![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মূল: নীল গাইম্যান
অনেক দিন আগে একটা ছোট্ট উষ্ণ দেশ ছিলো যে দেশের প্রায় সব কিছুই ছিল পুরোনো। সেই দেশে থাকতো এক রাজকন্যা- ওর নাম সিনামন। ওকে রুপবতী করে তুলেছিল ওর মুক্তোর মতো দুটি চোখ কিন্তু ও ছিল অন্ধ। ওর দুনিয়া ছিল মুক্তোর রঙে সাজানো- ফ্যাকাসে সাদা আর গোলাপি, এবং মৃদু আভাময়।
সিনামন কথা বলতো না।
সিনামনকে কথা বলানোর জন্য ওর বাবা-মা এক বিশেষ ব্যবস্থা করলেন। যারাই সিনামনকে কথা বলাতে আসতো রাজা-রাণী তাদেরকে প্রাসাদের একটি রুম, ছোট ছোট আম গাছের একটা বাগান, কাঠে খোদাই করা রাণীর খালার একটা দেয়ালচিত্র আর একটি সবুজ তোতা পাখি দিতেন।
দেশটির একপাশ ছিল পাহাড়ে ঘেরা, অন্য পাশে ছিল জঙ্গল। দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসতো সিনামনকে কথা বলা শিখানোর জন্য। আসার পর তারা প্রাসাদের রুমে থাকতো এবং আম বাগানের পরিচর্যা করতো, তোতা পাখিটিকে খাওয়াতো আর রাণীর খালার দেয়ালচিত্রের প্রশংসা করতো ( যিনি সে সময়ে তার সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন, যদিও তিনি এখন বৃদ্ধ, বয়স আর হতাশায় জর্জরিত) এবং ব্যর্থ হয়ে বাকহীন ছোট্ট মেয়েটাকে অভিশাপ দিয়ে হতাশ হয়ে চলে যেত।
একদিন প্রাসাদে একটা বাঘ আসলো। বাঘটা ছিল আকারে বিশাল আর দেখতে বেশ ভয়ানক। কাল আর কমলা রঙ্গে ডোরাকাটা এক দুঃস্বপ্ন। অন্যান্য বাঘের মতোই সেটা এমন ভাবে চলাফেরা করতো যেন সেই এখানকার শাসক। জনগণ ছিল আতঙ্কিত।
"ভয় পাওয়ার কিছু নাই।" রাজা বললেন। "খুব কম বাঘই মানুষ খায়।"
"কিন্তু আমি খাই।" বাঘটা জানালো।
লোকজন এই ধরণের কথাবার্তায় খুব মজা পেলেও তাদের মন থেকে ভয় গেল না।
"আমার মনে হয় তুমি মিথ্যা বলছো।" রাজা বললেন।
"হয়তো বা।" বাঘটি বললো। " কিন্তু এবার সত্যি বলছি: আমি মেয়েটাকে কথা বলা শিখাতে এসেছি।"
রাজা রাণীর সাথে পরামর্শ করলেন আর বাঘটিকে প্রাসাদের রুমটিতে নিয়ে যাওয়া হল। তাকে দেয়ালচিত্রটি দেওয়া হল আর আম বাগান দেখানো হলো। তোতা পাখিটাও দেওয়া হত কিন্তু তার আগেই পাখিটা তারস্বরে চেঁচিয়ে উড়ে গিয়ে একটা উঁচু বীমে গিয়ে বসলো এবং সেখান থেকে আর একচুলও নড়লো না। রাণীর খালা যদিও পুরো ঘটনায় দ্বিমত পোষণ করেলেন। উনি ঝাড়ু আর লাঠি পেটা করে বাঘটাকে তাড়াতে চেয়েছিলেন।
সিনামনকে বাঘটার রুমে নিয়ে আসা হল।
"রিগাতে একজন তরুণী ছিলেন।" উঁচু বীম থেকে তোতাটা চিৎকার করে বললো। "যে বাঘের পিঠে চড়ে ভ্রমণে বের হয়েছিল। যখন তারা ভ্রমণ থেকে ফিরে আসলো তখন তরুণীটি ছিল বাঘের পেটের ভিতর আর বাঘের মুখ ছিল হাসিতে ভরা।"
"দেখেছো।" রাণীর খালা বললেন। "পাখিটাও এত বোকা না।"
"মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে যাও।" বাঘটা বললো।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজা-রাণী, রাণীর খালা আর বাকি কাজের লোকেরা পশুটির সাথে সিনামনকে রেখে চলে গেল। সিনামন বাঘের নরম পশমের মধ্যে হাত বুলালো, আর ওর মুখে প্রাণিটার গরম নিশ্বাস লাগলো।
বাঘটা সিনামনের ছোট্ট হাতে নিজের হাত রাখলো।
"ব্যথা।" বাঘটা বললো আর সিনামনের তালুতে সেটার সূচালো নখ বিঁধিয়ে দিল। ওর নরম বাদামী চামড়া ভেদ করে নখটা ঢুকে গেল আর উজ্জ্বল লাল রঙ্গের রক্ত বের হয়ে আসলো।
সিনামন ফুঁপিয়ে উঠলো।
"ভয়।" বাঘটা বললো আর গর্জন করতে লাগলো। প্রথমে এতই আস্তে যে ভালভাবে খেয়াল না করলে শোনায় যাবে না। এরপর পশুটা গড়গড় শব্দ করতে লাগলো যেটা পরে দূর থেকে ভেসে আসা অগ্নুৎপাতের মত মৃদু গর্জনে পরিণত হল। তারপর সে এতই জোরে গর্জন করতে লাগলো যে প্রাসাদের দেয়ালগুলো কাঁপতে লাগলো।
সিনামন কেঁপে উঠলো।
"ভালবাসা।" এই বলে বাঘটি নিজের রুক্ষ লাল জিহ্বা দিয়ে সিনামনের তালুর রক্ত চেটে পরিষ্কার করে দিল আর ওর নরম বাদামী মুখটাও লালারসে ভিজিয়ে দিল।
"ভালবাসা?" সিনামন দীর্ঘিদিনের অব্যবহৃত রুক্ষ আর ভাঙ্গা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো।
বাঘটা তার মুখ খুললো আর শব্দ করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো।
সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো।
সকালের আলো ফুটলে সিনামন আর বাঘটি রুম থেকে বের হয়ে আসলো।
সানাই বেজে উঠলো আর পাখিরা গান গাইলো। রাজসভার এক প্রান্তে রাজা-রাণী বসে ছিলেন। কয়েক জন বয়স্ক দাস হাত পাখা দিয়ে তাদের বাতাস করছিলো। সিনামন আর বাঘটি সেদিকে হেঁটে চললো। রাণীর খালা এক কোণায় বসে বিরক্তি নিয়ে চা পান করছিলেন।
"ও কি এখন কথা বলতে পারে?" রাণী জিজ্ঞেস করলেন।
"ওকেই জিজ্ঞেস করুন না।" বাঘটি হুঙ্কার দিল।
"তুমি কথা বলতে পারো?" রাণী সিনামনকে জিজ্ঞেস করলেন।
সিনামন মাথা নাড়লো।
"হাহ্।" রাণীর খালা বিদ্রুপ করলেন। "নিজের মাথা নাড়ানোর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারে না।"
"থামুন।" রাজা উনাকে থামিয়ে দিলেন।
"আমি কথা বলতে পারি।" সিনামন জানালো। " আমি সব সময়ই পারতাম।"
"তাহলে বলতে না কেন?" ওর মা জানতে চাইলেন।
ও এখনও কথা বলছে না।" রাণীর খালা একটা আঙ্গুল কামড়াতে কামড়াতে বিড়বিড় করলেন। "বাঘটা ওর হয়ে কথা বলছে।"
"কেউ কি এই মহিলাকে চুপ করাতে পারবে?" রাজা রুমের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
"কথা বলানোর চেয়ে বন্ধ করা সহজ।" বাঘটা উত্তর দিল। আর ঝামেলা মিটিয়ে দিল।
আর সিনামন জবাব দিল, "কেন বলি নি? কারণ বলার কিছু ছিল না।"
"আর এখন?" ওর পিতা জানতে চাইলেন।
"এখন বাঘটি আমাকে জঙ্গলের কথা বলেছে, বানরের চেঁচামেচির কথা বলেছে আর গোধূলির রুপের কথা বলেছে, পূর্ণ চাঁদের মাতোয়ারা সৌন্দর্যের কথা বলেছে আর বলেছে হ্রদ ভর্তি ফ্লেমিঙ্গো উড়ে যাওয়ার সময় যে শব্দ হয় তার কথা।" ও বললো। "আর এখন আমার একটা কথাই বলার আছে- আমি বাঘটির সাথে যাচ্ছি।"
"এটা কখনোই সম্ভব না।" রাজা বললেন। "আমি তোমাকে যেতে দি না।"
"একটা বাঘ যেটা চায় সেটা তাকে না দেয়াটা অনেক ঝামেলার।" সিনামন বললো।
রাজা-রাণী কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে রাজি হয়ে গেলেন।
"তাছাড়া আমার মনে হয় ও ওখানে আনন্দে থাকবে।" রাণী মত দিলেন।
"কিন্তু প্রাসাদের রুমটির কি হবে? আর আম বাগানটিরই বা কি হবে? তোতা পাখিটা কি করবে? আর রাণীর মৃত খালার দেয়ালচিত্রের কি প্রয়োজন হবে?" রাজা জিজ্ঞেস করলেন যিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে সব কিছুরই কার্যকারিতা আছে।
"সেগুলো জনগণকে দিয়ে দিন।" বাঘটি জানালো।
তাই ঘোষণা করে দেওয়া হল যে এখন থেকে দেশের জনগণ একটি তোতা, একটি দেয়ালচিত্র আর একটি আম বাগানের গর্বিত মালিক। আর রাজকন্যা সিনামন এখন কথা বলতে পারেন তবে কয়েক দিনের জন্য সে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তাদের ছেড়ে যাবেন।
রাজধানীর কেন্দ্রে মানুষজন জড়ো হল। প্রাসাদের দরজা খুলে গেল আর সেখান দিয়ে সিনামন আর বাঘটি বের হয়ে আসলো। ছোট্ট মেয়েটিকে পিঠে নিয়ে জনগণের মাঝখান দিয়ে বাঘটি মৃদু ছন্দে হেঁটে চললো। সিনামন শক্ত করে বাঘটির পশম ধরে আছে। আর শীঘ্রই তারা দুজনে বনের ভিতর হারিয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত রাণীর খালা ছাড়া আর কাউকেই মরতে হলো না। রাজধানীর কেন্দ্রে ঝুলে থাকা তার দেয়ালচিত্রটির সুবাদে তিনি ধীরে ধীরে মানুষের মনে চিরযৌবনা আর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে জায়গা করে নিলেন।
©somewhere in net ltd.