![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ড. আহমদ আবদুল কাদের।। দৈনিক কালের কণ্ঠ ১২ফেব্রুয়ারী ১০ সংখ্যার ধর্ম পাতায় “ইসলাম ধর্ম রাজনীতির ঊর্ধ্বে” শীর্ষক একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। এটি লিখেছেন জনৈক মাওলানা হোসেন আলী। এতে তিনি এমন বক্তব্য দিয়েছেন যার সঙ্গে কুরআন হাদিস,মহানবীর সা.জীবন চরিত, খোলাফায়ে রাশেদীনের কার্য পদ্ধতি ও ইসলামের ইতিহাস কোন কিছুর সঙ্গে মিল নেই। নিবন্ধের মূল কথাগুলো নিম্নরূপঃ
“—তবে তিনি(হযরত মুহাম্মদ সা.)যে রাষ্ট্রটি পরিচালনা করেছেন সেটা ইসলামী রাষ্ট্র ছিলো না,ছিল মদীনা রাষ্ট্র।এই রাষ্ট্রের সুচনা হয়েছিলো একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে মদীনা চুক্তির মধ্য দিয়ে।—- মদীনা সহ সমগ্র আরব ভূখন্ডে মুসলমানরা একক সংখ্যা গরিষ্টে পরিণত হয়েছিল।কিন্তু মদীনা রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। – যে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাকে কখনোই ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী সাম্রাজ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়নি।—-কুরআনে,হাদিসে এবং মহানবীর(সা.) পবিত্র সাহাবীদের কথা ও ক্রিয়াকলাপের মধ্যে মদীনা রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করার কোনো নজির নেই।—-আর সাহাবী রাষ্ট্রনায়কদের সম্বোধন করতেন আমিরুল মোমেনিন বলে।খলিফা উপাধিটি তাদের উপর পরবর্তীকালে আরোপ করা হয়।মহানবী(সা.) থেকে —আলীর(রা.) শাসনামল পর্যন্ত ধর্মের এবং রাষ্ট্রের নেতা অভিন্ন ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রকে ইসলামী করা হয়নি।
পরবর্তী সময়েও সেই যুগকে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ বলা হয়েছে,খোলাফায়ে ইসলামী যুগ বলা হয়নি।রার্ষ্টের ক্রিয়া কলাপ পরিচালিত হতো রাষ্ট্রীয় বিবেচনার বিষয় হিসেবে,আর ধর্ম থেকেছে রাজনীতির উর্ধ্বে আল্লাহ ও তার রাসুলের পথ প্রদর্শন হিসেবে। রাষ্ট্রকে ইসলামী করতে চাইলে অনায়াসেই তারা তা করতে পারতেন, কেউ প্রতিবাদ করতো না, কিন্তু তারা তা করেন নি। সেই যুগে কোন রাজনৈতিক প্রথা প্রচলন, প্রতিষ্ঠান, এমন কি জায়গার নামও ইসলামী করা হয়নি।
—–এর পর ইসলামের ইমাম-মাশায়েখরা রাজনীতিকে কখনোই ধর্মের ভিতরে আনার চেষ্টা করেন নি। —-ইসলামের শরিয়তের ভিতরে মানুষের জীবনাচরণ বিধিবদ্ধ করার সুক্ষ্নাতিসুক্ষ্ন চেষ্টা করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিধিবদ্ধ করার কোন চেষ্টা করা হয়নি। —সব ইমাম,মুজতাহিদ ও মাশায়েখরা ইসলামের অন্তর্নিহিত ভাবাদর্শেই উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মকে রাজনৈতিক বিতর্কের উধ্ের্ব রাখার চেষ্টা করেছেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে।—ইসলামের ব্যাখ্যা ও বিধিবিধান জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বা মানতে বাধ্য করার অনুমতি ইসলামে একেবারেই নেই। –সুতরাং ধর্ম ও রাজনীতির স্বরুপের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। রাজনীতি চলে শক্তির মাধ্যমে, আর ধর্ম চলে অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাধ্যমে। –এ দুই প্রতিষ্ঠানকে যার যার জায়গা থেকে বিচ্যূত করার চেষ্টা ঘোরতর বিভ্রান্তি। “
উপরের উদ্ধৃত অংশটি হচ্ছে মাওলানা হোসেন আলীর নিবন্ধটির সারমর্ম্। এখানে লেখক যা বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন তা কুরআন হাদিস, সাহাবায়ে কেরাম ও ইমাম মুজতাহিদগণের ব্যাখার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।তিনি মূলতঃ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে গ্রহণযোগ্য ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্যেই প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।কেউ ধর্ম নিরপেক্ষ হতে চাইলে আমাদের কিছু বলার নেই তবে কুরআন হাদিসের মূল ভাবধারাকে এড়িয়ে গিয়ে কুরআন হাদিসের নাম ব্যবহার করে ধর্মনিরপেক্ষতার সাফাই গেয়ে চরম বিভ্রান্তি ছড়াবেন সেটা গ্রহণ যোগ্য নয়। নিম্নে সংক্ষেপে উল্লেখিত কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করলেই তা পরিষ্কার হবে।
১. লেখক দাবী করেছেন মহানবী(সা.) প্রতিষ্ঠিত মদীনার রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র ছিলো না, ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তিনি যদি মদিনার সনদটি ভালোভাবে পড়তেন তাহলে এমন দুঃসাহস তিনি দেখাতে পারতেন না।মদীনার সনদের শুরুতেই বলা হয়েছেঃ “এটি আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ(সা.) কর্তৃক প্রণীত কুরায়শ ও ইয়াসরিবের মধ্যে সকল বিশ্বাসী ও মুসলমানদের এবং যারা তাদের অনুসারী এবং এভাবে যারা তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং যারা তাদের সাথে জেহাদে শামিল হয় তাদের প্রতি” (ইবনে ইসহাক,পৃ.২৩১)। কাজেই এটি ব্যক্তি মুহাম্মদের পক্ষ থেকে ছিলো না, ছিলো আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ(সা.) এর পক্ষথেকে। তাছাড়া “মুহাম্মদ ও আল্লাহর রাসুল” বাক্যাংশটি সনদের ৩টি স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে (দ্রষ্টব্যঃ ইবনে ইশাম,পৃ ৫০১-৫০৪) যা তার ধর্মীয় ভিত্তিটাই তুলে ধরে। এই সনদের শেষের দিকের একটি ধারায় বলা হয়েছে,” এই সনদ যারা গ্রহণ করে তাদের মধ্যকার যাবতীয় বিবাদ বিসম্বাদ যা সাধারনভাবে মীমাংসা করা সম্ভব হবে না তার মীমাংসার ভার আল্লাহ ও তার রাসুল মুহাম্মদ সা.এর নিকট ন্যস্ত করতে হবে।” (ইবনে ইশাম,পৃ.৩৪১-৩৪৩)
উপরের উদ্ধৃতাংশ থেকে এটি স্পষ্ট প্রমান হয় যে মদীনার সনদ কোন ধর্ম নিরপেক্ষ সনদ ছিলো না, এটি ছিলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের সনদ।সনদের শুধু ব্যাক্তি মুহাম্মদের নাম ব্যবহার করা হয়নি,ব্যবহার করা হয়েছে আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ(সা.) এর নাম।সনদকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রমান করার চেষ্টা করা নিছক অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়। বস্তুত মদিনার সনদ ছিলো তদানিন্তন ইয়াসরিবের সকল পক্ষের জন্যে একটি চুক্তি বিশেষ যা দেয়া হয়েছিল আল্লাহর রাসুল হযরত মুহাম্মদ এর পক্ষ থেকে। চুক্তির পক্ষভুক্ত গ্রুপগুলো ছিল মুহাজির,আনসার, ইহুদী(বিভিন্ন উপগোত্রসহ) ইত্যাদি।সনদে ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সবার দায় দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।আর মহানবী(সা.)কে এই চুক্তিতে আ্ল্লাহর রাসুল হযরত মুহাম্মদ সা.কে হিসেবে চুড়ান্ত ফয়সালাকারী শীর্ষ হিসেবে ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই চুক্তির ভিত্তিতেই মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. লেখক আরেকটি কথা বারবার বলার চেষ্টা করেছেন যে মদীনার রাষ্ট্র ইসলামি রাষ্ট্র নামে অভিহিত হতো না, এমনকি খুলাফায়ে রাশেদীনও ইসলামি রাষ্ট্র বলে অভিহিত হতো ন্া। নবী(সা.) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট ও সমাজ ভিত্তিগত ভাবেই ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সমাজ। তাকে পৃথক নামে অভিহিত করার কোন প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়না। তদুপরি “খুলাফায়ে রাশেদ”পরিভাষাটি বলে দিচ্ছে তারা এমন খলিফা যারা ছিলেন রাশেদ অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনে ও রাষ্ট্রপরিচালনায় তারা কখনও সত্য তথা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হননি। ইসলাম নিরপেক্ষ শাসন কখনই সত্যপন্থী শাসন হতে পারে না বরং তা হবে কুফরী,জুলুম ও ফিসক। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ ‘যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফের,—-তারা জালেম –তারা ফাসেক” (সুরা মায়েদা : ৪৪- ৪৭আয়াত)।
৩. লেখক আরো বলেছেনঃ ‘খলিফা শব্দটি পরবর্তী কালে আরোপ করা হয়েছে।’ এটি সর্বতোভাবে অসত্য বরং চরম অজ্ঞতা।প্রকৃতপক্ষে মহানবীর (সা.) বক্তব্য থেকে পরিভাষাটি চয়ন করা হয়েছে।মহানবী(সা.বলেছেন,”— আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা বেচে থাকবে তারা শীঘ্রই অনেক মতভেদ দেখতে পাবে, তখন তোমরা আমার সুন্নাহকে এবং সৎপথ প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে আকড়িয়ে ধরবে——।” (আহমদ, আবুদাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজা) এই হাদিসের প্রথম চারজন সাহাবীর শাসনকে খেলাফতে রাশেদা বলা হয়েছে। পরবর্তী যুগে সবাইকে রাসুলের সুন্নাহ ও রাশেদ খলিফাদের সুন্নাহ তথা রীতিকে আকড়ে ধরতে হবে।কাজেই কোন মুসলমান খেলাফতে রাশেদার শাসন পদ্ধতির অনুসরন না করলে তা হবে স্পষ্টত মহা নবীর(সা.) আদেশের বিপরীত কর্ম্। তদুপরি আবু বকর রা.) নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে বলা হতো খলিফাতুর রাসুলূল্লাহ(আল্লাহর রাসুলের খলিফা)। এর হযরত ওমর রা) কে প্রথম প্রথম বলা হতো খলিফাতু খলিফাতির রাসুল(আল্লাহর রাসুলের খলিফার খলিফা)। পরবর্তী সময়ে পদবীটি দীর্ঘ হওয়ার আশংকায় শুধূ বলা হতো খলিফা। কাজেই খলিফা পদবীটি পরবর্তীতে আরোপ করা হয়েছে বলা নির্জলা ভ্রান্ত।
৪.পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে,” তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসুলের আনুগত্য কর আর আনুগত্য করো তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বশালীদের(উলিল আমর)। যদি মতবিরোধ হয় তাহলে আল্লাহ ও তার রাসুলের(কুরআন সুন্নাহ) নিকট)পেশ করো।(সুরা নিসা,৪:৫৯)। অর্থাৎ শাসকদের সাথে কোন মতানৈক্য হলে মীমাংসার মূল মানদণ্ড হচ্ছে কুরআন হাদিস। এতে স্পষ্ট প্রমান হয় যে শাসন বিষয়ক মতবিরোধসমুহ নীতিগতভাবে কুরআন সুন্নাহ দ্বারাই মীমাংসিত হবে,অন্য কিছু দ্বারা নয়।মুসলমানরা আল্লাহর আনুগত্য পরিপন্থী কোন আইনের আনুগত্য করতে বাধ্য নয়।পবিত্র কুরআন বলছে, “এমন লোকের আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি,যে তার নফসের কামনা বাসনার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে এবং যার কর্মধারা সীমালংঘন করেছে। (সুরা কাহাফঃ ২৮) মহানবী সা)বলেছেন, –মাসিয়াত বা পাপাচারের কোন নির্দেশ দেয়া হলে কোন আনুগত্য নেই (বুখারী, মুসলিম, আবুদাউদ, ইবনে মাজা)। ইসলামের নীতির সাথে সাংর্ঘর্ষিক নির্দেশই মাসিয়াত। অতএব, ইসলাম মুক্ত শাসন ও আনুগত্যের অবকাশ অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতার অবকাশ কুরআন হাদিসে নেই।
৫. ইসলামের আদি যুগে রাষ্ট্র, ইসলামী রাষ্ট্র ইত্যাদি ভাষা প্রচলিত ছিলোনা। মুজতাহিদ ইমামগণ কুরআন সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র কে ‘দার’ বলে আখ্যায়িত করতেন।আর তারা ইসলামের ভূমিকে/ইসলামী দেশকে বলতেন দারুল ইসলাম বা ইসলামের দেশ/ভূখন্ড, শত্রুদেশকে বলতেন দারুল হরব/দারুল কুফর। বর্তমান যুগে প্রকৃত দারুল ইসলামকেই আমরা বলি ইসলামী রাষ্ট্র।দারুল ইসলাম কোন সময় দারুল হরবে পরিণত হয় সে প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানিফা(রহ) বলেন, তিনটি শর্ত ব্যতীত দারুল ইসলাম দারুল কুফর হয় না।প্রথমত যদি কুফরী(ইসলামবিরোধী) আইন জারী হয়ে যায় দ্বিতীয়ত, যদি সে দেশ কোন দারুল কুফরের সাথে মিলিত হয়ে যায়।তৃতীয়ত, যদি সে দেশে মুসলমান অথবা জিম্মী পূর্বের মতো নিরাপত্তার সাথে বাস করতে না পারে। “( বাদায়ে সানায়ে,৭মখন্ড, পৃ.১৩)
ইমাম আবু ইউসুফের(রহ) ও ইমাম শায়বানী (রহ) মতে দারুল ইসলামে কুফরী আইন জারী হলেই তা দারুল কুফরে পরিণত হয়ে যায়। ” (বাদায়ে সানায়ে,৭ম খন্ড,পৃ.১৩) ফতওয়া আলমগীরিতে কুফরী আইন জারীর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে : “প্রকাশ্যভাবে যদি সেই দেশে ইসলামী আইন অনুসারে বিচার ফযসালা না হয়।” অতএব,প্রমানিত হলো যে ইসলামী আইনের শাসন না থাকলে কোন রাষ্ট্রকে প্রকৃত পক্ষে দারুল ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র বলা চলে না, বরং তা হবে কুফরী রাষ্ট্র– তা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই হওক,কমিউনিষ্ট রাষ্ট্র হউক অথবা আর যাই হউক।
৬. আমরা সবাই জানি যে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় আইন দ্বারা। মুসলমানদের জন্যে ফরজ হচ্ছে কুরআন সুন্নাহর আইন মেনে চলা। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,”আল্লাহর নাযিলকৃত নির্দেশ অনুযায়ী যারা ফয়সালা করে না তারা ফাসেক- পাপাচারী। “(সুরা আল মায়েদা : ৪৭) অন্যত্র বলা হয়েছে, “না, তোমার বরের শপথ,তারা কখনও মুমিন হবে না, যতক্ষণ তারা তোমাকে(হে নবী) নিজদের সকল মতবিরোধের ব্যাপারে ফয়সালাকারী বলে মেনে না নেয়। অতঃপর তুমি যে ফয়সালা করবে,তাতে নিজেদের অন্তুরে কোন রকম সংকীর্ণতা বোধ করবে না; বরং পুরোপুরি তা মেনে নিবে। (নিসাঃ ৬৫)
কাজেই যে রাষ্ট্র ইসলামী আইন দ্বারা পরিচালিত হয় না নীতিগতভাবে তা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়্।
৭. মদিনার রাষ্ট্রে আল্লাহর রাসুল কুরআন আইনী চালুকরেছেন, সেই অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করেছেন,আইনকে কার্যকর করেছেন এবং অপরাধীকে বাধ্য করেছেন আইন মেনে চলতে।খুলাফায়ে রাশেদীনও একই ভাবে জিহাদ পরিচালনা করেছেন, জাকাত অস্বীকারকারী ও মুর্তাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, কিসাস ও হদ কায়েম করেছেন,সাৃলাত কায়েম করেছেন এবং সবই করেছেন কুরআন সুন্নাহর আলোকে ও নির্দেশে,রাষ্ট্রের স্বার্থ বিবেচনা করে নয়(যেমন লিখক ভেবেছেন) রাষ্ট্রের স্বার্থ ও জনগনের স্বার্থ অবশ্যই গুরুত্বপুর্ণ কিন্তু তা কুরআন সুন্নাহকে পরিহার করে নয়।
৮. খেলাফতে রাশেদার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক পন্থায় যখন দেশ পরিচালনার সুত্রপাত হলো তখন হযরত ইমাম হোসাইন রা,) তার প্রতিরোধে নিজের জীবন দিলেন। উমাইয়া আমলের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান ইমাম জায়েদ ইবনে আলী রহ) সমর্থন করেন ইমাম আবু হানিফা সহ বড় বড় ইমামগন।আব্বাসীয় আমলের কোন কোন শাসকের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন নফসে জাকিয়া, সমর্থন দিয়েছিলেন ইমাম আবু হানিফা স্বয়ং, ৃইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল(রহ)প্রমুখ।ভারতীয় উপমহাদেশে অসংখ্য সুফিদরবেশগন যুদ্ধজেহাদে অংশ গ্রহণ করেছিলেন বিশেষ করে বাংলাদেশ অঞ্চলে হযরত শাহী সুলতান বলখী মাহিসোয়ার ও রাজা পরশুরাম-বলরামের যুদ্ধ-সংঘাত, বাবা আদমশহীদ ও রাজা বল্লাল সেনের যুদ্ধ,মখদুম শাহ মাহমুদ গজনবীর সাথে রাজা বিক্রম কিশোরীর দ্বন্ধ,রাজা গৌর গোবিন্দের সাথে হযরত শাহজালালের যুদ্ধ, শাহনুর কুতবুল আলম ও রাজা গনেশের সংঘাত সর্বজন বিদিত। নতুন ধর্মপ্রচার কারী সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন তদানিন্তনযুগের নেতৃস্থানীয় আলেম আবদুল্লানহ আনসারী ও শায়খ আবদুন্নবী।সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে দরবারে কুর্নিশ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের সর্বজন মান্য শায়খ আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফেসানী(রহ)। সর্বযুগেই হকপন্থী আলেমগন শাসকদের অন্যায় অত্যাচার ও শরীয়ত বিরোধী কর্মতৎপরতার সাধ্যমতো প্রতিবাদ করেছেন,প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কাজেই ইমাম মুজতাহিদ মাশায়েখগন শরীয়াতের আওতায় রাষ্ট্রকে আনার চেষ্টা করেননি এ কথা বলা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক।
৯. আমাদের সমস্ত ইমামগণ একমত যে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে পরামর্শ ও স্বাধীন বায়াত অপরিহার্য্। তা না হলে এটি সত্যিকার খেলাফত হবে না, হবে রাজতন্ত্র/জুলুম তন্ত্র। মুজতাহিদ ইমামগন দারুল ইসলাম,দারুল হরব/কুফর,দারুসসুলেহ,দারুল আমান, শাসকদেরগুনাবলী, আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধজেহাদ,তার শর্ত, নিয়মাবলী,দণ্ডবিধি, দেওয়ান্ী আইন, রাজস্ব নীতি সহ অর্থনৈতিক বিষয়াবলীসহ সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন ও খুটিনাটি বিধি বিধান প্রণয়ন করেছেন। তারা শুধূ ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিধানাবলীই প্রণয়ন করেননি।সামাজিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,আন্তর্জাতিক ইত্যাদি বিধানাবলীও প্রণয়ন করেছেন। এ বিষয়ে রচিত গ্রন্থাদি পড়া থাকলে এমন কথা বলা সম্ভব হতো না।
১০. আরেকটি অদ্ভূত কথা তিনি বলেছেন যে “ইসলামের ব্যাখ্যা ও বিধিবিধান জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বা মানতে বাধ্য করার অনুমতি ইসলামে একেবারেই নেই “। আফসুস! মাওলানা সাহেব অতি সাধারন কথাটিও জানেন না যে ইসলামী রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তথা কাযিগন কিসাস, হদ ও তাযিরের বিধি বিধানের আলোকে বিচার ফয়সালা করতেন আর সরকারী কর্তৃপক্ষ তাদের রায়কে কার্যকর ও প্রয়োগ করতেন তথা রায় মানতে বাধ্য করতেন। সেগুলোকি শরীয়াতের বিধি বিধার ছিলো না? অবশ্য যে সমস্ত বিষয়ে কুরআন হাদিস ভিত্তিক মতবিরোধের সুযোগ আছে সেসব বিষয়ে বিশেষ কোন মত কে সবার উপর চাপানো উচিত নয় বিশেষ করে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রগুলোতে। কিন্তু অকাট্য ও সর্বসম্মত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো কার্যকর করা অবশ্যই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
১১. এ ব্যাপারে অনেক ধর্মনিরপেক্ষবাদী লেখকের বিভ্রান্তির কারন হয় কুরআনের একটি বক্তব্য ‘লা ইকরাহ ফি দ্বীন” (সুরা বাকারাহঃআয়াত ২৫৬) — “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই” এই কথার অর্থ বুঝতে ভুল করার ফলে।নবী করিম সা. ও সাহাবায়ে কেরাম এবং সমস্ত মুফাস্সেরই কুরআন একমত যে এখানে ‘দ্বীনে জোর জবরদস্তি নেই’ মানে দ্বীন গ্রহনের ব্যাপারে কোন জোরজবর দস্তি নেই। ইসলাম গ্রহণ করা না করার ব্যাপারে সবাই স্বাধীন।তবে দ্বীন গ্রহণ করলে দ্বীনি দায়িত্ব ও বিধিবিধান অবশ্যই তার উপর প্রযোজ্য হবে।ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্র তা কার্যকর করবে। ঈমান গ্রহণ করার পর আর কেউ যা ইচ্ছে করা স্বাধীন নয়। এমন কি ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদেরকেও ইসলামী রাষ্ট্রের বিধি বিধান(কিসাস,হুদুদ,তাযির ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে। অমুসলিম নাগরিকগণ শুধূ ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও স্বীয় ধর্মীয় কর্তব্য পালন এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনকানুনের(বিয়ে, তালাক, উত্তারাধিকার ইত্যাদি) ক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্মীয় বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে। দণ্ডবিধি ও অন্যান্য দেওয়ানী ক্ষেত্রে(দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া) তারা মুসলমানদের সমান। এগুলো মুসলিম অমুসলিম সবার জন্যে সমভাবে প্রযোজ্য।
১২. রাজনীতি বলতে যদি ম্যাকিয়াভেলিয়ান রাজনীতি হয় যেখানে ধোকা প্রতারনা,মিথ্যা প্রতিশ্রুতি,শঠতা,চরিত্র হননই মূল কথা তাহলে নিঃসন্দেহে এ রাজনীতির স্থান ইসলামে নেই। এসব রাজনীতির সঙ্গে ইসলাম সম্পর্কহীন। বস্তুত ইসলামের রাজনীতি হচ্ছে খেলাফতে রাশেদার আদর্শ অনুসরনের রাজনীতি যা নবীর সা. উম্মাতকে অনুশীলন করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এটাই কুরআন সুন্নাহর দাবী।
১৩. খোলাফায়ে বাশেদীন ও উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফা সবাইকে আমীরুল মোমিনিন বলা হতো(তা লেখকও স্বীকার করেছেন)। আমীরুল মোমেনীন অর্থ হচ্ছে মোমেনদের নেতা। মুমিন কারা ? যারা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি তথা ইসলামের প্রতি, তার বিধিবিধানের প্রতি ঈমান রাখে তারাই মুমিন। এর অর্থ হচ্ছ মুসলমানদের শাসকগন মুসলমানদেরই নেতা, তাদেরই মধ্য থেকে।অবশ্য তারা অমুসলমানদেরর নেতাও হতে পারেন যদি অমুসলরা তাদেরকে মেনে নেয়। তাছাড়া আমীরুল মোমেনিন উপাধিই স্পষ্ট বলে দিচ্ছে এ সমস্ত রাষ্ট্র ও তার পরিচালকবৃন্দ ধর্মনিরপেক্ষ শাসক ছিলেন না, ছিলেন ইসলামের পক্ষের শাসক। তাই তাদের ডাকা হতো আমীরুল মোমেনিন বলে। তাছাড়া যেহেতু লেখকের নামের আগে মাওলানা রয়েছে কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি তিনি একথাও জানেন যে ইসলামী রাষ্ট্রের(দারুল ইসলামের) অমুসলিম নাগরিকদের বলা হতো জিম্মি, সামরিক দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া ও নিরাপত্তার বিনিময়ে তাদের নিকট থেকে এক প্রকার কর(জিযিয়া) আদায় করা হতো। তাই যদি হয় তাহলে ইসলামে রাষ্ট্রের ধারণা নেই একথা বলতে গেলেন কিভাবে ? যদি কারো ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞানও থাকে তাহলে কেউ এত বড় দৃষ্টতা দেখাতে পারেন না। যদি ধর্মনিরপেক্ষ কেউ হতে চান, ইসলাম মুক্ত রাষ্ট্র, শাসন কারো পছন্দ হয় তাহলে তা তিনি কায়েমের সংগ্রাম করতে পারেন কিন্তু নামের আগে মাওলানা লিখে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা খুবই দূঃখজনক। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আধূনিক যুগের যাবতীয় গোমরাহী থেকে রক্ষা করুণ।
©somewhere in net ltd.