![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদুল ফিতর
তৈয়ব খান
‘সাওম’ এর শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা। সুবেহ সাদিক শুরু হওয়ার আগে থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একাধারে পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে শরিয়ত অনুযায়ী সাওম বলা হয়। সাওম বা রোজা ইসলামের মূলভিত্তি। রোজাদার ব্যক্তি এফতারের এক মিনিট আগেও কিছু খেয়ে ফেললে বা পান করলে বা স্ত্রী সম্ভোগ করলে তার রোজা হবে না। অর্থাৎ প্রবৃত্তির তাড়না থেকে নির্দিষ্ট সময় পযন্ত বিরত থাকাই হল সাওম। তাকওয়া বা পরহেজগারী অর্জনের জন্য রোজার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তি অর্জন করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি অর্জন হয়। আর সেটিই হলো ‘তাকওয়া’ বা পরহেজগারীর ভিত্তি।
রমজান মাসেই পবিত্র আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে। রাসুলে করিম (সাঃ) বলেছেন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সহিফা রমজান মাসের ১ তারিখে নাজিল করা হয়েছে। রমজানের ৬ তারিখে ‘তাওরাত’, ১৩ তারিখে ইঞ্জিল এবং ২৪ তারিখে আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে। হযরত জাবের (রাঃ) এর এক রেওয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘যবুর’ রমযানের ১২ তারিখে এবং ‘ইঞ্জিল’ ১৮ তারিখে নাজিল হয়। উল্লেখিত হাদিসে পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের অবতরণ সম্পর্কে যে সব তারিখের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব তারিখে ঐ কিতাবগুলো গোটাই নাজিল করা হয়েছিলো কিন্তু আল কোরআনের বৈশিষ্ট হলো এই যে, তা সম্পূর্ণভাবে রমজানের কোন এক রাতে লওহে মাহ্ফুজ থেকে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ করে দেওয়া হলেও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে ধীরে ধীরে তা অবতীর্ণ হয়। (সূত্র: তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরাআন)।
তবে আসমানী গ্রন্থ ‘ইঞ্জিল’ নাজিল হওয়ার তারিখ সম্পর্কে দু’রকম মন্তব্য এলেও এটি যে রমজান মাসেই হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ মাসের গুরুত্ব অনেক। ব্যক্তিকে সহী, শুদ্ধ করার লক্ষ্যেই রমজানের রোজার আবির্ভাব হয়েছে। সারা দিন না খেয়ে কষ্ট করে রোজা পালন কেবল মুসলমানদের জন্যই একতরফাভাবে আসেনি বরং মহান আল্লাহ পাক পবিত্র আল কোরআনে ঘোষণা দিয়েছেন-
*‘হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিলো, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো। *গণনার কয়েকটি দিনের জন্য। অতপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে ান্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিশকিনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা বুঝতে পারো। * রমজান মাসই হলো সেই মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ ও মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন নাÑ যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুণ আল্লাহ তা’লার মহত্ত বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩-৮৫)।
রমযানের মূল আরবী শব্দটি হলো রামাদান। আরবী ভাষায় যার অর্থ- ভীষণ গরম, কঠোর সূর্যের তাপ, তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া ইত্যাদি। নবী করিম (সা.) বলেন, এ মাসে যেহেতু গুনাহ বা পাপ বিমোচিত হয় এবং মানুষের সকল গুনাহ গলিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় সেজন্যেই এই মাসের নাম রমজান।
গোনাহ থেকে রোজা মানুষকে রক্ষা করে। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেন, “রোজা (গোনাহ থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরূপ। সুতরাং রোজাদার অশ্লীল কথা বলবে না বা জাহেলী আচরণ করবে না। কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে উদ্যত হলে অথবা গালমন্দ করলে সে তাকে দুইবার বলবে, ‘আমি রোজাদার’। তিনি আরও বলেন, যার হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ! রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মহান আল্লাহর কাছে কস্তুরীর সুগন্ধ থেকেও অতি উত্তম। আল্লাহ বলেন, রোজাদার খাদ্য, পানীয় ও কামভাব পরিত্যাগ করে আমার উদ্দেশ্যে রোজা রাখে। সুতরাং আমি তাকে বিশেষভাবে রোজার পুরস্কার দান করবো। আর নেক কাজের পুরস্কার দশগুণ পর্যন্ত দেওয়া হয়ে থাকে।”
এ মাসে একটি বরকতপূর্ণ রাত্রি আছে। যার নাম লায়লাতুল কদর। যার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, “(১) আমি একে নাজিল করেছি শবে কদরে। (২) শবে কদর সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন? (৩) শবে কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। (৪) এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। (৫) এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” কদর এর অর্থ হচ্ছে মাহাত্য ও সম্মান। আমল না করার কারণে এর আগে যার কোন সম্মান ও মূল্য মহিমান্বিত থাকে না, সে এ রাত্রিতে তওবা, এসতেগফার ও এবাদতের মাধ্যমে মহিমান্বিত হয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও বিশ্বাসের সাথে এবং সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে, শবে কদরের রাত্রে দাঁড়ায়, তবে তার আগেকার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।
সমস্ত রমজান মাসের পানাহার ও ইন্দ্রিয় সম্ভোগ থেকে বিরত থেকে, মিথ্যা অসত্য কথা বলা থেকে বিরত থেকে রোজাদার তার পাপরাশি ঝরিয়ে পরহেজগারী অর্জন করে এবং শবে কদরের রাত্রির এবাদত তাকে সম্মানিত করে তোলে। তাই রমজানের গুরুত্ব এত বেশি।
রোজা পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে- গুনাহ থেকে বিরত থাকা ও পরহেজগারী অর্জন করা। রমজান মাসে পানাহার থেকে বিরত থাকার পেছনে যদি আধ্যাত্মিক বরকতের কোনো লক্ষ্য না থাকে কিংবা এর মাধ্যমে যদি তাকওয়া অর্জন না হয়, তাহলে এই রোজা শুধু দৈহিক রোজা হবে, দেহের বাইরে এই রোজার আর কোনো তাৎপর্যই থাকবে না। তাই রমজান মাসের ফযীলত থেকে উপকৃত হতে হলে ক্ষুধা-তৃষ্ণার বাইরেও সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। ইন্দ্রিকে সংযত রাখতে হবে, তবেই রোজার উদ্দেশ্য সফল হবে। সামাজিকভাবে আমরা যে চিত্র দেখতে পাই, কিছু অসাধু লোক খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, পণ্যের মিথ্যা তারিফ করে বাজে সওদা গ্রাহকের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, অনৈতিকভাবে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, এমতাবস্তায় নামকাওয়াস্তে রোজাও পালন করছে। তারা সত্যিই রোজার তাৎপর্য বুঝতে পারছে না। যারা অবৈধ আয় করছে, ঘুষ নিচ্ছে, মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানী পেরেশানী করছে, হানাহানি করছে, তারা কি রোজার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারছে? রোজা মানুষকে পরিশুদ্ধ করে। পরিশুদ্ধ হতে হলে মন থেকে সমস্ত প্রকার অসামাজিক কাজ, অন্যায়, মিথ্যা মুছে ফেলতে হবে। গ্রহণ করতে হবে সত্য, ন্যায়, শান্তি ও আদর্শকে। রোজা আসেই এগুলো শিক্ষা দিতে। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলতে।
মুসলমানদের জন্য বছরে দু’টি উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর। রমজানের পুরো মাস কঠোর সিয়াম পালনের পর ১ লা শাওয়াল নিয়ে আসে একরাশ আনন্দ। এ আনন্দ অন্যরকম আনন্দ। এদিন আল্লাহ রোজাদারের উপর থেকে দিনের বেলা পানাহার ও অন্যান্য ইন্দ্রিয় সুখ জনিত কাজ বন্ধ রাখার যে হুকুম পুরো মাস জুড়ে জারি ছিলো তা উঠিয়ে নেন পরবর্তী রমজান আসার আগ পর্যন্ত। ঈদুল ফিতর মুসলমানদের জন্য মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাতসমৃদ্ধ হয়ে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংযম সাধনার দীক্ষা নিয়ে যে রমজানুল মোবারক এসেছিল, তার বিদায়লগ্নে বিমল আনন্দ এনে দেয়। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির বিশেষ আনন্দ অনুষ্ঠানের মতো ঈদুল ফিতরও মুসলিম মিল্লাতের এক বার্ষিক আনন্দের মেলা। কিন্তু অন্যান্য অনুষ্ঠানের চেয়ে এর স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। উৎসবের নামে অনাচার-কদাচার আর নৈতিকতা বিবর্জিত বল্গাহীন অনুষ্ঠান আড়ম্বরের কোনো অবকাশ নেই ইসলামের অনুমোদিত এ আনন্দে। বরং এ আনন্দ সংযমের ও আনুগত্যের। বছরে দু’টি বিশেষ দিনে এরূপ আনন্দের অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। তার একটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন আর অন্যটি ঈদুল আজহার দিন।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “লিকুল্লি কাওমিন ঈদ, হাযা ঈদুনা।” অর্থ: প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব উৎসব রয়েছে। মুসলমানদের জন্যও দু’টি উৎসব একাধারে আনন্দ এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি করার জন্যই আবির্ভূত হয়েছে। মানুষের প্রকৃতির স্বাভাবিক চাহিদা মোতাবেক দুঃখের পর সুখ আর বিষাদের পর আনন্দের একটি অপরিবর্তনীয় রীতি বা নিয়ম সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রচলিত রয়েছে। এমনই আনন্দের সুসংবাদ দিতেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উপরিউক্ত কথাটি স্পষ্ট করে বলেছিলেন।
পৃথিবীতে যেমন অনেক জাতির মানুষ রয়েছে, তেমনি রয়েছে তাদের আনন্দ-বেদনা প্রকাশের কিছু বিশেষ দিন। অন্যান্য জাতির মতো মুসলিম মিল্লাতেরও কতগুলো স্মরণীয় দিন রয়েছে, যেসব দিনে তারা নানা রকম আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকে। হজরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করিম (সাঃ) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি সেখানকার নও মুসলিমদের দু’টি বিশেষ দিনে নানারূপ খেলতামাশার মাধ্যমে আনন্দ-উৎসব করতে দেখলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এ দু’টি দিন তোমাদের এরূপ করার কারণ কী? তারা বললেন, ‘আমরা জাহেলী যুগেও এ দু’টি দিন এমনি খেলা তামাশার মাধ্যমে উদ্যাপন করতাম।’ তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, আল্লাহ তোমাদের আনন্দ-উৎসবের জন্য এর চেয়েও দু’টি উত্তম দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন, পয়লা শাওয়াল আর অপরটি হলো ঈদুল আজহার দিন, ১০ জিলহজ।
নবী করিম (সাঃ) পয়লা শাওয়ালকে ঈদের দিন ঘোষণা করেন। আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তিনি ঈদের আনন্দ মুসলমানদের জন্য বরাদ্দ করলেন। সে সময় থেকেই চলে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতরের উৎসব। উল্লেখ্য যে, রমজানের রোজাও ও ঈদুল ফিতর হিজরি দ্বিতীয় বছর চালু করা হয়। ঐ বছর রোজা শেষ হওয়ার ১২ দিন আগে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় আর রোজার শেষে পয়লা শাওয়াল অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ঈদুল ফিতরের উৎসব। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) -এর নির্দেশমতো ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিতে দিতে মুসলমানরা খোলা ঈদের মাঠে গিয়ে হাজির হয়। নবীজী উপস্থিত সব মুসলমানকে সাথে নিয়ে খোলা মাঠে দুই রাকাত ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে খুতবা পড়ে ঈদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন।
তাই ঈদকে কেবল আনন্দের বা পানাহারের উৎসব বলে বিবেচনা করলে চলবে না, ঈদের উৎসব পালনের মধ্যে যে ধরনের সৌহার্দ, ভ্রাতৃত্ব, তাকওয়া রক্ষা করে চলা এবং ত্যাগের মহান অনুপম তাৎপর্য রয়েছে তা উপলব্ধি করতে হবে। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার আগুনে পুড়ে অন্তরকে খাঁটি সোনার পরিণত করার পর মুমিন বান্দার পক্ষে মহান আল্লাহর দরবারে নির্মল ও নিখাদরূপে উপস্থিত হওয়ার দিন হলো ঈদুল ফিতর। এ দিনের স্বচ্ছ, সুন্দর ও মধুর প্রভাতে মুমিন বান্দার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে যায়। বস্তুত দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর ঈদের আনন্দ হচ্ছে আল্লাহর শুকরিয়ারই বহিঃপ্রকাশ।
মুসলমানদের আদর্শিক লক্ষ্য ও গুরুত্বের মাপকাঠিতে বিচার করলে দেখা যায় ঈদুল ফিতরের এ খুশি মোটেই নিরর্থক নয়। ইসলামের অসংখ্য শিক্ষার মতো ঈদুল ফিতরেরও কয়েকটি অনুপম সুন্দর শিক্ষা রয়েছে। ঈদের এ মহান দিনে মুসলমানদের জাতীয় জীবনে সাম্য-মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করার আবেদন তীব্র হয়ে দেখা দেয়। ইসলাম ত্যাগ-তিতিক্ষার, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে যে শিক্ষা দিয়েছে, সেই মহান শিক্ষার তাগিদ নতুন করে অনুভূত হয় এ ঈদের দিনে। অসহায়, এতিম ও দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার যে প্রশিক্ষণ এক মাস ধরে মুমিন বান্দা লাভ করেন, তার ফল প্রত্যক্ষ করার সময় হচ্ছে ঈদুল ফিতর। এ দিন দুই রাকাত বিশেষ নামাজ পড়ে বিশ্ব জাহানের একচ্ছত্র অধিপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। অস্থায়ী জীবনের এ এক দিনের আনন্দের পর স্থায়ী ও চিরন্তন জীবনের মহা আনন্দের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার তাগিদ অনুভূত হয় মুসলিমদের মনে। ঈদুল ফিতরের আনন্দ আমাদের বিনয়ী, নম্র ও হৃদয়বান করে তোলে, যেন ঈদের প্রভাত থেকেই মুসলমানরা পরের সুখে সুখি হওয়ার তাগিদ অনুভব করে। ছোটদের প্রতি স্নেহমমতা আর বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তির প্রাণপ্রবাহে হৃদয় ভরে যায়। স্রষ্টার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার সাথে সাথে যেন তার সমস্ত সৃষ্টির সাথে ভালো আচরণ করা যায়, সৃষ্টিকে ভালোবেসে স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করা যায় সেটিই পবিত্র ঈদুল ফিতরের লক্ষ্য। সাধারণভাবে এক দিনের হইহুল্লোড় ও মাতামাতিতে ঈদের কোন সার্থকতা নিহিত নয়। বরং প্রতিটি ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন মন-মানস ও উন্নত চরিত্রের অধিকার লাভ করাতেই রয়েছে ঈদ উৎসবের আসল সার্থকতা।
যারা রমজানের সারা মাস রোজা রাখলো না, বরং রমজানের পবিত্র দিনগুলোতে নির্লজ্জভাবে পানাহার করলো, তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নয়। ঈদুল ফিতরের উৎসবে তাদের কোনো অধিকার নেই। মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ভাষায়, ‘এ আনন্দ তাদের জন্য ওয়ায়িদ বা শাস্তির হুমকিস্বরূপ।’ মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘ঈদ আনন্দ তার জন্য নয়, যে ব্যক্তি কেবল নতুন জামা পরে; বরং ঈদ হচ্ছে তার জন্য যে আল্লাহকে ভয় করে। বস্তুত আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে এমন এক অপার্থিব আনন্দ রয়েছে, যা ঈদের আনন্দের চেয়েও অনেক বেশি তৃপ্তিদায়ক। মুসলমানদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমার এবাদত, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ যে কত অসীম, ঈদের পবিত্র দিনে মুমিন বান্দা তা চিন্তা করে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তারা বৃথা সাজসজ্জা ও নিষ্ফল আনন্দের পরিবর্তে রাসূল করিম (সাঃ)-এর নির্দেশ পালন করেই পরিতৃপ্ত হয়। ঈদের দিনে আল্লাহর কাছে তওবা করে, কারণ এ দিনে তওবা কবুল হয়। এ দিনে মুমিন বান্দা মোনাজাত করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার রোজা কবুল করুন, আমাকে আপনার নেক বান্দাদের মধ্যে শামিল করে নিন। হে আমার জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ! আপনি আমার অজ্ঞানতাপ্রসূত কৃতকর্মের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন। আমাকে জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে রক্ষা করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমার সমস্ত গোনাহ মাফ করুন আর আমার ঈদকে আপনি সফল ও সার্থক করুন।’
দুঃখ-দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে যারা জর্জরিত, ঈদুল ফিতরে তাদেরও বিশেষ আনন্দের ব্যবস্থার জন্য সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে। মক্কা মুয়াজ্জমার অলিতে গলিতে লোক পাঠিয়ে নবী করিম (সাঃ) ঘোষণা করেছিলেন, ‘জেনে রেখো, সাদকায়ে ফিতরা প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, আজাদ-গোলাম ও বড়-ছোট সবার প্রতি ওয়াজিব।’ সাদকায়ে ফিতরের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে নবী করিম (সাঃ) বলেন, ‘সাদকায়ে ফিতরের বদৌলতে আল্লাহ ধনীর গুনাহা মাফ করেন এবং গরিবের সঙ্গতিকে বাড়িয়ে দেন।’
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে দেহ-মনকে নির্মল ও পবিত্র করে নেয়ার পর ঈদুল ফিতরের আনন্দঘন মুহূর্তে আমরা যেন মোনাজাত করে বলি, ‘হে প্রভু! আপনি আমাদের সরল পথে চলার তওফিক দান করুন, আমাদের রোজা কবুল করুন এবং আমাদের আপনার পূণ্যবাণ বান্দাদের আন্তর্ভূক্ত করুন। সাহাবায়ে কেরামের মতো আমরা যেন রাসূলে পাক (সাঃ)-এর এ মহান আদর্শ অনুসরণ করতে পারি, তাঁর দেখানো পথে চলতে পারি আপনি আমাদের সেই তৌফিক দান করুন।
তৈয়ব খান
৩২/২ সেনপাড়া পর্বতা
সেকশন ১০, মিরপুর, ঢাকা- ১২১৬
মোবাইল: +৮৮০১৯৪২-৮৪৭২০৭
©somewhere in net ltd.