![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষকে বিশ্বাস করতে চাই এবং বিশ্বাস রেখেই কাজ করতে চাই।বাস্তবের ভিতরে বসবাস করতে ভালবাসি। কল্পনা করতে ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তবকে ভুলে নয়। সততা বলতে আংশিক বুঝি না, পুরোটাই বুঝতে চাই। প্রকৃতির মাঝে শান্তি এবং স্বস্তি দু\\\'টোই খুজে পাই। নারীর প্রতি আকর্ষন আছে তবে উন্মাদনা নেই। বয়সকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধা মনে করি না। লিখতে ভালবাসি, কবিতা-গল্প, যা কিছু। চারটে বই প্রকাশ করেছি নিজ উদ্যোগে। প্রতিভা নেই, শখ আছে। অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে, পারি না কেন বুঝি না।
জেদ্দা বিমানবন্দরে যখন পৌঁছাই তখন রাত নয়টা পার হয়ে গেছে। ইমিগ্রেশানের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি পুরো পরিবার নিয়ে, অনেকক্ষন হয়ে গেছে। জাম্বিয়া থেকে প্রতিবার ছুটিতে দেশে যাওয়ার পথে কোথাও না কোথাও হয়ে যাই। এবার ভেবে রেখেছিলাম মক্কা হিজরত করে ওমরাহ্ সেরে যাবো। হজ্জ করার সুযোগ কোনদিন পাবো কিনা কে জানে! ইমিগ্রেশানের সৌদী অফিসারদের হাব-ভাব দেখে খুব বিরক্ত হচ্ছি। আমরা কেউ ইহ্রাম পড়ে আসিনি কিন্তু সহযাত্রী অনেকেই এসেছেন ওমরাহ্ করতে।দেখেই বুঝা যায় যে এরা এসেছে আল্লাহ্র ঘর তাওয়াফ করতে। অফিসারদের মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছি না। আমাদের বুথের অফিসার আরেকজনের সঙ্গে, যিনি তার বুথে বেড়াতে এসেছেন, খোশ গল্প করছেন তাদের ভাষায়। সামনে একজন এহ্রাম বাঁধা বয়স্ক মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্লিয়ারেন্সের অপেক্ষায়। এর পাসপোর্টের দিকে একবার তাকাচ্ছে ফের কথায় মশগুল হচ্ছে। এভাবে পরিষ্কৃত হয়ে বেড়িয়ে যেতে প্রায় এক ঘন্টা লাগলো মাত্র অল্প কিছু যাত্রিদের। আমার পালা যখন এলো, সালাম দিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু সালামের জবাবটা পেলাম না। নিরস বিরস মুখখানি তার। আমি কারও সঙ্গেই এদের একটু হাসিমুখে কথা বলতে দেখিনি। দুবাই এয়ারপোর্টেও দেখেছি একই অবস্থা। কিন্তু ভেবেছিলাম জেদ্দায় অন্যরকম দেখবো। খুব অদ্ভূত লাগলো। আরবেরা বিশেষ করে মক্কা-মদিনার লোক হয়েও এরা এতো রুক্ষ-উন্নাসিক হয় কি করে!
লাগেজ বেল্ট থেকে ব্যাগ সংগ্রহ করে বাইরে বের হতে সারে দশটা বেজে গেল। বাইরে এসে খোঁজা-খুঁজি করলাম জায়েদ অথবা আহ্মেদ নামে কেউ আমাদের রিসিভ করতে এসেছে কিনা। কাউকে দেখলাম না। ভাবলাম হয়তো এসে পৌছায় নি এখনো। এদিকে এহ্রাম বেধে আসিনি বলে জায়গা খুঁজতে পেছনের দিকে গেলম। কাউকেই দেখলাম না, কোন দিক নির্দেশনাও চোখে পড়লো না। এদিক-সেদিক ইতি-উতি করছি এমন সময় এক নাদুস-নুদুস সৌদীকে দেখলাম পাশ কাটিয়ে টারমিনাল বিল্ডিংটায় ঢুকছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এহ্রাম বাঁধার স্থানটা কোথায়। তিনি কিছু না বুঝে বললেন, 'হোয়াত'? আমি অসহায়ের মতো আবারো অত্যন্ত ধীরে ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলাম এখানে এহ্রাম বাঁধার জায়গাটা কোথায়। এবার তিনি বিরক্ত হয়ে 'নো ইহ্রাম, নো ইহ্রাম' বলেই ভিতরে উধাও হয়ে গেলেন। আমি পরিবার নিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে লোকটির চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম। এরা ইংরেজীও জানে না, কোন সাইনবোর্ডও নাই, কি করবো বুঝতে পারছি না। জাম্বিয়াতে আমার এক আল্লাওয়ালা বন্ধু, যিনি ইতিমধ্যে হজ্জ করে গিয়েছেন, বলে দিয়েছেন এয়ারপোর্টের ভিতরেই এহ্রাম বাঁধার ব্যবস্থা আছে। অথচ এরা বলছে নেই! মনটা খারাপ হয়ে গেল। তা'হলে কি বন্ধুটি ভুল বললো নাকি আন্দাজের উপর বলেছে! আমার স্ত্রী বললো, এখানে দেরী না করে চলো মক্কায় হোটেলে চলে যাই। ওখানে একটা ব্যবস্থা হবে। আমার হঠাৎ মনে হলো আমাদের যিনি রিসিভ করতে আসবেন তিনি হয়তো এসে গেছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেই সব সুরাহা হয়ে যাবে। আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। জাম্বিয়ায় যে এজেন্সির মাধ্যমে ওমরাহ্র ভিসা থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং এবং এয়ারপোর্ট পিকআপের ব্যবস্থা করেছি, তারাই বলে দিয়েছে জায়েদ অথবা আহ্মেদ নামে যে কেউ একজন এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকবে আমাদের রিসিভ করবার জন্য। অথচ কাউকেই দেখছি না। আমাদের অপেক্ষমান দেখে এক ট্যাক্সি চালক এগিয়ে এলো। হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো আমরা মক্কায় যাবো কিনা এবং ট্যাক্সি লাগবে কিনা। আমি তাকে ব্যাপারটা বললাম। সে শুনে সব খোলাসা করে দিল। সে বললো, স্যার, এয়ারপোর্টে তো এহ্রাম বাধা যায় বলে শুনিনি! তবে আপনারা যেহেতু দুবাই হয়ে এসেছেন সেহেতু দুবাই থেকেই এহ্রাম বেঁধে আসা উচিত ছিল। এখন আপনারা যে কোনও একটি কাজ করতে পারেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কি?
ট্যাক্সি চালক বললো, মক্কায় পৌঁছে কাফ্ফারা হিসেবে একটি দুম্বা কোরবানি দিয়ে তারপর এহ্রাম বাঁধতে হবে, নয়তো একটু দুরে আয্ যাফা (নামটা ভুলও হতে পারে। ২০০১ সালের কথা) শহরে যেয়ে বাঁধতে হবে। ওখানে এক মসজিদে এহ্রাম বাধার ব্যবস্থা আছে।
ট্যাক্সি চালক যেভাবে বললো তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো। কাফ্ফারার ব্যাপারটা আমি আগেই শুনেছিলাম।
টাক্সি চালককে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি করা যায় বলতো?
সে বললো, মক্কায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে অনেক রাত হয়ে যাবে। যে কারনে কোরবানি ব্যাপারটা আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আমি বলি কি, যাফাতেই চলুন। একটু সময় লাগবে যদিও, তবু কাজটা হয়ে যাবে। এরপর মক্কায় ফিরতে ফিরতে রাত হবে ঠিকই কিন্তু তাওয়াফের তো কোন সময় নেই। হোটেলে রিপোর্ট করেই কাবা শরিফে চলে গেলেন।
ওর বুদ্ধিটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলো। ভাড়া ঠিক করতে যেয়ে জানলাম আয্ যাফায় যেতে লাগবে আধা ঘন্টার মতো এবং ওখান থেকে মক্কায় যেতে লাগবে দেড় ঘন্টার মতো।
আমি বললাম, আমিতো জানি জেদ্দা থেকে মক্কা যেতে এক ঘন্টাও লাগে না।
সে বললো, ঠিকই জানেন, কিন্তু উল্টো দিকে যেতে হবে আয্ যাফায়। যে কারনে ওখান থেকে আধা ঘন্টা বেশি লাগবে।
কি আর করা! কেউ নেই যেহেতু ওর ওপরই বিশ্বাস করে ছেড়ে দিতে হবে।
জাম্বিয়ায় ফিরে যেয়ে এজেন্টকে পাকড়াও করতে হবে সন্দেহ নেই। আমি বিদেশে কোথাও গেলে এয়ারপোর্ট পিক্ আপের ব্যবস্থা করে যাই। হয় হোটেল থেকে, নয়তো জানা-শোনা কেউ। অজানা জায়গার শুরুটা নির্ঝঞ্ঝাট হওয়া চাই।
এতক্ষন যার সঙ্গে এত কথা হলো তার নামই জানা হয় নি। জিজ্ঞেস করে জানলাম, নাম আব্দুল হামেদ। বুঝলাম হামিদ।
দেশ কোথায় তোমার? ভারতে না পাকিস্তানে?
ইন্ডিয়ান স্যার।
কতদিন হলো আছ এখানে?
প্রায় আট বছর হলো।
বুঝা গেল সে এতদিনে নিয়ম কানুন বুঝে ফেলেছে। এবার রওয়ানা হলাম।
কিছুদুর যাওয়ার পরই আমরা জেদ্দা শহর ছেড়ে ফাঁকা রাস্তায় যেয়ে পড়লাম। গাড়ি চলেছে রাতের আঁধার ভেঙে। একেবারে শুন্শান। কোথাও কিছু নেই। মাঝে মাঝে হঠাৎ পেট্রোল পাম্প দেখা যায়। কোথাও দু'একটা বাড়ি-ঘর, কিন্তু সেগুলো সরকারি দপ্তরই হবে মনে হয়। হঠাৎ দু'একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আধা ঘন্টা হয়ে যাওয়ার পর কেন যেন অজানা আশংকা জাগলো। কোথাও কোন শহর বা লোকালয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। আমি সামনের সিটে বসেছি। পিছনে স্ত্রী বসেছে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে। মেয়ে বড় হয়ে গেছে, কলেজে পড়ছে। ছেলে গ্রেড সেভেনে। পিছন থেকে স্ত্রী ফিস্ ফিস্ করে বললো, আমরা ঠিক মতো যাচ্ছি তো! কেমন ভয় ভয় করছে।
আমি হামিদকে জিজ্ঞাসা করলাম, হামিদ, তুমি রাস্তা ভুল করনি তো! এর আগে এসেছ কখনো? তোমার আধা ঘন্টা তো হয়ে গেছে। কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।
কি যে বলেন স্যার। বলেছি তো শহরটা একটু দুরে। কিন্তু প্রায় এসে গেছি। আর বেশিক্ষন লাগবে না।
আরও মিনিট দশেক চলার পর হামিদ বললো, স্যার, ঐ যে দেখছেন একটু আলো দেখা যাচ্ছে দুরে, ওখানেই আমরা যাচ্ছি।
আমরা দেখলাম সত্যিই দুরে কিছু আলো দেখা যাচ্ছে। এবার নিঃশঙ্ক হলাম। একটা মসজিদের পাশে এসে গাড়ি থামলো। একেবারেই ছোট শহর। যেন এই মসজিদের জন্যই কেবল শহরটা গড়ে উঠেছে। পাশেই দু'চারটে দোকান এহ্রামের জন্য প্রয়োজানীয় জিনিস-পত্র নিয়ে বসেছে। এখন মধ্যরাত তবুও দোকন খোলা এবং সারারাতই খোলা থাকবে। একটা দোকান থেকে সাবান, তোয়ালে ইত্যাদি কিনে নিলাম। স্যুটকেসে এসব থাকা সত্ত্বেও বের করতে ইচ্ছে হলো না। দোকানদার দেখলাম বাঙালী। বাংলাদেশের।
মসজিদে যেতে যেতে বাংলা কথা-বার্তা শুনতে পেলাম। কিছু অল্প বয়সী ছেলে মসজিদের আঙ্গিনায় বসে আড্ডা দিচ্ছে।
জিজ্ঞেস করে জানলাম বাংলাদেশী। মসজিদের পয়-পরিষ্কারের কাজ করে। খুব অবাক লাগলো, কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় এই মরুভূমির প্রান্তরে এই ছোট্ট শহর! আর এখানেই এরা সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে জীবনের তাগিদে পড়ে আছে। কেউ ২০/২২ বছরের বেশি তো নয়।
এখানে ওজু-গোসল করার সব ব্যবস্থাই আছে। গোসল সেরে দুই টুকরো কাপড়ে এহ্রাম বেঁধে মসজিদে দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলাম। আরও কয়েকজন মুসুল্লি দেখলাম এখানেই এহ্রাম বেঁধে যার যার মত নামাজ পড়ে নিচ্ছে। মহিলাদের জন্য মসজিদের ভিতর নামাজের আলাদা জায়গা আছে। স্ত্রী-কন্যা আপাদ-মস্তক সাদা বোরকায় ঢেকে নিয়েছে। এবার আমরা সবাই ওমরাহ্র নিয়তে নিয়তবদ্ধ মানুষ। এখন থেকেই আমাদের তালবিয়া পড়া শুরু হলো 'লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...' । মসজিদ থেকে বের হয়ে আবার সেই ছেলেগুলোকে দেখলাম তেমনি বসে আড্ডা দিচ্ছে। এবার ওদের দেখে মনের ভিতরে কোন সহানুভূতি হলো না, বরং কিঞ্চিত রাগ হলো কারন বাথরুমগুলো ভালভাবে পরিষ্কার করা হয় নি। গন্ধ করছিলো। কাজের প্রতি মনোযোগী না হয়ে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দেশে যেমন অভ্যাস কাজে ফাঁকি দেয়া, এখানেও ঠিক তাই। কিন্তু কিছু বললাম না। এহ্রাম বেঁধে ইহজাগতিক ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
মক্কায় এসে যখন হোটেলে উঠলাম তখন প্রায় রাত ১টা। হোটেলের নাম লেখা দেখলাম 'আল্ হেতাজ প্যালেস'। প্যালেস বলতে কিছু নয়, সাধারন মানের চার/পাঁচ তলার একটি দালান। তবে একেবারে খারাপ নয়। হজ্জ-ওমরাহ্ করতে এসে যত সাধারন মানে থাকা যায় ততই মঙ্গল, আমার ধারনায়। অনেকে ফাইভ স্টার হোটেলে আলিসান ব্যবস্থাপনায় হজ্জ করে যায়, তা কতটুকু শুদ্ধ সে একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন। আমার মতে এইসব আলিসান ব্যবস্থাই থাকা উচিত নয়, সবই সাধারন মানের হওয়া উচিত। হজ্জ পালনের সময় যদি উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক কাতারে সামিল হতে পারে, তা'হলে হজ্জের উদ্দেশ্যে আসা সব মুসুল্লিরও কয়েকদিনের জিবন-যাপন একই রকম হওয়া উচিত। রিসেপশানে চেক্ ইন করতে যেয়ে মিঃ জায়েদ অথবা আহ্মেদের কথা জিজ্ঞেস করলাম এবং তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। অপারেটর ফোন লাগিয়ে দিলো। ওদিক থেকে কথা শোনা গেল। জায়েদ বলছে। আমি ইংরেজীতে অনুযোগ করলাম এয়ারপোর্টে উপস্থিত না থাকার জন্য। সে একটা ঝামেলায় আটকে গিয়েছিল বলে দুঃখ প্রকাশ করলো। কথা শুনে বুঝা গেল না ভারতীয় কি স্থানীয় আরব। আমি আর কথা বাড়ালাম না। মাল-সামান নিয়ে কামড়ায় উঠে পড়লাম। হোটেলের কামড়া মন্দ নয়। ফ্যামিলি রুম, এক কামড়াতে সবাই, যে রকম চেয়েছিলাম। এটা একটা মাঝারি মানের হোটেল। তবে সবচেয়ে সুবিধাজনক ব্যাপারটা হলো এখান থেকে হারাম শরীফ একেবারে কাছে। আমরা কামড়ায় সবকিছু রেখে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে মসজিদুল আয়েশায় সবাই দু'রাকাত নামাজ পড়ে তারপর হারাম শরীফে যেয়ে ওমরাহ্ পালন করবো। যে কারনে হামিদকে অপেক্ষায় রেখে দিয়েছিলাম। ওকে নিয়ে মসজিদুল আয়েশায় গিয়ে দু'রাকাত নামাজ পড়লাম। মনটা ভরে গেল। সাদা রঙের মসজিদ, পরিষ্কার। এত রাতেও কত মুসুল্লী, বিনিদ্র। নামাজ শেষে হামিদ আবার হোটেলের বাইরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। ওর কাজ শেষ। ভাড়ার সঙ্গে একটা ধন্যবাদ জানাতে ভুললাম না। যাওয়ার আগে দেখিয়ে দিয়ে গেলো কোন্ দিক দিয়ে হারাম শরীফে যেতে হবে। আমরা সে পথে এগুলাম। একটুখানি এগিয়েই হারাম শরীফের বিশাল প্রাঙ্গন চোখে পড়লো। চারিদিক আলোয় আলোকময়। বিশাল বহিরাঙ্গন স্বেত পাথরে বাঁধানো মেঝে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কেউ বসে নামাজ পড়ছে, কেউ কোরান পাঠ করছে। কোথাও বা ক'জন একসঙ্গে বসে গল্প করছে। আমরা জুতা খুলে শীতল মেঝেয় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি মূল ফটক বা'বে সালামের দিকে। আমার সেই হাজী বন্ধুটি বলেছিলেন এই ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে। যদিও যে কোনও ফটক দিয়ে প্রবেশ করা যায়। আমি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়ছি। একটু পরেই আমরা প্রবেশ করবো সেখানে যেখানে আল্লাহ্র ঘর দন্ডায়মান। ফটক দিয়ে ঢুকে দেখলাম বিশাল মসজিদ প্রাঙ্গন। তার ভিতর দিয়ে এগুচ্ছি আমরা। এর পরই আমরা গিয়ে দাঁড়াবো হারাম শরীফের সামনে। দুর থেকেই এক ঝলক দেখতে পেলাম কালো কাপড়ে ঢাকা কা'বার কিয়দংশ। একসময় মসজিদ পেরিয়ে বিশাল আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ালাম। আমার সামনে এখন সেই স্বপ্নের কা'বা শরীফ। কালো মখমলের কাপড়ে ঢাকা পবিত্র ঘরখানি। মহাপ্রভুর কাছে কৃতজ্ঞতায় আমার দু'চোখ ছল ছল করে উঠলো। যেই কা'বা শরীফকে ছোট বেলায় কত দেখেছি রাস্তার পাশে ক্যালেন্ডারের ছবিতে। দেখেছি দাদার বাড়ির দেয়ালে বাধানো ছবিতে। দেখেছি আর ভেবেছি ওখানে কি কখনো যেতে পারবো! আজ আল্লাহ্ তা'য়ালা সে আশা পূর্ণ করেছেন। দু'হাত তুলে আমরা সবাই আল্লাহ্র কাছে মুনাজাত করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার গন্ড বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে।
আমি হারাম শরীফের আকারের কোন পরিমাপ করতে পারলাম না। খুব কি বড়, তাও তো নয়। খুব কি ছোট, তাও তো নয়! এ এমনই একক কাঠামোর একটি ঘর, যার পরিমাপ করা কঠিন।
এত রাতেও দেখলাম কম করেও শ'খানেক মুসুল্লি হবে হারাম শরীফ তাওয়াফ করছে। হাজ্রে আসওয়াত প্রস্তর খন্ডটি ছুঁয়ে তাওয়াফ শুরু করার নিয়ম। তবে ভিড়ের কারনে সম্ভব না হলে পাথরের বারাবর দাঁড়িয়ে হাত তুলে আল্লাহু আকবার এবং দোয়া পড়ে তাওয়াফ শুরু করা যায়। হাজরে আসওয়াতের ওখানে বেশ ভিড় দেখা গেল। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ হলো না বলে আমরা আল্লাহু আকবার বলে তাওয়াফ শুরু করলাম।
তাওয়াফের বেশ কিছু নিয়ম আছে যা মানতে হয়। তাওয়াফ শুরু করে কা'বা শরীফের প্রথম তিন কোণার পর চতুর্থ কোণ, যাকে বলে রুক্ন ইয়ামানি, সেখানে পৌঁছে দু'হাত দিয়ে ছুঁয়ে দোয়া পড়তে হয়। তারপর আবার ছুঁটতে হয়। এভাবে হাজ্রে আসওয়াতে পৌঁছলে একবার তাওয়াফ পূর্ণ হয়। প্রথম তিন চক্কর একটু জোড়ে হাঁটতে হয়, বাকি চারবার স্বাভাবিক ভাবে। সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করে হাজ্রে আসওয়াত ও কা'বার দরজার মাঝের জায়গাটুকু, যাকে বলে মুলতাজাম, সেখানে কা'বার গায়ে নিজেকে সেটে নয়তো গিলাফ ধরে খুব কেঁদে আল্লাহ্র মাগফেরত, করুনা-রহমত সবই চাইতে হয়। একটু ভিড় থাকলেও সুযোগ পেয়ে গেলাম, নইলে দুরে দাঁড়িয়েও এ কাজটি করা যায়। এরপর মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে দাঁড়িয়ে আমরা দু'রাকাত নফ্ল নামাজ পড়ে নিলাম, যা ওমরাহ্র একটি অংশ। এরপর যম্যম কুপের পানি আল্লাহ্র নামে পান করে ছা'য়ি করতে গেলাম। একটু পিছনেই ছা'ফা আর মারওয়া নামের দুই পাহাড় যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়াতে হবে সাত বার, একেই বলে ছা'য়ি। ছা'ফা পাহাড় থেকে শুরু করে মারওয়াতে শেষ হলে একবার ছা'য়ি পূর্ণ হয়। এভাবে মারওয়াতে গিয়ে সাতবার ছা'য়ি পূর্ণ হয়ে যায়। দুই পাহাড়ের প্রায় মাঝামাঝি সবুজ বাতির দু'টি পিলার আছে যেখানে পুরুষদের দৌড়ে পার হতে হয়, প্রতিবারই। হাজিদের সুবিধার্থে পাহাড় দু'টোকে বর্তমানে মূল মসজিদের প্রায় ভিতরেই নিয়ে আসা হয়েছে। মাঝে মাটি ফেলে কংক্রিটের ঢালাই করে বেশ উঁচু করা হয়েছে, যার উপর মারবেল পাথর বিছানো। যে কারনে ছা'ফা আর মারওয়ার চুড়া এখন আর তেমন উঁচু নয়। যদিও শেষের ২/৩ টি চক্কর খুব ক্লান্তিকর। তা'ছাড়া সাতবার ছা'য়ি পূর্ণ হতে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্ব হয়ে যায়। মারওয়া পাহাড়ের পাশেই দরজার পিছনে চুল কাটার লোক অপেক্ষমান। চুল ছেঁটে নিলাম। অবশ্যই টাকার বিনিময়ে, তবে যে যেমন দেয়। চুল কাটার পর ওমরাহ্ পূর্ণ হয়ে যায়।
আবার কা'বা শরীফের কাছে ফিরে এলাম। কা'বা ঘরের পাশেই লাগোয়া একটি নিচু দেয়াল ঘেরা জায়গা আছে অর্ধবৃত্ত আকারের যাকে বলে 'হাতিম', সেখানে আল্লাহ্ শুকরিয়া আদায় করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম।এটা ওমরাহ্র অংশ নয়, কিন্তু এখানে দুই রাকাত নামাজ পড়ায় অনেক ছওয়াব।
একবারে ফজর নামাজ শেষ করে তারপর হোটেলে ফিরবো মনস্থ করলাম। কা'বাকে সামনে রেখে মসজিদের বারান্দায় বসে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে একসময় ফজরের আযান হলো। জামাতে নামাজ পড়লাম। প্রচুর মুসল্লির সমাগম হলো। মহিলাদের জামাতে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের ভিতর আলাদা জায়গা আছে।
হোটেলে যখন ফিরলাম তখন চারিদিকে পরিস্কার হয়ে গেছে। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, বিশেষ করে আমার ছেলেটি। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। আমার মেয়েকে ভেবেছিলাম বোধ হয় একটু নাজুক, আজ দেখছি সে বেশ শক্ত-সামর্থ। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সবাই সন্দেহ নেই। গতরাত থেকে শুরু হয়েছে বিরামহীন যাত্রা। তবু আল্লাহ্র অশেষ কৃতজ্ঞতা আমাদের উদ্দেশ্য কামিয়াবের জন্য। ঘুমানোর আগে আগামী দুই দিনের পরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম। ২৭ ডিসেম্বর রাতে আমরা মক্কায় এসেছি। এটা ২০০১ সালের কথা। উদ্দেশ্য ছিল চারদিন থাকবো এবং সেরকম হিসেব করেই আমাদের রিটার্ন এয়ার টিকেট কনফার্ম আছে ৩১ ডিসেম্বর রাতে। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকেই স্টে ভিসা দিয়েছে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কারন কিছুদিন পরই হজ্জ শুরু হবে বলে হারাম শরিফের মেনটেনেন্স শুরু হবে ৩১ তারিখ থেকে। তখন কিছুদিন ওমরাহ্ বন্ধ থাকবে। আসার আগে আমাদের প্ল্যান ছিল দুই দিন মক্কায় থাকবো, একদিন মদিনা এবং পরদিন ফিরে এসে রাতের ফ্লাইটে দুবাই। কিন্তু এখন একেবারেই আট-সাট হয়ে গেল। কষ্টকর হলেও আমারা মনস্থ করলাম আজই মদিনায় যাবো রাসুলাল্লাহ্ (সা রওজা মোবারক জিয়ারত করতে। রিসেপশান থেকে জানলাম সারাদিনে কয়েকটি বাস যাতায়াত করে। বিকেল পাঁচটার দিকে ছাড়বে একটা। এটাই আমাদের জন্য ভাল হবে। যেতে লাগবে পাঁচ ঘন্টা, অর্থাৎ রাত দশটাতেই পৌঁছে যাবো।
একটানা ঘুমিয়ে সকাল দশটায় উঠলাম। নাস্তা সেরে কয়েকটি কাজ সারার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। বিমানের রিটার্ন টিকেট একদিন এগিয়ে আনতে হবে এবং মদিনা যাওয়ার টিকেট কিনতে হবে। ভাগ্যক্রমে বিমানের চারটি টিকেটই পেয়ে যাই পরিবর্তিত ফ্লাইটে আর মদিনার যাওয়া-আসার টিকেট একবারেই সেরে ফেললাম, যাতে ফেরার পথে টিকেট নিয়ে ঝামেলা না হয়। বাস স্টেশান কাছেই, হোটেলের পিছনের বড় রাস্তাটার পাশে। ফিরে এসে আবার আমরা কা'বা শরীফে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। ওমরাহ্ বারবার পালন করবার প্রয়োজন নেই, তবে অন্যের হয়ে আদায় করা যায়। আমরা ঠিক করেছি আজ জোহরের আগে আমি আমার জান্নাতবাসী আম্মার জন্য ওমরাহ্ করবো যিনি এক দশক হলো পরলোকগমন করেছেন। আর আমার স্ত্রী করবে ওর আম্মার জন্য এবং মেয়ে করবে স্ত্রীর খালার জন্য যিনি নি:সন্তান এবং ওদেরকেই ছেলেমেয়ে মনে করে সবসময় কাছে রেখেছেন। আমার মেয়ে স্যোৎসাহে রাজি হয়ে গেল।
বারোটার আগেই আবার এহ্রাম বেঁধে কা'বা শরীফে চলে গেলাম যাতে ওমরাহ্ শেষ করে যোহরের নামাজ জামাতে পড়তে পারি। আমাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিতেই কা'বা শরীফ চোখে পড়ে। একেবারেই কাছে। এবার দিনের বেলা দেখলাম অন্যরকম দৃশ্য। কা'বা শরীফের যাওয়ার পথে রীতিমত বাজার বসে গেছে। রাস্তার পাশে বিশেষ করে আফ্রিকান মহিলারা বাজার সাজিয়ে বসেছে। ভারতীয় অথবা পাকিস্তানী এবং আরবীয় কিছু বিক্রেতাও দেখলাম। মেস্ওয়াক-টুপি-তসবিহ্ থেকে শুরু করে ছোট ছোট কার্পেট পর্যন্ত। (চলবে)
©somewhere in net ltd.