নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইখতিয়ার শাকিল

ইখতিয়ার শাকিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন যেভাবে খুন হলেন......

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫৪

(লিখাটা পড়ার পর দয়া করে কেউ কাঁদবেন না। আমাদের কান্নার জন্য তাঁরা জীবন দেন নাই। একেকজন রাজাকারের ফাঁসি হয়, আর সেলিনা পারভীনদের আত্না শান্তি পায়। )
"১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি।

আমরা তখন ছিলাম সিদ্ধেশ্বরীতে, তত্‍কালীন ১১৫নং নিউ সার্কুলার রোডে। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। আমি ছাদে খেলাধুলা করছি আর মা একটা চেয়ার টেনে কী যেন লিখছেন।

একটি গাড়ি এসে থামে আমাদের বাসার সামনে। ছাদে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে আমরা দেখি কয়েকজন লোক আমাদের বাসায় ঢুকছে। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। এরা বাসার প্রধান লোহার কলাপসিবল দরজার কড়া নাড়ছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বের হয়ে কলাপসিবল গেইট খুলে দেয়। গাড়িতে করে আসা লোকগুলো ভদ্রলোকের কাছে সেলিনা পারভীনের পরিচয় জানতে চায়। ভদ্রলোক আমাদের ফ্ল্যাটটি দেখিয়ে দেন। ভদ্রলোককে ঘরে চলে যেতে বলে লোকগুলো আমাদের ফ্ল্যাটে এসে কড়া নাড়ে। মা দরজা খুলে দেন। লোকগুলো মার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং বাসায় কে কে থাকে তাও জেনে নেয়। এ সময় মার সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। আমি আর উজির মামা ততক্ষণে সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা উঁকি দিলে ওরা দেখে ফেলে। আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। আমি ও উজির মামা ভয় পাই। মা আমাদের ডেকে নিয়ে লোকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি মার কাছে চলে আসি। এরপর মাকে তাদের সাথে যেতে বলে লোকগুলো।
মা লোকগুলোকে বলেন, 'বাইরে তো কারফিউ। এখন যাব কীভাবে?' লোকগুলো বলে, 'আমাদের সাথে গাড়ি আছে। তাছাড়া আমাদের সাথে কারফিউ পাশও আছে। কোনো সমস্যা হবে না।' ওরা নাছোড়বান্দা, আম্মাকে নিয়ে যাবেই। মা তখন বলেন, 'ঠিক আছে। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি শাড়ি বদল করে আসি।' ওরা বাধা দেয়। বলে, 'দরকার নেই। গাড়িতে করে যাবেন আবার গাড়িতে করেই ফিরে আসবেন।' আমিও তখন মার সাথে যেতে চাই। কিন্তু লোকগুলো আমাকে ধমক দিয়ে বলে, 'বাচ্চা লোক নেহি জায়েগা।' উজির মামা কিছু বলতে চাইলে তাঁকেও বলে, 'বাড়াবাড়ি করবেন না।'

আমি তখন মার খুব কাছে। তাঁর হাত ধরে আছি। মা আমার মাথায় হাত বুলান। তিনি আমাকে বলেন, 'সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসব।' এই ছিল আমার জীবনে মার কাছ থেকে শোনা শেষ কথা।

মা ছিল একটু শীত-কাতুরে। সবসময় পায়ে মোজা আর স্কার্ফ ব্যবহার করতেন। ১৩ ডিসেম্বর যেদিন বাড়ি থেকে মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিনও তাঁর পরনে ছিল সাদা শাড়ি-ব্লাউজ, সাদা স্কার্ফ, পায়ে সাদা জুতা ও মোজা। ফলে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাঁকে অনেক শহীদের মধ্যেও আমার আত্মীয়রা সনাক্ত করতে পারলেন সহজেই।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জানতে পারি, আমার মা আর বেঁচে নেই। আমি জানতে পারি, মা আর কখনোই আমার গায়ে তেল মেখে দেবেন না। আমার জন্য আর তিনি কোনোদিন চকলেট নিয়ে আসবেন না। আত্মীয়রা আমাকে বললেন, 'আমার মা আল্লাহর কাছে চলে গেছেন'।" "

- সুমন জাহিদ (শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে।)
ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত।

৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ৷ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে৷ ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন '৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে৷ শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদে আর সভায়ও৷ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি৷ এরই মধ্যে শুরু হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন৷ তাঁর বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন৷ খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে এরা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন৷ শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন৷ এই তরুণদের সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা৷

চারিদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ৷ চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু৷ এরই মাঝে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ শিলালিপির উপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়্গ৷ হাসেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার৷ পরে অবশ্য প্রকাশের অনুমতি মিললো তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে৷ সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তাঁর ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন৷ কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান৷ যেটাতে ছিল দেশ বরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা৷ তাই কাল হলো৷ শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন৷

১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে৷ নিচের ছবি দুটি শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:১৭

কেএসরথি বলেছেন: হুমম।

২| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩৮

আমি অনি বলেছেন: সীমান্তের এ পাশ থেকে সমবেদনা জানাই। পড়ে বাস্তবিক মর্মাহত হলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.