![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নির্ভেজাল প্রকৃতি প্রেমী । সার্টিফিকেটের জোরে শিক্ষিত আসলে গবেট। মনে যা আসে লিখি। সাহিত্যের বিচারে না, মনের ইচ্ছায়, পরিবর্তনের মানসে...
আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অনাচার ও ভ্রষ্টাচার বিভিন্ন আঙ্গিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। তবে নূন্যতম প্রজ্ঞার
অধিকারী কােন ব্যক্তির কাছে সাধারণ মানুষের চিন্তার বা বিশ্বাস করার স্বাধীনতাকে শাসকগোষ্ঠী কতৃর্ক কেড়ে নেয়ার চেয়ে নির্মম ও অযৌক্তিক স্বৈরাচার আর কিছু হতে পারে না। প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে কােন শাসকের অমানিবক প্রচেষ্টাকেও কিছু
কিছু ক্ষেত্রে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষকেও শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় চিন্তা করতে বা শাসকগোষ্ঠীর মতবাদ অনুসারে চলতে বাধ্য করা কােনো অবস্থাতেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সকল জাতীকেই কােন না কোন সময় এ ধরনের পীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সংকীর্ণ অবস্থান থেকে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারের প্রশ্নকে তোয়াক্কা না করার ঘটনা আমরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে ঘটতে দেখেছি। এমন প্রবণতা সাধারণ জনগনের মধ্যেও দেখা যায়, যখন তারা অন্যের মতামত ও বিশ্বাসকে মুল্য দিতে অপারগ হয়ে স্বৈরাচারী নীতিতে নিজেরাও বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। যেমনটি বর্তমানে আমাদের দেশে দৃশ্যমান। ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অজুহাতে কাওকে কন্ঠরুদ্ধ করেই কান্ত হচ্ছেনা বরং বর্বরোচিতভাবে বেশকিছু মুক্তমনা লেখককে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের অপরাধ ধর্মকে তাঁরা প্রচলিত বিশ্বাস থেকে ব্যাখ্যা না করে তাঁদের নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে আলোচনা করেছেন। আবার সাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ঠিক একই কায়দায় ধর্ম বানিয়ে চলছে পাশবিকক্রিয়া। উভয় প্রতিক্রিয়াশীল এই দেশে প্রাণনাশের হুমকি নিয়ে অনেকেই নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। মানবজাতির ইতিহাসে বিভিন্ন অন্ধকার যুগের সুত্রাপাত এই ধরনের রক্ষণশীল পন্থার কারনেই হয়েছিল। এই উগ্রতা বা গোঁড়ামি মানুষদের ভিন্নমতাবলম্বী অন্য মানুষকে পোড়াতে, শেরােচ্ছেদ করতে, ফাঁসিতে ঝোলােতে, অঙ্গহানি করতে ও বন্দী করে রাখতে এমনকি জাতিগত গণহত্যা সাধনেও উদ্ভুদ্ধ করেছে। বতর্মান যুগে আমরা বিভিন্ন
দেশে নাৎসি ও কমিউনিজম শাসকেদর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যারর ঘটনা উদাহরণ
হিসেবে দেখতে পাই। অতীতে ধর্মপ্রচাকরগণ স্ব স্ব ধর্মের প্রবর্তনকল্পে এরুপ অনেক হীন কাজকে ধর্মীয় বৈধতা দিয়ে জায়েজ করেছিলেন। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটকেও খুব একটা আলাদা করে দেখার সুযোগ নাই।
কোরানের একাধিক আয়াতে হেজাজের সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব আয়াতে ধর্মীয় আদেশ-
নিষেধের সাথে তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনা ও সংঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন বিতর্ক, রটনাকারীদের কুৎসার জবাব,
ব্যক্তিগত ঝগড়ায় মধ্যস্থতা, যুদ্ধের জন্য সনির্বন্ধ আহ্বান, মুনাফেকদের নিন্দা, যুদ্ধলব্ধ মাল, নারীর প্রতি নির্দেশ এবং
বিরোধীপক্ষ ও অবিশ্বাসীদের মৃতুর পর দোজখের আগুনের হুমকি দিয়ে কোরানে শতাধিক আয়াত রয়েছে। নগরের বাসিন্ধারা
যদি পাপকাজে লিপ্ত থাকে তবে শ্রষ্টার ক্রোধে গোটা নগর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, পূর্বে এরকম গজব নাজেল হয়েছিল পুণ্যবান-
পাপী সবার ওপর।
এতএব একথা সহজেই অনুমেয় যে, কোরানে শ্রষ্টার মানবসূলভ গুণাবলী আছে। তিনি খুশি হোন, তিনি ক্রোধান্বিতও হোন। তাঁর পছন্দ-অপছন্দবোধ রয়েছে এবং তাঁকে সন্তুষ্ট
করা সম্ভব। এককথায় মানুষের সব ধরনের মানবীয় গুণাবলী ও স্বভাব শ্রষ্টার রয়েছে- যেমন ভালবাসা, রাগ করা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা (মুনাফেকদের ব্যাপারে) ষড়যন্ত্র, ছলনা ইত্যাদি।
(সুরা কালমে
রয়েছে : ‘যারা এই বাণী প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি ধীরে ধীরে ওদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাব
ওরা তা জানে না। আমি ওদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল অত্যান্ত শক্ত।’( ৬৮:৪৪-৪৫)। সুরা আ’রাফ-এ রয়েছে :
‘যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে আমি তাদেরকে ক্রমে ক্রমে এমনভাবে ধ্বংশের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারে না। আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল বড়ই নিপুণ।’
(৭:১৮২-১৮৩)।
সুরা আনফালে কুরাইশ-প্রধানদের
গোপন সভাকে উদ্যেশ্য করে বলা হয়েছে : ‘স্মরণ করো, অবিশ্বাসীরা তোমার বিরোদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল- তোমােকে বন্দী, হত্যা বা
নির্বাসিত করার জন্য। তারা যেমন ছলনা করত, তেমনই আল্লাহও ছলনা করেতন। বস্তুত আল্লাহর ছলনা সবেচেয় উত্তম")
যেহেতু বলা হয়ে থাকে, বিশাল এই মহাবিশ্বে একজনমাত্র শ্রষ্টা রয়েছেন, এতএব যৌক্তিকভাবে ধরে নিতে হবে সেই শ্রষ্টার আমাদের মত নগন্য মানুষের মানিবক বৈশিষ্ট ও দূর্বলতা থেকে মুক্ত। কিন্তু আমরা কোরানের শ্রষ্টার বৈশিষ্টাবলী হজরত মুহাম্মদের নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত বলে ধরে নিতে বাধ্য। আর হজরত মুহাম্মদ নিজেই বলেছেন তিনি নিজেও একজন মানুষ মাত্র। আমরা জানি তিনি অন্যান্য মানুষের মত মনে কষ্ট পেতেন, ছেলে হারানোর ব্যথায় কাতর
হয়েছেন, ওহুদের যুদ্ধে তাঁর চাচা হামজার বিকৃত লাশ দেখে শোকাতুর হয়ে প্রতিশােধের শপথ নিয়েছেন।
পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষন করলে প্রশ্ন আসে, কোরান, হজরত মুহাম্মদ ও আল্লাহকে কি আদৌ আলাদা করা সম্ভব নাকি
দুজন আসলে একই সত্ত্বা? কোরানের প্রচুর সুরা-আয়াত পর্যালোচনা করলে ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্ন সামনে চলে আসে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরও কয়েকটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা দরকার। সকল মুসলমান বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর বাণী। এই
বিশ্বাস কোরানেরই কিছু আয়াতের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে, যেমন: ‘কোরান ওহি, যা প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা নজম :
আয়াত ৪-৫)।
‘আমি কোরান অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে।’ ( সুরা কাদর : আয়াত ১)।
কোরান মুসলমানদের বিশ্বাসের একমাত্র দলিল, যা অবিসংবাদিত, রাজকীয় ও পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।
শুরু থেকে কোরানকে এত বেশি মর্যাদাশীল বলে ভাবা শুরু হয় যে (কোরান রচিত হওয়ার) মাত্র একশ’বছরের মধ্যে মুসলিম
পন্ডিতদের কিছু জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কোরান সৃষ্ট নাকি তা আল্লাহর মতই অসৃষ্ট, মানে তা কখনো অস্তিত্বহীন ছিল না।
এই বিতর্ক চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কিন্তু কোরান অসৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মৌলিক নীতিমালার সাথে
সাংঘর্ষিক।
তথাপি আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের (৮৩৩-৮৪২ খৃষ্টাব্দ) শাসনামলে সুন্নি ইমাম আহমদ বিন হানবল কোরানের অসৃষ্ট হওয়ার
মতবাদকে পরিত্যাগ করা দূরের কথা এ ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস এতই প্রবল ছিল যে তিনি বরং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত এজন্য
চাবুকের আঘাত সহ্য করে নেন। অর্থাৎ তিনি ‘আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক’ আয়াতখানিও আল্লাহর মতই চিরন্তন বলে মনে
করতেন। [কোরান অসৃষ্ট বিষয়টি ইমাম আহমদ বিন হানবলের মতো ব্যক্তিদের গভীর বিশ্বাসের মূলে রয়েছে কোরােনর একাধিক
আয়াত। যেমন সুরা বুরজে বলা হয়েছে : ‘বস্তুত এই হচ্ছে সম্মানিত কোরান, যা রয়েছে লাওহে মাহফজে (সংরক্ষিত
ফলকে)।’( ৮৫:২১-২২)। লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কোরান লিখেছিলেন পবিত্র সম্মানিত ফেরেশতারা। (দেখুন : ৮০ সুরা
আ’বাসা : আয়াত ১৩-১৬)
বিশ্বাসের মােহে আবদ্ধ থাকলে কাওকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে লাভ হয় না। বিষয়টি তাদের জন্য সত্য, যারা কোরান পড়েছেন।
কোরানের প্রথম সুরা ফাতেহা একটি গুরুত্ববহ উদাহরণ হতে পারে। এই সুরায় সাতটি আয়াত রয়েছে এবং একে ‘সাত পুনরাবৃত্তি' বলে। এই সুরার বিশেষ মর্যাদার জন্য একে কোরানের সর্বপ্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। সুরাটির অনুবাদ দেখা যাক:-
‘পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব্জগতের প্রতিপালক আল্লাহরই,
যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়
বিচারদিনের মালিক।
আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
তুমি আমাদেরকে চালিত করো সঠিক পথে-
তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছো,
তাদের পথ নয় যারা (তোমার) রােষে পতিত, এবং নয় তাদের পথ যারা পথভ্রষ্টও।’
এই বাক্যগুলো আল্লাহর হতে পারে না। এর বিষয়বস্তু থেকে এটা প্রতীয়মান যে, এটি নবির (শ্রষ্টার প্রশংসাকারী অন্য কারো) রচিত
কথামালা, কারণ এখানে আল্লাহর প্রশংসা রয়েছে, আল্লাহর প্রতি আকুতি ও মিনতি রয়েছে। শ্রষ্টা কখনো নিজের প্রতি বলবেন
না- ‘আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’
বাক্যের এই বিড়ম্বনা এড়ানো যেত যদি সুরাটির
আগে ‘বল’ ( আরবিতে- ‘কুল’) বা ‘ এই বলে প্রার্থনা কর’ কথাটি সংযুক্ত থাকত; যেমন রয়েছে সুরা ইখলাস-এর প্রথম
আয়াতে (বলো, ‘তিনি আল্লাহ (যিনি) অদ্বিতীয়), সুরা কাফিরুনে আছে (বলো, ‘হে অবিশ্বাসীরা!’) কিংবা সুরা কাহাফ-এ রয়েছে,
‘বলো, ‘আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে আল্লাহই তোমাদের একমাত্র
উপাস্য।’( ১৮:১১০)। এটি যৌক্তিকভাবে অসম্ভব যে, এই বিশ্বচরাচরের শ্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা কখনো বলবেন, ‘আমরা
একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ যেহেতু সুরা ফাতেহা কেবলমাত্র আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি মিনতি ছাড়া কিছুই নয় তাই ধারণা করা যুক্তিযুক্ত যে, এই সুরা আল্লাহর বাণী নয় বরং নবির দোয়া বা প্রার্থনা। বিখ্যাত
সাহাবি, কোরানের হাফেজ, হাদিস-বক্তা ও কোরানের অনুলেখক আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ সুরা ফাতেহার এই আয়াতকে তাঁর
অনুমোদিত কোরানে অন্তর্ভুক্ত করেননি এবং সুরা ফালাক ও সুরা নাসকেও তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন।
আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অনাচার ও ভ্রষ্টাচার বিভিন্ন আঙ্গিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। তবে নূন্যতম প্রজ্ঞার
অধিকারী কােন ব্যক্তির কাছে সাধারণ মানুষের চিন্তার বা বিশ্বাস করার স্বাধীনতাকে শাসকগোষ্ঠী কতৃর্ক কেড়ে নেয়ার চেয়ে নির্মম ও অযৌক্তিক স্বৈরাচার আর কিছু হতে পারে না। প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে কােন শাসকের অমানিবক প্রচেষ্টাকেও কিছু
কিছু ক্ষেত্রে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষকেও শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় চিন্তা করতে বা শাসকগোষ্ঠীর মতবাদ অনুসারে চলতে বাধ্য করা কােনো অবস্থাতেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সকল জাতীকেই কােন না কোন সময় এ ধরনের পীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সংকীর্ণ অবস্থান থেকে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারের প্রশ্নকে তোয়াক্কা না করার ঘটনা আমরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে ঘটতে দেখেছি। এমন প্রবণতা সাধারণ জনগনের মধ্যেও দেখা যায়, যখন তারা অন্যের মতামত ও বিশ্বাসকে মুল্য দিতে অপারগ হয়ে স্বৈরাচারী নীতিতে নিজেরাও বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। যেমনটি বর্তমানে আমাদের দেশে দৃশ্যমান। ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অজুহাতে কাওকে কন্ঠরুদ্ধ করেই কান্ত হচ্ছেনা বরং বর্বরোচিতভাবে বেশকিছু মুক্তমনা লেখককে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের অপরাধ ধর্মকে তাঁরা প্রচলিত বিশ্বাস থেকে ব্যাখ্যা না করে তাঁদের নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে আলোচনা করেছেন। আবার সাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ঠিক একই কায়দায় ধর্ম বানিয়ে চলছে পাশবিকক্রিয়া। উভয় প্রতিক্রিয়াশীল এই দেশে প্রাণনাশের হুমকি নিয়ে অনেকেই নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। মানবজাতির ইতিহাসে বিভিন্ন অন্ধকার যুগের সুত্রাপাত এই ধরনের রক্ষণশীল পন্থার কারনেই হয়েছিল। এই উগ্রতা বা গোঁড়ামি মানুষদের ভিন্নমতাবলম্বী অন্য মানুষকে পোড়াতে, শেরােচ্ছেদ করতে, ফাঁসিতে ঝোলােতে, অঙ্গহানি করতে ও বন্দী করে রাখতে এমনকি জাতিগত গণহত্যা সাধনেও উদ্ভুদ্ধ করেছে। বতর্মান যুগে আমরা বিভিন্ন
দেশে নাৎসি ও কমিউনিজম শাসকেদর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যারর ঘটনা উদাহরণ
হিসেবে দেখতে পাই। অতীতে ধর্মপ্রচাকরগণ স্ব স্ব ধর্মের প্রবর্তনকল্পে এরুপ অনেক হীন কাজকে ধর্মীয় বৈধতা দিয়ে জায়েজ করেছিলেন। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটকেও খুব একটা আলাদা করে দেখার সুযোগ নাই।
কোরানের একাধিক আয়াতে হেজাজের সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব আয়াতে ধর্মীয় আদেশ-
নিষেধের সাথে তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনা ও সংঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন বিতর্ক, রটনাকারীদের কুৎসার জবাব,
ব্যক্তিগত ঝগড়ায় মধ্যস্থতা, যুদ্ধের জন্য সনির্বন্ধ আহ্বান, মুনাফেকদের নিন্দা, যুদ্ধলব্ধ মাল, নারীর প্রতি নির্দেশ এবং
বিরোধীপক্ষ ও অবিশ্বাসীদের মৃতুর পর দোজখের আগুনের হুমকি দিয়ে কোরানে শতাধিক আয়াত রয়েছে। নগরের বাসিন্ধারা
যদি পাপকাজে লিপ্ত থাকে তবে শ্রষ্টার ক্রোধে গোটা নগর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, পূর্বে এরকম গজব নাজেল হয়েছিল পুণ্যবান-
পাপী সবার ওপর।
এতএব একথা সহজেই অনুমেয় যে, কোরানে শ্রষ্টার মানবসূলভ গুণাবলী আছে। তিনি খুশি হোন, তিনি ক্রোধান্বিতও হোন। তাঁর পছন্দ-অপছন্দবোধ রয়েছে এবং তাঁকে সন্তুষ্ট
করা সম্ভব। এককথায় মানুষের সব ধরনের মানবীয় গুণাবলী ও স্বভাব শ্রষ্টার রয়েছে- যেমন ভালবাসা, রাগ করা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা (মুনাফেকদের ব্যাপারে) ষড়যন্ত্র, ছলনা ইত্যাদি।
(সুরা কালমে
রয়েছে : ‘যারা এই বাণী প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি ধীরে ধীরে ওদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাব
ওরা তা জানে না। আমি ওদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল অত্যান্ত শক্ত।’( ৬৮:৪৪-৪৫)। সুরা আ’রাফ-এ রয়েছে :
‘যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে আমি তাদেরকে ক্রমে ক্রমে এমনভাবে ধ্বংশের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারে না। আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল বড়ই নিপুণ।’
(৭:১৮২-১৮৩)।
সুরা আনফালে কুরাইশ-প্রধানদের
গোপন সভাকে উদ্যেশ্য করে বলা হয়েছে : ‘স্মরণ করো, অবিশ্বাসীরা তোমার বিরোদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল- তোমােকে বন্দী, হত্যা বা
নির্বাসিত করার জন্য। তারা যেমন ছলনা করত, তেমনই আল্লাহও ছলনা করেতন। বস্তুত আল্লাহর ছলনা সবেচেয় উত্তম")
যেহেতু বলা হয়ে থাকে, বিশাল এই মহাবিশ্বে একজনমাত্র শ্রষ্টা রয়েছেন, এতএব যৌক্তিকভাবে ধরে নিতে হবে সেই শ্রষ্টার আমাদের মত নগন্য মানুষের মানিবক বৈশিষ্ট ও দূর্বলতা থেকে মুক্ত। কিন্তু আমরা কোরানের শ্রষ্টার বৈশিষ্টাবলী হজরত মুহাম্মদের নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত বলে ধরে নিতে বাধ্য। আর হজরত মুহাম্মদ নিজেই বলেছেন তিনি নিজেও একজন মানুষ মাত্র। আমরা জানি তিনি অন্যান্য মানুষের মত মনে কষ্ট পেতেন, ছেলে হারানোর ব্যথায় কাতর
হয়েছেন, ওহুদের যুদ্ধে তাঁর চাচা হামজার বিকৃত লাশ দেখে শোকাতুর হয়ে প্রতিশােধের শপথ নিয়েছেন।
পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষন করলে প্রশ্ন আসে, কোরান, হজরত মুহাম্মদ ও আল্লাহকে কি আদৌ আলাদা করা সম্ভব নাকি
দুজন আসলে একই সত্ত্বা? কোরানের প্রচুর সুরা-আয়াত পর্যালোচনা করলে ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্ন সামনে চলে আসে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরও কয়েকটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা দরকার। সকল মুসলমান বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর বাণী। এই
বিশ্বাস কোরানেরই কিছু আয়াতের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে, যেমন: ‘কোরান ওহি, যা প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা নজম :
আয়াত ৪-৫)।
‘আমি কোরান অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে।’ ( সুরা কাদর : আয়াত ১)।
কোরান মুসলমানদের বিশ্বাসের একমাত্র দলিল, যা অবিসংবাদিত, রাজকীয় ও পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।
শুরু থেকে কোরানকে এত বেশি মর্যাদাশীল বলে ভাবা শুরু হয় যে (কোরান রচিত হওয়ার) মাত্র একশ’বছরের মধ্যে মুসলিম
পন্ডিতদের কিছু জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কোরান সৃষ্ট নাকি তা আল্লাহর মতই অসৃষ্ট, মানে তা কখনো অস্তিত্বহীন ছিল না।
এই বিতর্ক চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কিন্তু কোরান অসৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মৌলিক নীতিমালার সাথে
সাংঘর্ষিক।
তথাপি আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের (৮৩৩-৮৪২ খৃষ্টাব্দ) শাসনামলে সুন্নি ইমাম আহমদ বিন হানবল কোরানের অসৃষ্ট হওয়ার
মতবাদকে পরিত্যাগ করা দূরের কথা এ ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস এতই প্রবল ছিল যে তিনি বরং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত এজন্য
চাবুকের আঘাত সহ্য করে নেন। অর্থাৎ তিনি ‘আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক’ আয়াতখানিও আল্লাহর মতই চিরন্তন বলে মনে
করতেন। [কোরান অসৃষ্ট বিষয়টি ইমাম আহমদ বিন হানবলের মতো ব্যক্তিদের গভীর বিশ্বাসের মূলে রয়েছে কোরােনর একাধিক
আয়াত। যেমন সুরা বুরজে বলা হয়েছে : ‘বস্তুত এই হচ্ছে সম্মানিত কোরান, যা রয়েছে লাওহে মাহফজে (সংরক্ষিত
ফলকে)।’( ৮৫:২১-২২)। লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কোরান লিখেছিলেন পবিত্র সম্মানিত ফেরেশতারা। (দেখুন : ৮০ সুরা
আ’বাসা : আয়াত ১৩-১৬)
বিশ্বাসের মােহে আবদ্ধ থাকলে কাওকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে লাভ হয় না। বিষয়টি তাদের জন্য সত্য, যারা কোরান পড়েছেন।
কোরানের প্রথম সুরা ফাতেহা একটি গুরুত্ববহ উদাহরণ হতে পারে। এই সুরায় সাতটি আয়াত রয়েছে এবং একে ‘সাত পুনরাবৃত্তি' বলে। এই সুরার বিশেষ মর্যাদার জন্য একে কোরানের সর্বপ্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। সুরাটির অনুবাদ দেখা যাক:-
‘পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব্জগতের প্রতিপালক আল্লাহরই,
যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়
বিচারদিনের মালিক।
আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
তুমি আমাদেরকে চালিত করো সঠিক পথে-
তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছো,
তাদের পথ নয় যারা (তোমার) রােষে পতিত, এবং নয় তাদের পথ যারা পথভ্রষ্টও।’
এই বাক্যগুলো আল্লাহর হতে পারে না। এর বিষয়বস্তু থেকে এটা প্রতীয়মান যে, এটি নবির (শ্রষ্টার প্রশংসাকারী অন্য কারো) রচিত
কথামালা, কারণ এখানে আল্লাহর প্রশংসা রয়েছে, আল্লাহর প্রতি আকুতি ও মিনতি রয়েছে। শ্রষ্টা কখনো নিজের প্রতি বলবেন
না- ‘আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’
বাক্যের এই বিড়ম্বনা এড়ানো যেত যদি সুরাটির
আগে ‘বল’ ( আরবিতে- ‘কুল’) বা ‘ এই বলে প্রার্থনা কর’ কথাটি সংযুক্ত থাকত; যেমন রয়েছে সুরা ইখলাস-এর প্রথম
আয়াতে (বলো, ‘তিনি আল্লাহ (যিনি) অদ্বিতীয়), সুরা কাফিরুনে আছে (বলো, ‘হে অবিশ্বাসীরা!’) কিংবা সুরা কাহাফ-এ রয়েছে,
‘বলো, ‘আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে আল্লাহই তোমাদের একমাত্র
উপাস্য।’( ১৮:১১০)। এটি যৌক্তিকভাবে অসম্ভব যে, এই বিশ্বচরাচরের শ্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা কখনো বলবেন, ‘আমরা
একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ যেহেতু সুরা ফাতেহা কেবলমাত্র আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি মিনতি ছাড়া কিছুই নয় তাই ধারণা করা যুক্তিযুক্ত যে, এই সুরা আল্লাহর বাণী নয় বরং নবির দোয়া বা প্রার্থনা। বিখ্যাত
সাহাবি, কোরানের হাফেজ, হাদিস-বক্তা ও কোরানের অনুলেখক আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ সুরা ফাতেহার এই আয়াতকে তাঁর
অনুমোদিত কোরানে অন্তর্ভুক্ত করেননি এবং সুরা ফালাক ও সুরা নাসকেও তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন।
©somewhere in net ltd.