![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রতীতির সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারিনি কখনো। মাঝে কতগুলো দিন চলে গেছে নিভৃতে। বলাকওয়া নেই, হুট করে তাই দেখা হয়ে যাওয়ায় বিস্মিত না হয়ে পারিনি। অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে, কোন কথা বলতে পারিনি সহসাই।
এই তো, দু দিন আগে হঠাৎ করে কেন জানি খুব মনে পড়ছিল ওর কথা। বাইরে তখন ঝর ঝর বৃষ্টি। উদাস হয়ে পড়েছিলাম প্রকৃতির কাক ভেজা রুপ দেখে। এমনই এক ক্ষণে মনে পড়ে গিয়েছিল প্রতীতির কথা। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল ওকে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল। জানতাম তা হওয়ার নয়। কিন্তু মন কি আর মানে? সেদিন তাই প্রতীতির সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় প্রথমেই মনে হয়েছিল যে বিধাতা হয়তো আমার মনের কথা পূরণ করতেই ওর সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছেন।
ওর সাথে আমার যেদিন দেখা হয় সে দিনেও মুখ গোমড়া করে রেখেছিল আকাশ। বৃষ্টি পড়বে পড়বে এমন অবস্থা। কয়েকটা বই কেনা শেষ করে নিউ মার্কেটে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। একটা দোকানের সামনে এসে পুতুলের গায়ে পরানো একটা শার্ট পছন্দ হয়ে গেল। শার্টটা কিনে বের হয়ে আসতে গিয়েই থমকে গেলাম। পা যেন আটকে গেছে মেঝের সাথে।
প্রতীতি হেঁটে যাচ্ছে!
ঠিক হেঁটে যাচ্ছে বলা যাবে না, হেঁটে আসছে। আমারই দিকে হেঁটে আসছে। যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিল।
'কী রে শুভ, কেমন আছিস? কত দিন পর তোর সাথে দেখা!'
'প্রতীতি!' এই একটা শব্দই আমার মুখ দিয়ে বের হলো শুধু। প্রতীতি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই প্রতীতি। আমার চিরচেনা প্রতীতি। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাকে ছাড়া ঘড়ির কাঁটা ঘুরতো না সেই প্রতীতি।
প্রতীতির সাথে আমার পরিচয়টা সাধারণ বা স্বাভাবিক ছিল না। অন্তত আমার তাই মনে হয়। বড় ভাইদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কয়েকটা দিন দেরি করে ভার্সিটিতে জয়েন করেছিলাম। কিন্তু পালিয়ে আর যাব কোথায়? ক্যান্টিনের সামনে ধরা পড়ে গেলাম যে ভার্সিটিতে নতুন এসেছি। ব্যস! শুরু হয়ে গেল পরিচিতি পর্ব। সেসবের কিছুই আর মনে নেই এখন। তবে সবার শেষে যে ঘটনার কারণে আমি নিস্তার পেয়েছিলাম, তা মনে আছে ভালো ভাবেই। এক বড় ভাই একটা মেয়েকে দেখিয়ে বললেন মেয়েটার মোবাইল নাম্বার নিয়ে আসতে। এবার তো পড়লাম অথৈ সাগরে। লাজুক হিসেবে কলেজে কুপরিচিত ছিলাম। যেখানে পুরো কলেজ লাইফে কোন মেয়ের সাথে কথাই বলিনি, সেই আমাকে বলা হলো কিনা একটা অপরিচিত মেয়ের নাম্বার নিয়ে আসতে। কিন্তু কি আর করা। কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার দিকে। সিড়িতে বসে কী যেন পড়ছিল সে।
'আপনার মোবাইল নাম্বারটা দিতে পারবেন, প্লিজ?'
কথাটা বলতেই মুখ তুলে তাকাল মেয়েটা। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে মেয়েটা সুন্দর না বিশ্রী, চোখগুলো কী রকম, চুল কেমন-এসব দেখে ফেলতো এক নজরেই। কিন্তু আমার সেদিকে মনযোগ নেই। কোন মতে নাম্বারটা নিয়ে যেতে পারলেই বেঁচে যাই। মেয়েটাকে ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছিলাম কেন আমার তার নাম্বারটা দরকার। কিন্তু তার আগেই কাঁদতে শুরু করে দিল সে। সত্যিকারের কান্না। হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী করবো বুঝতে পারছি না। পিছনে ফিরে সিনিয়রদের তাকালাম। কিন্তু সেখানে এখন কেউ নেই। কী আর করব। দ্রুত পায়ে চম্পট দিলাম।
ধাক্কাটা খেলাম ক্লাসে গিয়ে। মেয়েটা যে এখনও আমার পিছু ছাড়েনি! আমার ডিপার্টমেন্টেই পড়েছে তাহলে। বেশ হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার পাশে এসে বসে পড়ল সে।
'কেমন ভড়কে দিলাম?' প্রশ্ন শুনে আমি অবাক। বলে কী!
'আসলে কিছু করার ছিল না। নাহলে আমার মোবাইল নাম্বারটা যদি দিতে হতো! কলের ঠেলায় তো বাঁচতাম না।'
হা করে তাকিয়ে আছি। এতক্ষণে মেয়েটার উপর চোখ পড়ল আমার। সাধাসিধে ফর্সা চেহারার এই মেয়েকে দেখলে কে বলবে যে এর পেটে এত শয়তানি লুকিয়ে আছে!
কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে শুরু করেছিলাম। প্রতীতির সংস্পর্শে এসে আমার জীবনটাই পালটে গেল। আড্ডা, টইটই করে ঘুরে বেড়ানো আর পড়ালেখা-সবই আমরা করেছি এক সাথে।
ভালোই কেটে যাচ্ছিলো দিন গুলো। কিন্তু তা বোধ হয় সহ্য হলো না বিধাতার। ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষে পা রাখতেই বিয়ে হয়ে গেল প্রতীতির। ভাল পাত্র পেয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা মেয়ের বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে দেরি করেননি।
প্রতীতি যেদিন আমাকে প্রথম ওর বিয়ের কথা বলল, আমি কিছুই বলিনি। কী বলবো? কিছুই বলার ছিল না আমার। আমার নীরবতা কি ওকে আঘাত করেছিল? হয়তোবা। কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ওর চোখ দুটো দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল কয়েকটা মুক্তো দানা।
বিয়ের পর আর ভার্সিটিতে ফিরে এল না প্রতীতি। ও আর এসে কী করবে? ওর ভবিষ্যত তো এখন নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমার ভবিষ্যতে যেন নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। জীবন থেকে সব আনন্দ যাওয়ার সময় শুষে নিয়ে গিয়েছিল প্রতীতি। পড়ালেখায় মন বসাতে পারছিলাম না। ওর শুন্যতা গ্রাস করে নিচ্ছিল আমাকে। কেন হচ্ছিল এমনটা? আমি কি ওকে ভালবেসেছিলাম? তাহলে কেন সেদিন ওর চোখের জল মুছে দিতে পারিনি?
নাহ, প্রতীতি আর আমি শুধুই বন্ধু ছিলাম। খুব ভাল বন্ধু। বন্ধুত্বটা এতটা নিবিড় হয়েছিল কখন, তা আমি টেরও পাইনি। প্রতীতি কি পেয়েছিল? শুধুই কি একজন বন্ধুর জন্যই ঝরেছিল ওর অশ্রু? বড্ড দেরি হয়ে গেছে এখন। ভেবে লাভ নেই।
'কি রে কোথায় হারিয়ে গেলি?'
প্রতীতির কথায় একটানে বাস্তবে ফিরে এলাম। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ও। ওর চোখই বলে দিচ্ছে যে ও জানে আমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম।
'চল, কোথাও বসি।'
মন্ত্রমুগ্ধের মত ওর পিছনে হেঁটে চললাম। ফুচকার দোকানটায় প্রতীতি আর আমি যখন মুখোমুখি বসলাম, তখনও ঘোরে আমি। অনেক বছর আগে এমনই একটা ফুচকার দোকানে ও আর আমি বসে ছিলাম। একটা হিন্দি সিনামা দেখে ওর আর আমার মধ্যে 'ফুচকা খাওয়া প্রতিযোগিতা' করার ইচ্ছে জাগে। আসলে সেজন্যই ওকে নিয়ে দোকানটাতে আসা। দুজনে বসেছিলাম মুখোমুখি। সিনামাতে নায়ক-নায়িকার মধ্যে কে জিতেছিল খেয়াল নেই। তবে আমাদের মধ্যে কে জিতেছিল তা মনে আছে স্পষ্ট। অবশ্যই প্রতীতি জিতেছিল। তবে আমাকে হারানোর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল ওকে। মানুষজনের সামনে দ্বিতীয়বারের মত কাঁদিয়েছিলাম ওকে।
'আমাদের ফুচকা খাওয়া প্রতিযোগিতার কথা ভাবছিস তো?' শুনে অবাক হলাম না মোটেও। প্রতীতি আমার মনের কথা পড়ে ফেলবে-এটাই যেন স্বাভাবিক। তখনও কিছু বললাম না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার বন্ধুটাকে দেখছি। কত পালটে গিয়েছে ও। জোর করে মুখে হাসি ধরে রেখেছে যেন। ঠোঁটের কোণে সবর্দা ঝুলে থাকা মিষ্টি হাসিটা আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। ফর্সা চামড়া মেটে রঙ ধারণ করেছে। ফিনফিনে চুলগুলোতেও রুক্ষতা।
'জানিস শুভ। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। প্রাণটা কেমন আনচান করছিল এক নজর দেখার জন্য। তাই আর থাকতে পারলাম না। ছুটে এলাম।'
বলতে পারলাম না যে ওকে দেখার জন্য কেমন মুখিয়ে ছিলাম আমি। বুকে পাথর বেঁধে দিন গুলো কিভাবে কাটাচ্ছি তা আমিই ভাল জানি।
'তুই কি আমার সাথে রাগ করেছিস তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছি বলে? কিছু বলছিস না যে?'
'কি বলবো বল। তুই তো না শুনেই আমাকে একা রেখে চলে গেলি।'
'তোকে ছেড়ে যেতে পারি বল,পাগল? সব সময় তোর আশে পাশেই আছি আমি।'
বিদ্রুপের হাসি হাসলাম। এই থাকাকে থাকা বলে না, প্রতীতি। তোকে এভাবে চাইনি আমি। সর্বক্ষণ আমার পাশে চেয়েছিলাম। কথাগুলো মনের ভেতরেই রয়ে গেল। মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।
'আমাকে এবার যেতে হবে রে।' উঠে দাঁড়াল ও। কেমন হাহাকার করে উঠল আমার বুকের ভেতর সাথে সাথে।
'যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস।' এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারলাম না। মৃদু হাসলো ও। সেই হাসি, যে হাসি রাস্তায় রাস্তায় এত দিন ধরে খুঁজে বেরিয়েছি আমি।
চলে যাচ্ছে প্রতীতি। আর বসে বসে দেখছি আমি। কিছুই করার নেই আমার। ওর চলে যাওয়া আমি আটকাতে পারব না, আমার সাধ্যের বাইরে তা। কখনোই পারিনি ওকে আটকাতে।
বিয়ে করে আমাকে ফেলে যখন চলে গিয়েছিল, তখনো আটকাতে পারিনি।
বিয়ের দুই বছর পর যখন মা হতে গিয়ে মারা যায় ও, তখনও পারিনি।
©somewhere in net ltd.