নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাতসাগর

সাতসাগর › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘আদিবাসী’ বিতর্কে আলোচিতদের আলোচিত কিছু কথামালার পুঞ্জিভ’ত উপস্থাপন

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৪৩

ভূমিকা

পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসিদের ঐতিহাসিক কাল থেকেই প্রতিটি প্রশাসনিক বা ক্ষমতাকাঠামোতে (ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশ আমল) আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক বিতর্কে সরব অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি আপাত লক্ষণীয়। যদিও তাদের সরবতা প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ব্যাখ্যায় নেতিবাচকতাকেই প্রতিফলন করে। যার প্রমাণ আমরা স¤প্রতিক আদিবাসী বিতর্কেও লক্ষ্য করছি।



বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিয়ে আলাপচারিতার একটি প্রকাশ্য এবং খোলামেলা পরিসর ধীরে ধীরে তৈরী হচ্ছে। এই পরিসর নির্মাণে বাংলাদেশে ১৯৯০ এর পরবর্তী গণমাধ্যমের বিকাশ একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আর এর পেছনে আরো কাজ করছে আদিবাসী সংগঠন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের নানাবিধ তৎপরতা ও উদ্যোগ। সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ আরো কিছু দাবিতে এ সংগঠকেরা কাজ করে যাচ্ছেন প্রায় দেড় দশক বা কিছু বেশি সময় ধরে। তবে নানবিধ উদ্যোগ ও তৎপরতার পর এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের একটি অনঢ় অবস্থা আমরা লক্ষ্য করছি। বিশেষ করে নামকরণের প্রশ্নে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে কী নামে চিহ্নিত করা হবে সে বিষয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে একটা স্পষ্ট সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে (সুমন, ২০১১)।



আদিবাসী বির্তকের প্রেক্ষাপট

৯ই আগষ্ট ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রসংঘ আদিবাসী দিবস নিয়ে কাজ শুরু করে। এ দিন রাষ্ট্রসংঘ আদিবাসীদের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য “রাষ্ট্রসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্র“প” এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার প্রসার ও সংরক্ষণের সাথে এ সংশি¬ষ্ট সকল কাজের পর্যালোচনা করা এবং আদিবাসীদের মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণ করা। এ স্মরণীয় দিনটিকে কেন্দ্র করে ২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ৯ই আগষ্ট দিনটিকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এ দিবসটি ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত, সুযোগ বঞ্চিত ও নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত আদিবাসী জাতিসমূহের জন্য এবং তাদের সমাজের সমস্যাগুলোর উপর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সরকার, অন্যান্য বেসরকারী সংগঠন ও সচেতন সমাজ কর্তৃক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া (ঈযৎরংঃধরহ, ২০০৮)।



১৯৯৩ এর ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী বর্ষ উদযাপন আয়োজন করা হয়। এতে বাংলাদেশের বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য অংশ নেয়। সম্মেলনের আয়োজন করেন রাঙামাটি জেলা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার এবং ময়মনসিংহ থেকে নির্বাচিত এমপি ও ট্রাইবেল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সভাপতি প্রমোদ মানকিন। সম্মেলনে ১৪ দফা সম্মিলিত একটি ঘোষণা গৃহতি হয়। এই ঘোষণার কয়েকটি দফা নিুরূপ-

- বাংলাদেশের ৪৫টি জনগোষ্ঠীর ৩০ লাখ মানুষ ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণার জন্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

- বাংলাদেশের কোন আদিবাসী নেই। এখানে রয়েছে শুধু বাইরে থেকে আসা কিছু যাযাবর মানুষ যাদেরকে উপজাতি বলা হয়। তাই বাংলাদেশে আদিবাসী বর্ষ উদযাপনের কোন প্রয়োজন নেই। সরকারের এই বক্তব্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আদিবাসীরা মনে করেন এই বক্তব্য হিংসাপ্রসূত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বাংলাদশের আদিবাসীরা জানান সরকারের এই অবস্থানে ক্ষুদ্ধ, হতাশ ও আতঙ্কিত এবং তারা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

- বাংলাদেশসহ বিশ্বের সর্বত্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী নির্যাতনের কর্মসূচীর অজুহাতে সরকার কর্তৃক তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন ও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ উদযাপন কমিটি এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান করে ও উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় (জীবন আমাদের নয়, ২০০১:২৬৪)।



আর এ বছর ১৬ ই মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে শুরু হয় আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের বৈঠক। সেখানে জাতিসংঘ পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিষয়ক এক প্রতিবেদনে পাহাড়ে বসবাসরত এগারটি জনজাতিকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে উলে¬খ করে। আর চলতি সরকারের মেয়াদকালের মধ্যেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি সেখানে সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ফোরামের এধরনের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয় “এদেশে আদৌ কোন ‘আদিবাসী’ নেই”। এদেশে বসবাসকারী ভাষাগত সংখ্যালঘুরা সবাই ‘ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী’। আর এই সরকারী বক্তব্যের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এম এ মোমেন। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্যে বলেন বাংলাদেশে আদৌ কোন আদিবাসী নেই। এদেশে বসবাসকারী ভাষাগত সংখ্যালঘুরা সবাই ‘ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী’। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী বাঙালিরাই এ দেশের আদিবাসী, ভাষাগত সংখ্যালঘু ‘উপজাতি’ জনগোষ্ঠী আদিবাসী নয় (িি.িশধষবৎশধহঃযড়.পড়স)।



এদেশের আদিবাসীদের কখনো ‘উপজাতি’ আবার কখনো ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ অভিধায় চিহ্নিত করে বিভিন্ন সময় নানা সরকারি আইন ও আদেশ জারি করা হয়েছে। গত বছরের ২৮শে জানুয়ারী পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক নির্দেশনায় ‘উপজাতি’দের ‘আদিবাসী’ অভিধা ব্যবহার না করার কথা বলে। ২০০৫ সালেও দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে অনুরূপ নির্দেশনা দেয়া হয়। আবার ২০১০ সালে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে আদিবাসীদের ‘ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী’ উলে¬খ করে ১৭টি জনজাতিকে তালিকাভুক্ত করা হয়। একই সময় জারি করা হয় ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী’ সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট আইন-২০১০ (২০শে মে, ২০১১, কালের কন্ঠ)।



অন্যদিকে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে সংবিধান সংশোধন বিষয়ক বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১১ সালের ১৬ই মার্চ সংবাদ সম্মেলনে বলেন ‘উপজাতিরা আদিবাসী হিসেবে নয়, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি পাবেন। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আদিবাসী বলতে যা বোঝায় আমাদের উপজাতিদের তা বোঝায় না”। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত আরো বলেন, ‘আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য তাদের (উপজাতিদের) একটি দাবি আছে, কিন্তু এ দাবির ক্ষেত্রে কমিটির সম্পূর্ণ ভিন্নমত রয়েছে। বাংলাদেশ একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ। আমরা হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের জাতি। এখানে কোন উপনিবেশিক শাসন ছিল না, এমনকি মধ্যযুগেও না। তাই অষ্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থে আদিবাসী বোঝায় আমাদের উপজাতিরা তেমন নয়। তাই ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বা হিসেবে বাংলাদেশি নাগরিকত্বের মাধ্যমেই তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে।”



জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামের বক্তব্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এধরণের বক্তব্যের পরবর্তীতে ৩০ শে জুন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল ২০১১ পাশ হয়। সেখানে আইনীভাবে পাহাড়ি অঞ্চলে মানুষদের ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়ের পরিবর্তে ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ প্রত্যয়টি বলবৎ করে। যা এক অনিবার্য় বিতর্ককে স্বাগত জানায়।



আদিবাসী বিতর্কে পররাষ্টমন্ত্রীর বক্তব্য

পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি তার কার্যালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কী হিসেবে অভিহিত করা হবে সে সম্পর্কে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি ও কূটনীতিদের ব্রিফ করেন। আর সেই ব্রিফ অনুষ্ঠানে ৫০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি, কূটনীতিক এবং পররাষ্ট সচিব ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনু বিভাগের পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।



পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামে ২০১১ সালের প্রতিবেদনে পার্বত্য চুক্তির প্রেক্ষাপটে তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের ‘আদিবাসী’ বলায় দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমরা পুনরায় অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশ ও বাঙালির সমৃদ্ধ নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস, উপনিবেশিক ইতিহাস ও সমৃদ্ধ আত্মপরিচয়ে রয়েছে। তার বহি:প্রকাশ ঘটেছে ‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গটিতে তিনি বাঙালিদের বাংলাদেশের প্রকৃত আদিবাসী উলে¬খ করে বলেন ‘বাঙালীরাই এদেশের প্রকৃত আদিবাসী’। চার হাজার বছরেরও আগে এদেশে বসবাস শুরু করে বাঙালিরা। যার নিদর্শন খুজে পাওয়া গেছে উয়ারী বটেশ্বরে। তাছাড়া আইএলও কনভেনশন-১৬৯ এ উলে¬খ রয়েছে পাহাড়ী নয় বাঙালিরাই এ দেশের আদিবাসী”।



আবার দীপু মনি সংবিধানে শান্তিচুক্তি ও আদমশুমারি প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সব স¤প্রদায়কে সাধারণত সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের মর্যাদা বাড়াতে সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেছে। ফলে তারা এখন আর উপজাতি হিসেবে অভিহিত হবে না। এই পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তান ও ভারতের সংবিধান থেকে নিজেদের অন্য অবস্থানে নিয়ে গেছে বাংলাদেশ। কারণ ঐ দেশ দুটির সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনগণকে ‘উপজাতি’ হিসেবে উলে¬খ করা হয়েছে।



তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক আইন ও ঐতিহাসিক দলিল ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সইয়ের সময় তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই শব্দটি মেনেই ওই চুক্তি সই হয়। অথচ স্বার্থান্বেষী কিছু মহল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও জাতিসংঘের বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী অভিহিত করার মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অপপ্রয়াস চালায়। ঐ সব মহলের এধরনের অপতৎপরতা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। ২০০১ সালের আদমশুমারি উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনৈতিকদের বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ তিনটি পার্বত্য জেলার অধিবাসি। ১৫ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশকে অবহেলা করে ক্ষুদ্র অংশটিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার তৎপরতা কোনভাবেই দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারে না (প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০১১)।



বর্তমান সরকার কেন হঠাৎ ‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গটি সামনে আনলো বা এ প্রসঙ্গটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কিংবা

ভৌগলিক অখন্ডতার জন্য কোন হুমকি কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন ‘দেখুন একটি সরকার হিসেবে আমাদের উপর দায়িত্ব রয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখন্ডতার ব্যাপারে সব সময় সজাগ থাকা এবং তা নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে কোথাও যেন কোন ধরনের ভুল না হয় কোথাও যেন কোন ধরনের সমস্যার উদ্ভব না হয়। সময় মতো সেজন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করাও সরকারের দায়িত্ব। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করছি (৩ আগষ্ট ২০১১ প্রথম আলো)।



আদিবাসী বিতর্কে আইন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) আয়োজিত “আই এল ও সনদ ১৬৯ এবং বাংলাদেশে আদিবাসীদের মানবাধিকার” শীর্ষক আলোচনায় আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন সংবিধানে আদিবাসীদের ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা উপজাতি ও নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে উলে¬খ করা হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশে উপজাতি রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।



আদিবাসী বিতর্কে আদিবাসী নেতাদের বক্তব্য

‘আদিবাসী’ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে ব্যারিষ্টার রাজা দেবাশীষ রায় (চাকমা সার্কেল চীফ ও সদস্য, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম) বলেন, আমি অনেকটা বাধ্য হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দীপু মনির বক্তব্য খন্ডন করার প্রয়োজন বোধ করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর আইনানুগ মর্যাদা বিষয়ে গত ২৬ জুলাই তার বরাত দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কমে প্রকাশিত তার বক্তব্য এবং সাধারণভাবে গত মে মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনের একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ ধরে আমার বক্তব্য হাজির করব-



সরকারের ভ্রম

সংবাদে প্রকাশিত তথ্যমতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য প্রসঙ্গের মধ্যে বলেছেন:

১. সংবিধানে সকল সংখ্যালঘুকে সাধারণভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা আছে এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকার তাদের আর শুধু ‘উপজাতি জনগোষ্ঠী’ হিসেবে নয় ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছে।

২. পনেরো কোটি জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষকে বিশেষ ও উন্নত পরিচয়ের অধিকার দিতে গিয়ে বাকি ৯৮ দশমিক ২ শতাংশের অধিকার হরণ বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।

৩. সুচারুরূপে নথিবদ্ধ করা ভারতীয় উপমহাদেশের এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস পুনরায় নিশ্চিত করে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ষোড়শ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে পাশ্ববর্তী দেশ মোঙ্গল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে এই অঞ্চলে অভিবাসিত হয়। এখানে তারা আসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসেবে। বংশানুক্রমে বাংলাদেশের আসল অধিবাসী বা প্রথম জাতীয় জনগোষ্ঠী হলো এখানকার জাতিগত বাঙালিরা। তারাই এখন বাংলাদেশের পনেরো কোটি জনসংখ্যার নিরানব্বই শতাংশ।

৪. তিনি জোর দিয়ে বলেন জাতিগত বাঙালিরা এখানে ঔপনিবেশিক কায়দায় বসত করেনি এমনকি নিজ ভূখন্ডে কখনো তারা অ-আদিবাসী বা বিদেশী ছিলও না, হবেও না।

৫. তিনি আরও বলেন প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সব ঐতিহাসিক দলিলপত্র এবং ঔপনিবেশিক কালের ভারতীয় সাক্ষ্য প্রমাণে পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারীদের ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ বা ‘নবাগত বসতকার’ হিসেবেই সরকারীভাবে শনাক্ত করা হয়েছে।



এই পরিপ্রেক্ষিতে চাকমা রাজা এবং জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য হিসেবে মন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে আমার অবস্থান নিচে বর্ণিত হলো:





জাতিগত সংখ্যালঘু

মাননীয় মন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এবং ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী থেকে যে সূত্র টেনেছেন তা সঠিক নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর কোথাও ‘এথনিক মাইনরিটি’ বা বাংলা অনুবাদে ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ শব্দটি বলা নাই। ‘উপজাতি’ বলার পাশাপাশি এই সংশোধনীর নতুন যুক্ত হওয়া ২৩ (ক) অনুচ্ছেদে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা’ ও ‘ক্ষুদ্র স¤প্রদায়ে’র কথা বলা হয়েছে।



অধিকার ‘প্রদান’ ও ‘হরণ’

মাননীয় মন্ত্রী জাতীয় জনসংখ্যার ১ দশমিক ২ শতাংশের ‘অধিকার প্রদানকে’ বাকি ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ জনগণের অধিকার হরণ বলে যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন তা বেঠিক এবং ভুল বোঝার ফল। বাংলাদেশের বাদ পড়া প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত ১ দশমিক ২ শতাংশ জনগণের আত্মপরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি তাদের প্রান্তিক অবস্থান ঘোচানোর একটি শক্ত মঞ্চ ও আইনি ভিত্তি জোগাবে। এর দ্বারা এই জনগোষ্ঠী বা তার অন্তর্ভূক্ত কোনো সদস্যের বিশেষ কোনো সুবিধাজনক অবস্থান তৈরী হবে না। অন্যান্য দেশে যেমন নেপাল, ফিলিপাইন, স্ক্যান্ডিনেভীয় ও লাতিন আমেরিকার দেশে আদিবাসীদের অধিকার দিতে গিয়ে অ-আদিবাসীদের বঞ্চিত করতে হয়নি। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় যে কিছু নাগরিককে ‘আদিবাসী’ মর্যাদা দেওয়া মানেই নাগরিকদের একটি অংশ আপনা আপনি প্রশাসনিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে।



রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও অর্থনৈতিক অভিবাসী

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও অর্থনৈতিক অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন তা একইভাবে বাংলাদেশের বাংলাভাষী কিংবা উর্দুভাষী অন্য নাগরিকদের বেলায়ও প্রযোজ্য হতে পারে (যারা মুসলিম এবং বর্তমান ভারত বা মিয়ানমার থেকে অভিবাসী হয়েছিলেন) অভিবাসনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ যাই হোক তা কারও জাতীয় পরিচয় বা নাগরিকত্ব কিংবা নাগরিক অধিকার বা বৈষম্যের শিকার না হওয়ার অধিকারের ভিত্তি হতে পারে না। তা যদি হতো তা হলে তা হতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে যে বৈষম্যহীনতার নীতিকে শিরোধার্য করা হয় তার বরখেলাপ এবং পরিপন্থী। একই সঙ্গে তা হতো বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকারী বৈষম্যবিরোধী অনুচ্ছেদগুলোরও বিরুদ্ধে।





বাঙালিরা ‘ঔপনিবেশিক বসতকার’, ‘বিদেশি’ বা ‘অ-আদিবাসী’ নয়

যারা ‘আদিবাসী’ নয় মাননীয় মন্ত্রী তাদের সঙ্গে ‘ঔপনিবেশিক বসতকার’ এবং/অথবা ‘বিদেশী’ পরিচয়কে গুলিয়ে ফেলেছেন। কেউ আদিবাসী না হলেও যে ঔপনিবেশিক বসতকার হবে এটা অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার বেলায় প্রযোজ্য হলে হতে পারে বাংলাদেশের বেলা তা সত্য নয়। সা¤প্রতিক কালের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক প্রগতিশীল চিন্তাধারায় যারা আদিবাসী বলে বিবেচিত হয় না তাদের ‘ঔপনিবেশিক বসতকার’ এবং/অথবা ‘বিদেশী’ বলে ব্যাখ্যা করে না। বাঙালিরা যে বাংলাদেশের স্থানীয় (ন্যাটিভ) জনগোষ্ঠী অন্য জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী পরিচয় স্বীকার করার মাধ্যমে তা কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ বা অস্বীকৃত হয় না। অ-আদিবাসী মানে ‘বসতকার’ (সেটেলারস) নয় অন্ততপক্ষে বাংলাদেশ এবং এশিয়ার আরও কিছু দেশে তা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের বেলায় ‘আদিবাসী’ পরিচয় প্রযোজ্য কারণ তারা (১) প্রাক-ঔপনিবেশিক ও প্রাক-বিজিত সমাজের উত্তরসূরী এবং (২) অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে তারা প্রাক-ঔপনিবেশিক ও প্রাক-বিজিত পর্যায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অনুগামী রীতি ও প্রথার অনুসারী।



সরকার সম্ভবত ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি গত শতকের গোড়ার দিকের অর্থের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে সময় এই শব্দের ব্যঞ্জনা কেবল আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের অবস্থাকেই বোঝাত। কিন্তু জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পরিমন্ডলে উন্নয়নের ধারণায় পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে বোঝাপড়া অনেক দূর এগিয়েছে। আগে যাদের ‘উপজাতি’ বলে বিবেচনা করা হতো তাদের এখন আদিবাসী ধারণার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। যে ভুল ধারণাবশত ‘উপজাতি’ ও ‘আদিবাসী’ র মধ্যে বেঠিক ও কৃত্রিম পার্থক্য করা হয় তা আজকের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চিন্তাধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের যে সব নাগরিক নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে পরিচিত করে তাদের ওপর আদিবাসী ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় চাপিয়ে দিলে সেই কাজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবাদী প্রক্রিয়া ও পন্থার বাইরে চলে যাবে।



‘জাতিগত সংখ্যালঘু’, ‘নবাগত বসতকার’দের ‘উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ

মাননীয় মন্ত্রীর তরফে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘নবাগত বসতকার’ বলা এবং তাদের ‘উপজাতীয় জনগোষ্ঠী’ বলে অভিহিত করাও সঠিক নয়। যেমন ধরা যাক জনগোষ্ঠীর কথা। ইতিহাসে নথিবদ্ধ আছে যে তারা যে দেশে বাস করত তার নাম ‘চাকোমা’। পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ও ভুগোলবিদদের জবানি থেকে জানা যায় তাদের দেশ আজকের বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে কমপক্ষে ১৫৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা আরাকান ও ত্রিপুরা থেকে আলাদা ছিল। হয়তো ওই তারিখের একশ বছর আগেও তারা আজ যেখানে বাস করে সেখানেই বাস করে থাকতে পারে যেমন থাকতে পারে ওই অঞ্চল এবং বাংলাদেশের অন্যত্র বসবাসকারী অন্য আদিবাসীরাও। বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯ শতকের আগে স্থায়ীভাবে বাস করত বলে জানা যায় না। বাংলার কোথাও আদিবাসীরা বাঙালিদের উচ্ছেদ করে বসতি গেড়েছে বলেও কোনো প্রমাণ নেই। আদিবাসীরা যেখানে যখনই বসতি স্থাপন করা শুরু করুক না কেন তাদের বসতি স্থাপনের সময় সেসব অঞ্চল বাঙালি অধ্যুষিত ছিল না। বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) সনদের ১০৭ ধারা অনুযায়ী কোনো জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে পরিগণিত হতে হলে তাদের সহস্র বছর ধরে কোথাও বসবাস করার প্রয়োজন নেই যেমনটা প্রযোজ্য আমেরিকার বা অস্ট্রেলিয়ার বেলায়। আই এল ও কনভেনশন অনুযায়ী উপনিবেশায়ন বা দখলাধীন হওয়ার সময় (যেমন আঠারো বা উনিশ শতক) সেখানে তাদের বসতি থাকা এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অনুগামী রীতি ও প্রথার অনুসারী হওয়াই আদিবাসী বলে গণ্য হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। বাংলাদেশের আদিবাসীদের অবস্থান সেই শর্তের সঙ্গে মানানসই।



১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ব্রিটিশ আমলের কিছু আইনে এবং পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পরে আদিবাসী জনগণকে ‘ট্রাইবাল’ বা ‘উপজাতি’ বলে গণ্য করা হয়। তাহলেও ‘ট্রাইবাল’, ইনডিজিনাস (আদিবাসী) অথবা ‘অ্যাবরিজিনাল’ (প্রাচীন অধিবাসী) শব্দগুলো পরস্পরের বদলাবদলি ধারণা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার নজির রয়েছে। এমন কিছু নজিরের দিকে নজর দেওয়া যাক যেমন ‘অ্যাবরিজিনাল’ শব্দটি ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যাসি অ্যাক্ট এ লিপিবদ্ধ আছে। (আইনটি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম তফসিল দ্বারা সুরক্ষিত)



ডস এইচ টি রেগুলেশন, ১৯০০; ফাইন্যান্স অ্যাক্টস অব ১৯৯৫ অ্যান্ড ২০১০ পভার্টি রিডাকশন স্ট্র্যাটেজি (পি আর এস পি- ২০০৮, ২০০৯, ২০১০), স¤প্রীতি চাকমা বনাম কাস্টমস কমিশনার ও অন্যদের মামলায় মহামান্য আদালতের রায়ে (৫ ইখঈ, অউ, ২৯) ‘ইনডিজিনাস’ শব্দটি আদিবাসী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।



আদিবাসী দিবসে মাননীয় সরকার প্রধান থাকাকালে শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া এবং ড. ফখরুদ্দীন আহমেদও শুভেচ্ছা বার্তায় ‘আদিবাসী’ শব্দের উলে¬খ ছিল। এ ছাড়া সরকারি দলিল পি আর এস পিতে সরকারি আইন স্মল এথনিক গ্র“পস্ কালচারাল ইনস্টিটিউট অ্যাক্ট, ২০১০ এও তো আদিবাসী ধারণার স্বীকৃতি রয়েছে (২৭ জুলাই ২০১১ইং)।



আবার আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রাজা দেবাশীষ রায় বলেন ‘আদিবাসী’ বলে স্বীকার না নেয়ার পেছনে দুইটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এ জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায় যা সরকার বোঝা মনে করে। দ্বিতীয়ত, আদিবাসীদের ভূমির অধিকারসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও দিতে হবে যা সরকার দিতে চায় না (২৪ শে জুন ২০১১ প্রথম আলো)।



পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির (জে এস এস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং দেশের অর্ধশতাধিক আদিবাসী জাতির তালিকা সংবিধানে সংযুক্ত করার দাবি জানান। তিনি বলেন সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘উপজাতি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা নৃগোষ্ঠী ও স¤প্রদায়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আই এল ও) সনদ অনুসারে বাংলাদেশে আদিবাসী রয়েছে। তাই উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নয়, আদিবাসী হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। ১৭৫৭ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হওয়ার সময় বাংলার প্রতিবেশী ছিল কোচ, অহোম, গারো, খাশিয়া, ত্রিপুরা, চাকমা ও আরাকান রাজ্য। পরে এসব রাজ্য ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তাই সরকারের তরফ থেকে দেশে ‘আদিবাসী’ নেই বলে যে যুক্তি দেয়া হচ্ছে তা ঠিক নয়। তিনি আরো বলেন সংশোধিত সংবিধানে ‘বাংলাদেশের জনগন জাতি হিসেবে বাঙালি’ এ বাক্যটি পরিবর্তন করতে হবে। কারণ আদিবাসীরা নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী কিন্তু জাতি হিসেবে বাঙালি নয়। চাকমা অথবা মারমা একেকটি স্বতন্ত্র্য জাতি। একজন চাকমা কখনোই নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেবে না। কিন্তু তারা বাংলদেশেরই নাগরিক, এছাড়াও তিনি সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবে অসংগতি ও পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে বলে উলে¬খ করে বলেন ১২নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেবে না কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হচ্ছে।



‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমি কমিশনের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বাঙালি আদিবাসী বিতর্কের প্রসঙ্গ তুলে বলেন ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন আমরা নাকি বিদেশি আর বাঙালিরা আদিবাসী । সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে আদিবাসীরাও বাঙালি। আমি যদি বলি তিনি (শেখ হাসিনা) জাতি হিসেবে চাকমা তাতে তিনি কি রাজি হবেন? আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলাম কায়েম করার জন্যই এসব করা হচ্ছে’।



আদিবাসী বিষয়ক এধরনের অনভিপ্রেত আইনী ও প্রজ্ঞাপনী নির্দেশমালা একটা দীর্ঘ পরিসরের আলাপচারিতার ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রমোদ মানকিন বলেন ‘সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিষয়ক গেজেট বিজ্ঞপ্তির সংজ্ঞায় আদিবাসীদের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলা হয়েছে। এরপরও সরকার যদি সংবিধানে আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে উলে¬খ করতে চায় তাহলে ব্রাকেটে আদিবাসী কথাটি উলে¬খ করলে আর সমস্যা থাকে না। তিনি বলেন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বরং এতে দেশের আত্মমর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে। একই কারণে জাতিসংঘের বৈঠকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবেই উলে¬খ করা প্রয়োজন। আবার আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে উলে¬খ করে জারি করা গেজেট বিজ্ঞপ্তিটি এ দেশের আদিবাসীদের নানা সমস্যায় ফেলছে। এতে মাত্র ১৭টি জন জাতির কথা বলা হয়েছে। অথচ নৃতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন সময় গবেষণা করে দেখেছেন দেশে আদিবাসী জনজাতির সংখ্যা ৫০টির বেশি। তাই সংশি¬ষ্ট গেজেট ও আইনে সংশোধন এনে বাদ পড়া জনজাতিদেরও অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন।



জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের বৈঠকে দেশে কোন আদিবাসী নেই, বাংলাদেশ প্রতিনিধির এমন অবস্থান গ্রহণের খবরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, আদিবাসী নেতা হিসেবে আমি কয়েকবার জাতিসংঘের এই বৈঠকে অংশ নিয়েছি। বাংলাদেশ প্রতিনিধি যখনই আদিবাসী বিষয়ক বৈঠকে এমন দাবি করেন তখন পুরো হলরুমে বিষ্ময়ের সৃষ্টি হয়। বিশ্বের কাছে প্রশ্ন দেখা দেয় এদেশে আদিবাসী না থাকলে বাংলাদেশ প্রতিনিধি কেন বৈঠকে অংশ নিয়েছে? আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের এমন অস্পষ্ট অবস্থান এদেশের আদিবাসীদের কাছেই শুধু অপমানজনক নয় এটি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকেই হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা এটি কখনোই কাম্য নয়। আদিবাসীর সংজ্ঞা নিয়ে অনেক সময় সরকারি পর্যায়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। বলা হয় এ দেশের আদিবাসীরা বহিরাগত, তারা কখনোই এ দেশের আদি বাসিন্দা নন বরং বাঙালিরাই এ দেশের আদিবাসী। কিন্তু কেবল ‘আদি অধিবাসী’ শাব্দিক অর্থে আদিবাসীদের বোঝায় না। জাতিসংঘ, আইএলও এবং বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী বলতে যারা কোন দেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণের সময় সে দেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যাদের ভিন্নতর প্রথাগত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যারা বর্তমানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত যাদের দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ও ঐ অঞ্চলের প্রচলিত ভাষার বাইরে ভিন্নতর নিজস্ব ভাষা আছে তারাই আদিবাসী। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী নিঃসন্দেহে সরকার যাদের কখনো ‘উপজাতি’ আবার কখনো ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলছে তারা সবাই আদিবাসী। এদেশের আদিবাসীরা অনেক আগেই উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অভিধা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এখন সময়ের দাবি। এ দাবিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।



তিনি আরো বলেন ধরে নিতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই সরকার আন্তরিকভাবে আদিবাসীদের কিছু নাগরিক অধিকার দিতে চায়। আমি বিশ্বাস করতে চাই আদিবাসীদের মধ্যে যে চারজন মাননীয় সংসদ সদস্য ছিলেন তারা ‘আদিবাসী’ শব্দটিই থাকুক চেয়েছিলেন। বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার আদিবাসীরা জানতে চান, ‘এত বছর এত পরিশ্রম করলেন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য এখন সরকার চাচ্ছে “ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এখন কী ভাষায় সরকারকে আমরা বোঝাতে পারব জানি না। সরকার নানাভাবে নানা সময়ে আদিবাসীদের কথা বলেছে। সরকার প্রধানেরা গত ১০ বছরের বিভিন্ন সময়ে আদিবাসী দিবসে বাণী দিয়েছেন। আদিবাসী হিসেবে যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ ও ২০০৯ সালে বেগম খালেদা জিয়া ২০০৩ সালে এবং ফখরুদ্দীন আহমদ ২০০৮ সালে “আদিবাসী” হিসেবেই বাণী দিয়েছেন। নতুন শিক্ষানীতি স্কুলে দেখুন দেখবেন সেখানে আদিবাসী উলে¬খ আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দিনবদলের সনদ দেখেন সেখানে আদিবাসী আছে। গত আদিবাসী দিবসে আইনমন্ত্রী মহোদয়ের বাণী দেখেন সেখানেও আদিবাসী উলে¬খ আছে। তাহলে কেন আদিবাসী নয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে এখন স্বীকৃতির প্রশ্ন আসছে?’



প্রথম আলো পত্রিকার প্রেস ব্রিফিংয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৬ মার্চ রির্পোট করেছে ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ নাকি উপজাতি” এটি একটি বড় ইস্যু। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় আমরা তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারিনি। তাই কমিটি এবার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাংবিধানিকভাবে ‘আদিবাসী’ বা ‘উপজাতি’ হিসেবে সংগায়িত হবে না। কমিটি এদের “ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করবে।



আমার মনে হয় কোথাও কোন গোলমাল হয়েছে আদিবাসী শব্দের অর্থ নিয়ে অন্য রকম ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আদিবাসী অর্থ তো কে কোথায় প্রথম আবির্ভূত হলো বা বসতি গড়ে তুলল তা নয়। আদিবাসী বলা হলে অন্যরা অ-আদিবাসী বা বহিরাগত হয়ে যাবে তা তো নয়। আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকে ঐতিহাসিক কারণে এই আদিবাসীরা বঞ্চিত ও শোষিত। আমাদের দেশেও আদিবাসী মানেই নিজ বাসভূমে পরবাসী এক শ্রেণীর অসহায় মানুষ যাদের জায়গা জমি পাহাড় বন আবাসস্থল শক্তির জোরে কেড়ে নেয়া হয়েছে। যাদের এক সময় ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল এখন বিপন্ন। এই-ই-তো বৈশিষ্ট্য আদিবাসীদের যাকে কোন সংজ্ঞায় ফেলা সমীচীন হবে না।

জাতিসংঘ আদিবাসী বা ইনডিজিনাস পিপলস শব্দের কোন সংজ্ঞা দেয়নি কারণ আদিবাসী আন্তর্জাতিক ভাবে এটি চায়নি। এর মূল কারণ হলো আপনার পরিচয় কি হবে তা তো নির্ধারণ করবেন আপনি। আর সেই আত্মপরিচয় নির্ধারণী অধিকার আপনার আছে। তাই ক্ষমতাবলে বা পেশীশক্তির জোরে অপরের পরিচয় নির্মাণ কতটুকু যুক্তি-যুক্ত বা আইন সম্মত তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।



২০০৯ সালের আদিবাসী দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদিবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন নৃত্য, গীত, সাহিত্য, জীবনের মূল্যবোধ পৃথিবীর জন্য অমূল্য সম্পদ। বন ও পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসীদের রয়েছে ঐতিহ্যগত জ্ঞান। সরকার আদিবাসীদের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণে বদ্ধ পরিকর এবং তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহিত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নেও আমরা একযোগে করতে চাই।



সঞ্জীব দ্রং তার লেখার মাধ্যমে সরকারের গৃহিত নীতির ভ্রান্ত দিকগুলোকে নির্দেশনার সাথে সাথে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হওয়ার যোগ্যতা ও যুক্ততাকে তুলে ধরেন। তাছাড়া রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষমতাবলয় থেকে বা না থেকেও রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট জন পূর্বে যাদের আদিবাসী বলে সম্বোধন করেছেন তারা সময়ের ব্যবধানে তাদের “ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী” বলছেন। কিন্তু একই ব্যক্তি শেখ হাসিনা বা রাজনৈতিক দলের (আওয়ামীলীগ) এহেন ঘাটছাড়া বক্তব্য ঐ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাছাড়া ক্ষমতাবলয়ের খোলাখুলি হস্তক্ষেপ ক্ষমতার ক্ষমতাশীলদের কর্তৃত্বকেই তুলে ধরেছে। যা এই ধরনের বিতর্ককে আরো উস্কে দিয়েছে।



তাই সঞ্জীব দ্রং বলেন যে, আমি সরকারকে অনুরোধ করব কমপক্ষে ৪৬টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ৩০ লাখ মানুষের হৃৎস্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করুন। দেখবেন কেউ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শব্দটিকে মন থেকে গ্রহণ করবে না। ক্ষমতায় থেকে আপনারা কেন মানুষগুলোকে এই দুঃখ দেবেন।



পঞ্চদশ সংশোধনীতে (সংবিধান) আদিবাসীদের স্বীকৃতি না দেয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করেন রাঙামাটি ও বান্দরবানের আদিবাসী নেতারা। তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংবিধানে যথাযথভাবে স্বীকৃতির ব্যবস্থা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের রোড ম্যাপ ঘোষণার দাবি জানান। বান্দরবানের আদিবাসী নেতারা বলেন ১৯৭২ সালের সংবিধানে স্বীকৃতি না দিয়ে আদিবাসীদের অনানুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। এবার সরকার জবরদস্তি করে তথাকথিত উপজাতি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নৃগোষ্ঠী ও স¤প্রদায় আত্মপরিচয় চাপিয়ে দিয়ে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।



রাঙামাটির আদিবাসী নেতারা বলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটিসহ আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হলেও সংবিধান সংশোধন বিষয়ক বিশেষ কমিটি কোন প্রস্তাব অন্তর্ভূক্ত করেনি। আমরা আশা করেছিলাম সংসদের আদিবাসী প্রতিনিধিরা সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু তারা সেটা করেননি (২ জুলাই ২০১১ প্রথম আলো)।



‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির প্রশ্নে রাজধানীসহ যারা দেশের নানা প্রান্তের আদিবাসী সংগঠনগুলো প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে তারা মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন, পথসভাসহ নানা কর্মসূচী পালন করে। সংবিধান সংশোধন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলায় অসংখ্য মিছিল, সমাবেশ, পথসভা, মানববন্ধন নানা কর্মসূচী পালিত হয়। খাসিয়া ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি এন্ডু সলেমার বলেন “আদিবাসী অভিধায় সরকারের আপত্তি থাকলে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাওতাল ইত্যাদি সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে নিজ নিজ জাতির নামেই ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অভিধা মেনে নেব না”। (১৬ই জুলাই, ২০১১ দৈনিক প্রথম আলো)







আদিবাসী বিতর্কে মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন ‘জিয়ার আমলে যে বিষবৃক্ষ রোপন করা হয়েছিল এই সরকার সেইবৃক্ষকে এখনো জিইয়ে রেখেছে। কাগুজে মালিকানা দিয়ে আদিবাসীদের জমি আত্মসাৎ করা হচ্ছে।



২০১১ সালের আদিবাসী দিবসে তিনি আরো বলেন, “ঐতিহাসিক কারণে বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগণ অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৭০টি দেশে ৩৭ কোটি আদিবাসী রয়েছে। তাদের রয়েছে পাঁচ হাজার ভাষা। আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জ্ঞান, সাহিত্য,জীবনের মূল্যবোধ পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ। বন ও পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসীদের রয়েছে ঐতিহ্যগত জ্ঞান। পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসীদের ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হচ্ছে। আদিবাসী জনগণ বলছেন, প্রকৃতির প্রতি আদিবাসীদের যে মমত্ববোধ রয়েছে, সে শিক্ষা অনুসরণ করলে আজকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর যে উষ্ণতা বাড়ছে, সেটি হতো না। আমি গর্ববোধ করি এ জন্য যে, বাংলাদেশে মালো, ডালু, হাজং, পাত্র, কোচ, বানাই, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল, উঁরাও, মাহাতো, মুন্ডা, খাসি, মণিপুরী, খুমি, খেয়াং, পাংখু, লুসাই, বম, চাক, রাজবংশী, ম্রো-সহ যে ৪৫টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, তারা তাদের স্বকীয়তা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য দিয়ে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে আদিবাসীরা যাতে সকলের মতো সমান মর্যাদা ভোগ করতে পারে, সেটি দেখা আমাদের কর্তব্য। যেহেতু আদিবাসী জনগণ নানাদিক দিয়ে পিছিয়ে আছে, তাই সরকারকে আদিবাসীদের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি আহ্বান জানাই। সবচেয়ে আনন্দের খবর যে, জাতিসংঘ আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তার কৌশল পরিকল্পনায় আদিবাসী ইস্যুকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আদিবাসীদের নাগরিক অধিকারসহ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে আমরা আদিবাসী নেতৃবৃন্দসহ সকলের সহযোগিতা চাই। আমি আনন্দিত যে, আদিবাসীদের মধ্যে দু’জন কমিশনের সদস্য রয়েছে। আদিবাসীদের প্রতি যে কোন ধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তাদের পাশে থাকবে, কেননা আদিবাসীরাই বিশ্বে সবচেয়ে অসহায় ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অংশ।”



আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল (সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার) ২০১১ সালের আদিবাসী দিবসের বক্তব্যে বলেন, “ঐতিহাসিক কারণে বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগণ শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এ কারণেই জাতিসংঘ ‘আদিবাসী জনগণ : নতুন অংশীদার’ শে¬াগান নিয়ে ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ পালন করে। পরবর্তী সময়ে আদিবাসীদের প্রতি সকল সদস্যরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং আদিবাসীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম আদিবাসী দশক (১৯৯৫-২০০৪) ঘোষণা করে। দ্বিতীয় আদিবাসী দশক (২০০৫-২০১৪) এখন চলমান। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আদিবাসী দিবস উদযাপন করা হচ্ছে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তাছাড়া ২০০০ সালে জাতিসংঘ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিষদের অধীনে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠন করে। এই ফোরাম আদিবাসীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মানবাধিকার- এই ৬টি বিষয়ের উপর কাজ করছে। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রকে বলা হয় বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নয়নের দলিল। এই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে বিশ্বের সরকারগুলিসহ সকলকে আন্তরিক হতে হবে। জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে, আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জ্ঞান, সাহিত্য, জীবনের মূল্যবোধ পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ। পরিবেশ সংরক্ষণে আদিবাসীদের ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হচ্ছে। আমরা জানি বাংলাদেশে ৪৫টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের স্বকীয়তা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, প্রাচীন ও সমৃদ্ধ মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য দিয়ে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে আদিবাসীরা যাতে সকলের মত সমান মর্যাদা ভোগ করতে পারে, সেটি দেখা রাষ্ট্রের কর্তব্য। একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমি আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। আদিবাসী দিবসে আমি আহ্বান জানাই, সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করুক, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করুক।”



‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন মানবাধিকার নেত্রী খুশী কবির। তিনি এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তিতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও তা ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা তো তাদের ভোট দিয়েছি ইশতেহার দেখে। এখন এমন কী হলো যে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না? আসলে প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রন রাখার জন্যই সরকার এখন আদিবাসী বলতে নারাজ। (১১ই জুলাই, ২০১১ দৈনিক প্রথম আলো)





আদিবাসী বিতর্কে বিশিষ্টজনের বক্তব্য

ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ‘আদিবাসী’ বিষয়ক আলাপচারিতায় যে ধরণের বক্তব্য পেশ করেন তা বেশ কৌতুহল উদ্দীপক । কারণ তিনি তার বক্তব্যে ‘আদিবাসী’ শব্দটির অর্থের একটা বিবরণী তুলে ধরেন। তবে তার ব্যাখ্যার মধ্যে ‘বাঙালি’ সত্ত্বার স্বজাত্যকেন্দ্রিকতার প্রলেপন পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেন ‘আদিবাসী’ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে একটি অঞ্চলে সুপ্রাচীন অতীত থেকে বাস করছে এমন জনগোষ্ঠী। সেই বিচারে আজকের বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ বা আদি বাসিন্দা কারা? ক্ষুদ্র জাতি উপজাতি হলেই ‘আদিবাসী’ বা আদি বাসিন্দা হবে তেমন কোন কথা নেই। বাংলাদেশের বৃহওর পরিমন্ডলে ‘আদিবাসী’ বা আদি বাসিন্দাদের উত্তরসূরি হওয়ার প্রথম দাবিদার এদেশের কৃষক স¤প্রদায় যারা বংশ পরস্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী মাটি কামড়ে পড়ে আছে। বানভাসি, দূর্ভিক্ষ, মহামারী, নদীভাঙ্গন, ভিনদেশী হামলা কোন কিছুই তাদের জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। নদীভাঙ্গনে কেবল এখান থেকে ওখানে নদীর এক তীর থেকে অপর তীরে সরে গেছে। এমনটিতে মিশে আছে তাদের শত পুরুষের রক্ত কয়েক হাজার বছরের। কাজেই বাংলার আদিবাসী অভিধার প্রকৃত দাবিদার বাংলার কৃষক আদিতে প্রকৃতি পূজারী, পরবর্তী সময়ে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন গঙ্গা, ব্রক্ষপুত্র, মেঘনার এই বদ্বীপ ভূমিতে আদি অস্ট্রিক অস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়, মোগল, টিবেটো বার্মান বিচিত্র রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতকের আগে। অতঃপর ধাপে ধাপে এসেছে শক, হুনদল, পাঠান, মোঘল সেই সঙ্গে ইরানি, তুরানি আরব সবশেষে ইউরোপীয় উপনিবেশিক আমলে স্বল্পমাত্রায় হলেও পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান, ইংরেজ, ফরাসি, গ্রিক। কালের প্রবাহে বিচিত্র রক্তধারা একাকার হয়ে উদ্ভূত এক অতি শংকর মানব প্রজাতি ‘বাঙালি’।



বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ও খন্ড জাতি উপজাতি আজকের দিনেও তাদের পৃথক সত্ত্বা নিয়ে বিরাজ করছে। বৃহওর জনগোষ্ঠীর মাঝখানে বা প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও তাদের অবস্থান বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। এর কারণ প্রথমত আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে জাতিসত্ত্বার বিকাশে অপূর্ণতা এবং যথার্থ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সমাজ চেতনার অনুপস্থিতি। দ্বিতীয়ত অসম ও শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সমাজের দূর্বলতার অংশের দারিদ্র্যের চক্রাজালে আবদ্ধ থাকা এবং তৃতীয়ত বৃহওর জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমাজের ক্ষুদ্রতর বা পিছিয়ে থাকা অংশের প্রতি মানবতাবোধে উজ্জীবিত গ্রহণীয় বা রহপষঁংরাব দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। আমাদের সমাজে অন্য ধর্মালম্বী বা অন্য জাতি গোষ্ঠীর কোন মানুষকে হাত বাড়িয়ে বরণ করে নেয়ার মানসিকতার অভাব খুবই স্পষ্ট। ফলে সুদীর্ঘকাল পাশাপাশি থেকেও এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিজ নিজ বৃত্তে আবদ্ধ থেকে গেছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার এতদঞ্চলে আগমন কয়েকশ বছরের বেশি আগে নয়। বিশেষ করে চট্রগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এই তিন প্রধান স¤প্রদায়ের এতদঞ্চলে আগমনের নানা বিবরণী সুনির্দিষ্টভাবে ইতিহাসে বিধৃত আছে। চাকমাদের এতদঞ্চলে আগমন তিন চারশ বছর আগে থাইল্যান্ড বা মিয়ানমারের কোন একটি অঞ্চলে গোত্রীয় সংঘাতের জের ধরে এই জনগোষ্ঠী আরাকান হয়ে কক্সবাজার এলাকা হয়ে চট্টগ্রামে আগমন করে এবং চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপন করে বাস করতে থাকে। এক সময় তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজশক্তিতেও পরিণত হয়েছিল। এ জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানন্তরিত হয় ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশরা লুসাই পাহাড়ে তাদের দখল স্থাপনের জন্য হামলা চালানোর সময় চাকমা স¤প্রদায়কে কাজে লাগায়। ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে নিজেদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করে। তার বিনিময়ে লড়াই শেষে তাদের রাঙামাটি অঞ্চলে বসতি গড়ার সুযোগ দেয়া হয়। মারমা স¤প্রদায়ের ইতিহাসও প্রায় একই রকম। স¤প্রতি বান্দরবানের বর্ষীয়ান মং রাজা অংশে প্র“ চৌধুরী এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে বলেছেন, আমরা এই অঞ্চলের আদিবাসী নই। বান্দরবান এলাকায় মারমা বসতি ২০০ বছরের পুরানো মং রাজাদের বংশলতিকা এবং ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকায় এ বিষয়ে সংশয়ের কিছু নেই।



পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃতীয় বহৎ জনগোষ্ঠী ত্রিপুরা । তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে পার্শ¦বর্তী ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। কথিত আছে সেখানকার রাজরোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্রতর অংশ স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়ে এখানে এসেছে। সেটাও বেশিদিনের কথা নয় এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে আরো ৮টি ক্ষুদ্র জাতি। তাদের কোন কোনটি চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদেরও পূর্ব থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে। সংখ্যায় নগন্য হলেও তাদের পৃথক নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বা দৃশ্যমান, তারাও দীর্ঘকাল ধরে এদেশে বসবাস করছে বিধায় এদেশের নাগরিক হিসেবে সমঅধিকার ও সমসুযোগ তাদের অবশ্য প্রাপ্য। তবে এদের কোনটিই বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা বা ‘আদিবাসী’ নয়।



তিনি আবার ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়ের সাথে বর্হিঃবিশ্বের রাজনীতিকেও পাঠ করতে চান। তার মতে এখন খ্রীষ্ট ধর্মের অতি উৎসাহী প্রচারক যারা কিনা চার্চ ভিত্তিক তাদের ধর্মের পরিধিকে বাড়িয়ে নিতে চায়, তারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করছে। তারা মিশনারী কাজের মাধ্যমে ঐ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবেশ করছে। তাদের সাহায্য সহযোগিতা করছে ফলে তারা ধীরে ধীরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রাতার ভূমিকায় উপনীত হচ্ছে। অতঃপর চলতে থাকে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীকে তার পারিপার্শ্বিক বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া। তাদের বোঝানো হয় পারিপার্শ্বিক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শোষণ ও অবহেলার কারণেই তারা পিছিয়ে আছে। এ কাজে হাতের কাছে পাওয়া যায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষকেও। যারা নিজ নিজ এনজিও কার্যক্রম উদার সহযোগিতার বিনিময়ে পুঁজিবাদের বিশ্ব বিজয়ের এই সুদূর প্রসারী নবঅভিযানে পথ প্রদর্শক ও লোকাল কোলাবরেটর এর ভূমিকা পালন করেন নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে। কিছু রাজনৈতিক দল উপদলকেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমর্থক সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। তারা কথিত ‘আদিবাসী’ স¤প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হতে গিয়ে এমন সব কথা বলেন যা বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থের জন্য সংকট সৃষ্টি করে।



আবার পশ্চিমা বিশ্ব দুনিয়াজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ নোভাল পয়েন্টগুলোতে সামরিক ঘাটি গড়ে তুলেছে। তার সাথে তারা বিভিন্ন দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে পশ্চিমা জগতের “আউট পোষ্টে” পরিণত করছে এবং সংশি¬¬ষ্ট জাতি রাষ্ট্র বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে তাদের পৃথক করে দুনিয়াজুড়ে পশ্চিমের কায়েমি স্বার্থের নেটওর্য়াক গড়ে তুলছে। “আদিবাসী” ¯ে¬াগানটি এক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচেছ।



আদিবাসী বিতর্ককে অনেকে আবার জাতীয়তাবাদী বিতর্কে অন্তর্ভুক্ত করেন। অর্থাৎ পাহাড়ি জনগণ বাংলাদেশী হলেও তারা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে এমন চিন্তা করা অমূলক। কারণ জাতীয়তাবাদী ধারণা অবশ্যই জাতির জাতীয়তাকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু যে জাতি নিজেদের ‘বাঙালি’ পরিচয়ে পরিচিত নয় তাদের জাতীয়তা যদি ‘বাঙালি’ হয় তবে সেই জাতির উপর এটা চাপানো জাতীয়তাবাদ ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। রোবায়েত ফেরদৌস বলেন যে, আদিবাসীরা পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি করেছেন। তারা বলেছেন তাদের উপর জোর করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এটা তারা মানবেন না।



নির্বাচনী ইশতেহার, আওয়ামীলীগ যাকে দিনবদলের সনদ আখ্যা দিয়েছিল আদিবাসী বিষয়ে সেখানে যে প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছিল তা ছিল এ রকম; ‘সংখ্যালঘু আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃজাতি গোষ্ঠী এবং দলিতদের প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের চাকুরী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অনগ্রসর অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে বর্র্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী, আদিবাসী এবং অন্যান্য স¤প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন ধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে’ (নির্বাচনী ইশতেহার, অনুচেছদ ১৮.১ ও ১৮.২)।



কিন্তু নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতে যদি পঞ্চদশ সংশোধনীকে পর্যবেক্ষণ করা হলে দেখা যায় যে গত ৩০ জুন পাশকৃত পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির ছিটেফোটাও মেলেনি। সংবিধানের ৬ (২) ধারায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন। এর মানে কী? এর মানে খুব সোজা এখন থেকে বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন বসবাসরত অপরাপর জাতিগুলো যেমন মারমা, চাকমা, গারো, হাজং, খাসিয়া, মনিপুরী, সবাই চিহ্নিত হবেন বাঙালি জাতি হিসেবে। এর মধ্যদিয়ে আবারও ১৯৭২ সালের সংবিধানের সেই ঐতিহাসিক ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করা হলো। ক্ষমতাশীল দলকে এই সত্যকে বোঝাতে যে বাংলাদেশের চারিদিকে পৃথিবী ঘোরেনা আর পৃথিবীর মানুষ নিয়ম করে বিটিভি দেখে না, একজন চাকমার জাতিগত পরিচয় কখনও বাঙালি হতে পারে না। এই ঐতিহাসিক আর নৃবৈজ্ঞানিক সত্য ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর মানবেন্দ্র লারমা তৎকালীন সংসদকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। চলি¬শ বছর পর সংশোধিত সংবিধানে আবারও একই ব্যবস্থাপত্র দেয়া হলো যে বাংলাদেশের জনগণ সবাই জাতি হিসেবে বাঙালি হবেন। পাকিস্তান আমলে পশ্চিমারা আমাদের বলতেন পাকাস্তানী জনগণের জাতি হচ্ছে একটাই মুসলমান জাতি। আমরা তা মানিনি, আমরা বলেছি, আমরা জাতি হিসেবে কখনোই মুসলিম না, জাতি হিসেবে অবশ্যই আমরা বাঙালি । সরকার ও সংসদরা সংবিধান সংশোধনের সময় জাতি ও জাতীয়তা প্রশ্নে বিশ্বের সমসাময়িক জ্ঞান থেকে বিযুক্ত হয়ে কাজ করছেন যা মূর্খতারই নামান্তর আর এটাই সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা যে বাঙালি ২৪ বছর পাকিস্তানের জাতিগত ও ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের জাতিগত, ভাষাগত পরিচয় অর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাঙালিরাই আদিবাসীদের উপর জাতিগত ও ভাষাগত নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। যে বাঙালি ২৪ বছর পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে গণতন্ত্র অর্জনের জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই বাঙালিরাই আদিবাসীদের উপর সামরিক আধিপত্য বজায় রেখেছে। এক সময়কার নির্যাতিত বাঙালি অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতার প্রশ্নে এখন নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।



আমাদের প্রত্যাশা ছিল শাসকগোষ্ঠী সংবিধানে এই সত্য মেনে নেবে যে বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহুজাতি ও বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ এবং এর মধ্য দিয়ে সব জাতির পরিচয়, অধিকার ও সংস্কৃতিকে স্থান দেবে এভাবেই রাষ্ট্র হয়ে উঠবে সবার কিন্তু দেখি আশার সে রুটিতে লাল পিঁপড়ে। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যে বহুত্ববাদী নীতি বা বৈচিত্র্যের ভেতরে যে সংহতি তাকে নির্লজ্জভাবে পরিহার করে সংবিধানে ৯ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বাবিশিষ্ট বাঙালি জাতি’র মতো অসত্য বাক্য। বাংলাদেশ কোন একক ভাষা বা একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালিরা ছাড়াও আরো জাতির মানুষ বাস করে এবং তারা বাংলায় নয় তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলেন। সংশোধিত সংবিধানে এ দেশে বসবাসরত অন্য ভাষাভাষীর মানুষের মাতৃভাষাকেও পরিত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও অন্য ধর্মগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে কিন্তু দেশের অন্য জাতিগুলোর ভাষার অস্তিত্বের ব্যাপারে আমাদের সংবিধান ভয়ঙ্কর শব্দহীন এবং নিশ্চুপ। ভুলে গেলে ভুল হবে যে বাঙালির একক জাতীয়তাবাদের দেমাগ ইতিপূর্বে আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় শান্তির ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যাই কেবল পয়দা করেছে। কোন সমাধান বাতলাতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এরকম ধারণা কাজ করে যে একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলতে না পারলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোরদার হয় না। আমরা মনে করি একক জাতীয়তাবাদের প্রাবাল্য একটি ভূল প্রমিজ বরং একটি দেশের জনবিন্যাস ঐতিহ্য, ভাষা ও কৃষ্টির বহুমুখী বিচিত্র্য রুপই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এটিই বৈচিত্র্যের ঐকতান বা বহুত্ববাদ বিউটি অব ডেমোক্রেসি একক জাতিসত্ত্বাসুলভ দাম্ভিকতা বাদ দিয়ে দ্রুত এই সত্য বুঝতে পারলে রাষ্ট্রের জন্য বরং ভালো যে বাংলাদেশ কোন এক জাতি এক ভাষা আর এক ধর্মের রাষ্ট্র নয় এটি অবশ্যই একটি বহুজাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের রাষ্ট্র, সংবিধানেও এর ইঙ্গিত আছে। কারণ দেশের নাম পিপলস রিপাবলিক বলা হয়েছে, বেঙ্গলি রিপাবলিক বলা হয়নি। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবি থেকে আমরা তাই এক চুলও সরে আসতে পারিনা। খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী আসলে কারা ? যারা সংবিধানের ভেতর তাদের যথাযথ স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছে তারা নাকি যারা এই স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের দূরে ঠেলেছে তারা ? আমরা মনে করি সংবিধান কোন ধর্ম গ্রন্থ নয় আমরা চাইলে আবারও একে সংশোধন করতে পারি ক্ষমতাশীল সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাই করেছে। সেই আত্মম্ভর আশায় আদিবাসীদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিগুলো তুলে ধরছি। দ্বিধার দোলাচাল আর অস্পষ্টতার কুয়াশা সরিয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে বসবাসরত ৪৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতিসত্ত্বা ভাষা ও সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে বাংলাদেশে একটি বহুভাষা, বহুজাতি ও বহু সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ; এই বাক্যের সংযোজন করা হোক।



বাংলাদেশে প্রায় ত্রিশ লক্ষ আদিবাসী বাস করেন এবং তাদের কাছে সবচেয়ে অবমাননাকর শব্দ হচ্ছে উপজাতি। আদিবাসীদের কাছে এটি বাতিল, পশ্চাৎপদ ও পরিত্যাজ্য একটি শব্দ। সংবিধানে উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকারন্তরে তাদের অপমান করা হয়েছে, উপরন্ত বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি ছাড়াও অপরাপর জাতির পরিচয়কে তুলে ধরতে গিয়ে একই সঙ্গে উপজাতি, ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বা নৃগোষ্ঠী স¤প্রদায় ইত্যাদি অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে যা নিতান্তই হাস্যকর এবং এগুলোর স্পষ্ট কোন সংগায়ন সংবিধানে নেই। এর মধ্যে দিয়ে আদিবাসী পরিচয় নির্মাণে পবিত্র (?) সংবিধানে এক ধরনের দ্বিধা আর তালগোল পাকানো হয়েছে।



মহিউদ্দিন আহমেদও আদিবাসী বিষয়ক শব্দযুদ্ধ টিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম আদিবাসী জাতীয়তাবাদী আলোচনার সাপেক্ষে দেখতে আগ্রহী হন। তিনি তার আলোচনায় ১৯৭২ সালের ২৫ ও ৩১ শে অক্টোবর বাংলাদেশ গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা ও বিতর্ককে সামনে নিয়ে আসেন। ঐদিন মানবেন্দ্র লারমা আলোচনায় বলেন আমরা করুনার পাত্র হিসেবে আসিনি আমরা এসেছি মানুষ হিসেবে । তাই মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার আমাদের আছে। আমি একজন মানুষ যেখানে জন্ম গ্রহন করেছি যে জন্মভূমিতে আজন্ম লালিত পালিত হয়েছি সেই জন্মভূমির জন্য আমার যে কথা বলার রয়েছে সে কথা যদি প্রকাশ করতে না পারি যদি এই সংবিধানে তার কোন ব্যবস্থাই দেখতে না পাই তাহলে আমাকে বলতে হবে যে বঞ্চিত মানুষের জন্য সংবিধানে কিছুই রাখা হয়নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ কেউ বলে নাই আমি বাঙালি। আমি জানি না এই সংবিধানে আমাদের কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়। আমরা কোন দিনই নিজেদের বাঙালি মনে করি না। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায় তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, আমরা আমাদের বাংলাদেশী মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি মনে করি না।



কিন্তু মানবেন্দ্র লারমার বক্তব্যকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী পরিপন্থী হিসেবে উলে¬খ করে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সংসদকে বলেন মানবেন্দ্র লারমা আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তির প্রতি, আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি অবৈধ ভাষায় বক্তৃতা করেন। ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতির বদলে যে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে তারই প্রতি ষড়যন্ত্রমূলক এ বক্তব্য। অর্থাৎ পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচিতির সংগ্রাম বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের প্রারম্ভ থেকেই। কিন্তু এই বিতর্কের সমাধান প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ বিরতির পর একটা উপযুক্ত পরিসর তৈরির রাস্তা খুঁজে পাওয়ার পরিবর্তে পঞ্চদশ সংশোধনী তা আরো উস্কে দেয়। তাই বাঙালিদের জাতীয়তাবাদ ক্ষমতাধর চরিত্রের মুখচ্ছবি হিসেবেই প্রতীয়মান রইল। যা বাংলাদেশের ভিন্ন বর্ণ, চেহারা ও সংস্কৃতির অল্পসংখ্যক (সংখ্যার দিক দিয়ে) লোকদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিসর থেকে বাস্তুচ্যুত করার নামান্তর। অন্যদিকে তা আবার উপরাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদগত দ্বন্দ্বকে (বাঙালি বনাম আদিবাসী জাতীয়তাবাদ) স্বাগত জানাচ্ছে।



ঐ একই আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন আই এল ও সনদ ১৬৯ অনুসমর্থন করলে বা আদিবাসীদের ভূমির অধিকার দিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ব তিমুর বা বসনিয়ার মতো হয়ে যাবে দেশে এমন একটি ধারণা চালু আছে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি কাল্পনিক শত্র“ তৈরী করে রাখতে চায়। তা না হলে রাষ্ট্রের কোন গুরুত্ব থাকে না (৬ জুন ২০১১ প্রথম আলো)।





উপসংহার

আদিবাসী বিতর্কটি সা¤প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ আলোড়ন তুলেছে। তবে এই বিতর্কের কোন শান্তিপূর্ণ সমাধান এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। প্রত্যেক পক্ষই (আদিবাসী ও বাঙালি) তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনঢ়। আবার উভয় পক্ষেরই নিজস্ব যুক্তিমালা তাদেরকে এক অনিবার্য তর্কযুদ্ধে লিপ্ত করেছে। যদিওবা বাংলাদেশ সরকার তাদের অবস্থানকে পরিষ্কার করার মধ্যদিয়ে আইনিভাবে এই বিতর্কের একটা উপসংহার দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, তদুপরি এটি এখনও পর্যন্ত চলমান একটি বিষয় যা একধরনের সংকটকে তুলে ধরছে। আর এ ধরনের সংকটকে যদি বিবেচনায় আনতে হয় তাহলে তার বহুমাত্রিকতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।



মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৯

রুয়াসা বলেছেন: এসব ঘডনার সাক্ষী কি ভাইজান নিজে আছিলেন? সূত্র কই? এইডা কি থিসিস পেপার? ম্যালা নাম্বার পাইসেন তাইলে। :-B
একটা লেখাকে সহজবোধ্য করে উপাস্থাপন করাটাই শ্রেয় নয় কি? এসব লেখা জমা দিবেন স্কুলে। টিচার খুশি হবে। লেখায় সব কন্টেন্ট ধার করা, স্বকীয়তা বলতে কিছু নাই। যাই হোক শুধু সেকেন্ডারী তথ্য দিয়েও অনেক কিছু করা যায়। শুভ কামনা। আগে ব্লগের লেখা পড়েন, তারপর লিখেন কামে দিব।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.