![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিশোরকে দেখে আমি থমকে গিয়েছিলাম, হা করে তাকিয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। না, মাঝে পনেরটা বছর পার হয়ে গেলে কী হবে, ওকে চিনতে আমার মোটেই বেগ পেতে হয়নি। কিশোরও আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়েছিল। সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছিল তখন। এজন্য হয়ত আমাকে ভালভাবে দেখতে পাচ্ছিল না। নাকি আমাকে চিনতে পারছিল না? কে জানে, জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু আমি চিনতে ভুল করিনি। আসলে আমিই প্রথম ওর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
"কিশোর, তুই? কেমন আছিস? তোকে এখানে দেখতে পাব আমি কল্পনাও করিনি।"
কিশোর সাহা। আমার ভার্সিটির বন্ধু। চারটা বছর আমরা একসাথে ছিলাম সেটা এখন বিশ্বাসই হতে চায় না। কত আড্ডা, হই-হুল্লোর, ঘোরাঘুরি-সবই আজ স্মৃতি। তারপর জীবনের স্রোতে পড়ে একেকজন একেকদিকে হারিয়ে গেলাম। কিশোর ছিল বড়লোক বাবার একমাত্র পুত্র, তাই পড়াশোনা নিয়ে ওর খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। ওর যত মাথাব্যথা ছিল সব অ্যান্টিক জিনিসপত্র নিয়ে। সেই ভার্সিটি লাইফ থেকেই কোথাও অ্যান্টিক জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে শুনলেই ও দৌড়ত। এসবের পেছনে ও কত যে টাকা ঢেলেছে তার ইয়াত্তা নেই। মাঝে মাঝে তো ঠকও খেত। এরকম করে করে কিশোর অনেক জিনিস জমিয়েছিল। ওদের বাসায় গেলে ও বেশ আগ্রহ নিয়ে সেগুলো দেখাত। তারপর তো ও চলে গেল বিদেশে। আর আমি মধ্যবিত্তের ছেলে, দেশে থেকে পরিবারের ঘানি টানতে লাগলাম।
"সাঈদ, কতদিন পর তোর সাথে দেখা!"
ভার্সিটির পুনর্মিলনীতে গিয়েছিলাম। কারও সাথে দেখা হয়ে যাবে এমনটা আশা করিনি। এতগুলো বছর তেমন কারও সাথেই যোগাযোগ ছিল না। ভার্সিটির বন্ধুত্বটা নাকি টেকসই হয় না। কারণটা বোঝার চেষ্টা করিনি, তবে হাতেনাতে টের পেয়েছি।
সন্ধ্যার দিকে বাসায় চলে আসব ভাবছিলাম এমন সময় কিশোরের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। কথায় কথায় জেনে নিয়েছিলাম, ও এতগুলো বছর বিদেশেই ছিল। মাঝখানে অবশ্য একবার বিয়ের জন্য দেশে এসেছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যায়। এখন বয়স হয়েছে, বিদেশে নাকি আর মন টিকছিল না। তাই স্ত্রীকে দেশে চলে এসেছে। পারিবারিক ব্যবসাটা এখন থেকে ও নিজেই নাকি দেখাশোনা করবে। সেদিন রাত হয়ে যাচ্ছিল বলে মন খুলে কথা বলা হয়নি।
"তুই চলে আয় না একদিন আমার বাসায়। তোর ভাবীর সাথেও দেখা হয়ে যাবে। আমাদের সাথে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যা। এখন বড্ড একা লাগে রে।"
কাজের চাপে কিশোরের কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। একদিন হঠাৎ ও ফোন দিল। তারপর ওর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করতে লাগল। আমি আর না করিনি। ঠিকানাটা নিয়ে নিয়েছিলাম। শায়লা মেয়ে দুটোকে নিয়ে বাবার বাড়িতে গেছে। কী একটা অনুষ্ঠান আছে নাকি। আমাকে নিয়ে যেতে বেশি চাপাচাপি করেনি ওরা। কারণ ভাল করেই জানে আমি এসব সামাজিকতা এড়িয়ে চলি। কিন্তু পুরানো বন্ধুত্বকে এড়িয়ে যাই কী করে? তাই সুযোগ বুঝে আজ রওনা দিলাম কিশোরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বের হওয়ার আগে ফোনে জানিয়ে দিলাম ওকে।
রওনা হয়েছিলাম দুপুরে। কিশোরের বাড়িটা খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হয়ে গেল আমার। সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে। বাড়িটা শহরের বাহিরে, একটা বাগানবাড়ি। চারদিকে বেশ উঁচু করে দেয়াল তোলা। দেয়ালের উপর দেখি আবার কাঁটাতারের বেড়া। এত নিরাপত্তা আয়োজন কেন এখানে?
বিশাল লোহার গেটে জাঁদরেল গোঁফের এক দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমি পরিচয় দিলে সে মোবাইলে কারও সাথে যোগাযোগ করল। তারপর গেট খুলে আমাকে ভেতরে যেতে দিল।
বাহিরে থেকে দেখে যতটা মনে হয়ে ভেতরে বাড়িটা কিন্তু ততটা বড় না। আসলে ঐ উঁচু দেয়ালটাই বাড়ির চেহারায় একটা ভারিক্কি ভাব এনে দিয়েছে। গেট থেকে একটু হেঁটেই আমি ডুপ্লেক্স বাড়িটার সদর দরজায় চলে এলাম। বেল বাজাতেই দরজাটা খুলে গেল, যেন কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দরজায় এক মধ্যবয়স্কা দাঁড়িয়ে আছে। কাজের লোক হবে হয়ত। পোশাক দেখে তাই মনে হচ্ছে।
মহিলা কোন কথা বলল না, দরজাটা খুলে ধরল। আমি ভেতরে ঢুকার পর সে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর পথ দেখিয়ে আমাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসলো।
"সাহেব আসতেছেন। আপনি বসেন।"
আমি আর কী করব। বসে বসে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে লাগলাম। কয়েক মিনিট পরই কিশোর নেমে এল।
"এসেছিস? এত দেরি দেখে আমি আরও ভাবলাম আজকে হয়ত আর আসবি না।"
"তোর বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এত দেরি হয়ে গেল।"
"আর বলিস না। এটা আমার দাদার বাড়ি। শহরের দিকেই উঠতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম বাড়িটা এখানে খালি পড়ে আছে। এখানেই থাকি। শহরে যে থাকতেই হবে এমনটা তো আর না। ওখানেও কেউ নেই। তার চেয়ে এখানে একটু নিরিবিলিতে ভালই তো আছি।"
"তবুও।"
"বাদ দে। ফ্রেশ হয়ে নে। তোর ভাবী নাস্তা নিয়ে বসে আছে।"
পনের মিনিট পরে আমরা ছাদে বসে আছি। একটু পরেই ভাবী হাতে ট্রে নিয়ে ঢুকলেন। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।
"আরে বসুন বসুন। আমি হোমড়া চোমড়া কেউ নই," কিশোরের বউ হেসে বললেন।
মহিলার বয়স অনুমান করতে পারছি না, তবে কিশোরের কাছাকাছি হবে। গায়ের রঙ শ্যামলা, উচ্চতা হবে পাঁচ ফিট চার। একটা শাড়ি পরে আছেন তিনি, মাথায় ঘোমটা।
আমি হেসে বসে পড়লাম। বলার মত কিছু মুখ দিয়ে আসলো না। মানুষ সামাজিক প্রাণি হলেও আমি ব্যতিক্রম। তাই বলে পশু বা দেবতা নই। আমি আসলে মানুষের সঙ্গ খুব একটা পছন্দ করি না, অমিশুক। নিজের মত থাকতে পছন্দ করি।
"নিন, নাস্তা নিন। একটু পরে রাতের খাবার দেওয়া হবে।"
এরপর চলল আড্ডা। কিশোরের প্রবাস জীবনের গল্প, বিয়ের গল্প, ছেলেমেয়ের গল্প। আমিও আমার বিয়ে, বউ-বাচ্চা নিয়ে টুকটাক কিছু বললাম।
রাতের খাবারের পর ভাবী আমাদের থেকে বিদায় নিলেন। আমি আর কিশোর আবার ছাদে চলে এলাম। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা প্রশ্নটা তখন করেই ফেললাম।
"আচ্ছা, কিশোর, তোর বাড়ি ঘিরে এত নিরাপত্তা কেন? বাহিরে উঁচু দেয়াল, কাঁটাতার, একটু আগে কুকুরের ডাকও শুনলাম।"
কিশোর হেসে দিল। "তোর কী মনে হচ্ছে?"
"কিছুই মনে হচ্ছে না। তোর কাছ থেকেই শুনি।"
"রাত তো অনেক হল। আজ থাক। কাল নাহয় নিজের চোখেই দেখিস।"
বন্ধুকে বিদায় দিয়ে মনের ভেতর খুঁতখুঁতানি নিয়ে আমার রুমে চলে এলাম। কেমন যেন লাগছে। পুরো বাড়িটাতে কী এক রহস্য যেন মায়াজাল বিছিয়ে রেখেছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও টের পেলাম না।
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম। কিশোর ড্রয়িং রুমে পত্রিকা পড়ছে।
"ঘুম ভাঙ্গল?" পায়ের আওয়াজ শুনে ও মুখ তুলে বলল। "টেবিলে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। চল।"
দুজনে একসাথে নাস্তা করলাম। ভাবীকে চোখে পড়ল না। আমিও আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
"কাল রাতে একটা প্রশ্ন করেছিলি না তুই? চল, এবার তোকে দেখাই," নাস্তা শেষে কিশোর বলল।
"তোর অফিস নাই?"
"আজ যাব না। তোর আগমন উপলক্ষ্যে ছুটি।" ছোট বাচ্চাদের মত ভাব ধরল কিশোর।
আমাকে দোতলার করিডোরের শেষ মাথায় নিয়ে এল ও। জায়গাটা অনেক বড়, কিন্তু দরজা একটাই। সেই দরজাটাতে আবার বেশ বড়সড় এক সাহেবি তালা ঝুলছে। কিশোর পকেট থেকে একটা বড় চাবির ঝোলা বের করল। তারপর তালাটা খুলতে লাগল। দরজাটা খোলার পর ভেতরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।
কিশোর ভেতরে গিয়ে সুইচ টিপতেই রুমটা আলোকিত হয়ে উঠল। আমি রুমের ভেতর ঢুকলাম আর মূর্তির মত জমে গেলাম যেন। রুমটা অনেক বড়, প্রায় চারটা রুমের সমান লম্বায়। পুরো রুম জুড়ে অনেকগুলো টেবিল; উপরটা বাক্সের মত, কাঁচ দিয়ে ঢাকা। সেসব কাঁচের বাক্সের ভেতরের জিনিসগুলো দেখে আমি বুঝে গেলাম এই বাড়িতে এত নিরাপত্তার আয়োজন কেন। কিশোরের অ্যান্টিক জিনিসপত্র জমানোর বাতিক এখনও যায়নি, বরং বেড়েছে। তার সারা জীবনের সংগ্রহগুলো এখানে শোভা পাচ্ছে। এবং সেগুলোর পরিমাণ খুব একটা কম না।
"এখানে এমন অনেক মূল্যবান জিনিস আছে যেগুলো বিক্রি করতে পারলে চোরেরা লাখ লাখ টাকা পাবে," কিশোর গর্ব করল। অবশ্য ও বাড়িয়ে বলেনি। দেশ-বিদেশের অনেক দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছে ও। আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল সেসব। নবাব সিরাজ উদ দৌলার তরবারি, সম্রাট অশোকের আমলের কিছু দুষ্প্রাপ্য বই, পাল আমলের রাজাদের পারিবারিক আঙটি, বেশ পুরানো কয়েকটা তৈলচিত্র-আরও কত কী! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম।
"কত যে খাটনি গেছে তুই কল্পনাও করতে পারবি না," কিশোর পাশ থেকে বলল। একটা বাক্সের সামনে এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। না, এখানে আহামরি কিছু নেই। তবে একটা অদ্ভুত জিনিস আছে।
একটা হলুদ ন্যাকড়া। ময়লা, ছেঁড়া। এত দামী দামী জিনিসের ভেতর ন্যাকড়াটাকে কেমন বেমানান লাগছে। জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে গিয়ে হয়ত ভুলে থেকে গেছে। কিন্তু ন্যাকড়াটাকে অনেক সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা হয়েছে। ভুলে কেউ নিশ্চয় ন্যাকড়া ভাঁজ করে রাখবে না? কিশোরকে ন্যাকড়াটার কথা বললাম।
"তুই বোধ হয় ন্যাকড়াটা সরাতে ভুলে গেছিস।"
"না রে বন্ধু, ভুলিনি," কিশোর বলল। "আমিই ওটা ওখানে রেখেছি।"
"তুই রেখেছিস? এত দামী জিনিসপত্রের মধ্যে ঐ ময়লা ন্যাকড়া রাখতে গেলি কেন?"
"কারণ ঐ ন্যাকড়াটার মত দামী কিছু আমার এই সংগ্রহশালায় নেই।"
আমি হতভম্ব হয়ে বন্ধুর মুখের দিকে তাকালাম। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি ওর? কিশোর হয়ত আমার মনের কথাটা মুখে ফুটে উঠতে দেখেছে।
"না, পাগল হইনি। সত্যি বলছি।"
"মানে কী? এটা কিভাবে সম্ভব?"
কিশোর কী যেন ভাবল। তারপর বলল, "আগে তোর ভাবীকে জিজ্ঞেস কর। ও অনুমতি দিলে তবেই কাহিনীটা আমি বলব।"
আমি আর কথা বাড়ালাম না। রুম থেকে বের হয়ে নিচে নেমে আসলাম। হলুদ ন্যাকড়াটা আমার চোখে ভাসছে। এটা কিভাবে সবচেয়ে দামি হয়? রহস্যটা আমাকে জানতেই হবে। বাগানে পেয়ে গেলাম ভাবীকে। অনুমতি চাইলাম তার কাছে।
"আসলে আপনাকে কী অনুমতি দেব, আমি নিজেও জানি না ঐ হলুদ ন্যাকড়ার গুরুত্ব কী।"
তার কথা শুনে আমি একটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।
"অনেক দিন ধরেই হলুদ ন্যাকড়াটাকে দেখছি। ও যেখানে যায়, হলুদ ন্যাকড়াটা সাথে রাখে। একবার জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে আর করা হয়নি। এখন আপনার কারণে হয়ত আমিও ঘটনাটা জানতে পারব।"
কিশোরকে গিয়ে কথাটা বললে ও হাসল। "ঠিক আছে। আজ রাতে খাবারের পর ছাদে বসা যাক তাহলে।"
আমার আর তর সইছিল না। কখন যে রাতটা আসবে! আর রাতটা যখন একটু একটু করে এগিয়ে এল তখন উত্তেজনায় আমার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা।
ঝালমুড়ি নিয়ে ভাবী ছাদে আসলেন। তারপর কিশোরের পাশে গিয়ে বসলেন।
"তখন আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে," কিশোর কোন ভূমিকায় না গিয়ে বলতে শুরু করল। "বিয়ের পর কণাকে নিয়ে দেশে থাকলাম ছয় মাস। আনন্দ-ফূর্তিতে কেটে যাচ্ছিল আমাদের দাম্পত্যের দিনগুলো। আমাদের যেন একে অন্যের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন খোদা। বিয়ের আগে আমরা কেউ কাউকে কখনো দেখিইনি। কিন্তু তাতে আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছিল না। আমরা বেশ মানিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর কণাকে নিয়ে চলে গেলাম ইংল্যান্ডে। প্রথম একটা বছর কোন সমস্যা হল না। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই আমার কাজের চাপ বেড়ে গেল। কণাকে সময় দিতে পারছিলাম না। ওদিকে কণা নতুন একটা পরিবেশে একা হয়ে পড়েছিল। দেশের পরিচিত কেউ তার পাশে ছিল না। সব সময় ও মনমরা হয়ে থাকত। কিন্তু আমি ছিলাম নিরুপায়। কণা আর আমার দূরত্ব আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল ও। কিন্তু আমি তখন ছিলাম অবুঝ। কণার এই পরিবর্তনটা আমার কাছে অন্যরকম ঠেকেছিল। আমি ভাবতাম পরিচিত মানুষদের থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ও হয়ত আমার উপর রাগ দেখাচ্ছে। ওর একাকীত্ব আমি বুঝতে চাইতাম না। শুধু আমার প্রতি ওর অবহেলাটুকুই আমার চোখে পড়েছিল।"
কিশোর একটু থামল। আমি কিছু বললাম না। পরিবেশটা অদ্ভুত ঠেকল আমার কাছে। প্রকৃতিও যেন সব কিছু ভুলে কিশোরের কাহিনী শুনছে। ভাবীকে দেখলাম আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে।
"এর মধ্যে আবার বাসা থেকে বাবা-মা নাতি-নাতনীর মুখ দেখার জন্য চাপ দিচ্ছিল। আমরা চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কোন লাভ হচ্ছিল না। এ নিয়ে প্রতি নিয়ত আমাদের খিটিমিটি চলছিল। পুরো সংসারে নেমে এসেছিল অশান্তি। আমি অফিসের কাজে মনযোগ দিতে পারতাম না।"
"সংসারে একবার বিষ ঢুকলে সেটা পুরো সংসারকে তছনছ করে দেয়, বন্ধু। তোকে বলে রাখলাম, মনে রাখিস। যাই হোক, এমনই একদিন অফিস থেকে আসার পর কণার সাথে কথা কাটাকাটি শুরু হল, তারপর ঝগড়া।" ভাবীকে দেখলাম হাত দিয়ে কিশোরের হাতে চাপ দিতে। "না, কণা। আজ আমাকে বলতে দাও। এত দিনের কথা সব বুকে জমে আছে। আজ একটু হালকা হতে চাই।"
কিশোর আবার বলা শুরু করল। "এরপর আচমকা আমি কণার গালে একটা থাপ্পড় মেরে বসেছিলাম। একটা মুহুর্তের জন্য সেদিন সময় যেন থমকে গিয়েছিল। আমি নিজে হতভম্ব হয়ে কণার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আগে কখনই আমি ওর গায়ে হাত তুলিনি। ওকে আমি আঘাত করেছি সেটা আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, মেনে নিতে পারছিলাম না। তাহলে বন্ধু, কল্পনা কর, কণার কী অবস্থা হয়েছিল। ও কয়েক মূহুর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর দৃষ্টিতে যদি ঘৃণা থাকত, তাহলেও হয়ত আমি শান্তি পেতাম। কিন্তু ওর দু চোখে কোন ঘৃনা ছিল না, কোন রাগ ছিল না, না ছিল কোন অভিমান। সেখানে আমি শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখিনি সেদিন। সেই দৃষ্টি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। কণা দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। আমি ওর পিছু পিছু গেলাম। ভেবেছিলাম ও রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেবে। কিন্তু ও সেরকম কিছুই করেনি। ঝাড়পোঁছ দেওয়ার জন্য রাখা একটা হলুদ ন্যাকড়া নিয়ে সোফার ধুলো ঝাড়তে শুরু করেছিল। জোরে জোরে সোফা ঝাড়ছিল ও। আমার উপরে জমে থাকা সব রাগ গিয়ে পড়ছিল ঐ সোফার উপর। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ও। আমার কেমন যেন লাগছিল তখন। নিজের অনুভূতিটাকে ধরতে পারছিলাম না। আচমকা কণা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর ওকে ন্যাকড়াটা দিয়ে চোখের পানি মুছতে দেখেছিলাম। তারপর আবার সোফা ঝাড়তে শুরু করেছিল ও। সাথে সাথে আমি সব বুঝে গিয়েগিয়েছিলাম। সবকিছু পানির পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। চোখের সামনে থেকে কেটে গিয়েছিল কুয়াশা । যে সত্যটাকে ভয়ে আমি এতদিন এড়িয়ে চলছিলাম, সেটা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের এই করুণ অবস্থার জন্য যে আমিই দায়ী সেটা বুঝতে আমার আর বাকি ছিল না। কণার প্রতি যে অন্যায় আমি করেছি, তার অপরাধবোধে আমি পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলাম।"
কিশোর বিরতি নিল। ভাবী এখন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছেন। বারবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। কিশোর তাকে কাছে টেনে নিল।
"এরপর থেকে আমি আমার ভুল শোধরানোর চেষ্টা করে আসছি আজ পর্যন্ত। হয়ত আমাদের কোন সন্তান হয়নি, হয়ত আমার বাবা-মা এতে সন্তুষ্ট নন। কিন্তু তাতে আমার আর কিছু আসে যায় না। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভালই আছি। আর যে ন্যাকড়াটা দিয়ে কণা সোফা ঝাড়ছিল, সেটা আমি তখন লুকিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ কণার চোখের পানিতে ভেজা ঐ ময়লা কাপড়টার জন্যই তো আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। এর চেয়ে দামী বিস্তু আমার কাছে আর কী হতে পারে?"
কিশোর এটা কোন প্রশ্ন করেনি। আমি তাই উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আর দেওয়ার মত কোন উত্তরও আমার কাছে নেই। অশ্রুসিক্ত দম্পতিকে ভালবাসায় আসক্ত হওয়ার সুযোগ দিয়ে আমি নিচে নেমে গেলাম।
২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:২১
সাঈদ শিহাব বলেছেন: ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে বিষয়টা খেয়াল রাখব।
২| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০০
আহমেদ জী এস বলেছেন: সাঈদ শিহাব
ভালো লেগেছে ।
ঈদের শুভেচ্ছা ।
২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:২২
সাঈদ শিহাব বলেছেন: ধন্যবাদ। একটু দেরি হয়ে গেল যদিও, তারপরও বলি, আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৯
একলা চলো রে বলেছেন: ঝড়ঝড়ে অনুবাদ। সাবলীল লেখা। একটানে পড়ে ফেলাআর মতোই। ব্রাম স্টোকারও আমার প্রিয় লেখক। গল্প বলার আয়োজন দেখে আশা করেছিলাম গল্পের মধ্যে আরো গভীর কিছু থাকবে। কিন্তু তেমন কিছু নেই। সাদামাটা গল্প। সাদাসিধে কাহিনী। তবে সেটা ব্রাম স্টোকারের দোষ, আপনার নয়। আপনি অনেক ভালো লিখেছেন। থাপ্পড় শব্দটা ব্যবহার না করে চড় ব্যবহার করলে আরো ভালো শোনায়। এই বিষয় দু'টো বাদ দিলে আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। অনুবাদক হিসেবে আপনি চমৎকার, সন্দেহ নেই। প্লাস