নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, গ্রন্থকার, ফোটোগ্রাফার, কবি, আবৃত্তিকার, যুক্তিবাদী মানবতাবাদী আন্দোলনকর্মী
"লালন ফকির"
১৭৭৪ - ১৭/১০/১৮৯০;
লালন আদপে "অজ্ঞেয়বাদী"। ভারতবর্ষের প্রথম মহাত্মা উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তিনি প্রথাগত পড়াশুনা করেননি। তবু, ভাবলেন ও রচনা করলেন>>>
"যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে,
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।"
এটি লালনের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয়। ভেদাভেদহীন সমাজগঠনের পক্ষে সঙ্গীতময় প্রচার। ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক, পরজন্ম মার্কা মতবাদের প্রতি চপেটাঘাতের অপর একটি উল্লেখযোগ্য গান>>>
"এসব দেখি কানার হাট বাজার,
বেদ বিধির 'পর শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার।
এক কানা কয় আর কানারে
চল এবার ভবনদীর পারে ,
নিজে কানা পথ চেনে না পরকে ডাকে বারংবার।
পণ্ডিত কানা অহংকারে
মাতবর কানা চোগলখোরে,
পণ্ডিত কানা অহংকারে
সাধু কানা আন-বিচারে,
আন্দাজে এক খুঁটি গাড়ে
জানে না সীমানা তার।
এসব দেখি কানার হাট বাজার।"
.
#লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :
“লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈনধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন; আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।" রবিঠাকুর লালনের অনুপ্রেরণায় ১৫০টি গান রচনা করেন।
.
লালনকে নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। ১৯৬৩-তে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়া গ্রামে লালনের আখড়া বাড়ি ঘিরে "লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র" প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ১৯৭৮ সালে "শিল্পকলা একাদেমী"র অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় "লালন একাদেমী"। এখানে "লালন উত্সব" করা হয় প্রতি ১৭ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুদিনের স্মরণে হাজার হাজার বাউল এবং লালন অনুগামী সম্মিলিত হয়। পাঁচদিন ধ'রে চলে সঙ্গীতময় উত্সব ও মেলা। এবারে হচ্ছে ১২৬তম "লালন উত্সব"। সঙ্গের ছবিটি তাঁর জীবদ্দশায় আঁকা একমাত্র প্রতিকৃতি। পেন্সিল স্কেচটি শিলাইদহে পদ্মার হাউসবোটে এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ৫ মে, ১৮৮৯-তে। এটি বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘরে রক্ষিত।
.
লালন যুক্তিবাদী ছিলেন না। তাঁর বেশকিছু গানে মানবতার কথা পাওয়া যায়। যদিও তাঁর বহু গান দ্বর্থবোধক। যা বাউল মতবাদের অনুসারী। যেমন>>>
"খাঁচার ভিতর অচীনপাখি কেমনে আসে যায়,
তারে ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম পাখির পায়ে।"
বা,
"শুনি, মরলে পাব বেহেস্তখানা,
তা শুনে তো মন না,
বাকির লোভে নগদ পাওনা কে ছাড়ে এই ভূবনে।"
--- এটাই বাউলের বৈশিষ্ট্য; যা দেহতত্ত্ব। "যাহা দেখো ব্রহ্মাণ্ডে, তাহাই আছে দেহভাণ্ডে।" এটা যুক্তিসম্মত নয়; বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ, মহাবিশ্বের সমস্ত ধরনের পদার্থ মানবদেহে নেই। কিন্তু এই মতটি অন্য সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। অনেকটা বস্তুবাদী।
আত্মা-পরমাত্মার মিলনের সহজ সরল পদ্ধতির কথাই বাউলতত্ত্ব। যৌনমিলনে আট কুঠুরি অর্থাত্ যোগ ও তন্ত্রের সহস্রদল পদ্ম ফুটে জ্ঞানার্জনের তত্ত্ব; তথা দেহতত্ত্ব। এই জ্ঞানই আত্মা-পরমাত্মার মিলন। তবে, এতে তন্ত্র ও যোগের মতো লুকোছাপা ভণ্ডামী নেই। সহজ সরল স্বাভাবিক আবেদনে তত্ত্বটি বলা। কারণ, সহজযান> সহজিয়া থেকেই বাউল। এতে দেহতাত্ত্বিক সাধনাই মুখ্য। অর্থাত্ স্বাধীন দুটো বিপরীত সত্ত্বার যৌনমিলনই সাধনার মুখ্য অঙ্গ। নারী-পুরুষ মিলন ছাড়া বাউলের জীবন যাপিত হয় না। একতারার জীবন দোতারায় বাজাতেই হবে। এজন্য গানে দুটি অর্থ থাকে। একটি গূঢ়তত্ত্ব, ইঙ্গিতময়; অপরটি সহজ আটপৌরে ব্যাখ্যা। এমন দ্বর্থবোধক গান>>>
"মিলন হবে কতদিনে,
আমার মনের মানুষের সনে।"
বা,
"আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা,
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা,
তার ওপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।"
--- এসবে গূঢ়ার্থে আত্মাতত্ত্ব এবং লঘু অর্থে প্রেম-সমাজ ও দেহতত্ত্ব।
.
বাউলের জীবনযাপন সহজ সরল সঙ্গীতময় জীবন। জীবনবোধ সঙ্গীতে প্রকাশ। উন্মুক্ত স্বাধীন যৌথজীবন। সঙ্গী-সঙ্গীনী নির্বাচন ও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আধুনিক নিয়ম। কেউ কারোর ওপর নির্ভরশীল হয় না; অধিকারও বর্তায় না। সম্পূর্ণ স্বাধীন দুটো সত্ত্বার ইচ্ছা ভিত্তিক মন ও শরীরের মিলন এবং যৌথজীবন যাপন চলে। কখনো না পোষালে হিংসাহীন বিচ্ছেদ এবং তা আপোস মীমাংসায় হয়। আবার নতুন সঙ্গী-সঙ্গীনীর সঙ্গে যৌথজীবন শুরু করে। যৌথজীবন বাধ্যতামূলক। এটি বৈজ্ঞানিক জীবনযাপন। এটি আধুনিক, মানবিক এবং আগামীর সমাজের অঙ্গ।
.
সামগ্রিক বিচারে লালন ফকির ঐশ্বরীক শক্তি বা আত্মা-পরমাত্মা তত্ত্বের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদী। কখনো স্থিরভাবে অবিশ্বাস করেননি এবং বিশ্বাসও করেননি। 'স্রষ্টা আছেন, তবে তাঁর পরিচয় লালন ফকির জানেন না। যেদিন জানা যাবে, সেদিনই মিলন হবে। এই মিলনের লক্ষ্যেই সাধনা'। হয়ত মৃত্যুই সেই মিলন ও প্রাপ্তি! এই হলো লালনের মতবাদ।
এখানেই রবিঠাকুরের "মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান"; মিল পাওয়া যায়। এটা অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বোধ।
তবে, তিনি ধর্ম সংক্রান্ত কূটকচালিতে না গিয়ে ধর্মবেত্তাদের প্রতি বহু সহজ প্রশ্ন গানের মাধ্যমে করেছেন। যা আবার বাউলের স্বভাবসিদ্ধ দ্বর্থবোধকও>>>
"সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিম্বা আসায় বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কার রে।"
--- এই যাওয়া আসাটা গূঢ়ার্থে জন্ম-মৃত্যু এবং লঘু অর্থে যৌনমিলনে জাতভেদের প্রতি প্রশ্ন।
.
তবে, তাঁর কাছে মানুষ ও সমাজ ছিল মুখ্য। তিনি ধর্ম বর্ণ জাতপাতের ভেদাভেদহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা করেছেন; যা খানিকটা চৈতন্যদেবের "অচিন্ত্যভেদাভেদ" মতবাদের অনুসারী; তফাত্ কৃষ্ণে।
.
লালনের সব নয়, মাত্র দু-একটি গানকেই যুক্তিবাদী মানবতাবাদীরা স্বাগত জানাতে পারে; যেগুলোতে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী আছে।
@
#শমীন্দ্রঘোষ
১৭/১০/১৬
©somewhere in net ltd.