নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসীম নীল আকাশে পাখী যেমন মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, কল্পনার ডানায় চড়ে আমিও ভেসে চলেছি মনের আনন্দে--রূঢ় পৃথিবীটাকে পিছনে ফেলে।

খেয়ালের বশে কোন পথে চলেছো পথিক...

শামছুল ইসলাম

পাখী ডানায় ভর করে মুক্ত নীল আকাশে মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, আমিও কল্পনার ডানায় চড়ে মনের গহীন আকাশে .......

শামছুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: দাদু ভাই, আমি চলে যাচ্ছি

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:৪৩


.
‘মা’-ডাকটা শোনা মাত্র আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। আমার শাহজাহান আমাকে এই নামেই ডাকে। আকিকা করে গ্রামের মাওলানা সাহেবকে ডেকে দিল্লির বাদশাহের নামে নাম রেখেছি। কত লোক যে সেই দিন খেতে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। সেই আমি, আমেনা বেগম, এখন মানুষের বাসায় কাজে করে খাই। বস্তির ছোট্ট জানালা বিহীন খুপরির ঘরে আমার আর আমজাদের সংসার। ঢাকা শহরে থাকি। মোজাম্মেল হকের আদরের ছোট মেয়েকে এই শহরে কেউ চেনে না।
.
আমজাদকে বাবাই ঠিক করেছিলেন আমাকে পড়ানোর জন্য। আমার বড় দুই ভাই, আক্তার ও আফজাল এইচএসসির গণ্ডি পেরোতে পারেনি; বাবার সাথে জমিজমা দেখাশোনা করে, মাছের চাষ করে। বাবাও জীবনে অনেক কষ্ট করে উপার্জন করেছেন। পড়ালেখা করায় সময় পান নি। তাই তিনি চেয়েছেন তার মেয়েটা অন্তত লেখাপড়া শিখুক। সেই চাওয়া থেকেই শিক্ষক হিসেবে আমজাদের নিয়োগ। ওর বাড়ি পাশের গ্রামে। হেঁটে হেঁটে আমাকে পড়াতে আসতো। মা ওকে খুব স্নেহ করতো। এক গ্লাস ঠান্ডা সরবত আর পিরিচে বিস্কুট দিয়ে মা আমাকে পাঠাতো। ও আমার দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাতো না। ক্লাস নাইনে পড়ি। গ্রামের আর দশটা ছেলের থেকে ও ছিল ভিন্ন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গরিব ছেলেটাকে গ্রামের সবাই পছন্দ করতো। ও যখন পড়াতো, আমার মাথায় কিছু ঢুকতো না। আমি অপলক ওর নির্মল-সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ও পড়া ধরলে কিছুই পারতাম না।
.
আমার ইস্কুলের শিক্ষক বলতো, আমার মাথায় নাকি শুধু গোবর। রান্না-বান্না, ঘরগোছানো, উঠোন ঝাড়ু দেওয়া- সংসারের এই সব কাজ আমার খুব ভালো লাগতো। আমি কল্পনায় আমজাদের সাথে ঘর-সংসার করি। ফলাফলটা হল এই, ইস্কুলের প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলাম না। আমজাদ লজ্জায় আর পড়াতে আসে না। বাবার টাকার জোরে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেলাম। বাবার অনুরোধে আমজাদ আবার পড়াতে আসলো। আমি খুশি। কিন্তু ও দেখি খুব গম্ভীর। আমার পড়াশোনার ধরণ দেখে একদিন আমাকে খুব করে বকলো। আমি কেঁদে ফেললাম। ও কী করবে বুঝতে না পেরে ওঠে এসে আমার হাত ধরলো। করুণ কণ্ঠে বললো, “তোমার রেজাল্ট খারাপ হলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়; মাসে মাসে এতগুলো টাকা নেই তোমার বাবার কাছ থেকে।” আমার কী যে ভালো লাগছিল। আমি মৃদু স্বরে বলি, “আজ থেকে তোমার কথা চিন্তা করে আমি মনোযোগ দিয়ে পড়বো। তুমি..” কথাটা শেষ করতে পারলাম না। মার ডাক শুনতে পেলাম, “আমেনা, ও আমেনা।”
-“আসছি মা” বলে উঠে দাঁড়াই। ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেই।
.
একদিন আমার প্রবল ইচ্ছা ও জেদের কাছে নতি স্বীকার করে বাবা আমার আর ওর হাত এক করে দেন। সে এক দীর্ঘ কাহিনী। দু লাইনে তার সারমর্ম করতে হলে বলতে হয়, আমি কোমর বেঁধে পড়াশোনা করে মোটামুটি ফলাফল করে কলা বিভাগ থেকে পাশ করি। তারপর এইচএসসি-তে ফেল করে পড়ালেখায় ইতি টেনে সংসার জীবন শুরু করি।
.
বিয়ের পর সময়টা যেন স্বপ্নের মতো কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আমজাদ মাঝে মাঝে যেন কেমন খাপছাড়া আচরণ করতো। ঢাকা যেতে চাইতো। চাকরির খোঁজে। আমি বলতাম, “শ্বশুর বাড়িতে তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে?”
-“না, তা বলেনি। কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে এতো কষ্ট করে পড়ালো, ওদের প্রতি আমার দায়িত্ব নেই?”
ফুলের মধ্যে যেমন পোকা থাকে, আমার সুখের ঘরে তেমনি একটা পোকার উপস্থিতি টের পাই। সে কুট কুট করে আমার সুখকে কাটতে থাকে। আমার মা হওয়ার সংবাদ শুনে ও খুব খুশি হলো। ঢাকা যাওয়ার আর নাম করে না। গ্রামেই একটা কোচিংয়ে পড়ায়। আমি ওর টাকা নেই না। ওর বাবা-মা কে পাঠানোর জন্য বলি। ও খুব খুশি হয়।
.
আমজাদের সাথে আমি সব কিছু শেয়ার করতে চাই। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আছে শেয়ার করা যায় না। এই যেমন, সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মা হওয়ার অনুভূতি। সারারাত প্রসব ব্যথায় ছটফট করছিলাম হাতপাতালে। সকালে নবজাতকের কান্না শুনে সব ব্যথা ভুলে গেলাম; ওর চাঁদ মুখটা দেখে হৃদয়টা বর্ষার ভরা নদীর মতোই প্লাবিত হলো।
শাহজাহান যেদিন আমাকে প্রথম ‘মা’ বলে ডাকে, সেদিনের কথাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি ওর কপালের একপাশে কালো টিপ দিয়ে দিচ্ছিলাম; কারো বদনজর যাতে না লাগে। ও ফোকলা দাঁতে খিল খিল করে হাসছিল। আমজাদ পাশেই ছিল। দুজনেই খুব আনন্দ পাচ্ছিলাম। আমি ওর গালে গাল ঘষে বলি, “বল,মা,মা।”
কী অবাক কাণ্ড। শিশু কণ্ঠে ডেকে উঠলো “মা,মা।” আমি ওর দুগাল চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলাম। আমজাদও হাসছে। তারপর বলে, “ আমেনা, ওকে বাবা বলতে বলো না!”
আমি ওর কথায় হেসে কুটি কুটি হয়ে যাই।
-“এ্যাই বোকা ছেলে, কখনও শুনেছো, কোন শিশু প্রথমে ‘বাবা’ বলে ডেকেছে?”
ওর মন খারাপ দেখে সান্ত্বনা দেই, “দু-এক মাস পর তোমাকেও বাবা বলে ডাকবে।”
কিন্তু তখন কি আমি জানতাম, শাহজাহান পাঁচ বছর পরও ওর বাবাকে ডাকবে না। সেই গ্রাম্য ডাক্তারকে আমি কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবো না। সামান্য জ্বরে সে আমার ছেলেকে উচ্চ মাত্রার এন্টিবায়েটিক দিয়েছিল। দুদিনের মধ্যেই জ্বর ছেড়ে দিল। কিন্তু ছেলে আমার আর স্বাভাবিক হলো না। ডাকলে সাড়া দেয় না, ঝুনঝুনি বাজালে ফিরে তাকায় না। খালি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
.
আমার জীবনটাকে কোন এক দৈত্য এসে যেন লণ্ডভণ্ড করে দিল। প্রতিমাসে ডাক্তার দেখাতে হয়। কত আশা নিয়ে ঢাকা যাই! কিন্তু প্রতিবারই বিফল মনে ফিরি! দেদারসে টাকা খরচ হচ্ছে। বাবা কিছু বলেন না। কিন্তু বুঝতে পারি ভাইয়েরা, ভাইয়ের বউয়েরা নানা কথা বলে। আমি আমজাদকে ঢাকা পাঠিয়ে দেই। ভাল একটা চাকরি খুঁজে নিক। আমার ছেলের চিকিৎসা করাবো ওর বাবার টাকায়। ও একটা মেসে থাকে। চাকরির বাজার খুব খারাপ। গ্রামের সাধারণ একটা ছেলে শহরে আরও অচল।
.
নাতির চিকিৎসা ও জামাইয়ের মেসে থাকার কথা চিন্তা করে বাবা আমাকে ঢাকায় একটা বাসা ভাড়া করে দেয়। আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমার নামে কিছু সম্পত্তি লিখে দেয়। প্রতি মাসে চলার মতো একটা টাকা যেন সেখান থেকে আসে। ব্যাপারটা আমার জন্য খুব লজ্জাজনক। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি তা মেনে নেই। দুই ভাই বাবার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে। তারা তাদের সম্পত্তি ও ব্যবসার অংশ আলাদা করে দিতে বলে। আমার বাবা কাউকে কষ্ট দিতে পারে না। তাই ওদের কথা মেনে নেয়।
.
সব কিছু মিলিয়ে বাবার মনটা নিশ্চয়ই খুব অস্থির ছিল। একদিন বাথরুমে পড়ে যেয়ে বাবার বাম পাশটা অবশ হয়ে গেল। কোন কথা বলতে পারে না। আকারে-ইংগিতে কথা বলে। আমাকে দেখে বোবা কান্নায় দুচোখ ভাসালো। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। এখন থেকে শাহজাহানের মতো ওর নানাকেও কারো দয়ার উপর বেঁচে থাকতে হবে। আমার স্বাবলম্বী বাবার এই পরিণতি মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
.
চলবে...
.
মো. শামছুল ইসলাম

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:৪৯

পথ হতে পথে বলেছেন: করুন কাহিনী মনে হচ্ছে।

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:৪২

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ।

হ্যাঁ, করুণ কাহিনী। তবে আশার আলোও আছে।

২| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:০৩

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: দুঃখের গল্প :(

শত শত পরিবারে এমনটা ঘটে, আমরা কীভাবে খবর পাবো?

লেখককে সাধুবাদ জানাই :)

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:৪৯

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই আর্কিওপটেরিক্স।

সঠিক বলেছেন, শত শত পরিবারে এমনটা ঘটে, আমরা কীভাবে খবর পাবো?

আমি আমার অফিসের এক সহকর্মীর কাছে মেয়েটার এই করুণ কাহিনী শুনে খুব মর্মাহত হই।

সেই করুণ কাহিনীটা সবাইকে জানানোর জন্য এই গল্প।

৩| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:০৪

পবিত্র হোসাইন বলেছেন: চলুক ... সাথে আছি

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:৫০

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ হোসাইন ভাই।

৪| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:০৫

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: কত অচিকিৎসা ঘটে গ্রামে, ফলাফল হয়ে জীবননাশ অথবা পঙ্গুত্ব...
শিশুরা এর শিকার হয় বেশি :(

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:৫১

শামছুল ইসলাম বলেছেন: আপনি যথার্থ বলেছেন, কত অচিকিৎসা ঘটে গ্রামে, ফলাফল হয়ে জীবননাশ অথবা পঙ্গুত্ব...
শিশুরা এর শিকার হয় বেশি
। হাতুড়ে চিকিৎসকদের জন্য অনেক মানুষের নানা রকম ক্ষতি হচ্ছে।

৫| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৬

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: আহারে,এসব গল্প পড়লে খুবই খারাপ লাগে।

কবে যে একটুকরো রোদ্দুরের দেখা পাবো!

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৪:০০

শামছুল ইসলাম বলেছেন: এক টুকরো রোদ্দুর আসছে অচিরেই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.