![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নির্ভেজাল প্রকৃতি প্রেমী । সার্টিফিকেটের জোরে শিক্ষিত আসলে গবেট। মনে যা আসে লিখি। সাহিত্যের বিচারে না, মনের ইচ্ছায়, পরিবর্তনের মানসে...
হাকালুকি হাওড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি। পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় ও পূর্বে পাথারিয়া মাধব পাহাড় বেষ্টিত হাকালুকি হাওড় সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫ টি উপজেলায় বিস্তৃত। ছোট বড় প্রায় ২৩৮টির ও বেশী বিল ও ছোট বড় ১০টি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওর বর্ষাকালে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়। এই হাওড়ে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকর ও বেশী এবং দেশের গুরুত্বর্পূন ও সংকটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতী পাওয়া যায়।
হাকালুকি হাওড় পরিবেশ বান্ধব পর্যটন উন্নয়নের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এই হাওড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি। হাকালুকি হাওড় বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
শীত মৌসুমে হাওড়ের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। বিলের জলের মাঝে ও চারিধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উচুভূমি বিলের জলে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্য। সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওড়ের জলরাশির মাঝে সূর্যের প্রতিচ্ছবি সত্যই দৃষ্টিনন্দন ও মনঃমুগ্ধকর। শীত কালে হাওড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যকে সমৃৃদ্ধ করে বিভিন্ন ধরণের অতিথি পাখির আগমন ও কলরব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অতিথি পাখিরা আসে এই হাকালুকি হাওরে খাদ্য ও আবাসস্থলের সন্ধানে এবং বেছে নেয় বিভিন্ন বিল, নদী, খাল, কৃষিভূমি ও বিস্তৃত প্রান্তর তাদের শীতকালীন নিরাপদ আবাসস্থল রুপে। হাকালুকি হাওড় পরিণত হয় দেশীয় ও অতিথি পাখির মিলন কেন্দ্রে।
বর্ষাকালে হাকালুকি হাওড়ের ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদী একীভূত হয়ে রুপ ধারণ করে সাগরের ন্যায় এক বিশাল জলাশয়ের। এ সময় হাকালুকি হাওড়ের বিলের পাড় ও কান্দায় বিদ্যমান জলাভূমিবন পানির নিচে ডুবে গিয়ে সৃষ্টি করে ডুবন্ত বন যা ব্যবহৃত হয় মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে। বর্ষাকালে হাকালুকি হাওড় পাড়ে বসবাসরত মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম উন্মাদনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা হয সহজ, যোগাযোগের বাহন হিসাবে স্থান করে নেয় দেশীয় দাঁড়বাহী ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা। জেলেরা মেতে ওঠে মাছ ধরার উৎসবে, বিভিন্ন প্রকার সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এই সময অনুষ্ঠিত হয় । হাকালুকি হাওড়ের জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডারও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
পরিচ্ছেদসমূহ
• ১ নামকরণ
• ২ উদ্ভিদবৈচিত্র্য
• ৩ বাথান পদ্ধতি
• ৪ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
• ৫ আরো দেখুন
• ৬ তথ্যসূত্র
নামকরণ
"সাগর" শব্দটি থেকে "হাওর" শব্দের উৎপত্তি[৪] বলে ধরে নেয়া হয়।[৩] তবে "হাকালুকি" নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন লোককাহিনী রয়েছে:
জনশ্রুতিমতে, বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এমনভাবে লুকি দেয় বা লুকিয়ে যায় যে, কালক্রমে ঐ এলাকার নাম হয় "হাঙ্গর লুকি", ধীরে ধীরে তা "হাকালুকি"-তে পর্যবসিত হয়। আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড এক ভূমিকম্পে "আকা" নামে এক রাজা ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় "আকালুকি" বা হাকালুকি। আরো প্রচলিত যে, এক সময় বড়লেখা থানার পশ্চিমাংশে "হেংকেল" নামে একটি উপজাতি বাস করতো। পরবর্তিতে এই "হেংকেলুকি" হাকালুকি নাম ধারণ করে। এও প্রচলিত যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি একসময় বাস করতো কুকি, নাগা উপজাতিরা। তাঁদের নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করা হয় "হাকালুকি", যার অর্থ 'লুকানো সম্পদ'।[২]
উদ্ভিদবৈচিত্র্য
হাকালুকি হাওরের স্থায়ী জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ জন্মে। এক সময়ের অন্যতম আকর্ষণীয়, ভাসমান বড় বড় গাছপালা (swamp forest) এখন আর নেই। চাতলা বিল-এ ছোট আকারের এরকম একটি বন আছে (২০০০ খ্রিস্টাব্দ)।
বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী পাওয়া যায় এই হাওড়ে। নিম্নে হাওড়ের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আংশিক তথ্য দেয়া হল: উদ্ভিদ : ৫২৬ প্রজাতি ,মোট পাখী : ৪১৭ প্রজাতি, তন্মন্ধে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখী ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখী,অনান্য বন্যপ্রাণী :১৪১ প্রজাতি, মাছ : ১০৭ প্রজাতি, তন্মদ্ধে ৩২ প্রজাতি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপদগ্রস্থ । এছাড়াও রয়েছে নানান ধরনের কীটপতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অনুজীব। গুল্ম, জলজ উদ্ভিদ ও কৃষিঃ- বিষ্ময়কর বেশ কিছু গুল্ম দেখা যায় হাকালুকি হাওড়ে। বিলুপ্ত প্রায় অনেক জলজ উদ্ভিদ দিব্যি কালের সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছে এই হাওড়ে। হিজল, করচ, নলখাগড়া সহ কয়েক প্রজাতির গুল্ম বছরের পাঁচ মাস জীবন বাঁজী রেখে পানির নিচে থেকেও অলৌকিকতার আদলে বেঁচে থাকে। এগুলো বিভিন্ন বিলের কান্দায় ৮০০-১০০ হেক্টর ডিগ্রেডেড জলাভুমিতে দেখা যায়। এগুলোর সাথে প্রচুর বনতুলশী, আরাং, ছিটকি ফার্নে গুল্ম আকারে এবং বনলত ও শতমূল গাছ লতার আকারে একটা আরেকটার সাথে জড়াজড়ি করে অবস্থান করে। এছাড়া প্রচুর জারুল হাওড়ের বিভিন্ন এলাকায় জন্মে। জলজ উদ্ভিদের মধ্যে পানিফল/সিঙ্গারা, মাখনা, ফুটকি, ছোট কুট, পানচুলি/চাঁদমালা, ঘেচ, মালঞ্চ, শাপলা, কম্বল/রক্ত কম্বল, নিল পদ্ম/রক্ত কম্বল, সুন্দি, কচুরী পানা, টোপা পানা উল্লেখযোগ্য। গভীর পানিতে ফলে এরকম কিছু আদি ধানের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় হাকালুকি হাওড় এলাকায়। এগুলো বেশীরভাগ ধানের জাত ভারতের। গভীর জলের ধান হিসাবে গভীর জলি আমন ধান, কালা পুরা, বাগদার, হাসবাদাল,পরিচক, আইনা, কার্তিকা উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য ধানের মধ্যে বোরো ধান, রাতা বোরো, খইয়া বোরো, কন্যা শাইল, পশু শাইল অধিক হারে ফলে। কিছুটা উচু এলাকায় সিলেট এলাকার ঐতিহ্যবাহী বিরুন ধানের কিছু আবাদ হয়। শীতের সময় মৌসুমী ফসল হিসাবে ঐতিহ্যবাহী ফরাস সিমের প্রচুর আবাদ হয় হাওড় পাড়ের জমিতে। এছাড়া গম,শরিষা, চিনা বাদাম, আলু, টমেটো, মরিচ, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, শশা, গাজর, লাল শাক, পাতা কফি, বাঁধা কফি, ওল কফি, মূলা ও তিষি চাষ হয়ে থাকে। মূলতঃ সবজী চাষ ইদানিং কালে কিছু অন্য এলাকার (আঞ্চলিক ভাষায় আবাদী) লোকজন গিয়ে অধিক হারে চাষ করা শুরু করেছে। সরকারী সংশ্লিষ্ট দপ্তর সমূহ এ ব্যপারে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে হাওড়ের অনাবাদী জমি সমূহে ফসল ফলানোর জন্য। কুলাউড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের কৃষিবিদ ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর সাহেবের তদারকী ও সরাসরি দিক নির্দেশনায় বর্তমানে সবজী চাষে বিপ্লব ঘটাতে চলছে হাওড় অঞ্চলের কৃষকরা। হাকালুকি হাওড়ে শুকনা মৌসুমে গরু ও মহিষের পালন চলে অদ্ভুদ সুন্দর নিয়মে। এক একজন রাখাল ১০০-২০০ গরু পালন করে এই হাওড়ে। গরু বা মহিষের মালিকেরা মাস চুক্তি পশু প্রতি ১০০ টাকা করে রাখালকে বুঝিয়ে দেয়। রাখাল শুকনার সময় ঐ পশু সমূহকে পালন করে নিজের মত করে। বর্ষাকাল এলে মালিকেরা তাদের পশু গুলো ফেরৎ নিয়ে যায়। গরু মহিষ গুলো দিনে রাতে হাওড়েই থাকে রাখালের সংগে। নিয়ে যায়। গরু মহিষ গুলো দিনে রাতে হাওড়েই থাকে রাখালের সংগে। সত্যিকারের কাউ বয় দেখতে হলে হাকালুকি হাওড়ে যেতে হবে। সেখানে রাখালের হাতে এখনো বাশেঁর বাঁশি থাকে। দুপরের রোদে হিজল গাছের তলে বসে আপন মনে রাখাল তার বাঁশিতে প্রাণের সুর তুলে গান গায় হাকালুকি হাওড়ে। রাতে গরু-মহিষগুলো এক যায়গায় গুচ্ছ হয়ে শুয়ে রাখালের বাঁশির সুরে গান শুনে ঘুমিয়ে পড়ে।
-
ইকো-ট্যুরিজমের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় আমাদের হাকালুকি হাওড়সহ ৭টি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। উপরোক্ত প্রাকৃতিক উপাদান ছাড়াও রয়েছে স্থানীয় পেশাজীবি মানুষের ইতিহাস, সামাজিক আচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ।
বাথান পদ্ধতি
হাকালুকি হাওরের বিশাল প্রান্তরে শুষ্ক মৌসুমে অবাধে বিচরণ করে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি। হাওর উপকূলবর্তি এলাকার লোকজন, ফসল উঠে গেলে বছরের শুষ্ক মৌসুমের নির্দিষ্ট কয়েক মাস তাদের গৃহপালিত গবাদি পশু পাঠিয়ে দেন হাওরে বসবাসরত একশ্রেণীর মানুষের কাছে, যারা এগুলোর তত্ত্বাবধান করে। এই কাজের বিনিময়ে এরা দুধ পায়। মেয়াদ শেষে প্রকৃত মালিক এসে গরু-বাছুর ফেরত নেয়। এই পুরো ব্যবস্থাকে হাওর এলাকায় "বাথান" বলা হয়। বাথানের মালিকেরা এসকল গবাদি পশুর দুধ বিক্রী করে প্রচুর উপার্জন করে থাকেন। একারণে হাকালুকি হাওর এলাকা স্থানীয়ভাবে দুধ ও দৈ-এর জন্য বিখ্যাত।[২]
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বাংলাদেশের মৎস সম্পদের একটা বড় অংশ রয়েছে হাওরাঞ্চলে, তন্মধ্যে হাকালুকি হাওর এলাকায় অধিকাংশ বিল ভরাট হয়ে গেছে। দুটি জরিপ থেকে জানা যায় (পরিপ্রেক্ষিত ২০০৯): ২৮১টি বিলের মধ্যে সম্পূর্ণ ও আংশিক ভরাট হয়ে গেছে ২৩৩টি বিল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে হাওরাঞ্চলের বিলগুলোতে পানির পরিমাণ। ফলে যে বিলগুলো এখনও টিকে আছে, সেগুলোতে পানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ায় হুমকির মুখে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রাপ্তিযোগ্যতা। এছাড়া সময়মতো বৃষ্টি হয় না, বা যখন হয়, তখন একসাথে অতিবৃষ্টি হওয়ার ফলে হাওর পানিতে ভরে গেলেও তা স্থায়ী হয় না, ফলে মাছ আসে না। এতে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। অভিজ্ঞদের বক্তব্য থেকে এর বিস্তারিত কারণ যা জানা যায় তা হলো, সময়মতো পানি না হলে মাছ ডিম ছাড়তে পারে না। বৃষ্টি হলে পানির তাপ কমে, এসময় মাছ ডিম ছাড়ে। বদ্ধ পানিতে উত্তাপ বেশি থাকে, তাই সময়মতো বৃষ্টির খুব বেশি দরকার।[৫]
©somewhere in net ltd.