাথী কইলো, ভিন ধর্মের বন্ধু লোক খুব ভাল। শহরের পোলাপানদের কুংফু শিকায়। আত্মরক্ষার্থে আর কি। ব্যাপক নাম ডাক। হ্যারে দাওয়াত দিতে অইবো। হেদায়েত আল্লাহর হাতে।
পরদিন ফজরের ওয়াক্তে সেই সাথী আসছে, খুব মন খারাপ। সে আমার কাচে আইসা কয়, তার হেই ভিন-জাতি বন্ধু আত্মহত্যা করছে গত রাইতে। আজ তার ধর্মমতে শেষ-কৃত্য অইবো। এইডা শুইনা আমরা সকলেই চকচন্দা হয়া গেলাম। দ্বীনের দাওয়াতটা পৌঁছাইতে পারলাম না। আফসোস নাগলো।"
জ্যাঠা বসে ছিলেন নামাজের ভঙ্গিতে। এবার যোগ ব্যায়ামের মত বসে নিলেন। তারপর বলা শুরু করলেন, " দেহো অবাক কান্ড। একটা মানুষ, যে কিনা অন্যগোরে আত্মরক্ষা শিখায়। কারাতে কুংফু শিখায়। সে নিশ্চই নিজেও দক্ষ। একাই হয়তো দশ বারো জনরে শোয়ায়া দিবার পারে। অথচ, লোকটো নিজেই নিজেহে মাইরা ফালাইলো! অন্যের হাত থিকা কিবা কইরা বাঁচা নাগে, এইডো সারাজীবন শিখাইচে। কিন্তু নিজের হাত থিকা নিজে কিবা কইরা বাচপো, এই জ্ঞানডাই তার শেখা অয় নাই!"
আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম। জ্যাঠা আসলে কোন প্রসঙ্গ থেকে কীসে গিয়ে ঠেকে, এটা আগে থেকে অনুমান করা যায় না। আসলেই তো। একটা লোক, এত মানুষকে আত্মরক্ষা শিখাচ্ছে, অথচ, নিজেই এদিকে নিজেকে মেরে ফেললো! সবথেকে ভয়ংকর তো তাহলে নিজের থেকে নিজে সেইফ থাকা। অন্যের ক্ষতি থেকে বাচা যায় হয়তো, কিন্তু নিজেই নিজের হন্তারক হয়ে উঠলে কে বাচাবে?
"দুনিয়া জুইড়া এই যে আত্মহত্যা বাড়তিচে, ক্যান? দুনিয়ার সব জায়গায় কওয়া হয়, এইডা শিখো, এই জ্ঞান নেও, তুমি আগাই যাবা, অপ্রতিরোধ্য হবা। কিন্তু, নিজের কাছে? এইখানেই তো ধরা!"
"ইসলামে এর প্রতিকার কী জ্যাটা? আমরা তো জানি আত্মহত্যা মহাপাপ, সরাসরি জাহান্নাম। আর কি কিছু নাই?"
"নাই মানে? তুমি কোরান হাদিস চইসা দেখো। আল্লাহ ও রাসুল (সা) যত দুয়া আমাগোরে শিখায়া দিয়া গেছেন, সব নিজের জন্যে দুয়া। এবংকি বাপ-মারে নিয়া দুয়া আছে দুইডা তিনডা। এছাড়া, আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব, সমাজ দেশ দুনিয়ার এই সবকিচুরে নিয়াও এতো দুয়া নাই, যতো আছে খালি নিজেরে নিয়া।"
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। রাব্বানা আতি না ফিদ্দুনিয়া... হে আল্লাহ, আমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে রক্ষা কর।
রাব্বানা জালামনা আন ফুসানা...
আমি নিজের উপর অনেক অবিচার করেছি, আমাকে ক্ষমা করো।
তাই তো। যত দুয়া জানি, মনে করার চেষ্টা করলাম অর্থসহ। সব নিজের জন্য। আশ্চর্য!
জ্যাঠা নিজেও বিড়বিড় করলেন, রাব্বানা জালাম না আনফুসানা...
"নিজের উপর জুলুম। বাবা রে। এইডো খুব মারাত্মক জিনিস। নিজের উপর জুলুম করা যাইবো না।"
"জ্যাঠা একটু ভেঙেচুরে বলেন। বোঝার চেষ্টা করি।"
"হোনো মিয়া। তুমি যদি জান্নাতে যাও, কার সওয়াবের জন্য যাইবা? অন্যের আমল করা না নিজের?"
"অবশ্যই নিজের।"
"আর জাহান্নামে গেলি?"
"হেইডোই নিজের আকাম কুকামের জন্য।"
"তাইলে দেহো। নিজের ভাল কর্মের জন্যে জান্নাত, নিজের খারাপ কর্মের জন্যে জাহান্নাম। তোমার জাহান্নামে অন্য কেউ না, তোমাহেই যাওয়া নাগবো!"
"জ্যাটা, নিজের উপর জুলমের ব্যাপারটা?" আমি মনে করিয়ে দিলাম। জ্যাঠা খুব আবেগপ্রবণ হয়েছেন। তার চেহারার দিকে তাকালে, শান্তি শান্তি কাজ করে। কেমন আল্লাহওলা মানুষ।
"জুলম হইলো গিয়া অবিচার। অন্যের উপর জুলম। অন্যের ক্ষতি করলা, অন্যরে কষ্ট দিলা। গুনা অইবো। কিন্তুক নিজের উপর জুলম? খেয়াল কইরো, আমরা যারা জুলমের ব্যাপারে সতর্ক, তারা কেবল অন্যের উপর জুলমের ব্যাপারেই সতর্ক। কারো পাচ মিনিট নষ্ট কইরা কই, সরি ভাইজান। কিন্তুক নিজে ঘন্টার পর ঘন্টা বেহুদা কামে নষ্ট কইরা কি নিজেহে কই, 'সরি?' এর মানে অইলো,
অন্যের উপর জুলমের ব্যাপারে যতটা না আমরা শংকিত, নিজের ব্যাপারে ততোটাই উদাস! কেন?"
"এর মানে কি জ্যাটা, নিজের হক আগে?"
"এই যে আসল কতা কইচাও। নিজের হক। নিজের উপর যে নিজের হক আছে এইডো আমরা অনেকেই জানি না।"
আমি বললাম, "একটা হাদিস শুনছিলাম যে,
তোমার শরীরের তোমার উপর হক আছে, তোমার চোখের তোমার উপর হক আছে, আর তোমার স্ত্রীর তোমার উপর হক আছে।
মানে, শরীরকে অযথা কষ্ট দেওয়া, যথাযথ খাবার–পোশাক থেকে বঞ্চিত করা ঠিক না।"
"হ, সুন্দর কতা কইচাও। এক সাহাবী সব সম্পদ দান করে দিতে চাইলে রাসুল (সা) কইলেন, “তুমি যা নিজের উপর খরচ করো, সেটাই তোমার জন্য সর্বোত্তম সদকা।”
" মানে, সবকিছুর আগে নিজেরে প্রাধান্য দেয়া নাগবো?"
"তা তো অবশ্যই। হাশরের দিন আল্লাহ বান্দার অন্যের হকের আগে এই নিজের হকের জন্যই আগে ধরবো। আর এই হক এতো সূক্ষ্ম যে নিজের 'নফসে লাওয়ামা'হে কষ্ট দেয়াও ঠিক না।"
"নফসে লাওয়ামা?"
"কোরান-হাদিস থিকা তিন রকমের নফসের কতা পাওয়া যায়৷ নফসে লাওয়ামা হইলো, যে নফস ভুল করলে অনুতপ্ত হয়, নিজেকে দোষারোপ করে। তোমার কি এমন মনে হইচে, এই জামাডো না কিনা আর কয় ট্যাহা বেশি দিয়া অন্য আর একটো জামা কিনতে মন চাইছে, কিন্তুক তুমি কম দামিডোই কনচাও?"
আমি যে পাঞ্জাবি পরে ছিলাম, এটা কেনার সময় আর একটি পছন্দ হয়েছিল। দুইশত টাকার কমবেশির জন্য এইটি নিয়েছি। সেটা জ্যাঠাকে বললাম।
জ্যাঠা বললেন, "তোমার সামর্থ্য আছিলো। তাও তুমি বেশি ভাল লাগাডো নাও নাই। এতেও নিজের নফস হে কষ্ট দেয়া হইচে। হয়তো তোমার মনে এহুনো খুত খুত করে। এইযে খুত খুত— এইডোই নফসে লাওয়ামা'হে কষ্ট দেওয়া। এইডো পাপ না অইলিও, এই কষ্ট দেয়া ঠিক না।"
এতো সূক্ষ্ম কষ্টের কথা চিন্তা করেই কেমন জানি লাগলো। বিষয়টি এভাবে তো ভেবে দেখি নি। ইসলামে এত সূক্ষ্ম অনুভুতিকেও মূল্যায়ন করা হয়েছে?
জ্যাঠা আরবিতে বিড়বিড় করছেন, বোধহয় কোরানের কোন আয়াত। তারপর জোরে বাংলায় বললেন, "কে হারাম করেছে আল্লাহর সে সৌন্দর্যকে যা তিনি বান্দাদের জন্য বের করেছেন এবং পবিত্র রিজিককে?”
আমরা কি করি, নিজেই নিজের উপর পুলিশগিরি করি। এই হালাল খাবারডো খাইলে সমস্যা নাই, আমরা ভাবি, না না, আমি খামু? আমার পরিবার তো পাইলো না। একটো ভাল জামা। না না। এইডো কেনা যাইবো না। আমার বেশি আনন্দিত হওয়া যাইবো না। অথচ, ইসলামে তা বৈধ। পরিবার বা অন্য কারো উপরেও বেইনসাফি অইবো না। তাও আমরা নিজের জন্য অইডো করবার চাই না। বঞ্চিত করি নিজের হালাল খায়েসরে।"
"এইডো আবার আত্মকেন্দ্রিক হইয়া যাইবো না জ্যাটা? স্বার্থপরতা?"
জ্যাঠা প্রায় চিৎকার করে বললেন, "স্বার্থপর কাক কয়? নিজের হক আদায় করা স্বার্থপরতা? তুমি ত মিয়া সীমার মদ্যেই আচাও। এইডোরে কয় নিজের প্রতি ইনসাফ করা। নিজেরে ভালবাসা!"
আমি কিছু বলতে গেলাম, জ্যাঠা একটু থেমে বলে চললেন, "সবার আগে নিজেহে ভালবাসো। যে নিজেহে ভালবাসে, তার কাছে সবাই ভালবাসা পায়। আমরা কি করি। বেবাক মানুষেক ভালবাসি। বাপ-মা, ভাইবোন, স্ত্রী সন্তান— সবাইরে। কিন্তু নিজের কতাই ভুইলা যাই।"
গৌতম বুদ্ধের একটি উক্তির কথা মনে পড়লো, 'এই পৃথিবীতে তোমার ভালবাসা পাওয়ার সবথেকে বড় দাবিদার, তুমি নিজে।'
আমি জ্যাঠাকে এটা বললাম না। জ্যাঠা বলেই চললেন, "নিজেহে বঞ্চিত করতি করতি, নফসে লাওয়ামা বিদ্রোহ কইরা বসে। একদিন কাঠগড়ায় দাড় করায়। কী পাইলাম সারা জীবন? খালি অন্যের জন্যে কইরা গেলাম। তহুন যদি সময় আরো খারাপ যায়, এই নিজের প্রতি বঞ্চনা, নিজের প্রতি ঘেন্না তৈরি করে। মানুষ দিনকে দিন, মানসিকভাবে ভাইঙ্গা পড়ে। এমনকি আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিয়া ফালায়। তাইলে দেহো, ব্যাপার কোনে যাইয়া থামে। এই জন্যে আল্লাহ, হাশরের দিনে এই নিজের হক নিয়াই আগে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।"
মুয়াজ্জিন মোসলেম দাদা এসে মসজিদে ঢুকলেন। সালাম দিয়ে আমাদের পাশে এসে বসলেন। মাগরিবের আজানের সময় আর অল্প কিছু বাকি। মোসলেম দাদা দীর্ঘদিন আজান দেন, আবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ান। নির্দিষ্ট ইমাম নেই এই মসজিদে। অথচ, কাচা মসজিদ পাকা, টাইলস হয়ে গেল। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে মানুষও হয় চার পাঁচ জন।
জ্যাঠা উঠতে যাচ্ছিলেন। বোধহয় অজু করবেন। আমি শেষ প্রশ্নটি করে জ্যাঠাকে থামালাম। "নিজের যত্ন নেয়ার ব্যাপারটা একটু যদি কইতা জ্যাঠা?"
জ্যাঠা একটু থামলেন। তারপর বললেন, "নিজেরে ভালবাসা মানে নিজের খেয়াল রাহা। কিবা কইরা? নিজের শরীর স্বাস্থ্য, নিজের মন সবসময় আগে আসপো। আগে নিজে ভাল থাকা নাগবো৷ একটো যুবক, তোমার মতো, বিকেলে হয়তো খেলে, শরীরচর্চা করে। এইডো ভাল কাম। ঐ যুবক নিজের যত্ন নিতিছে। কোন মাইয়া, নিজেরে সুন্দর দেহানোর জন্য রূপচর্চা করতিচে। নন-মাহরাম পুরুষরে দেহানো পাপ। কিন্তু, হে যদি নিজের মনের খায়েশের জন্য রূপচর্চা করে, হেইডোও এই নিজের যত্নের মধ্যে পড়বো। একি রহম, কেউ তাহাজ্জুদ বেশি কইরা পড়ে, রোজা রাহে, কোরান পড়ে, দোয়া দরুদ পড়ে। এইগুলো আবার মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাহে।
নিজের যত্ন নিবার যাইয়া, কহুনও মনে করবা না যে, আমি তো এই সময়ডো, এই পয়সাডো পরিবারের জন্য দিবার পারলাম নি। এইডো শয়তানের প্ররোচনা। তুমি মিয়া যহুন নিজের যত্ন নেও, তুমি আসলে পরিবারের জন্যেই তা করতিচাও। তুমি ভাল থাকলি, তাইলেই না তোমার পরিবারের জন্য ভাল কিচু করবা। তুমি ভাল না থাকলি, কারো উপকারেই আসপা না।
এই জন্যে, সবার আগে নিজেরে ভাল রাহা নাগবো। তুমি নিজের শরীর মনের যত্ন হিসেবেই দেকপা, তোমার বাপ মায়ের ভাল থাকাডো নিশ্চিত করবার চাইবা। তোমার আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করবার চাইবা। এইডো নিজের মনের শান্তির জন্যেই চাইবা।"
"এর মানে কি জ্যাটা, আমরা অন্যের জন্যে যা করি, সেইডাও আসলে নিজের ভালোর জন্যেই?"
"আ, হা..." সুন্দর কইচাও। আসলে আমরা অন্যের জন্য যেডো করি, ঘুইরা ফিরা আসলে তা নিজের ভাল থাকার জন্যেই করি। এর মানে অইলো, তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত ভাল থাকপা, যতক্ষন অন্যের ভাল থাকা নিশ্চিত করবা। নিজেহে ভালবাসা, নিজের যত্ন নেয়া তাই স্বার্থপরতা না, আত্মকেন্দ্রিকতা না। আত্মসচেতনতা।"
মোসলেম দাদা কখন উঠে গেছেন। আজানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জ্যাঠাও উঠে পড়লেন। এস্তেঞ্জার কাজ সারবেন হয়তো।
আমি বসে বসে ভাবছি, জগৎ বিখ্যাতরা কেন সব সময় বলেন, আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই। নিজেকে কেন মানুষ খুঁজে ফেরে? কারণ, নিজেকে ভালবাসাটাই সহজাত? আবার সক্রেটিস বলেছেন, নিজেকে জানো, নো দাইসেল্ফ। এই নিজেকে জানার মানে কি তাহলে নিজের ব্যাপারেই সচেতন হওয়া? নিজেকে ভালবাসা?"
এই সিরিজের অন্য লেখাগুলোর লিংক। চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।
২. যুক্তি ও বিশ্বাস
https://www.somewhereinblog.net/blog/SHADHIN09/30381545
১. ইলম কী
https://www.somewhereinblog.net/blog/SHADHIN09/30381289
২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:০৩
স্বাধীন আকন্দ বলেছেন: আত্মসচেতনা বলাই মনে হয় সুন্দর। স্বার্থপররা কখনো অন্যের কথা চিন্তা করে না।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৪৮
অদ্ভুত অবাক বলেছেন: ভালো লাগলো পড়তে, অনেক কিছু জানলাম। একটা সময় বন্ধুদের বলতাম আমরা সবাই স্বার্থপর কিন্তু সব স্বার্থপরতাই খারাপ নয়।