![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কী খাচ্ছি আমরা!!
তৈয়ব খান
দৃশ্যপট ১।
জনবহুল রাস্তা, গাড়ি-রিক্সার অবিরাম চলাচল। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। নদ্দা বাজার সংলগ্ন নদ্দা বাসস্ট্যান্ড। খোলা ঠেলাগাড়িতে মোমবাতি জ্বালিয়ে তেলেভাজা চানাচুর, নিমকি, মুড়কি, বাতাসা বিক্রি করছে এক কিশোর। মাঝবয়সি এক মহিলা (নাতি হবে বোধহয়) একটি আধময়লা গেঞ্জি পরা এক বালককে নিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক দর কষাকষি করে মুড়কি কিনলেন পাঁচ টাকার। তুলে দিলেন বালকটির হাতে। তার একটু আগেই দেখে এলাম বয়স চল্লিশেক বয়সের এক দাঁড়িওয়ালা মুসুল্লি যান ও মানুষ চলাচলরত ধুলিধূসর রাস্তার পাশে কুপিবাতি জ্বালিয়ে পেঁয়াজু বিক্রি করছে। কড়াইতে রাখা তেলের চেহারা কালচে হয়ে গেছে। সামনের এ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে রাখা পেঁয়াজুর বেশিরভাগই বিক্রি হয়ে গেছে ইতোপূর্বে। যা বাকি আছে, তা কিনতেও ক্রেতা অবশিষ্ট আছে নিশ্চয়ই। নইলে বসে থাকা কেন? যা হোক, পাঁচটাকার মুড়কি পেয়ে বালকটির চোখজোড়া যখন খুশিতে চকচক করে উঠলো; তা দেখে বিক্রেতা, ক্রেতা উভয়ের উপর আমার ভীষণ রাগ হলো। বালকটি আনন্দে ঐ মহিলার সাথে চলে যাবার পর আমি কষে এক ধমক লাগালাম দোকানিকে- ‘খাবার ঢেকে বেচতে পারো না?’ ধমক খেয়ে চুপসে গেলো বেচারা। তড়িঘড়ি করে বাক্স-ঠেলাগাড়ির ভেতরের কুঠুরি থেকে টুকরো টুকরো পলিথিন বের করে খাবারগুলো ঢাকতে লেগে গেলো।
দৃশ্যপট ২।
ক’দিন আগে পত্রিকার কাজে মোহাম্মদপুর গিয়েছিলাম। কাজ শেষে ফেরার পথে দেখলাম প্রিপারেটরি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (বালক শাখা) এর সামনে ছাত্ররা স্কুলের কেচিগেটের ফাঁক দিয়ে হকারদের কাছ থেকে কিনে খাচ্ছে বিভিন্ন রকমের আচার, ঝালমুড়ি। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। সবাই হকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেঁচিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে তাদের চাহিদা মোতাবেক খোলা খাবারটি হকার দ্রুত পরিবেশন করে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, কিছু অভিভাবক বাচ্চাদের এসব দৃশ্য দেখেও তেমন পাত্তা না দিয়েই নিজেরা নিজেদের গল্পে মেতে আছেন।
দৃশ্যপট ৩।
মিরপুর ১০ এর ফলপট্টি লাগায়া মূল সড়ক থেকে রাস্তাটি এঁকে বেঁকে জনতা হাউজিং পর্যন্ত চলে গেছে। ফলপট্টি থেকে একটু সামনে এগুলেই মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সংঘ। এ সংঘের উত্তর দেয়াল ঘেঁষা ফুটপাতের উপর গড়ে উঠেছে কিছু খোলা খাবারের দোকান। এখানে মাংশের চপ, কাটলেট, ডিমের বড়া, নুডুলসসহ অনেক খাবারই পাওয়া যায়। নামমাত্র ঢেকে রাখা এসব খাবার খাচ্ছেন সচেতন অনেকেই শুধু মুখরোচক বলে। এ রাস্তার ধার ঘেঁষেই বেশ কটি স্কুল। শিক্ষার্থাও খাচ্ছে বড়দের দেখাদেখি। মিরপুর- ২ এর স্টেডিয়ামের বাইরের রাস্তায় খোলা খাবার বিক্রি হচ্ছে এভাবেই।
দৃশ্যপট ৪।
বাংলাবাজারের নর্থব্র“ক হল রোড, কিংবা সদরঘাট ওভারব্রিজ টু কাঠের পুল এর রাস্তা এতটাই ব্যস্ত, যে না দেখেছে তাকে বিশ্বাস করানো কঠিন। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বের নর্থব্র“ক হলের সামনে দিয়ে এ রাস্তার পাশের হোটেলগুলোয় অবিরাম ধূলি ঢোকে অবলিলায়। দেখলাম, অতি-ফ্যাশন দুরস্ত অতি-আধুনিক অতি-প্রগতিশীল তরুণীর উর্ধ্বাঙ্গের একপাশে অতি অবহেলায় কোনরকম ফেলে রাখা উর্ণির মতো ‘গামছাঢাকা’ হয়ে আছে গামলায় রাখা ভাত। যার শতকরা আশিভাগই উদোম। তবে পার্থক্য একটাই, এসব তরুণীদের পোশাক থাকে অতি-দামী এবং চকচকে, আর ভাত ঢাকা দেওয়া গামছার চেহারা অতি-বিবর্ণ অতি-ময়লা। তরকারী দেখে মনে হবে সদ্য ভূমিষ্ট শিশু; তাই ঢাকনার দরকার পড়েনি। বাচ্চাদের দিগম্বড় দেখতে খারাপ না লাগলেও গামলায় রাখা মাছ-মাংশ-সবজি-তরকারী দেখে ভীষণ কষ্ট হয়। ঢাকনা কেনার খরচ মনে হয় অনেক। পরন্তু, খাবার যারা পরিবেশন করছে, তারা যে হাতে নোংরা গামছা দিয়ে টেবিল মুছছে আবার সেই হাতেই খাবার নাড়াচাড়া করছে।
এরকম দৃশ্য আপনি হরহামেশাই দেখে থাকবেন ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায়। এসব খাবারের রকমফের থাকলেও (আচার, ঝালমুড়ি, চানচুর মাখা, কাঁসুন্দি মাখানো ফল বিশেষত পেয়ারা- কামরাঙা, কিংবা ঘুগনি, পেঁয়াজু, ছোলা সেদ্ধ, কাটা পেঁপে, কাটা আনারস, চটপটি, ফুচকা, হালিম, সসপেনের রঙিন শরবত, ঘোল বা মাঠা) বিক্রি ও পরিবেশন হচ্ছে একই রকমভাবে অর্থাৎ খোলামেলা। রাস্তায় পথচারিদের হাঁটা-পায়ের উড়ানো ধূলি, গাড়ির ধোঁয়া, বাতাসে উড়ে আসা গাছের ঝরা পাতা জীবাণূ বহন করে এনে ফেলছে এসব খাবারে।
ভোক্তাদের রসনার তোড়ে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি- হ্যাঁ, এসব খাবার মুখরোচক। তবে এর সাথে এ-ও জানাচ্ছিÑ খাবারগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ‘বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্স্টিটিউশন্ অর্ডিন্যান্স- ১৯৮৫’ জারি করেছে। এর আগে মানুষের ভোগের জন্য খাদ্য প্রস্তুত ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ- ১৯৫৯’ জারি হয়। এ অধ্যাদেশের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে- “মানুষের ভোগের জন্য পরবর্তিতে রান্না ছাড়াই সাধারণভাবে ব্যবহৃত কোন দুধ, রুটি, কেক, পেস্ট্রি বা মিষ্টি, কনফেকশনারী অথবা অন্যকোন খাদ্যবস্তুর বিক্রয়, প্রদর্শন, রাখা বা মজুদ করা, বা বহন করা যাইবে না যদি না ঐগুলি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমুষ্টিমত ধূলি, ময়লা এবং মাছি থেকে যথাযথ আবরিত বা সুরক্ষিত থাকে।”
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রচণ্ড ধূলি ময়লা পড়ছে খাবারের উপর, ঢাকনা নেই। খাদ্যে ধূলি-ময়লা, মাছি যাতে না বসতে পারে তা নিশ্চিত করণের আইন আছে, যথার্থ বাস্তবায়ন নেই। ফলে একদিকে দেদার বিক্রি হচ্ছে খোলা খাবার, আর স্বাস্থ্যহানীতে ধূঁকছে নাগরিক। কর্মব্যস্ত জীবনের কঠিন বাস্তবতায় আমরা বাধ্য হচ্ছি নগরের অলিতে গলিতে গড়ে উঠা খাদ্য পরিবেশনকারী হোটেল রেস্তুরায় খেতে কিন্তু কতটুকু মানসম্পন্ন খাবার খেতে পারছি আমরা?
বড়দের চাইতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। ওরাও খাচ্ছে খোলা খাবার, ভেজাল খাবার। দিনে দিনে গোটা নগরবাসী আক্রান্ত হচ্ছি নানার অসুখে। এর প্রতিকার কিভাবে?? আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে? খোলা খাদ্য বর্জন করতে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে? খাদ্য পরিবেশন প্রতিষ্ঠানগুলোর মান সম্মত খাদ্য পরিবেশনার মাধ্যমে? নাকি প্রয়োজন সবগুলোরই!
তৈয়ব খান
কবি, লেখক
পরিচালক, মোহনা এন্টারপ্রাইজ
সাভার, ঢাকা
মোবাইল: ০১৯৪২-৮৪৭২০৭
©somewhere in net ltd.