![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে আর সম্ভবত মানুষ হিসেবে কেউ গণ্য করে না। তাই এরা মরে, যত্রতত্র মরে, পোকামাকড়ের মতো মরে। জন্মটাও এদের পোকামাকড়ের মতো, মৃত্যুটাও তাই। যতদিন এরা জীবিত থাকে, পোকামাকড়ের মতোই কিলিরবিলির করেই বেঁচে থাকে। এরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। অসাধারণদের কথা আলাদা। এদেশে যারা অসাধারণ; তারাই দেশ নেতা, দেশ পরিচালক। তাই তাদের সাধারণ মানুষের কথা ভাবলে চলে না। চললে ক্ষমতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে কিংবা ক্ষমতায় যেতে গেলে অসাধারণ হতে হয়। সাধারণ ও অসাধারণ এ দু’টির সংজ্ঞা আলাদা। সাধারণ জনতা সারাজীবন পরিশ্রম করবে, হাড় কালি করবে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু পয়সা আয় করবে এবং অতি দীন হীনভাবে কোনরকমে বেঁচে থাকবে। অসাধারণরা সাধারণদের কাঁধে ভর দিয়ে ক্ষমতায় যাবে, ক্ষমতায় টিকে থাকবে, বিলাসী জীবন যাপন করবে, ম-া খাবে, মিঠাই খাবে।
অসাধারণরা ক্ষমতার জন্য সাধারণদের স্বার্থ রক্ষার দোহাই দিয়ে হরতাল করবে, অবরোধ করবে, লংমার্চ করবে আর মানুষ মেরে ফেলবে। আর একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে সাধারণের কথা বেমালুম ভুলে যাবে। তা নইলে আর অসাধারণ কেন? এটা এদেশে এখন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ মারা যাওয়ার দৃশ্যটি এদেশে চিরায়ত।
পুরোনো ঢাকার দর্জিওয়ালা বিশ্বজিৎ মারা গেলো পোকামাকড়ের মতো কিলিরবিলির করতে করতে। যারা মারলো তারা অসাধারণ। ২রা এপ্রিল মঙ্গলবার কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার শ্রীমন্তপুর এলাকায় রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে ফেলে যে ত্রিশজন মানুষকে আহত করা হলো তারাও সাধারণ মানুষ। গত ১ এপ্রিল রাজশাহীর শালবাগান এলাকায় যে পুলিশ কর্মকর্তার মাথা থেতলে দেওয়া হলো সেও একজন সাধারণ মানুষ। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এসব মানুষদের উপার্জন করতে হয়।
শিশুরাও নিরাপদ নয়। গত ২ এপ্রিলে ১৮ দলীয় জোট এবং ছাত্রশিবিরের ডাকে হরতাল চলাকালে ফেনিতে একটি পরিত্যক্ত ককটেলের বিস্ফোরণে আহত হল একজন শিশু। একই দিনে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার হাজির মোড় এলাকায় জামায়াত শিবির পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ১৭জন সদস্য আহত হয়েছেন। তা-বের আতঙ্কে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলো এক সাধারণ সাইকেল মেরামতকারী। চট্টগ্রামের বহদ্দরহাটে যাত্রীবাহী বাসে আগুন লাগিয়ে দেয় পিকেটাররা। সাভারের গেন্ডা ও শিমুলতলীতে শিবিরের নেতাকর্মীরা দু’টি বাসে আগুন দেয়। নারায়ণগঞ্জে যুবদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে আহত হন ১৫জন। জয়পুরহাটে সংঘর্ষে পুলিশের কর্মকর্তাসহ আহত হয়েছে ১০জন। ময়মনসিংহ শহরের বাইপাস রোডের কেওয়াটখালিতে একটি মাল বোঝাই ট্রাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় মালামালসহ ট্রাকটি। খুলনার শিরোমনি মীড়বাড়ি এলাকায় তিনটি বাস ও একটি ট্রাক ভাঙচুর করা হয়। বগুড়ার এরুলিয়াহাট এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বরিশালে যানবাহন ও দোকানপাটে ভাংচুর চালানো হয়। একই সাথে আক্রমণ করে আহত করা হয় পুলিশসহ পাঁচজনকে। সিলেটে শাহী ঈদগাহ এলাকায় বিজিবি ও পুলিশের গাড়ি ভাংচুরের চেষ্টা চালানো হয়। চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের পল্লীবিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করা হয়। হরতালের সহিংসতায় এ যাবৎ প্রায় দু’শ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তারা সবাই সাধারণ মানুষ।
ছেলেবেলায় একটি গল্প পড়েছিলাম। এক ডোবায় কিছু ব্যাঙ বাস করতো। একদিন কিছু দুষ্ট বালক ব্যাঙগুলোর প্রতি ঢিল ছুঁড়ে মারছিলো এবং এতে ব্যাঙরা বেশ হতাহত হচ্ছিল। বেশকিছু ব্যাঙ দুষ্ট বালকদের ঢিলের আঘাতে হতাহত হবার পর, এক বয়স্ক সাহসী ব্যাঙ পানি থেকে মাথা তুলে বালকদের জিজ্ঞেস করলো, তোমরা আমাদের ঢিল ছুঁড়ছো কেন? বালকেরা জানালো তারা খেলছে। এতে সাহসী ব্যাঙটি বললো, তোমাদের জন্য যা খেলা ও তামাশা, আমাদের জন্য তা মৃত্যুর কারণ।
আইনশৃঙ্খলার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এই যে এতসব নাশকতা, এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কারা? এককথায় সাধারণ মানুষ এবং দেশের জাতীয় সম্পদ। প্রশ্ন হলো, যারা এসব নাশকতামূলক কর্মকা-সহ সাধারণ মানুষ হত্যা করছে বা যারা সমর্থন দিচ্ছে তারা কতোখানি জনদরদী। এ প্রসঙ্গে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর এর গোপিন্দল এলাকায় ৫জনের হত্যাকা-ের ঘটনা এবং তার পরবর্তী বিএনপি’র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কতোটা যুক্তিযুক্ত? ‘দেশের স্বার্থে আরও লাশ পড়বে’ এ ধরনের কথা একজন দেশনেত্রীর মুখে কতোটা মানানসই এটাও ভাবনার বিষয়। বিরোধী দল কেন হরতাল করে, আর সরকার কেন নিজ অবস্থানে অনড় থাকে এটা সকলেই কমবেশি জানেন।
হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে হরতাল হতেই পারে। সেই হরতাল অবশ্যই শান্তিপূর্ণভাবে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি পরিপূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞ। এ ধ্বংসজ্ঞ কী ধরনের কল্যাণ বয়ে আনবে? মানুষ মরবে, জাতীয় সম্পদ ধ্বংস হবে, সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত জীবন যাপন করবে? এভাবে আর কতোদিন?
বিরোধী দলের প্রধান দাবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু সেই দাবী সরকার মানতে চাইছে না। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় যাবার পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। অথচ গত ২ এপ্রিল মঙ্গলবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল-সংক্রান্ত রায়ের সমালোচনা করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিদায়ী সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, এই রায়কে কোনো রায় হিসেবে গণ্য করা যায় না। তিনি বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী আপিলের আদেশের মূল অংশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের আগেই সরকার তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে। ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগের রুলসের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে রায়ের মূল অংশের ভিন্ন একটি অপারেটিভ অংশ ঘোষণা করেন তিনি। জয়নুল আবেদীন আরও বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের শপথ থাকাকালীন ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার রায়ের মূল অংশ ঘোষণা করেছিলেন। ১৮ মে তিনি অবসর নেন। পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের সময় তাঁর শপথ ছিল না। কাজেই তাঁর প্রদত্ত রায়কে কোনো রায় হিসেবে গণ্য করা যায় না। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন মন্তব্য করেন, ‘দেশের বর্তমান এই সংঘাত, প্রাণহানি, ভাংচুর এবং গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি সবকিছুর জন্য বর্তমান সরকার ও সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এই রায়কে পুঁজি করে সরকার গণতন্ত্রকে নস্যাৎ এবং ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।’
সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গৃহীত একটি বিষয় আলাদতে সুরাহা হবার পরও বিরোধী দল তা মানতে পারছেন না। ফলে সংঘাত হচ্ছে, প্রাণহানী হচ্ছে। তাহলে যারা ভোটের মাধ্যমে জনমত নিয়ে সংদদে জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাদের প্রতি কতখানি আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে?
অপর দিকে শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের দাবীর প্রতি সমর্থন দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তাও বা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত হচ্ছে? বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পেছনে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টিও জড়িত। একটা শ্রেণি চাচ্ছে, অপরাধীদের বিচার হোক, অন্য একটা শ্রেণি তাদের বাঁচাতে মাঠে নেমেছে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ধ্বংস, হত্যা ও নৈরাজ্যের পরিমাণ বাড়বে বৈ কমবে না। তাহলে কি আমাদের গণপ্রতিনিধিদের প্রতি আমাদের আস্থা নেই? এ অবস্থা উত্তোরণের উপায় কী? উপায় বিভিন্ন রকমের আছে, কী সেই উপায়? সেই উপায় হচ্ছে, উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সংসদ সদস্যরা খোলামেলা আলাপ আলোচনা করুক। যার যা বলার তা সংসদে গিয়ে বলুন। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে বা সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে আগামী সংসদ নির্বাচন, এ দু’টি বিষয়ই সংসদে সুরাহা হোক।
অথবা, সরাসরি জনগণের মাধ্যমে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দু’টি ছেড়ে দেওয়া হোক ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে। এখানে দু’টি ইস্যুই থাকবে। একটি আমরা নাগরিকরা কি সত্যিকারার্থেই যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই? যার যেখানে ইচ্ছা ভোট দিক, মতামত জানাক। অপরটি, আমরা কি সত্যি সত্যিই নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করে আগামী সংসদ গঠন করতে চাই? জনগণই রায় দিক ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ এর মাধ্যমে। কেননা, আর যেহেতু আমরা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছি না, সেক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ এর বিকল্প হতে পারে না। জনগণই যদি সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে, তবে জনগণই সিদ্ধান্ত নিক, কি করবে কি করবে না।
আমরা সাধারণ নাগরিক। আমরা সুখী জীবন যাপন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং সুন্দর সোনালী ভবিষ্যৎ গড়তে চাই। আমরা চাই না, বোমা, গুলি কিংবা অন্য কোন নাশকতা মূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে কোন মানুষের জীবন অকালে ঝরে যাক। আমরা চাই না, জাতীয় সম্পদের কোন প্রকার ক্ষতি হোক। কেননা, আমরা এখনও আমদানী নির্ভর দেশ। যে সব জাতীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা এখনও এদেশে তৈরি করতে পারছি না। আমাদের যে সব ভাইবোনদের জীবন ঝরে গেছে তা আমরা ফিরিয়ে আনতে পারছি না। থামাতে পারছি না ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো চোখের পানি আর অনাগত ভবিষ্যতের টানাপোড়েন। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী করবো এবং সে সিদ্ধান্ত যত তাড়াতাড়ি হয় ততোই মঙ্গল। তা না হলে, এই যে হেফাজতে ইসলামের আহুত লংমার্চ, এ লংমার্চ চলাকালে না জানি কতো ক্ষতি আরও হবে।
তৈয়ব খান
তারিখ: ৪ এপ্রিল, ২০১৩।
©somewhere in net ltd.