![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষকে বিশ্বাস করতে চাই এবং বিশ্বাস রেখেই কাজ করতে চাই।বাস্তবের ভিতরে বসবাস করতে ভালবাসি। কল্পনা করতে ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তবকে ভুলে নয়। সততা বলতে আংশিক বুঝি না, পুরোটাই বুঝতে চাই। প্রকৃতির মাঝে শান্তি এবং স্বস্তি দু\\\'টোই খুজে পাই। নারীর প্রতি আকর্ষন আছে তবে উন্মাদনা নেই। বয়সকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধা মনে করি না। লিখতে ভালবাসি, কবিতা-গল্প, যা কিছু। চারটে বই প্রকাশ করেছি নিজ উদ্যোগে। প্রতিভা নেই, শখ আছে। অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে, পারি না কেন বুঝি না।
যথাসময়ে আমরা ওমরাহ্ শেষ করলাম। যোহ্রের নামাজ আদায় করলাম জামাতে। এবার মনস্থ করেছিলাম হাজরে আস্ওয়াত ছুঁয়ে তারপর তাওয়াফ শুরু করবো। এই সময়টায় ভিড় একটু কম ছিল বলে সুযোগটা পেয়ে গেলাম। অতটা সহজ না হলেও কাজটা করতে পারলাম। আমরা সবাই এক এক করে পাথর ছুঁয়ে নিলাম সুযোগ করে। স্পর্শে খুব মসৃনতা অনুভব করলাম। হাজার বছরের ছোঁয়ায় এর উপরিভাগ একেবারে মসৃন হয়ে গিয়েছে। হোটেলে ফেরার পথে কয়েকটি তসবিহ্ কিনে নিলাম দেশে ফিরে উপহার দেবো বলে। একটু এগিয়েই পথের পাশে দালানগুলোর নিচ তলায় দেখলাম ছোট ছোট খাবারের দোকান। অনেকটা ফাস্ট ফুডের মতো। একটাতে যেয়ে দেখলাম শওয়ারমা বিক্রি করছে। আরও কিছু আরবী খাবার। আমরা চারটে শওয়ারমা নিলাম 'টেক অ্যাওয়ে' হিসেবে। হোটেলে যেয়ে খাবো। পরে দেখলাম খাবারগুলো বেশ মজাদার। আসল শওয়ারমা। জাম্বিয়াতে খেয়েছি, এক দোকানে লেবানিজ কুক তৈরি করতো। তার চেয়েও এদেরটা বেশি ভাল লাগলো। দামও তুলনামূলকভাবে কম।
আমাদের চার দিনের কর্মসূচির মধ্যে শেষ দিনটা রেখেছিলাম মক্কার ঐতহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখবো বলে। কিন্তু একদিন কমে যাওয়ায় আমরা আজই যতটুকু সময় পাওয়া যায় ঘুরে দেখবো। আর তাই দুপুরের খাবার সেরেই আমরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম কয়েকটি প্রসিদ্ধ জায়গা দেখতে। সবই তো পবিত্র স্থান। এবারের ড্রাইভারটি পাকিস্তানী। আমার ছবি তোলার সখ আছে। যে কারনে যেখানেই যাই না কেন আমার সঙ্গে সবসময় স্টীল এবং ভিডিও ক্যামেরা দু'টোই থাকে। ভিডিও ক্যামেরা অন্ করে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ভিডিও করতে সমস্যা হবে কিনা। সে আমাকে নিরুৎসাহিতই করলো। বললো, কিছুদিন আগে এক জার্মান ভদ্রলোক কা'বার ভিতরে ছবি তুলছিল বলে তাকে পুলিশ আ্যারেস্ট করেছে। বলে কি? আমি যদিও ভিতরের ছবি তুলছি না, কিন্তু কে জানে কি হয়! আমি কয়েক সেকেন্ডে কা'বা শরিফের আশপাশ এবং হোটেলের সামনের চত্বরের অংশটুকু তুলে বললাম, জলদি চলো।
তবে ড্রাইভার বললো, বাইরে তুলতে পারবেন। সমস্যা হবে না।
আমরা সবাই গাড়িতে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। বিকেল পাঁচটার আগেই ফিরতে হবে, নইলে মদিনা যাওয়ার বাস মিস্ করবো।
ড্রাইভার (ওর নামটি মনে নেই) প্রথমেই নিয়ে গেল সেই পাহাড়টার কাছে যেখানে রসুলাল্লাহ্ (সাঃ) সঙ্গী আবুবকরকে নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করার পথে কাফিরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য একটি গুহায় অাশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তিন দিন অবস্থান করেছিলেন। পাহাড়ের চুড়ায় গুহাটি অবস্থিত। ভাবতেও অবাক লাগে এই উঁচু পাহাড়ে কত না কষ্ট করে তিনি উঠেছিলেন। এরপর আমরা ছুটে চলেছি আরাফাত ময়দানের পাশ দিয়ে। ড্রাইভার আগেই বলে দিচ্ছে আমরা কোথায় যাচ্ছি। আরাফাত শুরুর জায়গাটা সাইনবোর্ড দিয়ে লেখা আছে। চোখ জলে ভিজে ওঠে। হজ্জের সময় এই ময়দানটি মুসল্লি দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে, আর এখন একেবারে বিরান ধু ধু, কি বিশাল প্রান্তর। এই দেখার গভীরতাই আলাদা। এখানেই নাকি বসবে শেষ বিচারের বিচারিক অনুষ্ঠান। এর পাশ দিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। যেতে যেতে একসময় কিছু পাহাড়ের সারি বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে সংকীর্ন করে ফেললো। চালক বললো, ঐ যে পাহাড় ঘেঁষে বাঁধানো নালা চলে গেছে, ওটা খলিফা হারুন-অর-রশিদের সময় করা হয়েছেিল শীতল আর পরিস্কার পানি প্রবাহের জন্য। যার উৎস ছিল সুদুর কোন এক নদী। আমরা সত্যিই দেখতে পেলাম যতদুর পাহাড় আমাদের পাশাপাশি চলছিল ততদুর সেই পাহাড় ঘেঁষা বাঁধানো নালা। মাইলের পর মাইল। এর পর মিনায় এসে পড়লাম। দেখলাম সারি সারি তাঁবু টানানো, যেখানে হাজিরা রাত্রি যাপন করে থাকেন হজ্জের সময় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ এবং অন্যন্য আনুষঙ্গিক কার্য্যাদি সম্পন্নের জন্য। যেতে যেতে আমরা সেই প্রতিকী শয়তানের স্তম্ভের কাছে চলে গেলাম। এ জায়গাটি এখন দোতলা করে দেয়া হয়েছে, যাতে একসঙ্গে অনেক হাজী কংকর ছুড়তে পারে। এখনতো ফাঁকা। দু'চার জন মুসল্লিকে দেখলাম চারপাশে দেখছে, হয়তো আমাদেরই মতো দেখতে এসেছে। এই জায়গাটিতে বেশ কিছু স্থাপনা চোখে পড়ে। এর পর ড্রাইভার দেখিয়ে দিল সামনে পাহাড়ের চুড়ায় কংক্রিটের একটি সুউচ্চ পিলার যেখানে পৃথিবীতে আসার পর আদম আর হাওয়ার প্রথম মিলন হয়েছিল, ঐতিহাসিক ভাবে কয়েক হাজার বছর পর। এই পাহাড়ের আরবি নাম 'জাবাল এ রহমত'। চলতে চলতে আরও দেখলাম অন্য আর একটি পাহাড়ের চূড়ায় স্মারকস্তম্ভ যেখান ইব্রাহিম (আঃ) তার প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে আল্লাহ্র আদেশ পালন করতে কুরবানি করতে উদ্যত ছিলেন। এর পর ফিরে আসার পথে হেরা পর্বতের পাদদেশে এসে গাড়ি থামলো। অনেকেই 'হেরা পর্বত' বলে থাকেন, আসলে হেরা একটি গুহার নাম। পর্বত বা পাহাড়টির আরবি নাম 'জাবাল এ নূর'। কি সুউচ্চ পাহাড় অথচ এই পাহাড়ের চুড়ায় সেই পবিত্র গুহায় প্রায় প্রতিদিন রাসুল (সাঃ) ধ্যান করতে আসতেন। আর এই গুহাতেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে পেয়েছিলেন প্রথম অহি, ফেরেস্তা জিবরাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে। সেই পবিত্র স্থানে একটিবারের জন্য শরীর-মন স্থিত করতে কষ্টসাধ্য হলেও কিছু মুসুল্লি পায়ে হেঁটে সেখানে উপস্থিত হন। নফল নামাজ আদায় করেন। কেমন এক স্বর্গীয় অনুভুতি জাগবে না কি সারা হৃদয়-মনে! আমার হাতে ভিডিও ক্যামেরা ছিল বলে আমি জুম করে দেখতে পেলাম কিছু মুসুল্লির আনা-গোনা। ইচ্ছে হলো খুব একবার দেখে আসতে, কিন্তু হাতে সময় নেই। ফিরে এলাম হোটেলে।
কিছুক্ষন পরই মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। পাঁচটায় বাস ছাড়বে। খুব কাছে বলে আমরা হেঁটেই বাস স্টেশানে পৌঁছলাম। একরাতের জন্য বলে প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়-চোপড় একটা বাক্সে নিয়ে বাকি সামান হোটেলেই রেখে গেলাম। বাস সময়মতই ছাড়লো। কিছুদুর যাওয়ার পর মাগরেবের ওয়াক্ত হলে একটা ছোট মসজিদের পাশে গাড়ি থামলো। মসজিদটা যেমন ছোট জায়গাটাও তেমন পরিস্কার নয়। কাগজের টুকরা, ব্যবহৃত পলিব্যাগ, ভাঙ্গাচোরা ইটপাথর এদিক-সেদিক ছড়ানো আছে। আশেপাশে অল্প কিছু বাড়িঘর দোকনপাট আছে। নামাজ আদায় শেষে সন্ধ্যা হতেই আবার রওয়ানা হ'লাম গন্তব্যের দিকে। এখানে রাতের ভ্রমন সম্ভবত: একই রকম, চারিদিকে অন্ধকারের বুক চিরে গাড়ি চলছে। শহর-উপশহরের কোন দেখা নেই। বিশাল দেশ অথচ লোকসংখ্যা একেবারেই কম। তার উপর বেশির ভাগই মরু অঞ্চল। হয়তো সেই কারনে এমন ফাঁকা ফাঁকা। মাঝে যাত্রা বিরতি ছিল ছোট্ট একটা শহরে। আমরা কিছু ফলমুল আর প্যাকেট খাবার কিনে নিলাম। অনেকেই তা করলো।
রাত প্রায় দশটায় মদিনা পৌঁছুলাম। বাস স্টেশানে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে একেবারে রাসুল (সাঃ)-এর রওজা মোবারকের সামনে মার্বেল পাথরের বিশাল আঙ্গিনার সামনের রাস্তাটার পাশে নামিয়ে দিল। এখানেও হোটেল আগেই বুক করা ছিল। চালক বলে দিল এই প্রাঙ্গন পার হয়েই ওপাশে হোটেল পেয়ে যাবো। একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো কোন হোটেলে উঠবো। নাম বললাম, সে চিনলো। বললো, ঐ তো সামনেই। হিন্দিতেই বলছিলো। কোথা থেকে এসেছি জানতে পেরে বাংলা বলা শুরু করলো। সে বাংলাদেশের ফেনি এলাকার। এখানে আছে অনেক দিন হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতেই হোটেলে এসে পড়লাম। চেক্ ইন করে দোতলা কামরায় উঠে পড়লাম। এই সময়টায় আসাতে আমরা দু'জায়গাতেই একবারে কাছাকাছি হোটেল পেয়ে গেছি। রুমের জানালা দিয়ে রওজা মোবারকের প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। যিনি আমাদের ব্যাগ বহন করে নিয়ে এলেন (এতদিন পর তার নামটা ভুলে গেছি) তাকে কিছু বকশিশ্ দিতে চাইলাম কিন্তু নিলেন না। বললেন, এখানে যারা আসেন তাদের একটু সেবা করতে পারি এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। এই সুযোগটা পেয়েছি বলে আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
খুব সত্যি কথা বলেছে সে। এমন সুযোগ কি সবার জন্য আসে! এরা দরিদ্র শ্রেনীর মানুষ। অর্থের প্রয়োজন এদেরই বেশী। নিশ্চয়ই দারিদ্রকে পরাভূত করতে কিংবা শুধু সংসারের একটু স্বচ্ছলতের জন্য কোনও একদিন দেশ পরিবার ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু এরাই আবার নিঃস্বার্থ এবং নির্লোভ হয়ে ওঠে আল্লাহ্-খোদার নামে। সন্তুষ্টি তার যতটুকু পেয়েছে, তাতেই।
রওজা মোবারক জিয়ারত করার বাসনা ব্যক্ত করতে যেয়ে তার কাছ থেকে এই প্রথম জানতে পারলাম যে রাত ন'টার পর অর্থাৎ এশার নামাজের পর মস্জিদ-এ-নববী বন্ধ থাকে যে কারনে এখন জিয়ারত করা যাবে না। আবার সেই তাহাজ্জুদ নামাজের সময় খোলা হবে।এটা অবশ্য আমাদের জানা ছিল না।
তাহাজ্জুদ নামাজের অপেক্ষায় রইলাম। ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখলাম। সময়মত উঠে কিছুক্ষন পরই তাহাজ্জুদের আজান শোনা গেল। তাহাজ্জুদের আজান হবে এটা আমাদের ধারনায় ছিল না। আমি হোটেলের জানালা দিয়ে দেখছি আজান হচ্ছে আর মুসুল্লিরা দলে দলে মসজিদের দিকে যাচ্ছে। মসজিদুল নববীতে তাহাজ্জুদ, অতঃপর ফজরের নামাজ আদায় করলাম। রসুল (সাঃ)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করলাম। সে এক অভূতপুর্ব অনুভূতি! সে এমন এক প্রশান্তি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সৃৃষ্টিকর্তার কাছে প্রানভরে কৃতজ্ঞতা জানালাম। জিয়ারত শেষে আমি একাই জান্নাতুল বাকি জিয়ারত করতে গেলাম যেখানে শায়িত আছেন রাসুলুল্লাহ্র সাহাবিগন। এখানে শায়িত আছেন তৃতীয় খলিফা ওসমান (রাঃ)। জান্নাতুল বাকি রওজা মোবারকের পাশেই অবস্থিত। মাঝে কেবল একটি প্রশস্ত রাস্তা এদিক-ওদিক চলে গেছে। বিশাল এলাকা নিয়ে এই জান্নাতুল বাকি। অসংখ্য কবর, কিন্তু কোনটাই বাঁধানো নেই। কেবল মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু করে তার উপর একটি করে মাঝারি আকারের প্রস্তর খন্ড বসানো আছে চিহ্ন হিসেবে। দু'একটি কবর দেখা যায় প্রস্তর খন্ড দিয়ে ঘের দেওয়া আছে। হয়তো বিশিষ্ট কেউ কিন্তু জানা গেল না কোন গাইড নেই বলে। এখানে সবুজের কোন চিহ্ন নেই, আছে কেবল ধু ধু মাটি।
দ্বিপ্রহরের আগের সময়টুকু মদিনার কিছু ঐতিহাসিক স্থান দেখে নেওয়ার মনস্থ করলাম। ট্যাক্সি নিয়ে বের হলাম সবাই। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জায়াগার মধ্যে একটি ছিল ওহুদ প্রান্তর, যেখানে মুসলিমদের সঙ্গে কফেরদের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এবং রাসুল (সাঃ)-এর দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছিল। ওহুদ প্রান্তের এক কোণে বীর হামজা (রাঃ)-এর কবর। যিনি বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিলেন। লোহার গ্রিল বেষ্টিত বেশ বড় এলাকার মাঝখানে তাঁর কবর। কেবলমাত্র মাটি উঁচু করে কয়েকটি পাথর বসিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা দোয়া পাঠ করলাম। প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, নিজেকে নিয়ে যেতে চাই চৌদ্দশত বছর আগের দিনটিতে। আমি দেখতে পাচ্ছি সেই যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে ঢাল-তলোয়ারের টুং-টাং শব্দ হচ্ছে আর ধ্বনিত হচ্ছে 'আল্লাহু আকবার'। আমি এদিক-ওদিক হাঁটি, পাহাড়টার পাদদেশ গিয়ে দাঁড়াই। মনে হয় যেন এখানেই রাসুল (সাঃ) দাঁড়িয়েছিলেন। পাহাড়ের পাদদেশটাতে তো নিশ্চয়ই। আরও কত সাহাবীর পদভার ছিল এখানে। আমি অনুভূতি নেয়ার চেষ্টা করি। মক্কাতে যেমন দেখেছি, এখানেও তেমনি দেখলাম সব পাহাড়ই খুব বিরস কঠিন কালো রঙের হয়ে থাকে, কোন গাছ-গাছড়া নেই বললেই চলে। মক্কাতে ব্যাপারটা বেশি মাত্রায় দৃষ্টিগোচর হয়। তবে মদিনার আবহাওয়া এবং পরিবেশ মক্কার চেয়ে কিছুটা ভাল মনে হলো।
আরও অনেক জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারনে তা আর হয়ে উঠলো না। জোহরের নামাজ মসজিদুল নববীতে আদায় করবো বলে বেশি দেরি না করে হোটেলে ফিরে আসি। ওজু-গোসল সেরে আমি এবং স্ত্রী দু'জনে মিলে মসজিদে চলে যাই। নামাজ শেষেও বেশ কিছুক্ষন বসে থাকে। ঘুরে ঘুরে দেখি এদিক সেদিক। একটা জায়গায় দেখলাম বড় বড় ছাতা গুটিয়ে রাখা আছে। ওগুলো ইলেক্ট্রিক ছাতা। বৃষ্টি বা রোদ বেশি হলে সুইচ টিপে ওগুলো মেলিয়ে দেওয়া হয় মুসল্লিদের ছায়া দেওয়ার জন্য। সৌদি আরবের এখন সম্পদশালী দেশ, সুতরাং যে কোন কিছুই এখন আরামপ্রদ এবং নয়ানভিরাম করতে পারেই।
দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এলো। হোটেলে ফিরে গতরাতের সেই ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম পাশেই কয়েকটি রেস্তোরাঁ আছে। সে বিশেষ করে একটিকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, বাঙ্গালী খাবার খেতে হলে এই হোটেলে চলে যান। তাই করলাম এবং বলতে দ্বিধা নেই খুবই খাবার ছিল খুমই স্বাদের। এই রেস্তরাঁর মালিক পাকিস্তানী। মাছ-মাংস-ডাল সবই পাওয়া যায়। খাবার শেষে আশে-পাশে রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে ঢু মারলাম। কেনা-কাটার চিন্তা সম্ভবতঃ কিছুই নেই। তবুও যদি চোখে কিছু পড়ে যায়। আমি দেখলাম বেশ কিছু দোকানের মালিক বাংলাদেশের। চেহারা-সুরত দেখেই বুঝা যাচ্ছিল বলেই জিজ্ঞেস করে জানতে পারি। এদের দোকান সবই প্রায় একই রকম, অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র। গ্রোসারী ধরনের। পাশাপাশি টুপি-জায়নামাজ তো আছেই। আমার পরিবার অন্যদিকের ব্যস্ত, আমি এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, যার বয়স ২৫/২৬-এর বেশি হবে না, সে কেমন আছে, তার ব্যবসা কেমন চলছে। সে প্রায় উষ্মা দেখিয়ে বললো, এ দেশে আর থাকা যাবেনা। সরকার যেভাবে ব্যবসার উপর ট্যাক্স বসিয়েছে তাতে আর ব্যবসা থাকবে না। চলে যাবো।
শুনলাম সৌদী সরকার কি এক ট্যাক্স বসিয়েছে ইদানিং, যে কারনে এরা বিরক্ত। আমিও একটু বিরক্ত হলাম এই বাঙ্গালী লোকটির এইরকম কথা শুনে। নবীজির রওজা মোবারকের পাশে বসে এই রকম উষ্মা প্রকাশ ঠিক নয়। জানতে চাইলাম, তোমার কি কিছুই লাভ থাকবে না? সে বললো, আগে যা থাকতো তার চেয়ে এখন অনেক কম হবে। আমি বললাম, তুমি নবীজির রওজা মোবারকের পাশে বসে ব্যবসা করছো। প্রতিদিন এখানে আসতে পারছো, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি আছে? লাভ না হয় একটু কমই করলে!
আমর কথা শুনে সে চুপ করে রইলো। এরা আসলে আসে জীবিকার তাগিদেই, আর কিছু নয়।
হোটেলের নিচ থেকেই কিছু খোরমা-খেজুর কিনে হোটেল কক্ষে ফিরলাম সবাই। বিকাল পাঁচটায় ফের মক্কায় ফিরে যাবো। গোছ-গাছ করে বাস স্টেশনে পৌছলাম। দেখলাম অনেক লোক। ওয়েটিং রুমে কোন রকমে বসার জায়গা পাওয়া গেল। হাতে টিকেট থাকলেও সেটা আবার কাউন্টারে গিয়ে রিকনফার্ম করে সিট নিতে হবে। এখানে সবাই সৌদী। কারও কথাই বুঝতে পারছি না। কোন রকমে পৌঁছে টিকেট রিকনফোর্ম করলাম। ঘোষনা করা হলো বাস ছাড়বে মাগরেব নামাজের পর। এখন শীতের সময়, দিন ছোট। পাঁচটার পরই বেলা ডুবে যায়। সুতরাং পাশে মসজিদে আছর নামাজ আদায় করে নিতে বলা হলো। মসজিদ কোন্ দিকে! এরা কেউ ইংরেজি বুঝে না, হিন্দিও না। যাই হোক, মসজিদ শব্দটা কমন ছিল বলে রক্ষা। কিন্তু জবাবে যা বললো তাতে কোন রকমে দিকটা বুঝা গেল। সেই দিকে যেয়ে মসজিদটা খুঁজে পেলাম। খুব কাছেই আসলে। দু'চারটে বাড়ি-ঘরের আড়ালে। দোতলা মসজিদ। যেতে যেতেই জামাত শুরু হয়ে গেল।
বাস যখন ছাড়লো তখন চারিদিকে প্রায়ান্ধকার। আমরা ক্লান্ত শ্রান্ত। গা এলিয়ে দিয়ে সবাই প্রায় ঘুমিয়ে গেলাম। বাইরে দেখারও কিছু নেই অন্ধকার ছাড়া। ঘন্টা দুই চলার পর গাড়ি থেমে গেল এক মসজিদের পাশে। যাত্রা বিরতি এশার নামাজ এবং নিজস্ব সময়ের জন্য। এই জায়গাটা মনোরম লাগলো। মসজিদটা বেশ বড়, ছিমছাম। গাছপালা আছে চারিদিকে। খুব বেশি আলো নয়, আবার কমও নয়। এরকমটাই ভাল লাগলো আমার কাছে। গাছের নিচে কিংবা আশেপাশে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দোকান দেখলাম, ফল-ফলাদি আর কিছু খাবারের। দু'একজন ফেরি করছে পানীয়-জুস, বিস্কুট, ইত্যাদি। আমারা সবাই নামাজ আদায় করে নিলাম। মেয়েদেরও নামাজের ব্যবস্থা আছে এখানে। নামাজ শেষে আমার পরিবারের সবাইকে বাসে চলে যেতে বলে আমি কিছু খাবার কিনতে গেলাম। কারন এর পর বাস আর কোথাও থামবে না। কিছু ফল বিস্কুট আর জুস কিনে বাসে ফিরে দেখি আমার ছেলে-মেয়েরা তাদের মায়ের সেবা-শুশ্রূষায় ব্যস্ত। কারন জানলাম তিনি বাসে উঠতে যেয়ে সম্ভবতঃ পা পিছলে পড়ে যেয়ে ব্যথা পেয়েছেন। তবে ভাগ্যিস অতটা গুরুতর নয়! রাত দশটার কিছু পরে আমরা মক্কায় এসে পৌঁছলাম।
পরদিন ফজরের পর আমরা দু'জন আরও একবার ওমারাহ্ পালন করলাম। এবার শুধুই আমরা স্বামী-স্ত্রী। আমি আমার বৃদ্ধ আব্বার জন্য আর আমার স্ত্রী আমার শ্বশুরের জন্য। শেষবারের মত হারাম শরীফে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। হোটেলে ফিরে দুূপুরের খাবার সেরে তৈরি হয়ে নিলাম এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় আমাদের ফ্লাইট। দুবাইতে থাকবো একদিন, তার পরদিন বাংলাদেশ।
ট্যাক্সি ছুটে চলেছে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। তিনটি দিন চরম ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছি, কিন্তু পরম সন্তুষ্টি আর আত্মতৃপ্তি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। পরম করুনাময়ের কাছে কৃতজ্ঞে মন ভরে ওঠে। আমার মত একজন পাপিষ্ঠকে তিনি দয়া করে সুযোগ দিয়েছেন তাঁর পবিত্র ঘর হিজরত করতে, তাঁর প্রিয় হাবিব আর আমাদের প্রানপ্রিয় নবীজির রওজা মোবারক জিয়ারত করতে। যিনি বিচারদিনের মালিক, সেই মহাবিচারকের কাছে আমি আমার দরখাস্ত পেশ করে ফিরে চলেছি। মন্ঞ্জুর করার মালিক তিনি। আমি পিছন ফিরে তাকাই। আমার চোখ দু'টো জলে ভিজে ওঠে।
©somewhere in net ltd.