![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবনে চলার পথে প্রতি ক্ষণে, প্রতি মূহুর্তে কত কত মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। তাদের অনেকের সাথে আবার গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তারা হয়ে ওঠেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিছুক্ষণ নিরবে বসে থাকলেই মনে পড়ে যায় তাদের কথা। ভোলা যায়না তাদের দয়া ও ইহসানের কথা।
.
যখন আমি ছোট্ট ছিলাম মনে পড়ে তখনকার বাল্যবন্ধুদের কথা। যাদের সাথে একসাথে মাঠে খেলতে যেতাম, গোল্লাছুট, ক্রিকেট ফুটবল কানামাছি আরো কত কত খেলা। ছোট্ট হৃদয়ে কত শত কথা মনে আসতো যেমন চাঁদটা মনে হয় আমার সাথে চলছে, আকাশটা বুঝি অমুক জায়গায় গিয়ে নিচে নেমে গেছে, এসব কথা অন্য কারো সাথে বলতে পারতামনা তাই বন্ধুরা সবাই মিলে একে অপরের সাথে নিজেদের ভাবনাগুলো শেয়ার করতাম। এরপর ক্লান্ত হয়ে গেলে একজন আরেকজনকে বাসায় নিয়ে মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাওয়াতাম। ভালো কোন খাবার পেলে বন্ধুদের সবার সাথে ভাগ করে খেতাম। সেই বন্ধুদের অনেকেই আজ হারিয়ে গেছে, জানিনা আজ তারা কে কোথায় কি অবস্থায় আছে।
.
এরপর যখন একটু বড় হলাম দূরের এক মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হলাম, পরিচয় হলো নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে, আবাসিক মাদ্রাসায় পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকায় এই বন্ধুরাই ছিলো পরিবারের মত। জ্বর হলে মাথায় পানি দিয়ে দিতো তারা, অসুস্থ হলে এমনভাবে সেবা শুশ্রুষা করতো;পরিবারের কথা মনেই হতোনা,
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে মন খারাপ থাকলে সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাওয়া বা সামর্থ্যের মধ্যে ভালো কিছু রান্না করে খাওয়া ছিলো তখনকার বিনোদনের মূল উপায়। সেই বন্ধুরাও আজ জীবিকার তাগিদে বা জীবনের প্রয়োজনে কে কোথায় হারিয়ে গেছে কোন খোঁজ নেই।
.
এরপর যখন কর্মজীবন শুরু হয় তখন আবার পরিচয় ঘটে আরো নতুন কিছু মানুষের সাথে যাদের সাথে আগে কখনো পরিচয় ছিলোনা তারপরও তারা কত আপন করে নিলেন আমাকে, সুখে দুখে পাশে দাড়িয়েছেন নিঃস্বার্থভাবে, শোক সংকট বিপদ আপদে তারাই ছিলেন একান্ত আপনজন। কিন্তু একটা সময় তাদেরকেও ছাড়তে হয়েছে, খুঁজতে হয়েছে নতুন ঠিকানা।
.
সময়ের ব্যাবধানে এমন কত শত বন্ধুকে যে ছেড়ে আসতে হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই, আজও মনে পড়ে তাদের কথা, মনে পড়ে তাদের ইহসান এবং দয়ার কথা। মন চায় তাদের জন্য অনেক কিছু করি, তাদের সেই সব ইহসানের বদলা স্বরূপ কিছু করতে না পারি, অন্তত কৃতজ্ঞতাটুকু স্বীকার করি। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে এর কিছুই সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কিন্তু এটা কি ঠিক! তাদের এভাবে ভুলে যাওয়া কতটুকু সমীচীন!
.
কেউ আমাদের উপর দয়া করলে বা ভালো কিছু করলে উচিত তো হলো তার জন্যও অনুরূপ কিছু করা, না পারলে অন্তত দোয়ায় শরীক রাখা। কিন্তু আমরা তো এমন কৃপন হয়ে গেছি যে, কিছু করা তো দূরের কথা দোয়াতেও স্মরণ রাখিনা। অথচ হাদীস শরীফে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَنْ صَنَعَ إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا مَا تُكَافِئُونَهُ فَادْعُوا لَهُ حَتَّى تَرَوْا أَنّكُمْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ.
অর্থাৎ কেউ তোমাদের জন্যে ভালো কিছু করলে প্রতিদান স্বরূপ তুমিও তার জন্য অনুরূপ কিছু কর। যদি তা না পারো অর্থাৎ তার জন্য কিছু করার সুযোগ বা সামর্থ্য না থাকে, তাহলে তার জন্য এই পরিমাণ দোয়া কর, যাতে মনে হয়- যথাযথ প্রতিদান তুমি তাকে দিয়েছ। -সুনানে আবু দাউদ- ১৬৭২; সুনানে নাসায়ী- ২৫৬৭
.
এই হাদীসটি আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্নিত হয়েছে, মুসনাদে আহমাদের এক বর্ণনায় এ জায়গায় আরো একটা বিষয় এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কেউ তোমাদেরকে হাদিয়া দিলে তোমরাও তাকে অনুরূপ হাদিয়া দাও, যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তার জন্য এই পরিমাণ দোয়া করো যাতে মনে হয় যে যথাযথ প্রতিদান তুমি তাকে দিয়েছো।
এই দুটি হাদীসে আমাদের জন্য কয়েকটি শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে,
১। কেউ আমার প্রতি ইহসান করলে তার প্রতিও অনুরূপ ইহসান করা উচিত।
২। দোয়াও ইহসানের বদলা দেয়ার শক্তিশালী মাধ্যম। যদি কারো পক্ষে ইহসানের প্রতিদানে অনুরূপ কিছু করা সম্ভব না হয়, তাহলে তার বেশি দোয়া করা উচিত, পরিমানটা এত বেশি হওয়া উচিত যাতে মনে হয় যে, তার ইহসানের যথাযথ বদলা দেয়া হয়েছে।
.
শুধু যে ইহসানের বদলা হিসেবেই আমরা দোয়া করবো বিষয়টি এমন নয় বরং সদা সর্বদা যখনই দোয়ায় হাত তুলবো অন্য সকল মুমিন-মুসলিম ভাই বোনদের কথা স্মরণ রাখবো। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে আমাদের এমন কিছু দোয়া শিখিয়েছেন যাতে নিজেদের পাশাপাশি অন্যন্য মুমিন ভাই বোনদের জন্যেও দোয়া করা হয়ে যায়।
সুরা ইব্রাহীমে এমন একটি দোয়া এসেছে, দোয়াটি করেছিলেন সাইয়িদুনা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের, বলেছিলেন
رَبَّنَا اغْفِرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِلْمُؤْمِنِیْنَ یَوْمَ یَقُوْمُ الْحِسَابُ
অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করে দিয়েন। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪১
.
সুরা হাশরের এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা আমাদের আরেকটি দোয়া শিখিয়েছেন, দোয়াটি হলো –
وَ الَّذِیۡنَ جَآءُوۡ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَا اغۡفِرۡ لَنَا وَ لِاِخۡوَانِنَا الَّذِیۡنَ سَبَقُوۡنَا بِالۡاِیۡمَانِ وَ لَا تَجۡعَلۡ فِیۡ قُلُوۡبِنَا غِلًّا لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا رَبَّنَاۤ اِنَّکَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ
যারা তাদের পরে এসেছে (অর্থাৎ মুহাজির এবং আনসারদের পর যারা ঈমান এনেছে, কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুসলিম এই আয়াতের উদ্দেশ্য) তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে গত হয়ে গেছেন তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং মুমিনদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু । সুরা হাশর ৫৯;১০
.
এভাবে আরো অনেক জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে অপর মুমিন ভাই বোনদের জন্য দোয়া করা শিখিয়েছেন, দোয়ার ক্ষেত্রে অন্য মুমিন মুসলিম ভাই বোনদের শরিক রাখার অনেক ফায়দা আছে। সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস এসেছে।
হাদিসটি উম্মে দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لأَخِيهِ بِخَيْرٍ قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكَّلُ بِهِ آمِينَ وَلَكَ بِمِثْلٍ
কোনো মুসলিম অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অগোচরে (কিংবা তার অনুপস্থিতিতে) দুআ করলে, সেই দুআ কবুল হয়। সে যখন তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দুআ করে, তখন তার খুব নিকটে নিযুক্ত একজন ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন’ (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তোমার এই দুআ কবুল করুন) এবং তোমাকেও এমনটি (অর্থাৎ এই কল্যাণ) দান করুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৩৩
.
এই হাদীসটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো প্রসারিত করতে উদ্বুদ্ধ করে । অন্যের প্রতি কল্যানকামনা ও উপকার করার বোধকে জাগিয়ে তোলে। তার অগোচরে কাউকে না জানিয়ে না দেখিয়ে লৌকিকতামুক্তভাবে তার জন্য কল্যানকামনা করতে এবং মহান মালিকের দরবারে তার জন্য দোয়ায় নিমগ্ন হতে উতসাহিত করে। পাশাপাশি এই আমলের যে কত বড় ফায়দা তাও এই হাদীস থেকে বুঝে আসে। আল্লাহ তাআলার একান্ত অনুগত বান্দা ফেরেশতারা যেহেতু নিস্পাপ তাই তাদের দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কেউ যখন অপর ভাইয়ের দোয়া করে তখন সে ফেরেশতাদের দোয়া লাভে ধন্য হয়। তারা তার দোয়ার সাথে আমীন আমীন বলে এবং এবং দোয়া করে আল্লাহ তাআলা তোমাকেও অনুরূপ কল্যান দান করুন। সুবহানাল্লাহ ।
.
সহীহ মুসলিমের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ এই হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক জায়গায় বলেন;
وَكَانَ بَعْضُ السَّلَفِ إِذَا أَرَادَ أن يدعو لنفسه يدعولأخيه الْمُسْلِمِ بِتِلْكَ الدّعْوَةِ لِأَنّهَا تُسْتَجَابُ وَيَحْصُلُ لَهُ مِثْلُهَا.
পূর্ববর্তী মনীষীগণ যখন নিজের জন্য কোনো বিষয়ে দুআ করতে চাইতেন,তখন আগে অন্য মুসলিম ভাইয়ের জন্য সেই দুআ করতেন। কেননা অন্য মুসলিম ভাইয়ের জন্য কৃত দুআ কবুল হয় এবং নিজের জন্যও অনুরূপ হাসিল হয়।
.
এ বিষয়ে সুনানে আবু দাউদে আরো সুস্পষ্টভাবে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, হাদিসটি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ
إِنَّ أَسْرَعَ الدُّعَاءِ إِجَابَةً دَعْوَةُ غَائِبٍ لِغَائِبٍ
অর্থাৎ ঐ দোয়া সবচেয়ে দ্রুত কবুল হয়, যা কেউ অপর অনুপস্থিত ব্যাক্তির জন্য করে। আবু দাউদ-১৫৩৫
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই আমলে যত্নবান হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন সুম্মা আমীন
©somewhere in net ltd.