নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসীম নীল আকাশে পাখী যেমন মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, কল্পনার ডানায় চড়ে আমিও ভেসে চলেছি মনের আনন্দে--রূঢ় পৃথিবীটাকে পিছনে ফেলে।

খেয়ালের বশে কোন পথে চলেছো পথিক...

শামছুল ইসলাম

পাখী ডানায় ভর করে মুক্ত নীল আকাশে মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, আমিও কল্পনার ডানায় চড়ে মনের গহীন আকাশে .......

শামছুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: দাদু ভাই, আমি চলে যাচ্ছি - ২য় পর্ব

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১০:৫৮

১ম পর্বের লিংক
.
বাবার অসুস্থতার পর থেকে বড় ভাই বিকাশে টাকা পাঠায়। কয়েক মাস ঠিকঠাক টাকা পেলাম। মাসের প্রথম সপ্তাহেই। তারপর থেকে টাকা পাঠানোটা অনিয়মিত হয়ে গেল। টাকার পরিমাণও কমে গেল। এদিকে শাহজাহানের চিকিৎসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন খাওয়ার আগে ওকে একগাদা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়াই। বড় খারাপ লাগে। এতটুকু একটা বাচ্চা। সে ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছে।
মানুষ অবস্থার সাথে আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়। আমিও আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়ে বাবার ভাড়া করা বাসা ছেড়ে দূরে এক বস্তিতে বাসা ভাড়া নেই। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাকে কোন একটা কাজ করে টাকা রোজগার করতে হবে। আমজাদের উপর ভরসা করলে চলবে না। বস্তির আপা-খালাম্মাদের সাথে ভাব জমালাম। বাসা-বাড়িতে বুয়ার কাজ করবো।
.
তিন বাসায় কাজ করি। পারলে আর একটা কাজ নিতাম। কিন্তু সময় করে ওঠতে পারি না। তবে কাজগুলো এমন ভাবে নিয়েছি, যাতে দুপুরে বাসায় এসে ছেলেকে গোসল করিয়ে, খাইয়ে যেতে পারি। আমার অটিস্টিক বাচ্চার কথা শুনে অনেকেই কিছুটা ছাড় দেয়। সারাদিনের ক্লান্তিতে রাতে অঘোরে ঘুমাই। আমজাদ রাত করে বাড়ি ফিরে। সকালে ছেলেকে খাইয়ে-দাইয়ে যখন কাজে যাই, তখন ও ঘুমে থাকে। একদিন রাতে ও আমাকে ঘুম থেকে জাগায়। আমার হাতে অনেকগুলো টাকা দেয়। গুনে দেখি ৯৫২ টাকা। আমি অবাক হই।
“তুমি এতো টাকা পেলে কোথায়?”
আমার কথার উত্তর না দিয়ে ও চুপ করে থাকে।
আমি আবার একই প্রশ্ন করি; এবার একটু উচ্চস্বরে, সন্দেহের সুরে।
ও আস্তে করে বলে, “রিকশা চালিয়ে এই টাকা পেয়েছি।“
আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। ওর কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদতে থাকি। কান্নায় ওর গেঞ্জিটা ভিজে যায়। দূরে একটা কুকুর বিশ্রী ভাবে ডেকে ওঠে। সময়কে ধরে রাখা যায় না। পারলে এই মুহূর্তটাকে স্থির করে রাখতাম।
.
মানুষের বাসায় কাজ করতে গিয়ে কত রকম মানুষের সাথে যে পরিচয় হয়। সেদিন এক বাসায় নির্দিষ্ট কাজের বাইরে ইলিশ মাছ কুটতে দিল। ভদ্রমহিলা বিধবা। স্বামী ডাক্তার ছিল। ছেলেরাও ভালো চাকরি করে। মাছ কুটার বিনিময় হিসাবে এক টুকরা ইলিশ দিল। বাসায় নিয়ে এসে পড়লাম আর এক বিপদে। নুন-তেল, মসলা লাগে। এক টুকরা, কে খাবে? আমি না আমজাদ? আমজাদ বললো, “তুমি খাও।“ আমার স্বামীটার মনটা খুব ভালো। আহা! তারে কেউ যদি অফিসে একটা চাকরি দিতো? ডোরা আপার মতো সেও অফিসে যাইতো। ডোরা আপার বাসায় ছুটির দিনে সেদিন বিকালে কাজে গেলাম। উনিও বাজার থেকে বেশ কয়েকটা ইলিশ কিনেছেন। মাছ কুটতে কুটতে আপাকে জিজ্ঞেস করি, “আপা, দাম কত?”
-“তুমি কিনবে?”
-“না আপা, ইলিশ কেনার আমার সামর্থ নাই। ডাক্তার বাড়িতে ইলিশ মাছ কুটার পর এক পিস দিছে। সেটার দাম কত, তাই চিন্তা করতে ছিলাম? ”
-“তোমাকে মাত্র এক পিস দিছে? তোমরা তো মানুষ তিন জন।“
আমি ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
“আপা, মাছটা শাহজাহানের বাবাকে ভেজে দিবো। একটু তেল-নুন-মসলা দিয়েন।“
ডোরা আপা মাথা নাড়ে।
কাজ শেষে চলে আসবো। আপা একটা প্যাকেটে অনেকগুলো মাছ ভরে আমার হাতে দেয়। সাথে তেল-নুন-মসলা।
“তোমার স্বামীকে নিয়ে খেও।”
মানুষের নিষ্ঠুর ব্যবহারে যে কষ্ট, কান্না এতোদিন বুকে জমা ছিল, আপার ব্যবহারে সেই কান্না বাঁধ ভাঙা জোয়ারের পানির মতো দুচোখ বেয়ে নেমে এলো।
আমার কান্না আপাকে বিচলিত করে।
“এই আমেনা, কান্না থামাও। তুমি এতো কাঁদলে গড আমার উপর রাগ করবেন।“
আপা খ্রিস্টান। উনি গডের রাগকে ভয় পান। আমার মুসলমান খালাম্মার কথা জানতে ইচ্ছে করে? উনি কি আল্লাহর রাগকে ভয় পান?
আমি চোখ মুছতে মুছতে নত হয়ে আপাকে সালাম করতে যাই।
“এই কি কর, কি কর” বলে আপা দুপা পিছিয়ে যান।
.
আপার সাথে সেই থেকে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। অসুবিধায় পড়লে উনার থেকে টাকা ধার নেই। আবার ফেরত দেই বা বেতন থেকে কেটে রাখতে বলি। এভাবে মোটামুটি চলছিল।
নতুন বিপদের আভাস পেলাম আমজাদের কাছ থেকে। ওর বাবা রেলে ছোট একটা চাকরি করতো। অবসরের পর সংসার চালাতে খুব কষ্ট হতো। তাই একটা এনজিও থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল একটা ব্যবসা করবে বলে। টাকা শোধ দিতে পারেনি। সুদে-আসলে কয়েক লক্ষ টাকা দেনা হয়েছে। এনজিও-র লোকেরা গ্রামের বাড়িতে এসে শাসিয়ে গেছে। তাঁরা কিছুদিন তাঁদের একমাত্র ছেলের কাছে এসে গা ঢাকা দিতে চায়।
.
একদিন রাতে কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখি আমার শ্বশুর-শাশুড়ি হাজির। মেজাজটা খুব গরম হয়ে গেল। বিয়ের পর হাতে গোনা কয়েক দিন ওদের গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। শাশুড়ি কেন যেন আমাকে দেখতেই পারতো না। আমজাদ মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। কড়া কথাগুলো আমজাদের জন্য জিহ্বার আগা থেকে ফিরিয়ে নিলাম। আমাদের একটাই ঘর, পাশে একটা রান্নাঘর। ঘরে একটা খাট। খাটের পাশে একটা আলনা। একটা ছোট্ট চেয়ার। শাহজাহানকে ওটাতে হেলান দিয়ে বসাই। উনারা সাথে করে দুটা পোটলা এনেছেন। তার একটা থেকে বালিশ-কাঁথা বের করলো। মনে মনে ভাবলাম, থাকার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। ঘরের মেঝেতে শাহজাহানের দাদা-দাদির থাকা শুরু হলো। দুটা মানুষের বাড়তি খরচ যোগাতে কুলিয়ে উঠতে পারছি না।
.
ডোরা আপার বাসায় তিন কাজ করি। আপাকে বলে থালাবাসন মাজার কাজটা জোর করে নিলাম। বিনিময়ে বেতন কিছু বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। আপা রাজি হতে চায় না। আমি আপাকে কথা দিলাম, শ্বশুর-শাশুড়ি চলে গেলে চার নম্বর কাজটা আবার ছেড়ে দেবো। আগের বেতনে কাজ করবো। আপার মনটা খুব নরম। আপা শেষ পর্যন্ত অসহায় আমার কথা ফেলতে পারে না। আমি থালাবাসন মাজতে মাজতে নীরবে চোখের পানি লুকাই।
.
চরম অসুবিধার সাথে সাথে কিছু সুবিধাও চলে আসে; যেমন বন্যার জলের সাথে আসে পলি। কয়েকদিন পর দেখি, দাদা তাঁর নাতির সাথে আপন মনে কথা বলে। সে সব কথার কোন আগামাথা নেই। কিন্তু শুনতে ভালো লাগে। দুটি অসম বয়সের মানুষের মধ্যে স্নেহের বন্ধন গড়ে ওঠছে; আমার মা মন তা টের পায়। আমি রান্না ঘর থেকে শুনতে পাই দাদা নাতির সাথে কথা বলছে:
“দাদু ভাই, আমারে তুমি চিনো না। আমি তোমার দাদা হই। কও কও, দাদা-দাদা”
দাদা নাতির উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ বিরতি দেয়। আবার শুরু করে:
“দাদা কইবা না, রাগ করছো আমগো উপরে। তা করতেই পার।”
দাদা-নাতির এক পাক্ষিক সেই কথায় আমার শাশুড়ি বাগড়া দেয়।
“থামবা তুমি। বুড়া মানুষ বেশি কথা কয়। তুমার হইছে সেই দশা। এই বোবাটার লগে আবার এতো কথা কিসের!”
শাশুড়ির ঝাড়ি খেয়ে শ্বশুর চুপ করে যায়।
আমার ছেলেটাকে শাশুড়ি দেখতেই পারেন না। কথাটা সত্যি, আমার ছেলে তো বোবা। কিন্তু কেউ বললে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি এখনো মাঝে মাঝে রাতে স্বপ্ন দেখি, শাহজাহান দৌড়ে মা, মা বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে। আমি দুহাত বাড়িয়ে আছি। পায়ে পায়ে বাড়ি খেয়ে ও পড়ে যায়। আমি চিৎকার করে উঠি-শাহজাহান। অনেক সময় ঘুম ভেঙ্গে যায়। আবার কখনো কখনো গো গো আওয়াজ করি। আমজাদ আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, খারাপ স্বপ্ন দেখছি কি-না। আমি কোন উত্তর দেই না। পাশ ফিরে শুই। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি আমার হাসিখুশি ছেলেটা আবার হাসবে, খেলবে।
.
চলবে...


মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:০৯

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর.........
শাহজাহানের দাদা দাদি এসে ভালো খারাপ দুটোই হলো..........

চলুক....

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:২০

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন: শাহজাহানের দাদা দাদি এসে ভালো খারাপ দুটোই হলো..........

২| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:৩৮

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: জীবন যে কতো রকম। সুন্দর পলটে লিখে যাচ্ছেন। গল্পের সাথেই আছি।

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:০৩

শামছুল ইসলাম বলেছেন: সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ সুজন ভাই।

৩| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:১০

পবিত্র হোসাইন বলেছেন: নির্মম বাস্তবতা

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:৩৮

শামছুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ হোসাইন ভাই।

৪| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:১৪

হারাধণ০২ বলেছেন: বড় নির্মম সুন্দর সত্য। ভালো লাগছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.