![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শপিং কমপ্লেক্সের উল্টো পাশে ল্যাম্পপোস্টের নিচে নিয়ন আলোয় দাঁড়িয়ে আছে সুমনা । দু’হাত মেহেদীতে নকশা আঁকা, পরনে কাঁচা মেহেদী রঙের জামদানী শাড়ি। তাজা ফুলের গহনায় মোড়ানো সর্বাঙ্গ। আমার বাসার ঠিক বিপরীতে ওদের বাসা। ওরা স্থানীয় আর আমি ভাড়া থাকি। ভাড়াটিয়া হলেও আমি অনেক দিন হয়ী এলাকায় আছি । প্রায় সময় দেখা হয় সুমনার সাথে। বয়স ত্রিশের উপরে। সৎ মায়ের সংসার, ভাইরা বিয়ে করে যে যার মত সংসার পেতেছে। কিন্তু সুমনাকে নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। দু’দিন আগে অফিস থেকে ফিরে টেবিলের উপর একটা খাম দেখতে পাই। পরে দেখবো ভেবে কাজের চাপে খুলেই দেখা হয়নি আর। আজ অফিস ছুটির পর শপিং কমপ্লেক্স থেকে শপিং সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছি। সেরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রাস্তার ওপারে চোখ যায়। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি ? ওকি সত্যি সুমনা! ওকে আজ এতো সুন্দর লাগছে যদি আগুনের তৈরি অপ্সরী বলি তো ভুল হবেনা কোনমতে !
ও আমাকে দেখেই গলা উঁচু করে ডাক দিলো ‘মিথিলা আপু এই মিথিলা আপু’... রাস্তা কোরাস করে ধীর পায়ে ওর কাছে গেলাম। অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সুমনা । বিষয়টা বুঝতে পারলাম না। ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম ‘তোকে আজ খুন খুব খুব সুন্দর লাগছে রে সুমনা’। ও বলল ‘তোমার সাথে কথা বলবো না আপু’। ওর মুখে হাত দিয়ে বললাম ‘ওরে অভিমানি মেয়ে কেন, কেন রে আপুনি কথা বলবি না কেন’?
-তোমার সাথে আড়ি।
- ঠিক আছে আড়ি কিন্তু কেন আড়ি তাতো বলবি? আমি তো ভাবছি তোর সাথে আড়ি দেওয়ার কথা আমার।
-তোমার দেওয়ার কথা?
-হুম এই যে এতো সুন্দর সাজ, হাতে মেহেদী আঁকা গায়ে তাজা ফুলের গয়না। এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই জানতে পারলাম না? তা যাই বলিস তোকে পরীর মত লাগছে।
মখু ভার করে সুমনা বলল -হাসালে আপু।
-হাসাম মানে?
-মানে তুমি বাসায় ছিলে না। মা বাঁধনের কাছে কার্ড দিয়ে এসেছিলো তুমি কি তা দেখেছ? আমি বাঁধনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমিল ও বলল ও তোমাকে কার্ডটি দিয়েছিলো। তুমি সব সময় বলতে সুমনা তোর মেহেদী সন্ধ্যায় আমি আপন হাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাবো তোকে। আর যখন সেই শুভ দিনটি এলো আমার জীবনে তখন তোমার...।।
কথার মাঝে মেরুন কালারের পাঞ্জাবি পরা এক সুদর্শন যুবক এসে দাঁড়ালো সামনে।
-সরি সুমনা অনেক দেরি করে ফেললাম চলিরে...
-আপু এসো পরিচয় করিয়ে দেই ও মারুফ। মারুফ ইনি মিথিলা আপু যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।
জানো আপু, আমার মেহেদী সন্ধ্যায় আমি তোমাকে ভীষণ মিস করেছিলাম। তোমাকে তো কার্ড দিয়ে এসে ছিলো মা কিন্তু তুমি এলে না কেন আপু?
মুহুর্তে মেমরি ক্যাস করলো সেই খামটি। যে খামটি আজো পড়ে আছে টেবিলের উপর। তবে ওটা সুমনারই বিয়ের কার্ড ছিল। একনজর ওর পাশে দাঁড়ানো যুবগটির দিকে তাকালাম। গায়ের রং উজ্বল শ্যামলা উচ্চতা প্রায় পাঁচফুট ছ’ইঞ্চি হবে, মিডিয়াম স্বাস্থ। লোকটির হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। ব্যাগগুলো ভারি ভারি মনে হচ্ছে বার বার হাত বদল করছে মারুপ। বললাম চলি সুমনা। আমি বিদায় না নিলে ওরা যেতে পারছে না।
-যাবে আপু আর কিছুক্ষণ দাঁড়াও না কথা বলি।
-পাগলী মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে কেন? বাসায় গিয়ে কথা বলবো।
-আপু সত্যি তুমি যাবে আমাদের ছোট্ট কুঠিরে?
- কেন যাবো না। শোন মারুফকে নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় আসিস কেমন।
-আচ্ছা আপু।
দু’দিন বাদে একটা জরুরী কাজে ঢাকা যাচ্ছিলাম । বাস স্টান্ডে পৌঁছতে দেখি সুমনা ও মারুফের দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বললাম তোরা এখানে? হাস্যজ্জ্বল মুখে উত্তর দিল সুমনা। ঢাকা যাচ্ছি আপু। মারুফের ছুটি শেষ ও চলে যাচ্ছে আমাকে রেখে যেতে রাজি হলোনা তাই আমিও...।
বললাম গুড। মারুফ সুমনার থেকে বয়সে একটু ছোট হবে। তবু কি দারুণ ভাবে ও সুমনাকে মানিয়ে নিয়েছে জীবনের সাথে। সুমনার গলায় একটা স্বর্ণের নেকলেজ, প্রায় এক ভরির মত ওজন হবে। এক হাতে একটা স্বর্ণের চূড় অন্য হাতে ঘড়ি। অনামিকাতে রয়েছে একটি স্বর্ণের আংটি। পরণে নীল রঙের কাতার, শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ, কপালে নীল টিপ লম্বা চুলগুলো আগালা বেণী করে পিঠের পরে এলিয়ে দিয়েছে, সব মিলিয়ে অপূর্ব লাগছে সুমনাকে।
মারুফ প্রশ্ন করলঃ আপু য়াপ্নি কোয়ায় যাচ্ছেন?
-ঢাকা।
-তাই,কোন বাসে যাচ্ছেন ?
- দিগন্ত পরিবহনে।
মারুফ হেসে উঠে বললঃ বাহ, আমরাও তো দিগন্তে যাচ্ছি ভালোই হলো সুমনার মন খারাপ ছিলো এখন আপনার সাথে আড্ডা দিতে দিতে যাওয়া যাবে। ওর মনটাও ভালো হবে।
মারুফের কথা শেষ হলে আমি মারুফকে প্রশ্ন করলাম মারুফ তুমি কি করছ? হাসি ভরা মুখে উত্তর দিলো একটি মাল্টিপার্পাস কোম্পানীতে এরিয়া ম্যানেজার হিসাবে নিয়জীত আছি আপু।
-ভাই বোন ক’জন?
-পৃথিবীর বুকে আমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই আপু।
-বাবা-মা?
- আমি যখন খুব ছোট তখন এক রোড এ্যামসিডেন্টে আমার বাবা-মা মারা যান। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ঠাই মেলে ফুফুর কাছে। কিন্তু সেখানে বাশি দিন থাকতে পারিনি। ফুফা ফুফুকে খুব অত্যাচার করতেন আমার জন্য একদিন ফুফু আমাকে রেখে আসেন এতিমখানায় সেখানে আমি বড়ে উঠি লেখা-পড়া শিখি। তারপর একদিন চাকরি নিয়ে ঢাকা চলে আসি। ওখানকার শিক্ষকদের সহযোগিতায় ফিরে পাই পৈত্রিক সম্পত্তি যা ফুফু আঁচল দিয়ে আগলে রেখেছিলেন এতোটা বছর। ঢাকার বুকে একটা চাকরি ও একটা বাড়ি কম কিসে বলুন আপু?
-তোমাদের পরিচয় কি ভাবে?
সুমনা বলল সে আর বলো না আপু। সুমনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মারুফ বলল ‘সে এক মজার কথা আপু। একদিন আমি আমার এক মহিলা কলিগ কে ফোন দিতে গিয়ে রং নাম্বারে সুমনার নাম্বারে ঢুকে যায়। মজার ব্যাপার হলো আমার সেই কলিকের নামও ছিলো সুমনা। ফোনটা অপর প্রান্ত থেকে রিসিভ হতেই আমি বললাম সুমনা বলছেন? উত্তর এলো হ্যাঁ সুমনা বলছি।
-শুনুন আপনি অফিসে আসার সময় একটা রেজিট্রার খাতা নিয়ে আসবেন। আর একটা স্টাপ্লার ম্যাশিং আর সীল প্যাড ও ভালো কথা কাল যে .........
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে কোথায় নিয়ে আসবো?
-কি আশ্চর্য অফিসে, অফিসে নিয়ে আসবেন।
-আসছে আমি তো আপনার কথার মাথা-মুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না। কে আপনি? স্টাপ্লার ম্যাশিং ফ্রম আমি তো এর কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব নিয়ে কোথায় যাবো আমি?
-নাহ সুমনা আপনাকে দিয়েনা কিছুই হবে না। আমি বক বক করেই চলেছি হঠাৎ সুমনা এসে আমার সামে দাঁড়িয়ে বলে স্যার এই কালকের সেই ফ্রমগুলো দেখন সব ঠিকঠাক মত পূরণ হয়েছে কি না?
আমি মুখ তুলে তাকালাম। একি আপনি? রেজিস্ট্রার খাতা কই?
-আপনি তো আনতে বলেন নাই স্যার?
-বললাম ফোনে আমি এতোক্ষণ ধরে আপনার সাথে বকবক করছি আর আপনি বলছেন আমি বলিনি?
-স্যার আপনি কিন্তু এখনো ফোনেই কথা বলছিলেন। কাকে ফোন দিয়েছেন আর কাকে কি বলছেন আল্লাহই ভালো জানেন।
-সেকি আমি আপনাকে ফোন দেইনি?
-না স্যার।
-তাহলে আমি কার সাথে কথা বলছিলাম? সে যে বলল সে সুমন?
-বলতে পারে। আপনি যাকে ফোন দিয়েছেন হয়তো তার নাম ও সুমনা। আর আপনি যখন বলেছেন আপনি সুমনা বলছেন তখন সে বলেছে হ্যাঁ আমি সুমনা বলছি আর আপনি শুরু করে দিয়েছেন বকবক।
-স্যার এখনো ফোনটা কিন্তু কাটেন নাই এখনো সরি বলে রেখে দেন না হলে ......
সুমনা এ কথা বলছিলো আর হাসছিলো রাগে আমার গা জ্বলছিল তবু সুমনার কথা মত সরি বলে রেখেদিলাম। সারাদিন পর রাতে ঘরে ফিরে সেই নাম্বারটিতে আবার ফোন দিলাম।
-আবার ফোন কেন দিলেন?
-ফোন দিলাম এই কারণে, সে যখন আমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিল না তখন আমি তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলাম এই সামান্য বিষয় বুঝতে পারছেন না তো চাকরি করতে কেন এসেছেন। চাকরি করা আপনাকে দিয়ে মানায় না।
প্রতি উত্তর না আসতেই সুমনা এসে আমার সামনে দাঁরায়। আর আমি সুমনার সাথে কথা শুরু করি ওদিকে ফোনের অপর প্রান্তের সুমনা কি বলল আর খেয়াল করাই হলোনা। যদিও ফোনটা কেটে দেওয়ার সময় আমি সরি বলেছিলাম তবু বিবেক আমাকে তাড়াকরছিল তাই ফের সরি বলতে ফোন দিয়েছিলাম। তারপর থেকে শুরু হয় সুমনার সাথে কথোপকথন তারপর, তারপর তারপর কি আপনি তাতো বুঝতেই পারছেন।
-হুম তা পারছি। সত্যি সুমনা বড় ভাগ্যবতী ও তোমার মত একটি বর পেয়েছে।
একটু থেমে বললাম বিয়েতেই কি প্রথম দেখা নাকি আগেও হয়েছে?
-আগেও দুয়েকবার হয়েছে আপু।
-সুমনা।
-জ্বি আপু?
-আমার তো মনে হয় তুই কি মারুফকে ঠকিয়েছিস?
- ঠকিয়েছি ?
-হ্যাঁ ঠকিয়েছিস।
-কি ভাবে আপু?
-তুই তোর বিবেককে প্রশ্ন কর।
-আমি তো বুঝতে পারছিনা আপু কি ভাবে...।
মারুফ খুব বুদ্ধিমান ছেলে ও বলল আমি জানি আপু কি বলতে চাইছে। হ্যাঁ আপু আমি সব জেনে শুনেই সুমনাকে বিয়ে করেছি ও আমাকে ঠকাইনি।
-আপ্নি জানেন আমি কি বলতে চাইছি?
-হ্যাঁ আপু জানি আপনি বলতে চাইছেন সুমনা আমার থেকে বয়সে বড় এইতো।
আমার কথা ক্যাস করতে পেরেছে মারুফ। আমি মুখে কিছু না বলে মৃদু হাসলাম। মারুফ বলল তাতে কি আপু? আমাদের নবী করিম (সঃ)আলাই ওয়াসাল্লামের স্ত্রী বিবি খাদিজা ছিলেম নবী করিম (সঃ) আলাই ওয়াসাল্লাম এর ১৫ বছরের বড়। সুমনা তো আর আমার থেকে আর অত বড় নয়।
কথায় কথায় আগিয়ে চলছে বাস এক সময় বাস এসে পৌঁছল গাবতলী । হাতে মেহেদীর দাগ তখনো ফিকে হয়ে ওঠেনি। সব আপনজনকে পিছনে ফেলে স্বামীর হাত ধরে সুমনা চলে এসেছে ঢাকা। সম্ভাবত এটাই ওর জীবনে প্রথম বার ঢাকা আসা । সুমনা বলেছিল আপু ঢাকা গিয়ে তুমি কোথায় উঠবা ?দাকায় আমার তেমন আত্মীয়স্বজন নেই তাই ঢা এসে আমি হোটেলে উঠি এবারও তাই করবো। মারুফ বলল সেকি আপু আপনি হোটেলে উঠবেন! নানা আপু আমরা থাকতে আপনি হোটেলে উঠতে পারেন না। এতো দিন কেউ ছিলো না এখন আমরা আছি এখন থেকে ঢাকায় এসে আপনি আমাদের বাসায় থাকবেন। আপনার এই অধম ভাইটির বাসায় থাকবেন। যদিও আমি খুব গরিব কিন্তু এক মুঠ ডাল ভা্ত ভালো ভাবে খাওয়াতে পারব।
মারুপের কথায় আমি বললাম ছি ছি এমন ভাবে বলতে আছে নাকি। আমি সুমনা ও মারুফ পাশাপাশি তিনটি সিটে বসা ছিলাম। গাবতলী নেমে আমি একটি সি এন জি ডাকতেই মারুফের মুখ শ্রাবণ মেঘের মত কালো হয়ে গেলো। সুমনা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল আপু চলোনা আমার নতুন সংসারটায় একটু পা রাখো প্লিজ।
বললাম না ভাই আজ না অন্য কোন একদিন যাওয়া যাবে আজ আসিরে সুমনা। মারুপ বলল বুঝতে পেরেছি আমার মত একটা গরীবের বাড়ি আ যেতে আপুর আপত্তি আছে। মারুফের এই কথায় বাদ্য হলাম সি এন জি ছেড়ে দিতে। কাঁচা মেহেদী রঙের পাঞ্জাবীতে পরা মারুফের। যে মুখে পরিচয়ের শুরুথেকে এতোটুকু হাসির রেশ থামেনি সে মুখ হঠাৎ কালো দেখে ভালো লাগলো না আপত্তি থাকা সত্বেও যেতে রাজি হলাম। মারুপের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সুমনাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে অনেক খুশি। ওদের নতুন সংসারে যাচ্ছি খালি হাতে কি ভাবে যাই তাই পাশের দোকানে গেলাম কিছু ফল কিনতে। মারুফ সুমনাকে বলল তুমি এগুলো একটু খেয়াল রেখো আমি একটি প্রাইভেট কার নিয়ে আসি ওপাশ থেকে। সাবধান এটা কিন্তু ঢাকা শহর এখানে চোখের পলকে সিন্তাই হয়।
সুমনা বলল দাঁড়াো আমি গয়নাগুলো খুলে ব্যাগে ঢুকাই তারপর তুমি ওপারে যাও। মারুফ হেসে বলল না তোমাকে গা থেকে ওগুলো খুলতে হবে না। শুধু একটু সাবধান থেকো সোনা। বলে মারুফ সামনে পা বাড়াল। বিপরিত দিক থেকে বেপরোয়া ভাবে ছুটে আসা একটি বাস থেতলে দিয়ে চলে গেল মারুফ কে। আমি কিছু আঙ্গুর, আপেল আর বেদানা কিনে পেছনে ফিরলাম। আল্লাহ গো বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল সুমনা। মারুফের শরীরের তাজা রক্তে মুহুর্তে বন্যা বয়ে গেল রাজ পথে। মেহেদী রাঙানো পাঞ্জাবিটি লাল রক্তে আরো লাল হয়ে গেলো।
কানে কড়কড় করে বেজে উঠলো বাসে বসে শোনা মারুফের সেই কথাগুলো। জানেন আপু সুমনা জীবনে অনেক কষ্ট করেছে আমি ওকে আর কোন দিন কোন কষ্ট পেতে দেবো না। কালই যাবো পাসপোর্ট অফিসে ওর নামে পাসপোর্ট করবো তারপর ভিসা। আগামি মাসের শেষের দিকে আমি ওকে নিয়ে পাড়ি জমাবো সিঙ্গাপুর, তারপর আমেরিকা। এভাবে একের পর এক দেশ। সুমনার ছোট্ট সংসারে কোনদিন কোন আমি দুঃখ আমি ছুঁতে দেবো না। সুমনার মেহেদী রাঙানো হাতটি টেনে আমার সমনে ধরে মারুফ বলেছিল আপু এই মেহেদী রাঙা হাতের মতই প্রতিটি দিন হবে আমাদের মেহেদী সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সন্ধ্যার মঞ্চ। মুহুর্তে ধুলোয় মিশে গেলো মারুফের সকল আশা, বাকহীন সুমনা। রাস্তায় পড়ে আছে মারুফের রক্তাক্ত লাশ। সুমনা জানেনা মারুফের ঠিকানা। তবু স্বামীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস রেখে জীবনের প্রথম ঢাকা শহরে পা রেখেছে সুমনা। আমি বললাম সুমনা তুই তোর বাড়িতে একটা ফোন দে বাড়িতে জানা এই ঘটনা।
সুমনা ফোন দিলো ওর বাড়িতে সৎ মা আর সৎ ভায়েরা বললঃ মারুফ মরেছে তো তুই আমাদের কেন ফোন দিচ্ছিস হতচ্ছাড়ি? ওর সাথে তুইও কেন মরলি না হাড় জ্বালানী? ভাবলাম এতোদিনে হাপ ছেড়ে বেঁচেছি শোন ঢাকায় গেছিস ওখানেই থাকিস এখনে যেন আর ফিরে আসিস না অপয়া দামড়ি কোথাকার বিয়ের দু’দিন না যেতেই বরতাকে খালি এবার আমাদের খাবি রাক্ষসিনী। ফোনটা পড়ে গেলো সুমনার হাত থেকে। বললাম এখন কি করবি সুমনা? মারুফের লাশ নিয়ে সে এখন কোথায় যাবি?, একথা বলেই সুমনা পড়ে গেলো মাটিতে । আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লাশবাহী গাড়ি এসেছে মারুফকে নিতে। তবে কি বেওয়ারিশ হবে মারুফ?
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো এভাবে ড্রাইভারদের নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে আর কত মারুফকে দিতে হবে জীবন? আর কত সুমনার মেহেদীর রং না শুখাতেই অঙ্গে জড়াতে হবে সাদা শাড়ি? আমি কিছুই বলতে পারিনি কারণ আমারই সামনে পড়ে থাকা মারুফের লাশ আমাকে কিছুটা সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল। লাশ বাহি গাড়িটি দেখে সুমনা প্রশ্ন করলো এটা কিসের গাড়ি? । বললাম আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লাশবাহী গাড়ি। মাথাঘুরে পড়ে গেলো সুমনা, তারপর চেয়ে দেখি সুমনাও নিথর হয়ে আছে। ওদের দু’জনার লাস যখন গাড়িতে উঠাতে যাবে তখন আমি চিৎকার করে বলেছিলাম না মারুপ সুমনা ওরা কেউ বেওয়ারিস নয় আমি মিথিলা আমি আছি আমি ওদের স্বজন ওদের বড় বোন......
১৭ জানুয়ারি ২০১৭
সময় সন্ধ্যা ৭.২৫।
শপিং কমপ্লেক্সের উল্টো পাশে ল্যাম্পপোস্টের নিচে নিয়ন আলোয় দাঁড়িয়ে আছে সুমনা । দু’হাত মেহেদীতে নকশা আঁকা, পরনে কাঁচা মেহেদী রঙের জামদানী শাড়ি। তাজা ফুলের গহনায় মোড়ানো সর্বাঙ্গ। আমার বাসার ঠিক বিপরীতে ওদের বাসা। ওরা স্থানীয় আর আমি ভাড়া থাকি। ভাড়াটিয়া হলেও আমি অনেক দিন হয়ী এলাকায় আছি । প্রায় সময় দেখা হয় সুমনার সাথে। বয়স ত্রিশের উপরে। সৎ মায়ের সংসার, ভাইরা বিয়ে করে যে যার মত সংসার পেতেছে। কিন্তু সুমনাকে নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। দু’দিন আগে অফিস থেকে ফিরে টেবিলের উপর একটা খাম দেখতে পাই। পরে দেখবো ভেবে কাজের চাপে খুলেই দেখা হয়নি আর। আজ অফিস ছুটির পর শপিং কমপ্লেক্স থেকে শপিং সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছি। সেরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রাস্তার ওপারে চোখ যায়। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি ? ওকি সত্যি সুমনা! ওকে আজ এতো সুন্দর লাগছে যদি আগুনের তৈরি অপ্সরী বলি তো ভুল হবেনা কোনমতে !
ও আমাকে দেখেই গলা উঁচু করে ডাক দিলো ‘মিথিলা আপু এই মিথিলা আপু’... রাস্তা কোরাস করে ধীর পায়ে ওর কাছে গেলাম। অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সুমনা । বিষয়টা বুঝতে পারলাম না। ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম ‘তোকে আজ খুন খুব খুব সুন্দর লাগছে রে সুমনা’। ও বলল ‘তোমার সাথে কথা বলবো না আপু’। ওর মুখে হাত দিয়ে বললাম ‘ওরে অভিমানি মেয়ে কেন, কেন রে আপুনি কথা বলবি না কেন’?
-তোমার সাথে আড়ি।
- ঠিক আছে আড়ি কিন্তু কেন আড়ি তাতো বলবি? আমি তো ভাবছি তোর সাথে আড়ি দেওয়ার কথা আমার।
-তোমার দেওয়ার কথা?
-হুম এই যে এতো সুন্দর সাজ, হাতে মেহেদী আঁকা গায়ে তাজা ফুলের গয়না। এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই জানতে পারলাম না? তা যাই বলিস তোকে পরীর মত লাগছে।
মখু ভার করে সুমনা বলল -হাসালে আপু।
-হাসাম মানে?
-মানে তুমি বাসায় ছিলে না। মা বাঁধনের কাছে কার্ড দিয়ে এসেছিলো তুমি কি তা দেখেছ? আমি বাঁধনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমিল ও বলল ও তোমাকে কার্ডটি দিয়েছিলো। তুমি সব সময় বলতে সুমনা তোর মেহেদী সন্ধ্যায় আমি আপন হাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাবো তোকে। আর যখন সেই শুভ দিনটি এলো আমার জীবনে তখন তোমার...।।
কথার মাঝে মেরুন কালারের পাঞ্জাবি পরা এক সুদর্শন যুবক এসে দাঁড়ালো সামনে।
-সরি সুমনা অনেক দেরি করে ফেললাম চলিরে...
-আপু এসো পরিচয় করিয়ে দেই ও মারুফ। মারুফ ইনি মিথিলা আপু যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।
জানো আপু, আমার মেহেদী সন্ধ্যায় আমি তোমাকে ভীষণ মিস করেছিলাম। তোমাকে তো কার্ড দিয়ে এসে ছিলো মা কিন্তু তুমি এলে না কেন আপু?
মুহুর্তে মেমরি ক্যাস করলো সেই খামটি। যে খামটি আজো পড়ে আছে টেবিলের উপর। তবে ওটা সুমনারই বিয়ের কার্ড ছিল। একনজর ওর পাশে দাঁড়ানো যুবগটির দিকে তাকালাম। গায়ের রং উজ্বল শ্যামলা উচ্চতা প্রায় পাঁচফুট ছ’ইঞ্চি হবে, মিডিয়াম স্বাস্থ। লোকটির হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। ব্যাগগুলো ভারি ভারি মনে হচ্ছে বার বার হাত বদল করছে মারুপ। বললাম চলি সুমনা। আমি বিদায় না নিলে ওরা যেতে পারছে না।
-যাবে আপু আর কিছুক্ষণ দাঁড়াও না কথা বলি।
-পাগলী মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে কেন? বাসায় গিয়ে কথা বলবো।
-আপু সত্যি তুমি যাবে আমাদের ছোট্ট কুঠিরে?
- কেন যাবো না। শোন মারুফকে নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় আসিস কেমন।
-আচ্ছা আপু।
দু’দিন বাদে একটা জরুরী কাজে ঢাকা যাচ্ছিলাম । বাস স্টান্ডে পৌঁছতে দেখি সুমনা ও মারুফের দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বললাম তোরা এখানে? হাস্যজ্জ্বল মুখে উত্তর দিল সুমনা। ঢাকা যাচ্ছি আপু। মারুফের ছুটি শেষ ও চলে যাচ্ছে আমাকে রেখে যেতে রাজি হলোনা তাই আমিও...।
বললাম গুড। মারুফ সুমনার থেকে বয়সে একটু ছোট হবে। তবু কি দারুণ ভাবে ও সুমনাকে মানিয়ে নিয়েছে জীবনের সাথে। সুমনার গলায় একটা স্বর্ণের নেকলেজ, প্রায় এক ভরির মত ওজন হবে। এক হাতে একটা স্বর্ণের চূড় অন্য হাতে ঘড়ি। অনামিকাতে রয়েছে একটি স্বর্ণের আংটি। পরণে নীল রঙের কাতার, শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ, কপালে নীল টিপ লম্বা চুলগুলো আগালা বেণী করে পিঠের পরে এলিয়ে দিয়েছে, সব মিলিয়ে অপূর্ব লাগছে সুমনাকে।
মারুফ প্রশ্ন করলঃ আপু য়াপ্নি কোয়ায় যাচ্ছেন?
-ঢাকা।
-তাই,কোন বাসে যাচ্ছেন ?
- দিগন্ত পরিবহনে।
মারুফ হেসে উঠে বললঃ বাহ, আমরাও তো দিগন্তে যাচ্ছি ভালোই হলো সুমনার মন খারাপ ছিলো এখন আপনার সাথে আড্ডা দিতে দিতে যাওয়া যাবে। ওর মনটাও ভালো হবে।
মারুফের কথা শেষ হলে আমি মারুফকে প্রশ্ন করলাম মারুফ তুমি কি করছ? হাসি ভরা মুখে উত্তর দিলো একটি মাল্টিপার্পাস কোম্পানীতে এরিয়া ম্যানেজার হিসাবে নিয়জীত আছি আপু।
-ভাই বোন ক’জন?
-পৃথিবীর বুকে আমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই আপু।
-বাবা-মা?
- আমি যখন খুব ছোট তখন এক রোড এ্যামসিডেন্টে আমার বাবা-মা মারা যান। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ঠাই মেলে ফুফুর কাছে। কিন্তু সেখানে বাশি দিন থাকতে পারিনি। ফুফা ফুফুকে খুব অত্যাচার করতেন আমার জন্য একদিন ফুফু আমাকে রেখে আসেন এতিমখানায় সেখানে আমি বড়ে উঠি লেখা-পড়া শিখি। তারপর একদিন চাকরি নিয়ে ঢাকা চলে আসি। ওখানকার শিক্ষকদের সহযোগিতায় ফিরে পাই পৈত্রিক সম্পত্তি যা ফুফু আঁচল দিয়ে আগলে রেখেছিলেন এতোটা বছর। ঢাকার বুকে একটা চাকরি ও একটা বাড়ি কম কিসে বলুন আপু?
-তোমাদের পরিচয় কি ভাবে?
সুমনা বলল সে আর বলো না আপু। সুমনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মারুফ বলল ‘সে এক মজার কথা আপু। একদিন আমি আমার এক মহিলা কলিগ কে ফোন দিতে গিয়ে রং নাম্বারে সুমনার নাম্বারে ঢুকে যায়। মজার ব্যাপার হলো আমার সেই কলিকের নামও ছিলো সুমনা। ফোনটা অপর প্রান্ত থেকে রিসিভ হতেই আমি বললাম সুমনা বলছেন? উত্তর এলো হ্যাঁ সুমনা বলছি।
-শুনুন আপনি অফিসে আসার সময় একটা রেজিট্রার খাতা নিয়ে আসবেন। আর একটা স্টাপ্লার ম্যাশিং আর সীল প্যাড ও ভালো কথা কাল যে .........
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে কোথায় নিয়ে আসবো?
-কি আশ্চর্য অফিসে, অফিসে নিয়ে আসবেন।
-আসছে আমি তো আপনার কথার মাথা-মুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না। কে আপনি? স্টাপ্লার ম্যাশিং ফ্রম আমি তো এর কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব নিয়ে কোথায় যাবো আমি?
-নাহ সুমনা আপনাকে দিয়েনা কিছুই হবে না। আমি বক বক করেই চলেছি হঠাৎ সুমনা এসে আমার সামে দাঁড়িয়ে বলে স্যার এই কালকের সেই ফ্রমগুলো দেখন সব ঠিকঠাক মত পূরণ হয়েছে কি না?
আমি মুখ তুলে তাকালাম। একি আপনি? রেজিস্ট্রার খাতা কই?
-আপনি তো আনতে বলেন নাই স্যার?
-বললাম ফোনে আমি এতোক্ষণ ধরে আপনার সাথে বকবক করছি আর আপনি বলছেন আমি বলিনি?
-স্যার আপনি কিন্তু এখনো ফোনেই কথা বলছিলেন। কাকে ফোন দিয়েছেন আর কাকে কি বলছেন আল্লাহই ভালো জানেন।
-সেকি আমি আপনাকে ফোন দেইনি?
-না স্যার।
-তাহলে আমি কার সাথে কথা বলছিলাম? সে যে বলল সে সুমন?
-বলতে পারে। আপনি যাকে ফোন দিয়েছেন হয়তো তার নাম ও সুমনা। আর আপনি যখন বলেছেন আপনি সুমনা বলছেন তখন সে বলেছে হ্যাঁ আমি সুমনা বলছি আর আপনি শুরু করে দিয়েছেন বকবক।
-স্যার এখনো ফোনটা কিন্তু কাটেন নাই এখনো সরি বলে রেখে দেন না হলে ......
সুমনা এ কথা বলছিলো আর হাসছিলো রাগে আমার গা জ্বলছিল তবু সুমনার কথা মত সরি বলে রেখেদিলাম। সারাদিন পর রাতে ঘরে ফিরে সেই নাম্বারটিতে আবার ফোন দিলাম।
-আবার ফোন কেন দিলেন?
-ফোন দিলাম এই কারণে, সে যখন আমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিল না তখন আমি তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলাম এই সামান্য বিষয় বুঝতে পারছেন না তো চাকরি করতে কেন এসেছেন। চাকরি করা আপনাকে দিয়ে মানায় না।
প্রতি উত্তর না আসতেই সুমনা এসে আমার সামনে দাঁরায়। আর আমি সুমনার সাথে কথা শুরু করি ওদিকে ফোনের অপর প্রান্তের সুমনা কি বলল আর খেয়াল করাই হলোনা। যদিও ফোনটা কেটে দেওয়ার সময় আমি সরি বলেছিলাম তবু বিবেক আমাকে তাড়াকরছিল তাই ফের সরি বলতে ফোন দিয়েছিলাম। তারপর থেকে শুরু হয় সুমনার সাথে কথোপকথন তারপর, তারপর তারপর কি আপনি তাতো বুঝতেই পারছেন।
-হুম তা পারছি। সত্যি সুমনা বড় ভাগ্যবতী ও তোমার মত একটি বর পেয়েছে।
একটু থেমে বললাম বিয়েতেই কি প্রথম দেখা নাকি আগেও হয়েছে?
-আগেও দুয়েকবার হয়েছে আপু।
-সুমনা।
-জ্বি আপু?
-আমার তো মনে হয় তুই কি মারুফকে ঠকিয়েছিস?
- ঠকিয়েছি ?
-হ্যাঁ ঠকিয়েছিস।
-কি ভাবে আপু?
-তুই তোর বিবেককে প্রশ্ন কর।
-আমি তো বুঝতে পারছিনা আপু কি ভাবে...।
মারুফ খুব বুদ্ধিমান ছেলে ও বলল আমি জানি আপু কি বলতে চাইছে। হ্যাঁ আপু আমি সব জেনে শুনেই সুমনাকে বিয়ে করেছি ও আমাকে ঠকাইনি।
-আপ্নি জানেন আমি কি বলতে চাইছি?
-হ্যাঁ আপু জানি আপনি বলতে চাইছেন সুমনা আমার থেকে বয়সে বড় এইতো।
আমার কথা ক্যাস করতে পেরেছে মারুফ। আমি মুখে কিছু না বলে মৃদু হাসলাম। মারুফ বলল তাতে কি আপু? আমাদের নবী করিম (সঃ)আলাই ওয়াসাল্লামের স্ত্রী বিবি খাদিজা ছিলেম নবী করিম (সঃ) আলাই ওয়াসাল্লাম এর ১৫ বছরের বড়। সুমনা তো আর আমার থেকে আর অত বড় নয়।
কথায় কথায় আগিয়ে চলছে বাস এক সময় বাস এসে পৌঁছল গাবতলী । হাতে মেহেদীর দাগ তখনো ফিকে হয়ে ওঠেনি। সব আপনজনকে পিছনে ফেলে স্বামীর হাত ধরে সুমনা চলে এসেছে ঢাকা। সম্ভাবত এটাই ওর জীবনে প্রথম বার ঢাকা আসা । সুমনা বলেছিল আপু ঢাকা গিয়ে তুমি কোথায় উঠবা ?দাকায় আমার তেমন আত্মীয়স্বজন নেই তাই ঢা এসে আমি হোটেলে উঠি এবারও তাই করবো। মারুফ বলল সেকি আপু আপনি হোটেলে উঠবেন! নানা আপু আমরা থাকতে আপনি হোটেলে উঠতে পারেন না। এতো দিন কেউ ছিলো না এখন আমরা আছি এখন থেকে ঢাকায় এসে আপনি আমাদের বাসায় থাকবেন। আপনার এই অধম ভাইটির বাসায় থাকবেন। যদিও আমি খুব গরিব কিন্তু এক মুঠ ডাল ভা্ত ভালো ভাবে খাওয়াতে পারব।
মারুপের কথায় আমি বললাম ছি ছি এমন ভাবে বলতে আছে নাকি। আমি সুমনা ও মারুফ পাশাপাশি তিনটি সিটে বসা ছিলাম। গাবতলী নেমে আমি একটি সি এন জি ডাকতেই মারুফের মুখ শ্রাবণ মেঘের মত কালো হয়ে গেলো। সুমনা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল আপু চলোনা আমার নতুন সংসারটায় একটু পা রাখো প্লিজ।
বললাম না ভাই আজ না অন্য কোন একদিন যাওয়া যাবে আজ আসিরে সুমনা। মারুপ বলল বুঝতে পেরেছি আমার মত একটা গরীবের বাড়ি আ যেতে আপুর আপত্তি আছে। মারুফের এই কথায় বাদ্য হলাম সি এন জি ছেড়ে দিতে। কাঁচা মেহেদী রঙের পাঞ্জাবীতে পরা মারুফের। যে মুখে পরিচয়ের শুরুথেকে এতোটুকু হাসির রেশ থামেনি সে মুখ হঠাৎ কালো দেখে ভালো লাগলো না আপত্তি থাকা সত্বেও যেতে রাজি হলাম। মারুপের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সুমনাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে অনেক খুশি। ওদের নতুন সংসারে যাচ্ছি খালি হাতে কি ভাবে যাই তাই পাশের দোকানে গেলাম কিছু ফল কিনতে। মারুফ সুমনাকে বলল তুমি এগুলো একটু খেয়াল রেখো আমি একটি প্রাইভেট কার নিয়ে আসি ওপাশ থেকে। সাবধান এটা কিন্তু ঢাকা শহর এখানে চোখের পলকে সিন্তাই হয়।
সুমনা বলল দাঁড়াো আমি গয়নাগুলো খুলে ব্যাগে ঢুকাই তারপর তুমি ওপারে যাও। মারুফ হেসে বলল না তোমাকে গা থেকে ওগুলো খুলতে হবে না। শুধু একটু সাবধান থেকো সোনা। বলে মারুফ সামনে পা বাড়াল। বিপরিত দিক থেকে বেপরোয়া ভাবে ছুটে আসা একটি বাস থেতলে দিয়ে চলে গেল মারুফ কে। আমি কিছু আঙ্গুর, আপেল আর বেদানা কিনে পেছনে ফিরলাম। আল্লাহ গো বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল সুমনা। মারুফের শরীরের তাজা রক্তে মুহুর্তে বন্যা বয়ে গেল রাজ পথে। মেহেদী রাঙানো পাঞ্জাবিটি লাল রক্তে আরো লাল হয়ে গেলো।
কানে কড়কড় করে বেজে উঠলো বাসে বসে শোনা মারুফের সেই কথাগুলো। জানেন আপু সুমনা জীবনে অনেক কষ্ট করেছে আমি ওকে আর কোন দিন কোন কষ্ট পেতে দেবো না। কালই যাবো পাসপোর্ট অফিসে ওর নামে পাসপোর্ট করবো তারপর ভিসা। আগামি মাসের শেষের দিকে আমি ওকে নিয়ে পাড়ি জমাবো সিঙ্গাপুর, তারপর আমেরিকা। এভাবে একের পর এক দেশ। সুমনার ছোট্ট সংসারে কোনদিন কোন আমি দুঃখ আমি ছুঁতে দেবো না। সুমনার মেহেদী রাঙানো হাতটি টেনে আমার সমনে ধরে মারুফ বলেছিল আপু এই মেহেদী রাঙা হাতের মতই প্রতিটি দিন হবে আমাদের মেহেদী সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সন্ধ্যার মঞ্চ। মুহুর্তে ধুলোয় মিশে গেলো মারুফের সকল আশা, বাকহীন সুমনা। রাস্তায় পড়ে আছে মারুফের রক্তাক্ত লাশ। সুমনা জানেনা মারুফের ঠিকানা। তবু স্বামীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস রেখে জীবনের প্রথম ঢাকা শহরে পা রেখেছে সুমনা। আমি বললাম সুমনা তুই তোর বাড়িতে একটা ফোন দে বাড়িতে জানা এই ঘটনা।
সুমনা ফোন দিলো ওর বাড়িতে সৎ মা আর সৎ ভায়েরা বললঃ মারুফ মরেছে তো তুই আমাদের কেন ফোন দিচ্ছিস হতচ্ছাড়ি? ওর সাথে তুইও কেন মরলি না হাড় জ্বালানী? ভাবলাম এতোদিনে হাপ ছেড়ে বেঁচেছি শোন ঢাকায় গেছিস ওখানেই থাকিস এখনে যেন আর ফিরে আসিস না অপয়া দামড়ি কোথাকার বিয়ের দু’দিন না যেতেই বরতাকে খালি এবার আমাদের খাবি রাক্ষসিনী। ফোনটা পড়ে গেলো সুমনার হাত থেকে। বললাম এখন কি করবি সুমনা? মারুফের লাশ নিয়ে সে এখন কোথায় যাবি?, একথা বলেই সুমনা পড়ে গেলো মাটিতে । আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লাশবাহী গাড়ি এসেছে মারুফকে নিতে। তবে কি বেওয়ারিশ হবে মারুফ?
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো এভাবে ড্রাইভারদের নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে আর কত মারুফকে দিতে হবে জীবন? আর কত সুমনার মেহেদীর রং না শুখাতেই অঙ্গে জড়াতে হবে সাদা শাড়ি? আমি কিছুই বলতে পারিনি কারণ আমারই সামনে পড়ে থাকা মারুফের লাশ আমাকে কিছুটা সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল। লাশ বাহি গাড়িটি দেখে সুমনা প্রশ্ন করলো এটা কিসের গাড়ি? । বললাম আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লাশবাহী গাড়ি। মাথাঘুরে পড়ে গেলো সুমনা, তারপর চেয়ে দেখি সুমনাও নিথর হয়ে আছে। ওদের দু’জনার লাস যখন গাড়িতে উঠাতে যাবে তখন আমি চিৎকার করে বলেছিলাম না মারুপ সুমনা ওরা কেউ বেওয়ারিস নয় আমি মিথিলা আমি আছি আমি ওদের স্বজন ওদের বড় বোন......
১৭ জানুয়ারি ২০১৭
সময় সন্ধ্যা ৭.২৫
২৭ শে জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১০
এস সুলতানা বলেছেন: আন্তরিক ধন্যবাদ
২| ২৯ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:৩৭
রাজীব নুর বলেছেন: একদম বাস্তব গল্প।
আপনি বেশ অভিজ্ঞ মানুষ।
২৯ শে মে, ২০২০ বিকাল ৩:০১
এস সুলতানা বলেছেন: আপন খেয়ালে লিখি , কি লিখ জানিনা। তবে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করি।
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৮:৩০
ইসিয়াক বলেছেন: চমৎকার লেখনী।
লিখতে থাকুন।
শুভকামনা।