![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি খুবই সাদামাটা একজন মানুষ। শখের বশে লেখালেখি শুরু করেছি। চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু লেখার। পছন্দ করি বই পড়তে।
হেপাটাইটিস—এই নামটি শুনলে হয়তো অনেকের মনে এক অজানা ভয়ের সৃষ্টি হয়। এটি লিভারের এক ধরনের প্রদাহ, যা ধীরে ধীরে লিভারকে অকেজো করে তোলে। এর নীরব চরিত্রের কারণে হেপাটাইটিসকে 'নীরব ঘাতক' রোগ বলা হয়। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত, যাদের অনেকেই নিজেদের অজান্তেই লিভারের গুরুতর ক্ষতি করে ফেলেন। হেপাটাইটিস মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, লিভারকে সরাসরি আক্রমণ করে, যা শেষ পর্যন্ত লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের মতো মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।
প্রতি বছর ২৮ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এই দিনটি হেপাটাইটিস সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে এবং এর প্রতিরোধ, পরীক্ষা ও চিকিৎসার গুরুত্ব তুলে ধরতে উৎসর্গীকৃত। ২০২৫ সালের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস আমাদের এক বিশেষ বার্তা নিয়ে এসেছে, যা এই নীরব মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ২০২৫: প্রতিপাদ্য ও তার তাৎপর্য
২০২৫ সালের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য হলো: "Hepatitis Can't Wait – Test. Treat. Prevent." যার বাংলা অর্থ: "হেপাটাইটিস অপেক্ষা করে না – পরীক্ষা করুন, চিকিৎসা নিন, প্রতিরোধ করুন।"
এই প্রতিপাদ্যটি হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। হেপাটাইটিস শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের প্রতিটি ধাপে সময় নষ্ট না করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন হেপাটাইটিস সম্পর্কিত কারণে মারা যান। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে, হেপাটাইটিস আমাদের জন্য অপেক্ষা করে না; তাই আমাদেরও হেপাটাইটিসের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে হেপাটাইটিসের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। দ্রুত পরীক্ষা, সময়োপযোগী চিকিৎসা ও কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তাই এই প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
হেপাটাইটিস কী এবং কেন এটি নীরব ঘাতক?
হেপাটাইটিস হলো লিভারের প্রদাহ বা ফোলাভাব। আমাদের শরীর পরিচালনায় লিভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে—এটি রক্ত পরিশোধিত করে, পুষ্টি উপাদান প্রক্রিয়াজাত করে এবং হজমে সহায়তা করে। যখন লিভারে প্রদাহ হয়, তখন লিভারের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। হেপাটাইটিস সাধারণত ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয় (যেমন হেপাটাইটিস A, B, C, D, E ভাইরাস), তবে অ্যালকোহল, নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ বা অন্যান্য রোগও এর কারণ হতে পারে।
এই রোগকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয় কারণ, এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রায়শই মৃদু বা অনুপস্থিত থাকে। অনেকে বছরের পর বছর ধরে আক্রান্ত থাকার পরেও কোনো গুরুতর লক্ষণ অনুভব করেন না। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, ততক্ষণে লিভারের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়, যা লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। এই দীর্ঘসূত্রতাই হেপাটাইটিসকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
হেপাটাইটিসের প্রকারভেদ ও সংক্রমণ পথ
হেপাটাইটিস মূলত পাঁচ ধরনের ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়, এবং প্রতিটি প্রকারের সংক্রমণ পদ্ধতি, তীব্রতা ও প্রভাব ভিন্ন হয়:
হেপাটাইটিস A (HAV): এটি সাধারণত দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। এটি তীব্র বা স্বল্পমেয়াদী রোগ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিভারের স্থায়ী ক্ষতি করে না এবং সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
হেপাটাইটিস B (HBV): এটি রক্ত, বীর্য বা অন্যান্য শারীরিক তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি দীর্ঘমেয়াদী বা ক্রনিক হতে পারে এবং লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ। মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যেও এটি ছড়াতে পারে।
হেপাটাইটিস C (HCV): এটিও মূলত রক্তবাহিত। দূষিত রক্ত, ইনজেকশনের সুঁইয়ের পুনঃব্যবহার এবং অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। হেপাটাইটিস C দীর্ঘমেয়াদী হয় এবং লিভার ক্যানসারের একটি বড় কারণ। এর কোনো টিকা নেই, তবে নতুন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধে এটি নিরাময়যোগ্য।
হেপাটাইটিস D (HDV): এটি কেবল হেপাটাইটিস B ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরেই দেখা যায়। এটি হেপাটাইটিস B-এর জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
হেপাটাইটিস E (HEV): এটি হেপাটাইটিস A-এর মতোই দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত এটি তীব্র ও স্বল্পমেয়াদী হয়, তবে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে।
হেপাটাইটিসের লক্ষণ ও উপসর্গ
হেপাটাইটিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অস্পষ্ট হওয়ায় রোগ শনাক্ত করা কঠিন হয়। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:
প্রাথমিক লক্ষণ: জ্বর, ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি, ক্ষুধামন্দা, হালকা জ্বর।
গুরুতর লক্ষণ: যখন রোগ আরও বাড়ে, তখন চোখ ও ত্বকের হলুদ ভাব (জন্ডিস), গাঢ় প্রস্রাব এবং ফ্যাকাশে মল দেখা দিতে পারে।
জটিলতার লক্ষণ: লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়া, পেটে পানি জমা (অ্যাসাইটিস), পা ফোলা, রক্তক্ষরণ এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তন (হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি) ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধ: নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন
হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই রোগের বিস্তার রোধ করা যায়:
টিকা (Vaccination): হেপাটাইটিস A এবং B-এর জন্য নিরাপদ ও কার্যকর টিকা পাওয়া যায়। শিশুদের জন্মের পরপরই হেপাটাইটিস B-এর টিকা দেওয়া হয়। ভ্রমণকারীদের জন্য হেপাটাইটিস A-এর টিকা সুপারিশ করা হয়।
নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন: রক্ত গ্রহণ বা রক্ত দান করার সময় নিশ্চিত করা উচিত যে রক্ত হেপাটাইটিস মুক্ত। সমস্ত রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি।
সুরক্ষিত যৌন আচরণ: হেপাটাইটিস B ও C যৌন সংক্রামক হওয়ায়, সুরক্ষিত যৌন আচরণ অবলম্বন করা উচিত।
দূষণমুক্ত খাদ্য ও পানি: হেপাটাইটিস A ও E প্রতিরোধে বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানি গ্রহণ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
চিকিৎসা ব্যবহারে সতর্কতা: ইনজেকশন নেওয়ার সময় ডিসপোজেবল সুঁই ব্যবহার করা এবং ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করার সময় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জামের ব্যবহার নিশ্চিত করা। সেলুন, পার্লার বা ডেন্টাল ক্লিনিকে ব্যবহৃত সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখা।
পরীক্ষা: জেনে নিন আপনার অবস্থা
দ্রুত শনাক্তকরণ হেপাটাইটিসের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে হেপাটাইটিস নির্ণয় করা যায়:
ব্লাড টেস্ট: হেপাটাইটিস B-এর জন্য HBsAg (হেপাটাইটিস B সারফেস অ্যান্টিজেন) এবং হেপাটাইটিস C-এর জন্য Anti-HCV পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাগুলো ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করে।
লিভার ফাংশন টেস্ট (LFT): এই পরীক্ষা লিভারের এনজাইম (ALT, AST) এবং বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করে লিভারের ক্ষতির পরিমাণ বা কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে।
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি: লিভারের আকার, গঠন এবং কোনো অস্বাভাবিকতা যেমন—সিরোসিস বা ক্যানসারের লক্ষণ দেখতে সহায়তা করে।
লিভার বায়োপসি: কিছু ক্ষেত্রে লিভারের টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করা হয় লিভারের ক্ষতির মাত্রা সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য।
বিশেষ করে, যদি আপনার হেপাটাইটিস B বা C সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে (যেমন—রক্ত গ্রহণ, অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, বা পরিবারের কারো হেপাটাইটিস থাকলে), তাহলে নিয়মিত পরীক্ষা করানো উচিত।
চিকিৎসা: সময়মতো পদক্ষেপ নিন
হেপাটাইটিসের চিকিৎসা রোগের প্রকার ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে:
হেপাটাইটিস A ও E: সাধারণত নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, বিশ্রাম ও সহায়ক চিকিৎসাতেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
হেপাটাইটিস B: এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না হলেও, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ভাইরাসের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে লিভারের ক্ষতি কমাতে পারে। আক্রান্তদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হয়।
হেপাটাইটিস C: নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ (DAAs) দিয়ে এটি ৯৫% এর বেশি ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য। এই ওষুধগুলো সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রোগীকে সুস্থ করে তোলে।
নিয়মিত ফলোআপ: হেপাটাইটিস B ও C-তে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ ও ফলোআপের মধ্যে থাকা জরুরি, এমনকি চিকিৎসা সফল হলেও।
লিভার সিরোসিস বা ক্যানসার প্রতিরোধ: সময়মতো চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনে লিভারের গুরুতর জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়েট ও জীবনধারা পরিবর্তন: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অ্যালকোহল পরিহার এবং নিয়মিত ব্যায়াম লিভারের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
হেপাটাইটিস ও বাংলাদেশ: একটি পর্যালোচনা
বাংলাদেশে হেপাটাইটিসের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশেষ করে হেপাটাইটিস B ও C এখানে একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৫.৫% মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। এই বিশাল সংখ্যক মানুষ নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস নিয়ে বসবাস করছে, যাদের অনেকেই রোগ সম্পর্কে অবগত নন।
বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। জাতীয় টিকা কর্মসূচির আওতায় শিশুদের হেপাটাইটিস B-এর টিকা দেওয়া হচ্ছে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তবাহিত সংক্রমণ রোধের চেষ্টা চলছে। তবে এখনও জনসচেতনতার অভাব, পরীক্ষা ও চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়, এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা বড় চ্যালেঞ্জ।
করণীয়: আপনি কী করতে পারেন?
হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
নিজে সচেতন হোন: হেপাটাইটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানুন।
নিয়মিত টেস্ট করুন: আপনার হেপাটাইটিস B ও C-এর ঝুঁকি থাকলে, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করান। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে কার্যকর চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব।
পরিবার-পরিজনকে সচেতন করুন: আপনার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের হেপাটাইটিস সম্পর্কে জানান এবং তাদেরও পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করুন।
সঠিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন: ভুল তথ্য পরিহার করুন এবং নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য সংস্থা (যেমন—WHO, স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ) থেকে তথ্য নিন।
আসুন সচেতন হই
হেপাটাইটিস একটি গুরুতর রোগ হলেও এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য। ২০২৫ সালের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য "হেপাটাইটিস অপেক্ষা করে না – পরীক্ষা করুন, চিকিৎসা নিন, প্রতিরোধ করুন" আমাদের একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়। সময় নষ্ট না করে আজই হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতন হোন। আপনার সামান্য সচেতনতা এবং সক্রিয় ভূমিকা এই নীরব ঘাতক রোগ থেকে আপনাকে, আপনার পরিবারকে এবং সমাজকে রক্ষা করতে পারে। আসুন, হেপাটাইটিস-মুক্ত বিশ্ব গড়তে সম্মিলিতভাবে কাজ করি।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক
হেপাটাইটিস—এই নামটি শুনলে হয়তো অনেকের মনে এক অজানা ভয়ের সৃষ্টি হয়। এটি লিভারের এক ধরনের প্রদাহ, যা ধীরে ধীরে লিভারকে অকেজো করে তোলে। এর নীরব চরিত্রের কারণে হেপাটাইটিসকে 'নীরব ঘাতক' রোগ বলা হয়। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত, যাদের অনেকেই নিজেদের অজান্তেই লিভারের গুরুতর ক্ষতি করে ফেলেন। হেপাটাইটিস মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, লিভারকে সরাসরি আক্রমণ করে, যা শেষ পর্যন্ত লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের মতো মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।
প্রতি বছর ২৮ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এই দিনটি হেপাটাইটিস সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে এবং এর প্রতিরোধ, পরীক্ষা ও চিকিৎসার গুরুত্ব তুলে ধরতে উৎসর্গীকৃত। ২০২৫ সালের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস আমাদের এক বিশেষ বার্তা নিয়ে এসেছে, যা এই নীরব মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ২০২৫: প্রতিপাদ্য ও তার তাৎপর্য
২০২৫ সালের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য হলো: "Hepatitis Can't Wait – Test. Treat. Prevent." যার বাংলা অর্থ: "হেপাটাইটিস অপেক্ষা করে না – পরীক্ষা করুন, চিকিৎসা নিন, প্রতিরোধ করুন।"
এই প্রতিপাদ্যটি হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। হেপাটাইটিস শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের প্রতিটি ধাপে সময় নষ্ট না করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন হেপাটাইটিস সম্পর্কিত কারণে মারা যান। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে, হেপাটাইটিস আমাদের জন্য অপেক্ষা করে না; তাই আমাদেরও হেপাটাইটিসের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে হেপাটাইটিসের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। দ্রুত পরীক্ষা, সময়োপযোগী চিকিৎসা ও কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তাই এই প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
হেপাটাইটিস কী এবং কেন এটি নীরব ঘাতক?
হেপাটাইটিস হলো লিভারের প্রদাহ বা ফোলাভাব। আমাদের শরীর পরিচালনায় লিভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে—এটি রক্ত পরিশোধিত করে, পুষ্টি উপাদান প্রক্রিয়াজাত করে এবং হজমে সহায়তা করে। যখন লিভারে প্রদাহ হয়, তখন লিভারের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। হেপাটাইটিস সাধারণত ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয় (যেমন হেপাটাইটিস A, B, C, D, E ভাইরাস), তবে অ্যালকোহল, নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ বা অন্যান্য রোগও এর কারণ হতে পারে।
এই রোগকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয় কারণ, এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রায়শই মৃদু বা অনুপস্থিত থাকে। অনেকে বছরের পর বছর ধরে আক্রান্ত থাকার পরেও কোনো গুরুতর লক্ষণ অনুভব করেন না। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, ততক্ষণে লিভারের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়, যা লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। এই দীর্ঘসূত্রতাই হেপাটাইটিসকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
হেপাটাইটিসের প্রকারভেদ ও সংক্রমণ পথ
হেপাটাইটিস মূলত পাঁচ ধরনের ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়, এবং প্রতিটি প্রকারের সংক্রমণ পদ্ধতি, তীব্রতা ও প্রভাব ভিন্ন হয়:
হেপাটাইটিস A (HAV): এটি সাধারণত দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। এটি তীব্র বা স্বল্পমেয়াদী রোগ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিভারের স্থায়ী ক্ষতি করে না এবং সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
হেপাটাইটিস B (HBV): এটি রক্ত, বীর্য বা অন্যান্য শারীরিক তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি দীর্ঘমেয়াদী বা ক্রনিক হতে পারে এবং লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ। মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যেও এটি ছড়াতে পারে।
হেপাটাইটিস C (HCV): এটিও মূলত রক্তবাহিত। দূষিত রক্ত, ইনজেকশনের সুঁইয়ের পুনঃব্যবহার এবং অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। হেপাটাইটিস C দীর্ঘমেয়াদী হয় এবং লিভার ক্যানসারের একটি বড় কারণ। এর কোনো টিকা নেই, তবে নতুন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধে এটি নিরাময়যোগ্য।
হেপাটাইটিস D (HDV): এটি কেবল হেপাটাইটিস B ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরেই দেখা যায়। এটি হেপাটাইটিস B-এর জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
হেপাটাইটিস E (HEV): এটি হেপাটাইটিস A-এর মতোই দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত এটি তীব্র ও স্বল্পমেয়াদী হয়, তবে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে।
হেপাটাইটিসের লক্ষণ ও উপসর্গ
হেপাটাইটিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অস্পষ্ট হওয়ায় রোগ শনাক্ত করা কঠিন হয়। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:
প্রাথমিক লক্ষণ: জ্বর, ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি, ক্ষুধামন্দা, হালকা জ্বর।
গুরুতর লক্ষণ: যখন রোগ আরও বাড়ে, তখন চোখ ও ত্বকের হলুদ ভাব (জন্ডিস), গাঢ় প্রস্রাব এবং ফ্যাকাশে মল দেখা দিতে পারে।
জটিলতার লক্ষণ: লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়া, পেটে পানি জমা (অ্যাসাইটিস), পা ফোলা, রক্তক্ষরণ এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তন (হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি) ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধ: নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন
হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই রোগের বিস্তার রোধ করা যায়:
টিকা (Vaccination): হেপাটাইটিস A এবং B-এর জন্য নিরাপদ ও কার্যকর টিকা পাওয়া যায়। শিশুদের জন্মের পরপরই হেপাটাইটিস B-এর টিকা দেওয়া হয়। ভ্রমণকারীদের জন্য হেপাটাইটিস A-এর টিকা সুপারিশ করা হয়।
নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন: রক্ত গ্রহণ বা রক্ত দান করার সময় নিশ্চিত করা উচিত যে রক্ত হেপাটাইটিস মুক্ত। সমস্ত রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি।
সুরক্ষিত যৌন আচরণ: হেপাটাইটিস B ও C যৌন সংক্রামক হওয়ায়, সুরক্ষিত যৌন আচরণ অবলম্বন করা উচিত।
দূষণমুক্ত খাদ্য ও পানি: হেপাটাইটিস A ও E প্রতিরোধে বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানি গ্রহণ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
চিকিৎসা ব্যবহারে সতর্কতা: ইনজেকশন নেওয়ার সময় ডিসপোজেবল সুঁই ব্যবহার করা এবং ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করার সময় জীবাণুমুক্ত সরঞ্জামের ব্যবহার নিশ্চিত করা। সেলুন, পার্লার বা ডেন্টাল ক্লিনিকে ব্যবহৃত সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখা।
পরীক্ষা: জেনে নিন আপনার অবস্থা
দ্রুত শনাক্তকরণ হেপাটাইটিসের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে হেপাটাইটিস নির্ণয় করা যায়:
ব্লাড টেস্ট: হেপাটাইটিস B-এর জন্য HBsAg (হেপাটাইটিস B সারফেস অ্যান্টিজেন) এবং হেপাটাইটিস C-এর জন্য Anti-HCV পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাগুলো ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করে।
লিভার ফাংশন টেস্ট (LFT): এই পরীক্ষা লিভারের এনজাইম (ALT, AST) এবং বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করে লিভারের ক্ষতির পরিমাণ বা কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে।
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি: লিভারের আকার, গঠন এবং কোনো অস্বাভাবিকতা যেমন—সিরোসিস বা ক্যানসারের লক্ষণ দেখতে সহায়তা করে।
লিভার বায়োপসি: কিছু ক্ষেত্রে লিভারের টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করা হয় লিভারের ক্ষতির মাত্রা সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য।
বিশেষ করে, যদি আপনার হেপাটাইটিস B বা C সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে (যেমন—রক্ত গ্রহণ, অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, বা পরিবারের কারো হেপাটাইটিস থাকলে), তাহলে নিয়মিত পরীক্ষা করানো উচিত।
চিকিৎসা: সময়মতো পদক্ষেপ নিন
হেপাটাইটিসের চিকিৎসা রোগের প্রকার ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে:
হেপাটাইটিস A ও E: সাধারণত নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, বিশ্রাম ও সহায়ক চিকিৎসাতেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
হেপাটাইটিস B: এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না হলেও, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ভাইরাসের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে লিভারের ক্ষতি কমাতে পারে। আক্রান্তদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হয়।
হেপাটাইটিস C: নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ (DAAs) দিয়ে এটি ৯৫% এর বেশি ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য। এই ওষুধগুলো সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রোগীকে সুস্থ করে তোলে।
নিয়মিত ফলোআপ: হেপাটাইটিস B ও C-তে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ ও ফলোআপের মধ্যে থাকা জরুরি, এমনকি চিকিৎসা সফল হলেও।
লিভার সিরোসিস বা ক্যানসার প্রতিরোধ: সময়মতো চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনে লিভারের গুরুতর জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়েট ও জীবনধারা পরিবর্তন: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অ্যালকোহল পরিহার এবং নিয়মিত ব্যায়াম লিভারের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
হেপাটাইটিস ও বাংলাদেশ: একটি পর্যালোচনা
বাংলাদেশে হেপাটাইটিসের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশেষ করে হেপাটাইটিস B ও C এখানে একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৫.৫% মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। এই বিশাল সংখ্যক মানুষ নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস নিয়ে বসবাস করছে, যাদের অনেকেই রোগ সম্পর্কে অবগত নন।
বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। জাতীয় টিকা কর্মসূচির আওতায় শিশুদের হেপাটাইটিস B-এর টিকা দেওয়া হচ্ছে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তবাহিত সংক্রমণ রোধের চেষ্টা চলছে। তবে এখনও জনসচেতনতার অভাব, পরীক্ষা ও চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়, এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা বড় চ্যালেঞ্জ।
করণীয়: আপনি কী করতে পারেন?
হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
নিজে সচেতন হোন: হেপাটাইটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানুন।
নিয়মিত টেস্ট করুন: আপনার হেপাটাইটিস B ও C-এর ঝুঁকি থাকলে, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করান। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে কার্যকর চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব।
পরিবার-পরিজনকে সচেতন করুন: আপনার পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের হেপাটাইটিস সম্পর্কে জানান এবং তাদেরও পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করুন।
সঠিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন: ভুল তথ্য পরিহার করুন এবং নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য সংস্থা (যেমন—WHO, স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ) থেকে তথ্য নিন।
আসুন সচেতন হই
হেপাটাইটিস একটি গুরুতর রোগ হলেও এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য। ২০২৫ সালের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য "হেপাটাইটিস অপেক্ষা করে না – পরীক্ষা করুন, চিকিৎসা নিন, প্রতিরোধ করুন" আমাদের একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়। সময় নষ্ট না করে আজই হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতন হোন। আপনার সামান্য সচেতনতা এবং সক্রিয় ভূমিকা এই নীরব ঘাতক রোগ থেকে আপনাকে, আপনার পরিবারকে এবং সমাজকে রক্ষা করতে পারে। আসুন, হেপাটাইটিস-মুক্ত বিশ্ব গড়তে সম্মিলিতভাবে কাজ করি।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক
©somewhere in net ltd.