![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নির্ভেজাল প্রকৃতি প্রেমী । সার্টিফিকেটের জোরে শিক্ষিত আসলে গবেট। মনে যা আসে লিখি। সাহিত্যের বিচারে না, মনের ইচ্ছায়, পরিবর্তনের মানসে...
সাদিক তাজিন।
গোটা উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশ বা বঙ্গ ভূখন্ড প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে খুবই সমৃদ্ধ। আর এই সমৃদ্ধিতে সিলেট তথা প্রাচীন শ্রীহট্টের রয়েছে অনবদ্য ও একচ্ছত্র অবদান। সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি বিশ্লেষন করলে তা প্রতিয়মান হয় স্বচ্চ আয়নার মত। এ অঞ্চলের মানুষের অতীত সৃজনশীলতা ক্ষেত্রবিশেষ বর্তমানকেও হার মানায়। নাগরী লিপি ও তদসংশ্লিষ্ট পুঁথি সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তেমনি এক স্বর্ণালী অধ্যায় রচনা করেছে।
নাগরী লিপি মুলত বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি শক্তিধর দ্বিতীয় বর্ণমালার বৈশিষ্টময় উদ্ভাবন ও প্রচলন, যা এখানকার জনসমষ্টির লিখিত ভাব প্রকাশ ও সাহিত্য চর্চার বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশদ বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে এখানকার নব্য প্রচারপ্রাপ্ত ধর্ম ইসলাম এর অনুসারীগন স্বীয় সম্প্রদায়ের ভাব বিনোদন, সাহিত্য সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে এই লিপির প্রচলন শুরু করেন। এটি সিলেটকেন্দ্রিক উপ বর্ণমালা হলেও এর প্রভাব ছিল সুদূর কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা পর্যন্ত বিস্তৃত।
নাগরী কোন ভাষা নয়, লিপিমাত্র। সিলোটী নাগরীকে কোন মৌলিক লিপি দাবী করার অবকাশ নেই। যদিও অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে একে স্বতন্ত্র ভাষা বা লিপি দাবী করেন যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। বাংলা, দেবনাগরী, কাইথী, ও আরবী লিপিমালার সমন্বয়ে স্বকীয় আদর্শের উজ্জিবন ও প্রচারের মানসেই এ লিপির উদ্ভব, বিকাশ ও প্রচলন বলা যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীতে এ অঞ্চলের সমাজ ব্যাবস্থায় আধুনিক ইংরেজি ও শুদ্ধ বাংলার চর্চা সম্প্রসারিত হলে আর্থিক ও রাজনৈতিক কারনে একেবারেই কমে আসে যুক্তাক্ষরবিহীন ৩২ হরফের এই বর্নমালার চর্চা।
নাগরী লিপির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে মতভেদের অন্ত নেই। তবে সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এর উদ্ভব মুলত চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে। হযরত শাহজালাল ও তাঁর ৩৬০ আউলিয়া এখানে সুফিবাদের যে ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন সেই সেই প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় ভাবধারার সাহিত্য চর্চার প্রয়োজনে এই লিপির উদ্ভব। যদিও পরবর্তী সময়ে কেবল ধর্মীয় ভাবধারার সাহিত্যের জন্য নাগরী সীমাবদ্ধ থাকেনি। লোকজ সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রেম, মোহ জীবনী সহ নানান ভঙ্গিমায় এ লিপির ব্যবহার ঘটে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এ অঞ্চলে আফগানরা উপনিবেশ স্থাপন করলে এবং তাদের প্রচলিত মুদ্রায় উক্ত লিপির প্রয়োগ থাকাতে অনেকেই মনে করেন আফগানরাই এ লিপির পুরোধা।
মুলত নব্য মুসলিম সমাজকে ইংরেজ আমলে এবং তৎপূর্ব হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতির আকর্ষন, প্রভাব এবং চেতনার বলয় থেকে মুক্ত রাখতে মুসলিম কান্ডারীরাই এ লিপির আবিষ্কার ও প্রচার করেন। যেমনটা করেছিলেন বৈষ্ণব সাধকরা ব্রজবুলি নামক আলাদা ভাষা তৈরি করে। যদিও তাদের নিজস্ব লিপি ছিলনা।
হযরত শাহজালালের আগমনপূর্ব শ্রীহট্টে যেহেতু সনাতন ধর্মের প্রাধান্য ছিল তাই সেরকম সাংস্কৃতিক চর্চাও ছিল এ অঞ্চলে ব্যাপক। কিন্তু এই প্রতিকুল পরিবেশে বিধি নিষেধের ছড়াছড়িতে ভরপুর একটি নতুন ধর্মের প্রচার এবং বিস্তার লাভ সহজসাধ্য ছিলনা। এসমস্ত কারনগুলোকে সামনে রেখে যাতে মানবমনে নবদীক্ষিত ধর্মের প্রতি অনাগ্রহের সঞ্চার না হয় সেই লক্ষ্যে পুঁথি সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। এতে প্রাথমিক অবস্থায় ধর্মের নানান আখ্যান, উদারতা, অলৌকিকত্ব, ত্যাগ, ট্র্যাজেডি ইত্যাদি আবেদন সৃষ্টিতে সহায়ক হয় সেইসব কাহিনী অত্যন্ত যত্নে লিপিবদ্ধ করা হয়। বিনোদন প্রধান মানুষের বিনোদন আাকাঙ্খায় কোন প্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে সুকৌশলে ধর্মীয় আচার, কৃষ্টি, স্বপক্ষীয় জ্ঞানের প্রচারেই পুঁথিসাহিত্য ব্যাপকতা লাভ করে। আর এ পুঁথিসাহিত্যের প্রয়োজনেই নাগরী নামক পৃথক লিপির ব্যবহার আরম্ভ করা হয়। নাগরী লিপির ব্যবহার ও পুঁথিসাহিত্যের বিকাশ সম্পর্কে ড.গোলাম কাদির বলেন:
"বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লিখন পঠন-পাঠনের চর্চায় বাংলার একটি বিকল্প লিপিমালার নাম, সিলটী নাগরী। খ্রিষ্টিয় সতের শতকে এ লিপির উদ্ভব ঘটে এখানে। আঠারো-ঊনিশ শতকে এ লিপির চর্চা ব্যাপক আকার ধারন করে। ফলে এ লিপির মাধ্যমে শতাধিক পুস্তক রচিত, মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়েছে। এমনকি বিশ শতকের প্রথমার্ধেও এর অনুবর্তন অব্যাহত ছিল। অথচ বৃহত্তর বাংলা ভাষাভাষীর প্রায় অগোচরেই রয়ে গেছে এই মানস চর্চাজাত তাৎপর্যময় বিষয়টি।"
উৎস: সিলেটী নাগরী লিপি: ভাষা ও সাহিত্য : বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৯৯।
বিলুপ্তির পথে হাটা এ সাহিত্য সিলেটের মানুষের সৃজনক্ষমতা প্রাচীনকালে কীরকম ছিল-সেই জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়। সমস্ত বাংলাদেশের আর কোথাও বাংলা বর্ণমালার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলা আরেকটি লিপি নেই। কবি গোলাম মুরতজা তাঁর 'লিপিবিদ্যার ইতিহাস'এ এবং ড. মনিরুজ্জামান তাঁর 'বাংলাদেশের উপভাষা' গ্রন্থে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নাগরী লিপির কথা ও পুঁথি সাহিত্যের কথা আলোকপাত করেছেন।
কালের বিবর্তনে পুঁজিবাদের দৌরাত্বে এ লিপির ব্যবহার শুন্যের কোটায় উপণিত হতে চলেছে। ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ লিপি যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহনের কথা বলছেন অনেকেই। অবলুপ্তির ঝুঁকি থেকে এ বিরল ঐতিহ্যকে সংরক্ষন, পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সভা, সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতামুলক আয়োজন করা যেতে পারে। পাশাপাশি সামাজিক পর্যায় থেকেও নাগরী লিপির প্রসারে কাজ করা সম্ভব। এ লিপি ও তদসংশ্লিষ্ট পুঁথি সাহিত্যের সংরক্ষনের মহান কাজটিতে ইতিমধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন বিশিষ্ট প্রকাশক ও নাগরী গবেষক মোস্তফা সেলিম। তিনি এ অঞ্চলের সন্তান হিসেবে তাঁর দ্বায়িত্ববোধ থেকে সাহসিকতার পরিচয় প্রদান করেছেন ২৫ খন্ডের নাগরী গ্রন্থ সম্ভার প্রকাশ করে। তাঁর এই ঐতিহ্যপ্রীতি কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।
আনন্দের বিষয় যে, নাগরী লিপি ও পুঁথি সাহিত্য নিয়ে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি এই প্রকাশনা দ্বারা।
যেহেতু নাগরী কেবল সিলেটের ঐতিহ্য নয় বরং বাংলা ভাষাভাষী সকল মানুষের অর্থাৎ বাংলাদেশের ঐতিহ্য তাই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলে নাগরী লিপি ও পুঁথি সাহিত্যকে পাঠ্য বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করাটা অত্যন্ত যৌক্তিক দাবী। সেটা করলে উক্ত লিপি অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং নতুনভাবে চর্চা ও সাধনার ফলে বাংলা সাহিত্যের পরিধি বিস্তৃত হবে। সামাজিক সংগঠন, সাহিত্য সংগঠনগুলো নাগরী ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা, বিতর্ক, সাধারন জ্ঞান, রচনা প্রতিযোগ ইত্যাদি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে।
কারো কারো মানসপটে এ প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যে, তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে ড্রাইনোসরের মত হারানো একটি লিপি উদ্ধারে এত গলদগর্ম হওয়ার কি আছে! কিন্তু মনে রাখা উচিত যে জাতি প্রত্ন ঐতিহ্যের ধারন, সংরক্ষন ও সুরক্ষা করেনা তারা এক কালে শিকড় বিহীন গাছের ন্যায় ভুপাতিত হয়। তাছাড়া নাগরী হলো যুক্তবর্ণহীন সেই সৃজনশীল লিপি যা লিপিবিদ্যার ইতিহাসে বিরল। আমাদের ঐতিহ্যঘন এই সম্পদকে সুরক্ষা, পঠন-পাঠনের এবং এ বর্ণে মুদ্রিত পুঁথি সাহিত্যের প্রসার ও উন্নয়নে সর্বচ্চো গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পুঁথিসাহিত্য ও এর অখ্যাত রচয়িতাগনের যথার্থ মুল্যায়ন উচিত।
সিলেটের গ্রামে-গঞ্জে, অখ্যাত জনপদে গত দুই-তিনশ বছর যাবৎ যেসব কবিরা লিখেছেন অনুভবের সত্যে এবং সৃজনী ভাবনায়, তাঁদের আকুতির আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। হারানো লিপি উদ্ধারের পাশাপাশি সেই কবিকুলের আকুতি পুণঃউচ্চারিত হোক প্রজন্মের কর্ণকূহরে।
২| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৪৯
সাদিক তাজিন বলেছেন: কৃতজ্ঞতা অশেষ।
৩| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৪৭
ভ্রমরের ডানা বলেছেন: ভাষার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে মানুষের সৃজনশীলতা। তা অবশ্য সিলেটিরা প্রমান করেছে! লন্ডনে বাংলাদেশী বলতে সিলেটীদেরই বোঝায়! আচ্ছা বাংলা র্যাপার ফকির লাল ভাই সম্পর্কে কিছু জানান! তার গান ভাল লাগে!
৪| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:২৫
সাদিক তাজিন বলেছেন: জানবেন। বিনীত ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০০
সৈয়দ আবুল ফারাহ্ বলেছেন: কথাগুলো তুলে আনায় ধন্যবাদ সাদিক তাজিন ।