নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার পরিচয় একজন ব্লগার, আমি সাহসী, আমি নির্ভীক, আমি আপোষহীন । যা বিশ্বাস করি তাই লিখি তাই বলি ।
ভদ্রলোকের চোখে মুখে এবার বিষণ্ণ ভাব জেগে উঠলো । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "এক্সিডেন্ট করে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়ার ধরুণ কোমায় চলে গেছে । অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন । আর ফিরবেন বলে মনে হয় না । তবুও ডেকেছে যখন, তখন যাচ্ছি । দেখি গিয়ে যদি কিছু করতে পারি ।"
চেরাগ আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি চিকিৎসক ?
আমার প্রশ্ন শুনে চেরাগ আলী এবার আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "আমাকে আপনি মনোবিজ্ঞানী বলতে বলতে পারেন আবার তান্ত্রিক ও বলতে পারেন । মনস্তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করি ।
আমি "ও" বলে একটু থেমে থেকে আবার প্রশ্ন করলাম, তা, চিকিৎসকেরা কি শেষ কথা বলে দিয়েছে?
হুম তেমনটাই শুনলাম৷ তারা নাকি বলেছে আর কোন আশা নেই । লাইফ সার্পোট খুলে ফেললে খরচ বেঁচে যাবে । যমে মানুষে টানাটানিতে যম জিতে যাচ্ছে ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভারাক্রান্তু হৃদয়ে বললাম, কিছু মনে করবেন না , একটা প্রশ্ন করি ?
চেরাগ আলী মাথা নেড়ে বললো, "আপনার মনে যে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, সেটা আমি জানি । আপনি জানতে চাইছেন, যেখানে চিকিৎসকেরা ফেল করে যাচ্ছে সেখানে আমি গিয়ে কি করবো ,তাই না ?
আমি, হ্যা সূর্চক মাথা নাড়লাম ।
শুনুন, চেরাগ আলী বলতে শুরু করলেন ,জগতে এমন অনেক কিছু আছে যা মানুষের আয়ত্বের বাহিরে । কোমা হচ্ছে, মস্তিস্কে আঘাতজনিত জটিল একটি অবস্থা ।মস্তিস্ক অর্কেজ হয়ে পরলে দেহ আর কাজ করে না । সকল অনুভুতি মরে যায় । আর একটু সহজ করে যদি বলি তাহলে বলা যায়, কোমার কাছাকাছি দু'টি অবস্থা আছে । একটি ‘ব্রেইন ডেথ’ অন্যটি ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’। ব্রেইন ডেথ হলো, মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি । সেক্ষেত্র মস্তিষ্ক তার সব কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে। এমনটা হলে রোগীকে ফিরে পাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে ।
পক্ষান্তরে,"ভেজিটেটিভ স্টেট" এ স্তরে, রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, কিন্তু চেতনা দিয়ে বা স্বেচ্ছায় কিছু করতে পারে না। এ অবস্থায় থাকলে, মনস্তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর জ্ঞান ফিরিয়ে আনা সম্ভব । বিষয়টা জটিল কিন্তু অসম্ভব নয় । দেখি গিয়ে; কিছু করার থাকলে, করবো ।
ভদ্রলোকের কথায় কোমা সর্ম্পকে খুব সহজে একটা ধারণা পেলাম । সেই সঙ্গে কোমায় চলে যাওয়া ব্যক্তির জন্য হৃদয়টা ব্যথায় ছেয়ে গেলো । আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললাম, চিন্তা করবেন না । দেখবেন , উনি ভালো হয়ে যাবে; ইনশা আল্লাহ্ ।
চেরাগ আলী এবার মৃদু হেসে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন, "দোয়া করবেন।"
বাকি পথটুকু আমাদের আর কোন কথা হলো না । অপরিচিতের ন্যায় দু'জন চুপচাপ বসে রইলাম । চেরাগ আলী নেমে গেলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে । আমি জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানালাম । গাজিপুর চলে আসায় ভাড়া দেওয়ার জন্য কন্টাক্টর ডাকতেই সে বললো, আপনার বন্ধু আপনার ভাড়া দিয়ে দিয়ে গেছেন ।
মনে মনে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম । এতো সামান্য পরিচয়ে কেউ কারো জন্য এমনটা করে।
সেদিনের পর থেকে চেরাগ আলীর সাথে আমার প্রায়ই প্রতিদিনই দেখা হতে লাগলো । উনি ওনার অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যান । আমি যাই উত্তরায় । দেখতে দেখতে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলো । আধ্যাত্মিক বিষয় টিষয়ের উপর আমার ভক্তি টক্তি না থাকলেও ভদ্রলোকের জ্ঞান আর প্রজ্ঞা তার প্রতি আমাকে অনুরক্ত করে তুলল । ধীরে ধীরে আমি ওনার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠলাম ।
সেদিন অফিসে পৌঁছে নিজের আসনে বসে সবে মাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি এমন সময় রিসিপশনিস্ট ফোন করে জানালো এক ভদ্রলোক এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান । নাম জিজ্ঞেস করাতে সে জানালো, ভদ্রলোকের নাম, নিতুন রায় । এই নামে কাউকে চিনি না । আমার সঙ্গে কি দরকার জানতে চাইলে, ভদ্রলোক রিসিপশনিস্ট'কে জানালেন , প্রয়োজনটা তিনি সামনা সামনি বলবেন । অগত্যা ওয়েটিং রুমে ভদ্রলোককে বসাতে বলে। ধীরে সুস্থে চা শেষ করে প্রায় মিনিট পনেরো পরে গেলাম নিতুন রায়ের সঙ্গে দেখা করতে ।
ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখি ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত ষাট পয়ষট্টি বছরের এক প্রোঢ় টিবিলের উপর দু'হাত রেখে বসে আছেন। আমাকে ঢুকতে দেখে তিনি উঠে দাঁড়াতে গেলেন । আমি বাধা দিয়ে বললাম আরে উঠেছেন কেন? বসুন প্লিজ । ভদ্রলোক আবার চেয়ারে বসে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ।
আমিও লোকটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। মাথা ভর্তি ঝাঁকালো, কাচা পাকা চুল। চোখে সোনালী ফেম্রে বাধানো দামী চশমা । গায়ের রং হালকা বাদামি ফর্সা । পাশেই টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা পিতলের কারুকার্য খচিত একটা ছড়ি। ভদ্রলোকের সবকিছুতেই আভিজাত্যের পরিপূর্ণ রূপ ফুটে উঠেছে ।
আমি চেয়ারে বসতে বসতে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে ।
প্রৌঢ় ভদ্র লোক সেটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার নামই তাহলে বাবন ?"
আমি হ্যা সূচক মাথা নেড়ে বললাম, জি হ্যা আমিই বাবন । বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি ?
ভদ্রলোক বললেন, বেশ , বেশ । আমাকে আপনি চিনবেন না বাবা । নিতান্ত বাধ্য হয়ে আপনার কাছে এসেছি । অনেক কষ্ট হয়েছে আপনার ঠিকানা খুজে বের করতে।বাড্ডায় আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম । আপনার বাবার সাথে কথা হলো । যথেষ্ট ভদ্রলোক উনি । তিনি জানালেন আপনি বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে গেছেন৷ কোথায় আছেন তিনি জানেন না৷
ভদ্রলোকের কথায় আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম , "আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন? ভদ্রলোক মাথা নেড়ে হ্যা বললেন।
এবার আমার আর বিস্ময়ের সীমা রিইলো না। আমি তাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, "আমাদের বাসায় কেন গিয়েছিলেন? কে আপনি? কি চান?"
ভদ্রলোক বললেন , "বিচলিত হবেন না বাবা,বিচলিত হবার কিছু নাই। সব খুলে বলছি আপনাকে তাহলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে৷
এরপর ভদ্রলোক চশমা খুলে সেটা ধুতির খোট দিয়ে ধীরে ধীরে মুছতে মুছতে বললেন, আমাকে আপনি চিনবে না বাবা ।"
আমি বললাম , যেহেতু বুঝতে পারছেন চিনবো সেহেতু পরিচয়টা দিলেই তো পারেন। অহেতুক কালক্ষেপন করছেন কেন? একটু থেমে কিছুটা শান্ত হয়ে বললাম,দেখুন সকাল বেলা আমার অনেক কাজ পরে আছে । আপনাকে আর সময় দিতে পারবো না । তাই অনুরোধ করছি ভনিতা না করে যা বলার তা তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।
ভদ্রলোক এবার কাপাকাপা গলায় বললেন , আজ কালকার ছেলে মেয়েরা অল্পতেই বিচলিত হয়ে পরে । কারো একটু ধৈর্য,সহ্য নেই । এরপর ভদ্রলোক একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, এতো উত্তেজিত হতে হবে না বাবা । সব খুলে বলছি । তার আগে কাউকে এক গ্লাস জল দিতে বলুন প্লিজ । বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
লোকটা কে , কোথা থেকে এসেছে কিছুই বুঝতে পারছি না । যেহেতু আমার নাম জানেন সেহেতু বোঝা যাচ্ছে আমার সর্ম্পকে সব তথ্য জেনেই এসেছেন ।
উঠে গিয়ে পিয়নকে পানি দিতে বলে আবার এসে তার সামনে বসলাম । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পিয়ন পানি দিয়ে গেলো ।
ভদ্রলোক এক চুমুকে গ্লাসের পুরো পানিটুকু পান করে পান্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, আপনার স্ত্রী অনুরাধা , অনুরাধ রায় তাই না ?
লোকটার মুখে অনুরাধার নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম ।
আমি বললাম. হ্যা, তো কি হয়েছে ?
খেয়াল করলার আমার উত্তর শুনে মুহুর্তের জন্য ভদ্রলোকে চোখ মুখ কঠিন হয়ে উঠলো। তবে নিজেকে তিনি সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, "আমি অনুরাধার জেঠু হই বাবা ।"
ভদ্র লোকের কথা শুনে আমি যার পর নাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। জেঠু মানে তো চাচা। অনুরাধার যে কোন জেঠু আছে এমন কথা অনু কখনো বলেনি আমায় । যতদূর জানি অনুরাধা পিতৃ মাতৃহীন । বড় হয়েছে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ার কাছে। বছর কয়েক হলো তিনিও মারা গেছেন । তখন থেকেই অনুরাধা একা ।
ভদ্রলোক যেহেতু অনুরাধার জেঠু পরিচয় দিচ্ছেন সেহেতু তিনি শ্রদ্ধার পাত্র । আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম ।
ভদ্রলোক, থাক, লাগবে না, লাগবে না এই জাতিয় কিছু বলে বাধা দিয়ে পা সড়িয়ে নিতে নিতে বললেন, "বাবা আপনার ব্যবহারে খুশি হলাম বাবা "
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না ।পিয়নকে চা বিস্কুট দিতে বলে এসে৷ চুপচাপ করে দাড়িয়ে রইলাম ।
চলবে .........
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৯
নয়ন বিন বাহার বলেছেন: চলুক...