নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেনিআসহকলা

সবাইকে শুভেচ্ছা।

শফিক আলম

মানুষকে বিশ্বাস করতে চাই এবং বিশ্বাস রেখেই কাজ করতে চাই।বাস্তবের ভিতরে বসবাস করতে ভালবাসি। কল্পনা করতে ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তবকে ভুলে নয়। সততা বলতে আংশিক বুঝি না, পুরোটাই বুঝতে চাই। প্রকৃতির মাঝে শান্তি এবং স্বস্তি দু\\\'টোই খুজে পাই। নারীর প্রতি আকর্ষন আছে তবে উন্মাদনা নেই। বয়সকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধা মনে করি না। লিখতে ভালবাসি, কবিতা-গল্প, যা কিছু। চারটে বই প্রকাশ করেছি নিজ উদ্যোগে। প্রতিভা নেই, শখ আছে। অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে, পারি না কেন বুঝি না।

শফিক আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার কৈশোরের কথা

০৫ ই মার্চ, ২০১৪ দুপুর ২:৩৬

কৈশোরের কথা লিখতে গেলে একটু ধন্দেই পড়তে হয়। কৈশোরের সময়কালটা ঠিক কোথা থেকে শুরু হয় এবং কত বয়স পর্যন্ত তা ব্যপ্ত হয়ে থাকে এই ব্যপারটাতে আমি কিছুটা কন্‌ফিউজ্‌ড। তারপরও ধরে নিচ্ছি দশ বছর থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত। তবে কৈশোরের শুরু এবং শেষটাতে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে একজন কিশোরের গঠন এবং মনস্তাত্বিক ভাবনায়। দশ বছরের কোন বালক-বালিকাকে সদ্য শৈশবত্যাগী কিশোর বলা যায় কি না সেও ভাববার বিষয়। অন্যদিকে কিশোর-কিশোরী যখন তাদের কথা লিখবে তখন দু'জনেরই শারীরিক বা দেহজ এবং মনস্তাত্বিক চিন্তাধারায় বিস্তর ফারাক থাকবে, যেটা আগেই বলেছি। বিশেষ করে মধ্য-কৈশোরে, অর্থাৎ ১২/১৩ বছরের কিশোর আর কিশোরীর মাঝে। আবার কৈশোর বেলার কথাগুলোর সমাপনী টানবো কোথায়? পনেরোতে গিয়ে যদি ছাড়ি হয়তো দেখা যাবে সেসব কথা যেন যৌবনেরই। আবার এমনও হতে পারে যে পনেরো শেষ করেও যেন কৈশোর শেষ হচ্ছে না। যাকগে, এতো ভাবনা না ভেবে আমার কথা সোজাসুজি লিখে যাই এবং আমার কথা বা গল্পগুলো দশ থেকে পনেরোতে বুক্‌ড...।



আমার কৈশোরের প্রারম্ভে তেমন কিছুূ উল্লেখ করার না থাকলেও মধ্য কৈশোর নিয়ে বেশ কিছু গল্প করা যেতে পারে। তেরো/চৌদ্দ বছরের কিশোর আমাকে পাড় হতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে। ২৫শে মার্চের আগের দিনগুলোর কথা অল্প কিছু মনে আছে, কারন তখন তো রাজনীতি বুঝি না, তবে বড়দের কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এই দেশে। তখন শেখ মুজিবের কথা শোনা যেতো খুব। কিন্তু ২৫শে মার্চ থেকে পরের ঘটনাবলি আমার কিশোর মনে খুব দাগ কেটে ফেলে। ভয়, শঙ্কা এবং উত্তেজনা সবকিছু মিলিয়েই। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ছিল টানটান উত্তেজনা। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। অফিস-আদালতও ঠিক মতো চলছে না। উত্তেজনা বিশেষ ভাবে চলছে বড়দের মধ্যে আর আমরা চুটিয়ে খেলাধুলা আর ঘুরেফিরে সময় কাটাচ্ছি। লেখ-পড়া যা হচ্ছে তা সন্ধ্যার পর বড়িতে বসেই। ওটার মাফ নেই। কিন্তু ২৫শে মার্চের রাতের পর সবকিছু বদলে গেল। উত্তেজনার জায়গায় জমা হলো ভয়-ভীতি আর শঙ্কা। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে টাঙ্গাইলের পতন হয়। মিলিটারি আসছে জেনে আমরা একদিন আগেই বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য গ্রামের বাড়ি পাড়ি জমালাম। আর ঐ কিশোর বয়সে এই ঘটনাটা আমার ভিতরে কেন যেন এক ক্ষোভের সন্ঞ্চার করলো, যা এখনো বিদ্যমান। আমি আমার সোনার কৈশোরের দিনগুলোর ভেঙ্গে যাওয়া দেখতে পেয়েছিলাম। অনিশ্চিত যাত্রায় গ্রামের বাড়ি গিয়ে কতদিন থাকবো সেও জানিনা। আমার বন্ধু-বান্ধবদের রেখে চলে গেলাম। যদিও অন্যেরাও অনেকেই চলে গেল।



গ্রামের বাড়ি গিয়ে কিছুদিন চুটিয়ে দেশের গান-বাজনা হলো। আমার বোনেরা গান গায়, হারমোনিয়ামও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সঙ্গে করে। গ্রামের অনেকেই আসতো গান শুনতে। 'আমার সোনার বাংলা' আর অন্যান্য সব দেশের গান। কিন্তু ৮/১০ দিন চলার পর তাও একদিন বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের চেয়ারম্যান আর অন্যান্য মুরুব্বিরা একদিন এসে বললেন, নাগরপুরে মিলিটারি এসে গেছে। যে কোন দিন গ্রামে চলে আসতে পারে। সুতরাং এখন এসব বন্ধ করতে হবে, নইলে বিপদ। ব্যস্‌, সব বন্ধ হলো। মিলিটারি নামক বালাইয়ের তখন বিস্তার চলছে। একদিন শোনা গেল রাতে গ্রামে মিলিটারি আসবে। সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে আমার তিন ছোট বোন আর আম্মাকে বাড়িতে রেখে আমার বড় দুই ভাই, আব্বা এবং ছোট চাচা, ওদিকে ফুফাতো ভাইয়েরা সব গ্রামের ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর ঢুকে পড়লো। আমাদের রেখে গেলো কারন আমাদের মারা পড়বার ভয় কম, বয়স বিচারে। যদিও সেই রাতে মিলিটারিরা আর আসেনি, কিন্তু ঝোপ-ঝাড়ের সেই মানুষগুলো সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে, মশার কামড় খেয়ে প্রায় অসুস্থ হয়ে ভোর বেলায় বাড়ি ফিরলো। তখন গুজবটাই বেশি ছড়াতো, আর ভয়-শঙ্কার কারনেই সবাই ছুটাছুটি করতো। তার কারন মিলিটারিদের নিষ্ঠুর গনহত্যা আর বাড়ি-ঘর পোড়ানোর কথা আমাদের কানে আসতো। আরেকদিন বিকেলে শোনা গেলো মিলিটারিরা গ্রামের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, শুনে সবাই দলে দলে গ্রাম ছেড়ে পাশের গ্রামে ছুটলো। বিশেষ করে যুবতী মেয়ে আর তরুন ছেলেরা। এভাবে ছুটতে যেয়ে আমার এক ফুপু, যার তখন কেবল বিয়ের বয়স, সরু বাঁশের সাঁকো পার হতে যেয়ে পড়ে পা ভেঙ্গে বসলেন। সেবারও মিলিটারিরা আসেনি এবং কখনই আর আসেনি। তবে ওদের শাসন তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওদেরই বশংবদদের দিয়ে। এভাবে সপ্তাহ তিনেক কেটে যাওয়ার পর আব্বা বললেন এবার শহরে ফিরতে হবে। রিডিওতে সরকারী ঘোষণা দেয়া হচ্ছে কাজে না ফিরলে চাকুরিচ্যুত করা হবে এবং খুঁজে খুঁজে কঠিন সাজা দেয়া হবে। গ্রামে প্রায় তিন সপ্তাহ কাটিয়ে আব্বা একদিন আমাকে এবং মেজো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে শহরের দিকে রওয়ানা হ'লাম। বড় ভাইকে রেখে যাওয়া হলো, কারন একেবারে তরুন যারা তাদের জিবন তখন হাতের মুঠোয় রাখতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের আরেক নাম ছিল তারুন্য। তখন আমাদের গ্রামে যাওয়ার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করতো। সেই ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রওয়ানা হ'লাম আম্মাকে মহা দু্শ্চিন্তার মধ্যে ফেলে। শহরের কাছাকাছি এসে দুর থেকে দেখলাম বিভিন্ন জায়গায় থোক্‌ থোক্‌ কালচে রঙের গাছপালা। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শহরের প্রবেশমুখেই গজনবি সাহেবের জমিদার বাড়ি। রাস্তার পাশ ঘেষেই চলে গেছে তার বাড়ির দেয়াল এবং কি অদ্ভূত ভাবে দেখলাম এই ক'দিনে দেয়ালগুলোতে যেন শেওলা পড়ে গিয়েছে। রাস্তায় কোন জনমানব নেই। দু'একজন নির্বাক মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে। আমি আজও সেদিনের সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারি না। তখন প্রায় দুপুর, চটচটে রোদ এবং চারদিক প্রায় জনশুন্য। বাড়িতে ঢুকে দেখি যেন কত বছর এখানে আসি নি। দৌড়ে ছুটে যাই আমাদের পাশের খেলার মাঠটাতে, দেখি ঘাসগুলো বড় হয়ে গেছে, কারো পা পড়েনি এখানে অনেকদিন। বন্ধুদের খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেই, কাউকে পেয়ে যাই। দু'চারজন ফেরেনি এখনো। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। স্কুল-কলেজ খুলে যায় কিছুদিন পর। যদিও যুদ্ধের ন'মাস কেটে যায় ভয়-ভীতি আর উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে। রাস্তায় বের হলে মাঝে মাঝেই মিলিটারির গাড়ির সম্মুখিন হতে হয়। আমরা তখন সেল্যুট মেরে দাঁড়িয়ে যাই। এটা শিখিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া এক সিলেটী ভদ্রলোক, যার আত্মীয় বলতে কেউ ছিলো না আমাদের শহরে। আমরা তাকে আশ্রয় দিয়ে গ্রামের বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলাম। এখন মনে হয় ঐ রকম করে পাক সেনাদের সেল্যুট না দিলে কি হতো না!



আমরা বন্ধুরা মিলে স্কুলে যতটা যাই তার চেয়ে বেশী খেলাধুলা করে সময় কাটাই। বিশেষ করে ক্যারম খেলার প্রচলন বেড়ে যায়। আমার বাড়ীর সামনের গলিটায় কাঁঠাল গাছ তলায় বসে ক্যারম খেলার প্রতিযোগিতা। আমাদের খেলার মনযোগ বিঘ্নিত হয় দুরে কোথাও মেশিনগান আর রাইফেলের আওয়াজ শুনে। প্রায়ই আশেপাশে কোথাও না কোথাও যুদ্ধ হতো। একদিন যুদ্ধ থেমে যায়, দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ঢাকা পতনের চারদিন আগে টাঙ্গাইলের পতন হয়। একদিন বিকেলে আমরা পাশের মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলছি। হঠাৎ দেখি দক্ষিন-পশ্চিম কোনের কড়ুই গাছটার উপর দিয়ে বড় বড় দু'টো যুদ্ধ বিমান উড়ে গেল। একটু পরই আরো দু'টো। এতো নিচু দিয়ে উড়োজাহাজ উড়ে যাওয়া আগে কখনও দেখিনি। ভয় পেয়ে গেলাম। ওদিকে আব্বা চিৎকার শুর করেছেন ঘরে ফেরার জন্য। আমরা খেলা বন্ধ করে দৌড়ে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম যেখানে দাঁড়ালে দুরের আকাশটা দেখা যায় যেদিকে জাহাজ দু'টো উড়ে গেল। আরও অনেকেই ইতিমধ্যে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। দেখলাম উড়োজাহাজগুলোর লেজ দিয়ে কি যেন পড়ছে। ওদিকে মাথার উপরে অনেক উঁচুতে দেখা গেল দু'টো ফাইটার প্লেন ইচ্ছেমত কসরত করছে। আব্বাকে দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাদের দু'ভাইকে ধমকের সুরে বললেন, যখন তখন বম্বিং হতে পারে আর তোমরা রাস্তায় দাড়িয়ে আছো? জলদি এসে বাংকারে ঢুকো। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিয়ে প্রায় প্রতি বাড়িতেই তখন সুবিধাজনক জায়গায় বাংকার তৈরি করা হয়েছেিল বম্বিং হলে যেন আশ্রয় নেয়া যায়। আমরাও 'এল' প্যাটার্নের একটা বাংকার তৈরি করেছিলাম প্রায় এক মানুষ সমান গর্ত করে। উপরে কাঠের তক্তা ফেলে তার উপর দিয়ে এমন করে মাটি ফেলেছিলাম যে উপর থেকে বুঝা যেতো না যে এখানে কোন বাংকার আছে। শুধু একজন মানুষ যাওয়ার জন্য ছোট্ট খোলা পথ ভিতরে যাওয়ার জন্য। আমারা দু'ভাই ও ছোট বোনেরা বাংকারে ঢুকে পড়লাম। যদিও মোটেই ইচ্ছে ছিল না। কারন জীবন বাঁচানোর চেয়ে যুদ্ধ আর বম্বিং দেখাটাই তখন মজার ব্যাপার মনে হচ্ছিল। কিন্তু কিছুই হলো না। প্রায় আধা ঘন্টা বাংকারে কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি। পরদিন সকালে উঠে শুনি টাঙ্গাইল স্বাধীন হয়ে গেছে। শোনা গেল সেই উড়োজাহাজের লেজ দিয়ে আর কিছু নয়, ভারতীয় ছত্রী সেনা ফেলা হয়েছিল শহরের অদুরে। সেদিনের সেই কিশোর বালক স্বাধীন শহরে বেরিয়ে কতকিছু দেখতে পেলো। এক পাক সেনা ধরা পড়ে বেদম পিটুনি খেয়ে ভাঙ্গা বাংলায় বলে চলেছে 'জেয় বাংলা'। ওদিকে সারি বেঁধে রাজাকারের দল হাত উঁচিয়ে কোথা থেকে এগিয়ে আসছে আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে। ওদের মুখেও তখন শুনেছি 'জয় বাংলা' বলতে।



দেশ মুক্ত হওয়ার পর অনেক কিছুই রাতারাতি বদলে যায়। মানুষের চালচলন, বেশভূষায় অনেকটা পরিবর্তন আসে। বিদেশ থেকে অনেক সাহায্যের কাপড় এসেছিল তখন। জাপানি সার্ট-প্যান্টের কাপড়, মরিনাগা গুড়ো দুধ, এসব তখন স্কুলে স্কুলে দেয়া হতো। আমিও পেয়েছিলাম। একটা শার্ট আর একটা প্যান্টের কাপড় সবার জন্য বরাদ্দ ছিল। ওগুলো টেট্রন-পলিয়েস্টার কাপড়। সেসময় ওগুলো তখন বেশ দামী কাপড়। সচরাচর সবাই পড়তে পারতো না। কিন্তু আমরা সহজেই পেয়ে গেলাম যুদ্ধের কারনে। দর্জির দোকানে দিয়ে চটজলদি বানিয়ে ফেললাম। তখন বাবড়ি চুলের প্রচলন হলো যুদ্ধ ফেরৎ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে। আমিও চুল বড় বড় করে রাখলাম। এরপর প্রতি বিকেলে ফিট্‌ফাট্‌ হয়ে কয়েক বন্ধু মিলে হাঁটতে বের হ'তাম।



কেউ একজন বলেছিলেন, প্রেম-ভালবাসা হচ্ছে কৈশোরের বিস্ময়, যৌবনের নেশা আর বার্ধক্যে সুখস্মৃতি। শুধু প্রেম-ভালবাসাই নয়, কৈশোর সময়টাই হচ্ছে সর্বতোভাবে বিস্ময়ের ব্যাপার, বিশেষ করে মধ্য-কৈশোর থেকে অন্তিম কৈশোর পর্যন্ত। এই সময় নতুন যা কিছু দেখা হয় তাই বিস্ময় লাগে। তাই যদি না হতো তা'হলে একদিন বিকেলে হাঁটতে যেয়ে পশু ডাক্তারের বাড়ির ভিতরের গাছগাছালিতে ভরা খোলা জায়গাটাতে যে মেয়েটিকে চিবুড়ি খেলতে দেখলাম তাকে দেখে কেন প্রেম করার আগ্রহ জেগেছিলো! একদিন যথারীতি চার বন্ধু মিলে হাঁটতে বেরিয়েছি। এবার আর শহরের দিকে নয়, দক্ষিনে সেই জমিদার বাড়ির পাশের রাস্তা ধরে, যার উল্টো দিকে ঐ পশু ডাক্তারের বড় বাড়িটা। তখন ভেটেরিনারী ডাক্তারকে পশু ডাক্তারই বলা হতো। বাড়িটা কোমর সমান দেয়াল ঘেরা, যে কারনে ভিতরের বড় লনটা অনায়াসেই রাস্তা থেকে দেখা যায়। আমি তখন সবার থেকে একটু বেশিই ফিট্‌ফাট্‌ এবং তারও একটা কারন আছে। স্বাধীনতার পর পর সব স্কুলে অটো প্রমোশান দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি। আমি অটো প্রমোশান না নিয়ে সেকেন্ডারি বৃত্তি পরিক্ষায় অংশগ্রহন করি এবং সেকেন্ড গ্রেডে বৃত্তি পেয়ে যাই। টাকার অংকটা যদিও অল্প ছিল, সম্ভবতঃ মাসিক ২০/২৫ টাকা। বৃত্তির টাকা আসতে সময় লেগেছিল বলে যখন আসলো তখন একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা হাতে চলে আসে বকেয়া সমেত। সেই সময় এই ক'টা টাকার অনেক মূল্য ছিল। তো আমি আরো দু'একটা কাপড়-চোপড় বানালাম। পকেটেও দু'চার টাকা থাকে তখন। সেই মেয়েটিকে দেখে আমাদের ঐদিকের বৈকালিক ভ্রমন প্রায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেল। আমার বন্ধুরাও আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে। মেয়েটি বয়সে আমার থেকে ছোট কিন্তু কিশোরী তো বটে। সেতো বুঝে নিয়েছি যখন সে ঢিলেঢালা জামা পড়ে চিবুড়ি খেলতে যেয়ে ছুট দিয়েছে। দেড় দুই মাস নিয়মিত চক্কর দিলাম, জুতা ক্ষয়ে গেল, কিন্তু ফল কিছুই হলো না। সে আমাকে তাকিয়েও দেখেনা। যোগাযোগ করার জন্য চিঠিও পাঠালাম কাজের বুয়া দিয়ে, কিন্তু সে আবার হিতে বিপরীত হলো। দু'একবার যাও তাকায় তাও রাজ্যের বিরক্তি তার চোখেমুখে। যেন আমি ওর জীবনটাকে বিভিষিকাময় করে তুলছি। একদিন বুঝতে পারলাম আমার ভিতরে যা শুরু হয়েছে ওর ভিতরে তার অনেক বাকি। এক সময় নিজেকে অপমানিত বোধ করলাম। ধুত্তরি বলে হাল ছেড়ে দিলাম। কিন্তু প্রতিক্রিয়া তেমন কিছুই হলো না আমার ভিতরে। মেয়েটিকে চেয়েও পেলাম না...এই জাতীয় কিছু।



যখন আমি নবম শ্রেনীতে পড়ি, আমার এক ফুফাতো বোন এলো মায়ের সঙ্গে বেড়াতে আমাদের বাড়িতে। একটু দুর সম্পর্কের। সে পড়ে অষ্টম শ্রেনীতে। আবারো আমার সেই বিস্ময়! খেলধুলা করি, কথা বলি আমার বোনদের পাশাপাশি। একদিন ওকে বললাম, তুমি এতো সুন্দর কেন? সুন্দর তো ছিল বটেই কিন্তু কেন বললাম জানি না। সে আরক্ত হলো। ওমা:, এতো পশু ডাক্তারের মতো নয়, অন্যরকম। কিন্তু তাতেই বা কি! একদিন পরেই সে তার মা'র হাত ধরে চলে গেলো। চলে যাওয়ার মাঝে ঐ একদিন যা হাতে ছিল, যখনই মুখোমুখি হয়েছি, ওর চাউনিতে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব দেখেছি। কিন্তু ওর সঙ্গে জীবনে আর কখনই দেখা হয় নি, সেও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। অথচ আমার ভিতরে কখনো হাহাকার করে ওঠেনি। এই সময়টাই নানারকম বিস্ময়ে ভরা থাকে, ভিতরে একটা অপরিচিত কিছু নড়া-চড়া করে। বিপজ্জনক!



আমার বই পড়ার নেশা ছোট বেলা থেকেই। বৃত্তির টাকা পেয়ে বেশ কিছু বই কিনলাম, এ্যাডভেন্চারাস। কিছু ক্রাইম ডেটেক্‌টিভ--'মাসুদ রানা' কেনা যাবেনা। ঐ বইয়ে কিছু ব্যাপার-শ্যাপার আছে। তাই কয়েকটা 'কুয়াশা' সিরিজ কিনলাম। 'বনহুর'-ও কিনলাম কয়েকটা। শরৎ বাবুর উপন্যাসও কিনলাম দু'একটা। বই কেনা এবং পড়া আমার ছোটবেলার নেশা। পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য হলাম। নানারকম বই নিয়ে এসে অবসর সময় পড়ি। বড় ভাই উচ্চ শিক্ষার্থে ঢাকা চলে গেলে আমি বাংলা ঘরটার এক কোনে আলাদা জায়গা পেয়ে যাই। আলাদা পড়ার টেবিল, বিছানা। আমার কৈশোর প্রায় যায় যায়, আমি একটু একটু স্বাধীনতা পেতে থাকি। কবিতা লেখা শুরু করে দেই পূর্ণোদ্যমে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়লেও কবিতা লিখি, কাঠফাঁটা রোদে কাকের শব্দ শুনেও কবিতা লিখি। এ্যাঙ্গোলা-নামিবিয়ার কালো মানুষেরা তখন শ্বেতাঙ্গদের হাতে বেদম মার খাচ্ছে, সে খবর পড়েও কবিতা লিখি। একটা কবিতা লিখি আর নিজেকে মনে হয় যেন সুকান্ত নয়তো জীবনানন্দ! এখন ভাবতেও লজ্জা লাগে।



একদিন কোনও এক সকালে একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গে। চোখ ছানাবড়া করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বোকা বনে বসে থাকি কিছুক্ষন। পরে বুঝতে পারি আমার কৈশোর প্রায় যায় যায়।







মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৩:৫০

মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন। চালিয়ে যান।

২| ০৫ ই মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৪:১৪

শফিক আলম বলেছেন: ধন্যবাদ। অবসরকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করি।

৩| ০৫ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৭

হৃদয় রিয়াজ বলেছেন: অসাধারণ লিখেছেন। পুরো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। অনেকটা ছোট গল্পের মতই অনুভূতি। শেষ হয়েও হইল না শেষ। আপনি আসলেই অনেক লাকি। আমি মাঝে মাঝেই খুব আফসোস করি, ইশ যদি সে সময়টায় জন্মাতে পারতাম। আদি পুরুষদের বীরত্বগাথার সাক্ষী হতে পারতাম!

অনেক অনেক শুভ কামনা আপনার জন্য। আশা রাখি এরকম লেখা আরও পাব :)

৪| ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:১০

শফিক আলম বলেছেন: বেশ আগের পোস্ট। এতদিন পরও পড়েছেন জেনে ভাল লাগলো। সুন্দর মন্তব্যও করেছেন। চলে যায় যে দিনগুলো তা নিয়ে কেবল আফ্‌সোস করাই চলে।
আমার ব্লগে কিছু পোস্ট আছে, পড়ে দেখতে পারেন। ভাল লাগতেও পারে। যেমন "আমাদের বাড়িটা" এই রকম আরো কিছু। ভাল থাকুন।

৫| ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:২৩

হৃদয় রিয়াজ বলেছেন: In Shaa Allah whenever I can manage a little spare time then definitely I will go through that one also. Now I am accessing from my University lab and here Avro is not available. I personally dont like to use English in blog. Sorry for my inconvenience :(

৬| ১৭ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৪৫

আহমেদ আলিফ বলেছেন:
আমারও লেখাটা খুব ভালো লাগলো ! খুব সাবলিল ভাবে লেখাটা লিখেছেন। এরকম লিখা আরো চাই!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.