![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বই পড়তে ও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি । পেশায় ছাত্র শিক্ষক দুটোই। মাস্টার্স করছি এবং একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে আছি ৮-৯ মাস হল। অনেক অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে হয়। কত-শত মানুষ, কত হাসি, কত গান, কত দুঃখ! কিন্তু হায়, লেখক হিসেবে আমার ক্ষমতা খুবই সীমিত! সাহিত্যের কিছু বুঝি না। যা ভালো লাগে তাই পড়ি। অনুগ্রহ করে ভুল গুলো ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ।
১.
সকালে বাজার করার পর থেকেই আরিফ সাহেবের মনটা খচখচ করছে। অফিসে এসেও ঠিকমত কাজে মন বসাতে পারছেন না। নাহ, ব্যাটা কসাই খুব ঠকিয়েছে। দুই কেজি গরুর মাংসে এক কেজি দিয়েছে হাড়। ব্যাটা, ভাল ভাল কথা বলে শেষমেষ এই করলি! ‘আসেন চাচা, আসেন, আপনার জন্য স্পিশাল। এমুন সুন্দর গোশ, আহা! মশলা-পাতি দেওনই লাগব না। মরিচ-পিঁয়াজ দিয়া তুইলা দিলেই অমৃত। খাইবেন আর হাত চাটবেন’।
গরুর মাংসের দামও বেড়েছে। ২৮০ টাকা কেজি। কয়দিন আগেও আরিফ সাহেব ২৫০ টাকা করে কিনেছেন। জিনিসপাতির দাম এইভাবে বাড়তে থাকলে তো মুশকিল।
তার উপর অফিসের জন্য বের হওয়ার আগে ছোট মেয়ে রিমার সাথে কথা বলা হয় নি। রিমা আরিফ সাহেবের বেশি বয়সের সন্তান। এই মেয়েটা আরিফ সাহেবের বড় আদরের। এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিচ্ছে। হরতাল-ফরতালের কারণে তিন-চার মাস ধরে পরীক্ষা হচ্ছে। রিমা খুব ভাল ছাত্রী। আরিফ সাহেব নিশ্চিত রিমা গোল্ডেন A+ পেয়ে যাবে। আগের সিস্টেম থাকলে স্ট্যান্ড করে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়ে যেত। কিন্তু পরীক্ষার সময় মেয়েটা বড় দুশ্চিন্তা করে। সারাক্ষণ মুখ শুকনো করে থাকে। দুশ্চিন্তা করতে করতে মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। দিনের বেলায় দরজা-জানালা সব বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। ফ্যানের বাতাসে ঘরের ভ্যাপসা গরম কাটে না। আরিফ সাহেব ভাবেন, মেয়েটার ঘরে একটা এসি লাগিয়ে দেবেন। একটা সেকেন্ড হ্যান্ড এসির দাম কতই বা হবে? আরিফ সাহেব হিসাব কষেন। টাকায় কুলিয়ে উঠতে পারেন না। ঠিক করেন, সামনের বোনাসটা পেলে এসিটা কিনে ফেলবেন।
আরিফ সাহেবের এই মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই বাবার খুব ন্যাওটা। সকাল বেলা আরিফ সাহেব ঠিক করেছিলেন, মেয়েটার সাথে একটু কথা বলবেন, মাথায় হাত দিয়ে একটু অভয় দিবেন, ‘দুশ্চিন্তা করিস না, মা। চোখ বুজে পরীক্ষা দিয়ে দে। যা খুশি হবে, কোন অসুবিধা নাই’।
ব্যাটা কসাই সব গোলমাল করে দিল। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল, রাগে গজগজ করতে করতে বাসায় ঢুকলেন, কিভাবে জানি অফিসের একটু দেরি হয়ে গেল, তাড়াহুড়া করে অফিসের জন্য রওনা দিলেন। মেয়েটার সাথে আর কথা বলা হল না।
এদিকে অফিসে এসেও ঝামেলা। অফিস বিল্ডিং নিয়ে সমস্যা। গতকাল শুনেছিলেন বিল্ডিং এ ফাটল ধরেছে। তারপর সবাই কাজ বন্ধ করে তাড়াহুড়া করে বাড়ি চলে গেলেন। আজ সকালে আবার শুনলেন, ওটা বড় কোন ব্যাপার না, বিল্ডিং এ কোন সমস্যা নাই। তারপরও লোকজনের ভয় জাচ্ছে না। আগের কয়েকটা ভবন দুর্ঘটনায় লোকজনের মনে ভয় ঢুকে গেছে। আরিফ সাহেবদের এই পদ্মা ইনস্যুরেন্সের অফিসের লোকজন অকারণেই গলা নিচু করে কথা বলছে। কেমন থমথমে ভাব। আরিফ সাহেব নিজেও কিছুটা চিন্তিত।
২.
সাভারের ‘জাহিদ প্লাজা’র সামনে রাস্তার অন্যপাশে হাফিজ মিয়াঁ নামের লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। বেশভূষা দেখে ভিক্ষুক অথবা পাগল শ্রেণীর বলে মনে হচ্ছে। বড় বড় জটা ধরা চুল। লোকটার বাম পায়ে সমস্যা। হাঁটুর ওখানটায় ইস্পাতের ফ্রেম দিয়ে সাপোর্ট দেয়া। জিনিসটা দামি মনে হচ্ছে। সূর্যের আলোয় ইস্পাত চকচক করছে। বোধহয় কেউ দয়াপরবশ হয়ে ওকে এটা বানিয়ে দিয়েছে। লোকটার পাশে একটা কালো-সাদা মেশানো কুকুর। কুকুরটা মাঝে মাঝে লোকটার পায়ের ইস্পাতের ফ্রেমটা চেটে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ওটা চকচকে রাখার দায়িত্বটা তারই।
কুকুরটা লোকটার পোষা কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চাটাচাটি করে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসছে।
হাফিজ মিয়াঁ রাস্তার পাশের একটা গাছে হেলান দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পুরো মনোযোগ রাস্তার ওপারের বিল্ডিং এর নিচে মানুষের জটলাটায়। লোকজন জড়ো করা হচ্ছে। মিছিল বের হবে বোধহয়। গত কয়েক মাস ধরেই হাফিজ মিয়াঁ দেখছে হরতালের দিনে এখান থেকে হরতাল বিরোধী মিছিল বের হয়। হাফিজ মিয়াঁ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মিছিল তার খুব ভাল লাগে। শরীরের ঠাণ্ডা মেরে যাওয়া রক্ত মিছিলের স্লোগানে আবার গরম হয়ে ওঠে। হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে সব মিছিলই হাফিজ মিয়াঁর ভাল লাগে। তবে বিপক্ষের মিছিল একটু বেশি ভাল লাগে। হরতালের দিনে তার ইনকাম একটু কম হয়।
‘চুপ কর বেকুব, ঘেউ ঘেউ কইরা তো কান ঝালা-পালা কইরা দিলি।‘
ধমক খেয়ে আহ্লাদে কুকুরটা ইস্পাতের ফ্রেমটা চাটতে চাটতে আরো বেশি ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।
‘বেশি ঘেউ ঘেউ করলে দেখবি খিদা লাগব বেশি। আইজ কিন্তু বেশি পাউরুটি দিবার পারুম না। আমার জবর খিদা লাগছে। কাল তুই বেশি খাইছস হারামজাদা।‘
কুকুরটার আহ্লাদ আরো বেড়ে গেল। ঘেউ-ঘেউ ও চাটাচাটি দূটোর মাত্রাই বাড়িয়ে দিল।
‘গায়ে গতরে তো ভালই বাড়ছোস দেখি। আমি দিন দিন শুকনা হইতেছি আর উনি দিন দিন শরীর বাড়াইতেছেন।‘
বলেই হাফিজ পিচিক করে রাস্তার পাশে থুতু ফেলল। আজ খুব গরম পড়েছে। চুল-দাড়ির মধ্যে কুটকুট করছে।
হঠাৎ করে কুকুরটা সামনে রাস্তার এক পথচারীর দিকে তেড়ে গেল। পথচারী লোকটা ভয় পেল খুব। দ্রুত সারেন্ডারের ভঙ্গীতে হাত দুটো উপরে তুলে ফেলল। হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা রাস্তায় পড়ে গেল।
‘হারামজাদা পল্টু, এদিকে আয়। ফিরা আয় বলতেছি।‘
কুকুরটার নাম তাহলে পল্টু। পল্টু হাফিজের দিকে ফিরে লেজ নাড়াতে থাকে।
‘থাবড়া দিয়া তোর দাঁত ফালায়া দিব। ব্যাটা, বদমাইশের বাচ্চা বদমাইশ।‘
হাফিজের রুদ্রমূর্তি দেখে কুকুরটা কুঁকড়ে যায়। লেজটা দুই পায়ের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে হাফিজের পাশে যেয়ে বসে পড়ে। বাপ-মা তুলে গালি দেওয়ায় কিছুটা আহত হয়েছে মনে হচ্ছে। এখন পল্টু নিতান্তই নিরীহ, শান্ত, ভদ্র কুকুর। মাঝে মাঝে লেজটা আস্তে আস্তে নাড়াচ্ছে।
৩.
এই মোটা মোটা কাঠের ভারী অফিশিয়াল টেবিলটা সুজনের মোটেও পছন্দ না। বাকী অফিসের আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইনের সাথে এটা যায় না। কিছুদিন আগে সবারই ডেস্ক চেঞ্জ হল। বেশ স্টাইলিশ অটবির ডেস্ক। কিভাবে জানি একটা ডেস্ক শর্ট পড়ল। সুজনের এমনই কপাল, শুধু ওর ডেস্কটায় চেঞ্জ হল না। ম্যানেজার স্যার অবশ্য বলেছেন অল্প কয়দিনেই নতুন ডেস্ক চলে আসবে। সুজন ‘একজিম’ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনী অফিসার। অল্প কয়দিন হল জয়েন করেছে। এই অফিসে সুজনই সব থেকে জুনিয়র অফিসার। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে।
নিজের উপর সুজনের খুব মেজাজ খারাপ লাগছে। গতকালই ওদের ব্যাংকের এই শাখার কাজকর্ম গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিল্ডিং এ কি জানি সমস্যা হয়েছে। ম্যানেজার স্যার এই কয়দিনে বাসায় বসে কয়েকটা কাজ সেরে রাখতে বলেছিলেন। সেই কাজের জন্য দরকারি কিছু কাগজ-পত্র গতকাল নিতে ভুলে গিয়েছিল সুজন। নিজের দোষে ফাউ-ফাউ আজ আবার অফিসে আসতে হল।
অফিসে লোকজন তেমন নেই। কাল-পরশু বোধহয় আবার অফিস খুলবে। বিল্ডিং এর সমস্যাটা নাকি তেমন কিছু না। এই বিল্ডিং এর অনেকগুলো অফিস, ফ্যাক্টরি আজকেই খুলে গেছে।
কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে সুজন কম্পিউটারটা অন করে। একটু ফেসবুকটা ঘুরে আসবে। আসলে দেখবে মেঘলার প্রোফাইল। মেঘলা ভার্সিটি এ সুজনের ক্লাসমেট ছিল। অবশ্য অন্য সেকশনে। তাই মেঘলার সাথে সুজনের খুব একটা কথাবার্তা হয়নি এ চার বছরে। সুজন খুবই শান্ত আর লাজুক ধরনের ছেলে। একটু ভীতুও বোধহয়। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে সুজন মেঘলাকে পছন্দ করে। পছন্দ মানে খুবই পছন্দ, একেবারে উথাল-পাতাল ভালবাসা। কিন্তু প্রকাশ করার সাহস হয় নি কখনো। মেঘলা আশেপাশে আসলেই সুজনের হাঁটু দুর্বল হয়ে পড়ে, হাতের তালু ঘামতে থাকে, কথা-বার্তা জড়িয়ে যায়।
ফোরথ ইয়ারে লজ্জার মাথা খেয়ে মেঘলাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল সুজন। সে কী টেনশানের দিন! সারা দিন ধরে বুকের ভেতর হার্টটা ডাবল জোরে ধকধক করতে থাকে। সুজনের মনে হতে থাকে ওর হার্টের শব্দ শুনেই অন্যরা বুঝে যাবে যে ও মেঘলাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর ফেসবুক চেক করে দেখে, মেঘলা ওর রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে কি না। লজ্জায় মেঘলার দিকে তাকাতে পারে না।
সেইদিন বিকেলের দিকে টেনশানে বদ হজম হয়ে সুজনের ডায়রিয়া হয়ে গেল। পরের দিন সকালেও যখন দেখল ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নি তখন প্রচন্ড অভিমানে সুজন রিকোয়েস্ট ক্যানসেল করে দিল। মেঘলার উপর অভিমান, ফেসবুকের উপর অভিমান, সারা পৃথিবীর উপর অভিমান। লজ্জায় পারলে মাটিতে মিশে যায় সুজন। ঠিকই তো, তার মত ফালতু একটা ছেলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করতে মেঘলার বয়েই গেছে। এমনিতেই বোধহয় হাজারের উপর ফেসবুক ফ্রেন্ড মেঘলার। অবশ্য অন্য একটা আশাও কাজ করে সুজনের মনে। হয়ত মাঝের এ দিনটায় মেঘলা ফেসবুক ব্যবহারই করে নি। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখলে হয়ত ঠিকই একসেপ্ট করত।
সুজন এখন কম্পিউটারে মেঘলার ফেসবুক প্রোফাইল ওপেন করেছে। নাহ, আজও প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করে নি। মেঘলার সব অ্যালবাম প্রাইভেট করে রাখা। মেঘলার ফ্রেন্ডলিস্টে না থাকায় সুজন শুধুমাত্র প্রোফাইল পিকচারটাই দেখতে পারে। মেঘলা নতুন কোন প্রোফাইল পিকচার দিলেই সুজন ডাউনলোড করে নেয়। গত চার বছরে সে মেঘলার মোট ১০৩ টা ছবি ডাউনলোড করছে। সুজন মেঘলার যেকোনো ছবির দিকে তাকিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতে পারে।
গতকাল হঠাৎ করে বসুন্ধরা সিটিতে মেঘলার সাথে সুজনের দেখা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, মেঘলা নিজে থেকেই সুজনকে চিনতে পেরেছে। মেঘলাকে দেখে অভ্যেসমত সুজনের হাঁটু দুর্বল হয়ে আসল, হাতের তালু ঘামতে থাকল, মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। সুজন যখন ভাবছে কোন একটা পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়বে কিনা তখন মেঘলাই সুজনকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে আসে,
‘আরে সুজন যে! কি খবর তোমার? কেমন আছো?’
খুব হাসি-খুশি আর উচ্ছল মেয়েটা। মেঘলা কাছে আসতেই সুজনের মনে হল চারপাশটা আলোয় ভরে গেল, চারপাশের হই-হট্টগোল শান্ত হয়ে পড়ল, কোথাও নরম সুরে চমৎকার একটা গান বাজতে শুরু করল।
আজ সুজনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। ও ঠিক করেছে, আজ মেঘলাকে কোথাও দেখা করার কথা বলবে। তা মেঘলা যতোই ওকে ফালতু আর বেহায়া ভাবুক। গতকালকের ঘটনাটা ওকে সাহসী করেছে। গতকাল সুজনের সাথে দেখা হওয়ায় মেঘলাকে সত্যিই খুশি দেখাচ্ছিল। মাউসটা নাড়াতে যেয়ে মাউসের ধাক্কায় কলমটা টেবিলের নিচে পড়ে গেল। উবু হয়ে ঝুঁকল সুজন, কোথায় গেল কলমটা? বাইরে কোথাও না দেখে খুঁজতে খুঁজতে টেবিলের নিচে ঢুকে পড়ল সুজন।
৪.
আজ মজিদের মনটা অনেক ভাল। বাপজানের জন্য শার্ট-প্যান্ট আর মায়ের জন্য শাড়ি পাঠিয়েছিল। একটু আগে বাপজান ফোন করেছিল, কাপড়গুলো পেয়েছে। মজিদের বাবা রহমত আলী জীবনে এর আগে কখনো প্যান্ট পরেন নি। এবারো বার বার বানাতে নিষেধ করছিলেন।
‘ওসব হইল সাহেব-সুবোদের কাপড়। আমার মত চাষা-ভুষো প্যান্ট পইরা কি করব।‘
মজিদ নাছোড়বান্দা। গত ছুটিতে যেয়ে বাপজানের প্যান্টের মাপ নিয়ে এসে, কাপড় কিনে প্যান্ট বানিয়ে কয়েকদিন আগে পাঠিয়েছে। না না করলেও বাপজান প্যান্ট পরে খুব খুশি মনে হল।
‘মজিদ তোর বাপেরে তো চেনাই যায় না রে। অফিসার সাবদের মত দেহায়।‘ মা রীতিমত উত্তেজিত গলায় বলেন, যেন বিশাল কোন ঘটনা ঘটে গেছে।
মজিদরা খুব গরীব হলেও ওদের বাবা-মা, ভাই-বোনগুলোর চেহারা ভাল। বেশ ফর্সা, চোখ-মুখের কাটিংও ভাল। মজিদের বয়স উনিশ বছর। একটু হালকা পাতলা বলে দেখলে আরো ছেলেমানুষ মনে হয়। একটু ভাল পোশাক-আশাক পরিয়ে দিলে কলেজ-ভার্সিটির ছাত্র হিসেবে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যাবে।
‘বাপজান, কাপড় পসন্দ হইছে?’
‘হ বাপ, মেলা পসন্দ হইছে। তোর মায় তো আমারে চিনবারই পারে না। তয় বাপ একটা কথা...’ শেষের কথাটা একটু নিচু গলায় বলেন রহমত আলী।
‘কি কথা?’
একটু সময় নিয়ে রহমত আলী আস্তে আস্তে বলেন, একটা চশমা হইলে ভাল হইত, বাপ। এমুন মানান কাপড়ের লগে চশমা ভাল মানাইতো।‘ বলতে বলতে রহমত আলী একটু লজ্জা পেয়ে যান।
‘ঠিক আছে বাপজান। এইবার আসার সময় তোমার চশমা নিয়া আনব।‘
ফোন কেটে দিয়ে মজিদ একটু হেসে ফেলে। বড় ছেলেমানুষ তার বাপজান। এইবার ছুটিতে গেলে বাপজানের জন্য চশমা কিনে নিয়ে যাবে। মায়ের জন্যও একটা কিনবে। না হলে মা আবার মন খারাপ করবে।
মজিদদের অবস্থা এখন বেশ ভাল। মজিদরা আগে খুবই গরিব ছিল। অফ সিজনে ঠিকমত ভাত জুটত না। মজিদ এখন ঢাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজ করে। শুরুটা করে ওর বড় ভাই আতিক। এরপর বোন সোনিয়াকেও এখানে চাকরি জুটিয়ে দেয়। সবশেষে সবার ছোট মজিদকেও কয়েকমাস আগে গার্মেন্টস এ ঢুকিয়ে দেয়। তিন ভাই-বোনের রোজগারে ওদের এখন সুখের দিন। আতিক আর সোনিয়া একই গার্মেন্টসএ কাজ করে, এই বিল্ডিং এর পাঁচতলায়। মজিদ একই বিল্ডিং এর চারতলায়, অন্য একটা গার্মেন্টস এ। বিল্ডিং এ কি নাকি সমস্যা হয়েছে। কয়টা ফাটল ধরছে, তাই নিয়ে ব্যাপক গ্যাঞ্জাম। মজিদ অবশ্য ফাটলগুলো দেখে এসেছে। তার কাছে তেমন গুরুতর কিছু মনে হয় নি। তাছাড়া রশীদ ভাই বলেছে কোন সমস্যা নাই। রশীদ ভাই লোক ভাল। ওদের বস। মজিদকে অনেক স্নেহ করেন। তাছাড়া রশীদ ভাই নিজেও তো বিল্ডিং এ আছেন।
মজিদ এইচ এস সি পাশ। রশীদ ভাই বলেছেন, ‘মনোযোগ দিয়ে কাজ কর। সুযোগ বুঝে ম্যানেজার স্যাররে বলে আমি তোকে অফিশিয়াল কাজে ঢুকিয়ে দেব। তাহলে আর লেবারগিরি করা লাগবে না।‘ মজিদ কাজ দিয়ে নিজেকে যোগ্য করে দেখাতে চায়। ফাও ফাও এই ফাটলের গ্যাঞ্জামে যেয়ে রশীদ ভাইয়ের চোখে ফাঁকিবাজ হতে চায় না।
মজিদদের নিজেদের মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি। মজিদের ইচ্ছা এই বর্ষার আগে টিন লাগিয়ে ফেলে। মিয়াঁ ভাইরে বলতে হবে এ ব্যাপারে।
আরিফ সাহেব তখন ছোট মেয়েটার কথা ভেবে মন খারাপ করে বসে ছিলেন, হাফিজ মিয়াঁ পল্টুকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বিল্ডিং এর নিচতলার মার্কেটে ঢুকল পাউরুটি কিনবে বলে, সুজন টেবিলের নিচে ঢুকে কলম খুঁজছিল, আর মজিদ তাদের টিনের বাড়ির স্বপ্ন দেখছিল। হঠাৎ কংক্রিটের তীব্র কর্কশ শব্দ করে নয় তলা ‘জাহিদ প্লাজা’ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ঠিক সিনেমার মত। মুহূর্তের মধ্যে নয় তলা বিল্ডিংটা মাত্র এক তলা সমান উঁচু হয়ে দাঁড়াল। একেকটা তলার ছাদ মিশে গেল তার পরের তলার ছাদের সাথে। আর তার ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে গেল পাঁচহাজার জন মানুষ!
চারপাশে হই-হট্টগোল, মানুষের আর্তনাদ, স্বজনদের আহাজারী, আকাশে বাতাসে হাহাকারের ভিড়ে একটা কালো সাদা রঙের কুকুর করুণ স্বরে ডাকতে লাগল। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এল, সেনাবাহিনী এল, টিভি চ্যানেলগুলোর অ্যান্টেনাওয়ালা ভ্যান এসে থামল।
পল্টু ডাকতেই থাকে, ডাকতেই থাকে।
©somewhere in net ltd.