![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তাবিজে প্রেম
সামস সসুমন
২০/১২/১৫
শৈশবের সেই পাগলামি আর অদ্যকার এই স্মৃতিচারণ যখন সত্যিকার অর্থেই সম্পুর্ণরুপে এক ভিন্ন বিষয় বই আর কিছুই নয়, তখন সেই সুখ স্মৃতি হালকা কষ্টের পরশ মাখিয়া বিস্মৃত অতীতের আস্তাকুরের গর্ভ হইতে তুলিয়া আনিলে মনের অগোচরেই দুই ফোটা আশ্রুজল যদি বিসর্জিত হয়, তাহাতে দোষের কি?
অন্য সকলে যাহাই বলুকনা কেন, অন্তত মতিলাল ইহাতে দোষের কিছুই খুঁজিয়া পাইতেছেনা। আর তাই, ডিসেম্বরের শেষের এই কনকনে শীতের সারাটা রাত্রি বিছানায় ঘুমানোর নামে এপাশ ওপাশ করিয়া নির্ঘুম কাটাইয়া দিয়া মতিলাল তাহার অতীত সুখ স্মৃতি রোমন্থন করিতে লাগিলো।
সেই অতীতের পুরোটা জুড়িয়া কেবলি সে এক গ্রাম্য বালিকার প্রতি তাহার প্রথম দূর্বলতার স্মৃতিতে মজিয়া থাকিলো। অবশ্য তাহার ও একটা সুনির্দিষ্ট কারন আছে। অদ্য সন্ধ্যায় মতিলালের সর্ব বড় ভ্রাতা ফোন মারফত জানাইয়া দিয়াছেন যে আসছে শুক্রবার তাহার (বালিকার) বিবাহের দিন ধার্য্য করা হইয়াছে। বিবাহ সম্পন্ন হইলে সেদিনেই বর পক্ষ কন্যাকে তাহাদের নিজ গৃহে তুলিয়া লইবেন মর্মে কথাও একপ্রকার পাকাপাকি হইয়া আছে। সংবাদটি মতিলালের জন্য দুঃসংবাদ কিনা জানিতে চাহিলে মতিলাল কিছু না বলিয়া ফোনটি নিঃশব্দে রাখিয়া দেয়। এরপর থেকেই সে সচেতনতার সহিত কৈশরের সেই বালিকাটির কথা ভুলিয়া থাকিতে চাহিলেও অবচেতন মন বার বার শুধু বালিকাটির কথাই মনে করাইয়া দিতাছে।
সেই কবেকার কথা। মতিলাল তখন আষ্টম শ্রেণীর দূরন্ত আর চঞ্চল স্বভাবের অথচ লাজুক এক কিশোর যে কিনা সদ্য কৈশরে পদার্পণ করিয়াছে। এই বয়সের বালক বালিকা গুলোর ভালোলাগা ধুমকেতুর মতো হটাৎ কোথা হইতে যে উদয় হয় আর কিসে যে তাহা বজ্রপাতের ন্যায় কোন এক বালক/বালিকার উপর পড়িয়া বসে তাহা কেবল ঐ সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলিতে পারিবেন। মতিলালের ক্ষেত্রেও ইহার ব্যতিক্রম হইলোনা। বালকের ভালোলাগা পাইয়া বসিলো একখানি সহজ সরল অথচ শুভ্র সুন্দর মায়া মাখানো প্রতিমার মতো সাজানো মুখের গ্রাম্য বালিকার উপর। কোনক্রমেই সেই মুখখানা বালক আর ভুলিতে পারিতেছেনা।
শুধু কি এটুকুই? না, ঘটনার এখানেই শেষ হইলো না। বালিকার প্রতি বালকের ভালোলাগার দরুন হরমন জনিত প্রভাবে তাহার হৃদয়ের আলরন বাড়িয়া গিয়া অতিরিক্ত যে শব্দ উৎপন্ন হইতে লাগিলো তাহাই বালিকাটির ডাকনামে রুপান্তরিত হইয়া এই কান ওই কান করিয়া সারা গ্রাম রাষ্ট্র হইয়া গেল। এই ঘটনার রেশ মতিলালের পরিবারের সবার কাছেই পৌছিয়া গেল। প্রথমে কেহই বিষয়টা সেরকম কান করিলোনা। কিন্তু ঘটনা আমলে নিতে পরিবারের সদস্যদের বেশি দিন অপেক্ষাও করিতে হয় নাই। একপ্রকার বলা যায় মতিলালই তাদের অপেক্ষা করিতে দেয় নাই। কিভাবে, সেই ঘটনাই এখন বলিতেছি।
জৈষ্ঠ মাসের কাঠাল পাকা গরমের এক দুপুরে মতিলালের সমবয়েসী এক কাকা বিদ্যালয় হইতে হাপাইতে হাপাইতে তাহার নিকটে আসিয়া বৃহৎ একখান দম ফেলিয়া কহিলো- "কাকা, তোর জইন্যে মুই একখান তাবিজ আইনছু। মোর কেলাশের এক মুসলমান বন্ধু মোক এইটা দিছে। অর বাপ মলভি, মাদ্রাসার অস্তাদি। অয় কইছে এই তাবিজখানত যদি আরবি অক্ষরেই তুই যে মেয়েটাকে ভালোবাসিস তার নাম আর তার বাপের নাম লিখে একটা গাছের মগডালে একনিশ্বাসে উঠিয়া বাধিয়া আসিস তাইলে অই মেয়ে তিনদিনের মইধ্যে তোর প্রেমে হাবুডুবু খাইবে। তাবিজ যতোই বাতাসে দোল খাইবে, তোর কথা ততো তার মনোত পইরবে। "
মতিলালকে আর পায় কে?? অনেক সাধনা করিয়াও যে মতিলাল সেই বালিকার সামনে গিয়া সোজা হইয়া দাড়াইতে পারে নাই, সেই মতিলাল আজ তাহাকে তাবিজ করিতে চলিলো। একদিক থেকে তাহার জন্য ভালোই হইলো। বালিকার সামনে দাড়াইয়া টলটলানো পায়ে কাপতে কাপতে কিছু বলিতে চাহিয়া তাহার মুখের দিকে তাকানোর মতো দুঃসাহসিক কাজ করার কথা আর তাহার চিন্তা করিতে হইবেনা। বালিকা তাবিজের কেরামতির জোরে নিজেই আসিয়া তাহার ভালোলাগার কথা পাড়িয়া বসিবে। ইহা হইতে সহজ কাজ আর কি হইতে পারে।
সেদিন রাত্রে মতিলাল তাহার কাকার সাথে সেই মুসলমান বন্ধুর সাক্ষাত করিয়া বন্ধুর হাতে পায়ে ধরিয়া সে ব্যতিত আর কেহ জানিবেনা মর্মে ১০টাকার ডাল পুরি খাওয়ানোর শর্তে রাজি করাইয়া একখান তাবিজ লিখিয়া লইলো। আরবী অক্ষরে লেখা সে তাবিজে বন্ধুবর প্রিয় বালিকা আর তাহার পিতার নাম শুদ্ধ করিয়া লিখিলো কিনা বা আদৌ লিখিয়াছিলো কিনা তাহার বোঝার সাধ্য নাই তাহাদের কাহারোই। কাজ হইবে মর্মে নিশ্চয়তা পাইয়া ভগবানের প্রতি আস্থা রাখিয়া মতিলাল আর তাহার কাকা সেদিন একটু রাত্রি করিয়াই বাড়ি ফিরিলো। কখন সকাল হইবে কখন সে এক নিশ্বাসে গাছের মগডালে উঠিয়া তাবিজ খানা টানাইবে ইহার ভাবনায় তাহার বুকের ধুকধুকানিতে সেই রাত্রি মতিলাল আর ঘুমাইতে পারিলোনা।
পরেরদিন সকালেই মতিলাল তাবিজ খানা তাহার শার্টের বুক পকেটে পুড়িয়া বাড়ির বাহিরে কিছুক্ষন এপাশে ওপাশে তাকাইয়া কেহ আছে কিনা সে বেপারে নিশ্চিন্ত হওয়ার পর নদীর পাড়ের দিকে এক ছুট লাগাইলো। অতো সকালে প্রাকৃতিক কার্য সারার প্রয়োজন ব্যতিরেকে আর কেহই নদীর পাড়ে আসিবেনা, আর আসিলেও মতিলালের মতো একটি বালক কোন গাছে উঠিয়া কি করিলো তাহা দেখিবারও কেউ থাকিবেনা ভাবিয়া সে একটু দূরের এক কাঠাল গাছে উঠিবে বলিয়া মন স্থির করিলো। কিন্তু কোন গাছেই তাহার মনপুত হয় না। কারন একনিঃশ্বাসে মগডালে উঠিয়া তাবিজ খানা টানানো যাইবে এই রকম গাছ তাহার চোখে পরিতেছেনা। অনেক করে খুঁজিয়া সে ছোট কিন্তু এই বৎসর প্রথম কাঠাল ধরিয়াছে এমন একখান গাছ সে এই কাজের জন্য ঠিক করিলো। একনিঃস্বাসে গাছে উঠিতে যাইয়া কাঠাল দেখিয়া তাহার আর বালিকার হবু সংসারের কথা মনে পড়িয়া গেলো। যদি এমন হয় এইগাছে যতোগুলো কাঠাল ধরিয়াছে ভগবান আমাদেরও ততোগুলি বাচ্চা কাচ্চা দিলেন, তাইলে কেমন হইবে। এই ভাবিয়া কাঠাল গুনিতে গিয়া মতিলাল দেখিলো ছোট বড় মিলাইয়া গাছটাতে প্রায় ১১-১২টা কাঠাল ধরিয়াছে। এতোগুলি বাচ্চার কথা চিন্তা করিয়া মতিলাল এবার লজ্জাই পাইয়া বসিয়াছে, ফলে আনমনেই সে জিহবায় একখান জোড়ে কামর বসাইয়া দিলো। ব্যাথা পাইয়া তাহার সম্ভিত ফিরিয়া আসিলে খেয়াল করিলো সে কখন যে নিঃশ্বাস ছাড়িয়া দিয়াছে তাহা মনেই নাই। কি আর করা, এখন আর তাবিজ বাধিয়া কি হইবে! একবার ভাবিলো-ফিরিয়া যাই, কিন্তু পরক্ষনেই মনে মনে ইহাই ভাবিলো যে আসল প্রেমে নিঃস্বাস কোন বিষয়ই না। ভালোবাসা হইলে কি এক নিঃস্বাসেই জীবন শেষ হইবে নাকি? কতোবারই তো নিঃস্বাস নিতে হইবে। তাই ইহা কোন বেপারই না। মতিলালের প্রেমের জোড়েই এই তাবিজ খানা কাজে দিবে। এই ভাবিয়া সেই তাবিজ খানা গাছের মগডালে বাধিয়া সে তরতর করিয়া নিচে নামিয়া আসিলো।
সেদিন মতিলাল বিদ্যালয়ে যাওয়ার পূর্বে বালিকার অপেক্ষায় চার রাস্তার মাথায় একটু বেশিই ঠায় দাঁড়াইয়া থাকিলো, দেখা হয় নাই। বালিকা আগেই চলিয়া গিয়া থাকিবে আপাততো সে তাহাই ভাবিয়া লইলো। বিকেলে বিদ্যালয় হইতে ফেরার সময় মাঠের কোনায় অযথাই কিছু সময় উৎকন্ঠায় পায়চারী করিলো। সন্ধ্যায় প্রাইভেট হইতে ফেরার পথেও মতিলাল তাহার অপেক্ষায় একটু বেশি সময় ধরিয়া ছোলা বুট চিবাইলো। কিন্তু বালিকার দেখা আর মিলিলো না। মতিলাল ইহার কোন কারণ ভাবিয়া পাইলোনা। কখনো মনে হয় অসুখ করিয়াছে, আবার কখনো মনে হয় হয়তো সে বাড়িতে নাই। কিছু সময় ইহাও মনে হইতে থাকিলো- তাবিজ কি কাজ করিতে শুরু করিয়াছে? হয়তো আমার প্রতি তাহার ভালোলাগা কাজ করিতেছে, যাহার ফলে আজ সে আমার সামনে পড়িলে কি করিবে তাহা ভাবিয়া লজ্জায় বালিকার শুভ্র বদন খানি লজ্জাবতির মতো লুটাইয়া পরিতেছে অথবা..... কি যে কারণ, তাহা ভগবানই যানে। মতিলাল আর ভাবিয়া উঠিতে পারিতেছেনা। এরকম সাত পাঁচ ভাবিয়া যখন কোন কূল কিনারাই উদ্ধার ককরিতে পাইলোনা তখন মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া সে বাড়ির দিকে হাটা শুরু করিলো।
বাড়ি আসিবার পথে শোভা বউদি তাহার দিকে চাহিয়া একখান মুচকি হাসি দিয়া বলিলো- "কি হে দেবরজী,আজকাল কাঠাল গাছেও দেখি পেত্নি থাকে? মতিলাল তাহার এই মশকরার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলোনা। বোকার মতো চাহিয়া থাকিলে বউদি দুষ্টামির ছলে মতিলালের হাতে আলতো একটু চিমটি কাটিয়া চলিয়া গেলো। মতিলাল বাড়ির দিকেই আসিতেছিলো, বাল্যকালের খেলার সাথী শিখা আসিয়া বলিলো-"বাড়িত যা আগোত, সবায় তোর জইন্যে অপেক্ষা করেছে।" বলিয়াই শিখা অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়িলো। এই মেয়ের এই এক অসুখ হয়েছে ইদানিং, কিছু বলার আগেও হাসে, পরেও হাসে। কি বলে তা সেই জানে। রাগ করিয়া সে আর তাহার কাছে জানিতেও চাহিলোনা। হন হন করিয়া বাড়ির পথে পা বাড়াইলো।
বাড়ির উঠনে পা দিয়াই সে আবিষ্কার করিলো মৌলভি সাহেব আমাদে বাড়িতে আসিয়া বসিয়া আছে, সাথে কাকা আর কাকার সে মুসলমান বন্ধু। ইহাদের দেখিয়া তাহার বুক ধক করিয়া উঠিলো। কিছুই বলিতে হইলোনা, মাতাজী আসিয়া সোজা কান ধরিয়া কহিয়া উঠিলো- "এই বয়সে এতো কিছু? লেখা পড়া নাই, সারাদিন শুধু সেই মেয়ের গান।"
এরপরের কাহিনী আর না বলিলেই চলিবে।
এরপর চলিয়া গেছে ৪টি বছর। এর মধ্যে মতিলাল বিদ্যালয়ের পাট চুকাইয়া উচ্চ শিক্ষার জন্য গ্রাম ছাড়িয়া শহরে পাড়ি জমাইয়াছে। বালিকার সহিত মাঝে মধ্যে কথা হইতো। শহরে আসিয়া মতিলাল বালিকাকে মুখোমুখি বলিবার সাহস অর্জন করিলো। কিন্তু যেদিন বলিবার জন্য মুখোমুখি দাড়াইলো সেদিন বালিকা নিজ হইতেই আগ বাড়াইয়া বলিয়া বসিলো-" এখন বলিয়া কি লাভ হইবে, আমি এখন আর একা নই।"
সেদিনের মতিলাল যে কষ্টটা পাইয়াছিলো তাহা আজও মনে পড়িলে তাহার মনের অজান্তেই আখিকোণে অশ্রু আসিয়া ভিড় করে। বালিকাকে হারাইয়া এরপর মতিলাল সেই অতীতগুলো, সে পাগলামী গুলো, সেই ভালোবাসাগুলোর অকাল সমাধী রচনা করিয়া দিয়াছিলো।
তারও পরে প্রায় ৬টি বছর চলিয়া গেছে। মতিলালের ভাবনাগুলো অনেকটাই পরিপক্ক হইয়া উঠিয়াছে। কৈশরের সে অবুঝ বালকের পাগলামি তার কাছে এখন নিছক পাগলামীই মনে হয়। কিন্তু তারপরেও মতিলাল কি এক আশায় পথ চাহিয়া থাকিয়া দ্বিতীয় কোন মেয়ের প্রেমে পরিলোনা। পাছে বালিকা ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে একা না পায়।
কিন্তু, আজ সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিলো। তাহার বিবাহ হইয়া গেলেই এই নিস্প্রোভ আশার বাতিটিও চিরোদিনের জন্য নিভিয়া যাইবে।
যাক, কতো বাতিই তো প্রতিদিন নিভিয়া
যায়। কিন্তু তাহার আলোটুকু কি কখনো মলীন হয়?
সামস সুমন
কপিরাইট সুংরক্ষিত
©somewhere in net ltd.