![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আসুন সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলি
অণুগল্প .....এক জোনাকী দুই জোনাকী
..............শাহজাহান পারভেজ রনি।
আমার বাবা। সকাল বেলায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে হাত মুখ ধুইয়ে দিত । কাজে বেরোনোর আগে নাস্তা তৈরি করে নিজ হাতে খাওয়াতো। আমি যখন ছোট এই ধরুন ৩/৪বছরের, মা আমার চলে গেল,বুঝিনি হঠাৎকরে কোথায় গিয়েছিল সে! জিজ্ঞেস করলে ,বাবাটাও কেমন জানি অন্য মনস্ক হয়ে যেত, বলতো -- ভেবোনা মা মণি তোমার জন্য জামা কিনতে গেছে, লাল টুকটুকে।আশায় থাকি, কখনোও সদর দরজায় কখনো ব্যালকনির টেরাকোটা টবের পাশটায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়, বিকেল গড়িয়ে রাত মা আসেনা। আকুল ব্যাকুল মনে বাবাকে আবারো জিজ্ঞেস করতাম, বাবা মা'মনি এখনো বুঝি গাড়ি পায়নি কি বলো! সেদিন সত্যিই বুঝিনি,ফিরতি গাড়িটা আার কখনোই পাবেনা মা আমার! মা'মণি আমার কখনোই ফিরবে না আর।ঘুমোতে গেলে ছোট্ট বিছানাটায় বাবার পাশে তবুও মা'কে খুঁজতাম। কেবলই খুঁজতাম।
সেই থেকে বাবাটা-ই আমার সব। বিরক্ত করে, নানারকম আবদার করে তাকে তটস্থ রাখতাম । মাঝে মধ্যে রেগেও যেত। তবে সোহাগের বেলায় কখনো কমতি ছিল না তার। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মা'কে আমি নির্ঘাৎ ভুলেই যেতাম যদিনা বাবা আমায় মনে করিয়ে না দিতেন। অন্যভাবে বললে- মা' কে আমি বাবার কাছ থেকেই শিখেছি বুদ্ধির পর।
এখন আমার ৩০।একটা বেসরকারী অফিসে কাজ করছি।ছুটি করে ফিরতে প্রায়শ:ই দেরী হয়। ফিরেই দেখি বাবা আমার বসেই আছে, না খেয়ে। আমাদের দু'জনের অভ্যেসটা এভাবেই দাঁড়িয়ে গেছে। কেউ কাউকে ছেড়ে মুখে খাবার তুলতে পারিনা। একারণে অফিসে বসে লাঞ্চ করা হয়না খুব একটা । ইচ্ছাতেই। এই ক'দিন আগেও বাবা ভাত মাখিয়ে না দিলে, মুখে তুলে না দিলে খাওয়া হতো না । বাবাও সব মেনে নিতেন।নির্বাক্যে।আমার মা নেই বলেই হয়তো অমনটা করতেন! বাবা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমার সবকিছুই তাকে বলা যায়। তার সংগে সবকিছুই শেয়ার করা যায়। তাছাড়া কাকে-ই বা বলবো সুখ দু:খগুলো? উনি ছাড়া আমার কেউ নেই যে আর! আমার বাবা আমার কাছে পৃথিবীর শ্র্রেষ্ঠ বাবা, শ্রেষ্ঠ মানুষ।
ঘটনার দিন সকাল বেলায় বাসা থেকে যখন বের হই গেটে ধাক্কা খেলাম। বাবা পেছন থেকে বলল,সামলে মা সামলে। যেতেই বাধা পড়লো। না হয় একটু বসে যা! আমি হাসতে হাসতে গেটের বাইরে পা বাড়াতেই বাবা আবার বলে উঠল---মা রে!একটু দেখে শুনে যাস, চারদিকে যা শুরু হয়েছে! আর হ্যা তোর মা'কে রাতে স্বপ্নে দেখেছি।প্রাণটা কেমন করছে। ভাবছি আজ একবার দেখে আসবো ওকে।
বাবার শেষ কথাগুলো মনে পড়ে যাওয়ায় অফিস পৌছে অস্থির লাগছিল, কাজে কম্মে মনসংযোগ করতে পারছিলাম না। সব দেখে বুঝে পাশের টেবিলের ওসমান ভাই ,বয়স্ক মানুষ; প্রশ্নটা করেই বসলেন, ম্যাডাম কোন সমস্যা?
মৃদু হাসিতে এড়িয়ে গেলাম ওসমান ভাই'কে।
দুপুর দু'টোর দিকে আন নউন নাম্বার একটা থেকে ফোন এলো। অপরিচিত কোন নাম্বার রিসিভ করার অভ্যেস কম, বিধায় কলটা কেটে দিলাম।আবারও ফোনটা বেজে উঠলো।এবার বিরক্তি সহকারেই রিসিভ করলাম।
---আপনি কি তিথি? অপরপ্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম - জি, কিন্তু আপনি!
---আমাকে চিনবেন না । আমি ঢাকা মেডিক্যাল থেকে বলছি। একটু আসতে পারবেন? আপনার বাবা সামান্য অসুস্থ।
আসছি, বলেই ফোনটা রেখে দিলাম।
ভেতরটা কেমন যেন শুনশান মনে হচ্ছিল, ঠিক তেমনটা,যেমনটা লাগত মা'য়ের কথা ভাবতে ভাবতে ,যখন আকাশের তারা দেখার সময়!
৪৫ মিনিটের মধ্যেই মেডিকেলে পৌছে গেলাম। কলার ভদ্রলোক ফোন মারফত এ্যাড্রেস করলেন।গন্তব্য বার্ন ইউনিট!
বিশ্বাস করুন সে সময় শরাীরটাকে যেকোন সময়ের চেয়ে বেশিই ভারি মনে হচ্ছিল। ভদ্রলোকের বিমর্ষ চেহারার সংকেত একটিবারের জন্যেও সেদিন সুবিধের মনে হয়নি । তা' হলে? বাবার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই, ভদ্র লোক আমায় শক্ত হতে বললেন। আবারও জিজ্ঞেস করলাম উনাকে ,বাবার কি আবার এ্যাটাকড্ হয়েছেন? তাহলে আমায় বা বার্ন ইউনিটে আনলেন কেন?ভদ্রলোক কোন কথা বললেন না। আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন - আমার সাথে আসো মা।
সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ। দুরে আরো একটা ।লাশ ঘিরে বেশ বিলাপ আহাজারি করছে বেশ কয়েকজন পুরুষ মহিলা। পরিজন হারানোর শোকে এক মহিলাকে মূর্ছাও যেতে দেখলাম। ইতোমধ্যে পুলিশের এক কর্মকর্তা,কনস্টেবল, ক্যামেরা হাতে কয়েকজন সাংবাদিক আমায় ঘিরে ধরলেন। বললেন- সন্ধ্যার সহিংসতায় অপর দুই বাস যাত্রীর সাথে আপনার বাবা'কেও যে পুড়িয়ে মারা হলো,যারা এই সহিংসতা চালালো, তাদের বিচার চেয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানান। আমরা রেকর্ড করবো।
এরপরের ঘটনা গুলোর কিছুই আর মনে করতে পারছিনা। কিছুতেই পারছিনা। ক্যামেরা, ফ্ল্যাশ, থানা পুলিশ, হাসপাতাল বাসা এমনকি বাবার দাফনটাও।
আজকাল কতগুলো ভাবনা অজান্তেই সামনে এসে দাঁড়ায়।
বাবার কত সুন্দর মুখ, চোখ, মেহেদী করা চুল দাড়ি! আর দেখা হবেনা । কখনোই না।
ইরানী আতর মাখা বাবার পাঞ্জাবী, আতরের অদ্ভুদ ঘ্রাণ! আর পাওয়া হবেনা। কখনোই না।
বাবার ঘুমন্ত চেহারার শিশুটাকে আর কখনোই চোখ মেলে দেখা হবেনা।নাহ্ কিছুতেই না।
কখনোই আর বাবার হাত ধরে যাওয়া হবেনা মায়ের কবরে, দু'জন মানুষের চোখের জলে ভিজে উঠবেনা একটা কবর!
লিখতে লিখতে গভীর রাতে কেউ একজন মাথায় হাত রেখে বলবেনা... অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড় মা।
আজ সকালে বাবা মা দু'জনকেই ছুঁয়ে আসলাম।সপ্তাহান্তে আমাকেই ওদের দেকভাল করতে হয়। কে আছে আর ওদের! আমি ছাড়া।
আজকাল কুলোতে পারছিনা । একজন মানুষের চোখে কতইবা জল থাকে যা দিয়ে ভেজানো যায় দু'দুটো জমিন! জল না পেয়েই বুঝি গতসপ্তাহের পুঁতে আসা ঘাসফুল গুলো এসপ্তাহেও প্রাণ পায়নি। শীতের প্রস্তুতি চলছে।
©somewhere in net ltd.