নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার জীবনদর্শন, আমার যত ভালোবাসা, আমার যত দায় ,,,,,,,,

Tania Farazee

আমি একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। ভাল লাগে প্রগতিশীল , যৌক্তিক লেখা ও কাজ।

Tania Farazee › বিস্তারিত পোস্টঃ

মা হওয়া

১৯ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৯

গল্প
মা হওয়া
তানিয়া আক্তার

অবশেষে স্নিগ্ধার একটি চাকরি হল। সে বাগেরহাট জেলার একটি অখ্যাত উপজেলাধীন একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেল। শিক্ষিত, মার্জিত রুচিসম্পন্ন, সুন্দরী এই ভদ্রমহিলা অল্পবয়সে পড়ালেখার পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। তার ইচ্ছে ছিল রাজনীতিবিদ হওয়ার। কিন্তু পারিবারিক বাধার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। পরে এম,এ শেষ করে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু' সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
স্নিগ্ধার কোন সন্তান নেই । বয়স ত্রিশোর্ধ হলেও তাকে দেখে বিশ একুশের উপরে কেউ ভাবতে পারেনা। স্নিগ্ধা দ্বিতীয়বার বিয়ে করবেনা বলে ঠিক করায় তার পিতামাতা আত্মীয়স্বজন তার উপর অভিমান করে দূরে দূরে থাকে। সবাই তাকে নিয়ে হতাশ। একেবারে সাধারণ কেউ কেউ তাকে পাগল বলতে চাইলেও তার কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে তা মুখে আনতে পারেনা। স্নিগ্ধা ধনী-গরীব, ছোট-বড় সকলকে ভালবাসে ও সম্মান করে। তার পুরুষ বন্ধুও কম নেই। সাধারণ লোক তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করতে চাইলেও একসময় তার চরিত্রে কালি লেপনের মত কিছু না পেয়ে নিরব থাকে। স্নিগ্ধার যখন সরকারী চাকরীর বয়স একেবারে যায় যায় তখন পরিবারের সকলের অনুরোধে স্কুলের চাকরিটি নিল সে।
স্কুলে কর্ম শুরু করার পর বাচ্চারা তাকে খুব পছন্দ করল। তার সময়ও অত্যন্ত ভাল কাটতে লাগল। কিন্তু' অল্প যোগ্যতা নিয়ে অন্য যারা তার কর্মক্ষেত্রে যুক্ত ছিল তাদের হিংসার শিকার হতে হয় তাকে মাঝে মাঝে। তবে সে জীবনটাকে এবং জীবনের জটিলতাকে অল্প বয়সেই এতটা বুঝে ফেলেছিল যে, কোন কিছুতে সে অতি উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় ভুগেনা। স্কুলের ছেলেমেয়ে, বইপড়া, গানবাজনা এসব নিয়ে তার সময় অতি দ্রুত কাটতে লাগল।
একদিন অবসরে স্কুলের সহকর্মীদের সাথে বসে বসে গল্প করছিল স্নিগ্ধা। হঠাৎ তার স্কুলের অফিসরুমের দরজার সামনে হাস্যমুখে ধীমান ব্যানার্জী নামক একজন ছাব্বিশ সাতাশ বছরের সুদর্শন, উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকের আবির্ভাব হল। স্নিগ্ধার চোখের দিকে চেয়ে তার মুখ কেমন যেন মলিন হয়ে গেল। আর স্নিগ্ধা তাই দেখে হেসে ফেলল। স্নিগ্ধার মুখের দিকে তাকালে অনেকেরই মুখ মলিন হয়ে যায়। কেননা স্নিগ্ধা যে চাকরিটি করছে তার চেয়ে বড় চাকরি করার যোগ্যতা যে তার আছে তা তার চোখে, মুখে, আচরণে সবখানে যেন লেখা । কিন্তু স্নিগ্ধা এ ব্যাপারে একেবারে নিষ্পৃহ।
ধীমানের সাথে স্নিগ্ধার খুব ভাল একটা বন্ধুত্ব হল। ধীমান স্নিগ্ধাকে প্রায়ই নানা কথা বলে হাসাতে পছন্দ করে। স্নিগ্ধা যখন হাসে তখন ধীমান মুগ্ধ হয়ে গভীর চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে। স্নিগ্ধা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, “কি দেখছেন ?” ধীমান পাল্টা প্রশ্ন করে, “আমার সাথে আমেরিকা যাবেন ? আপনাকে এখানে মানাচ্ছে ?” স্নিগ্ধা ঠাট্টাচ্ছলে এসব কথা এড়িয়ে যায়।
ওদের স্কুলটি মনোরম একটি গ্রামে। স্কুলের পাশে বড় দীঘি। দীঘিতে সারাদিন পদ্ম ফুটে থাকত। স্নিগ্ধা স্কুলের জানালা দিয়ে সেদিকে প্রায়ই চেয়ে থাকে। ওর ইচ্ছে হয় ধীমানকে সাথে নিয়ে দীঘির পাড়ে গিয়ে বসতে, আর গল্প করতে। কিন্তু গ্রামের লোকের মন্দ সমালোচনা থেকে দূরে থাকতে চায় বলে সে ধীমানের কাছ থেকেও অনেক দূরে থাকে। স্নিগ্ধার যেকোন কঠিন, জটিল কথা ধীমান সহজেই বুঝে ফেলে। ধীমানের এই গুণটিই স্নিগ্ধাকে তার প্রতি বেশী আকৃষ্ট করল।
সময় গড়াতে লাগল। ধীমান মাঝে মাঝে স্কুলের মহিলা শিক্ষিকাদের সাথে স্নিগ্ধার ঘরে এসে বসে। স্নিগ্ধা কি রেঁধেছে তা খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। স্নিগ্ধাও ধীমানকে খাওয়াতে পেরে খুশী হয়। এভাবে ওরা দুজন দু’জনের মনের খুব কাছাকাছি বাস করতে লাগল। পরস্পরকে ভালবাসল। কিন্তু কেউ সেকথা ভালভাবে বুঝতে পারলনা। তাই কেউ কারও কাছে তা প্রকাশ করার তাড়াও অনুভব করলনা। কেবল পরস্পর পরস্পরের অসুস্থতায়, আনন্দ-ব্যথায় খোঁজ খবর রাখা আর সমব্যথী হওয়ার মাঝেই নিজেদের ধরে রাখল।
ধীমান স্কুলে আসার ছ’মাস পর স্নিগ্ধার একবছরব্যাপী একটি প্রশিক্ষণের নির্দেশ এল। প্রশিক্ষণে যাওয়ার সময় ধীমান স্নিগ্ধার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। কি যেন বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারলনা। স্নিগ্ধা মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দু’জনের চোখের কোনে অশ্রু দেখা দিল। দু’জন দু’জনের কাছে তা লুকনোর চেষ্টা করল।
এর ছ’মাসের মধ্যে ধীমানের অন্য একটি চাকরি হয়ে গেল। তার পরিবারের সবাই তাকে একটি অল্প বয়সী হিন্দু মেয়েকে বিবাহ করতে বাধ্য করল। বিয়ের পূর্বেই ধীমান স্নিগ্ধাকে একথা জানাল। কিন্তু স্নিগ্ধা বরফশীতল হয়ে রইল আর অশ্রু সম্বরণ করল। স্নিগ্ধা মুসলিম বলে ধীমান তার কথা তাদের বাড়ীতে তার কট্টর ধর্মভীরু বাবা মার সামনে উচ্চারণ করতেও পারলনা।
স্নিগ্ধা প্রশিক্ষণ শেষে এসে দেখল কোথাও ধীমান নেই। বেশ নিঃসঙ্গ বোধ হল তার। স্কুল, স্কুলের মাঠ, দীঘির পাড়, নিজ ঘর, ঘরের আঙিনা সবটাই যেন তারই মত উদাস, বিষণ্ন হয়ে আছে বলে তার মনে হল। সে প্রাণপনে এসব এড়িয়ে পুনরায় তার স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার পদোন্নতি হল। সে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বাগেরহাট জেলার একটি মডেল স্কুলে যোগদান করল। স্বাভাবিকভাবেই ধীমানের সাথে তার যোগাযোগ কমে গেল। নতুন নতুন অনেক বন্ধু হল। ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব এল। কিন্তু সে বিয়ে আর করবেনা বলেই স্থির রইল। ভাল শিক্ষক হিসেবে অনেক নামও কুড়োতে লাগল।
স্কুলের পাশেই স্নিগ্ধার বাসা। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার বছরখানেক পর স্নিগ্ধা একদিন খুব ক্লান্ত হয়ে দুপুরের পূর্বেই স্কুল থেকে ঘরে ফিরল। এসে দেখল তাকে ঘরের কাজে সাহায্যকারী মহিলা তার ঘরের দরজায় একটি খাম হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে বসা।
স্নিগ্ধা প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে ? উত্তর এল-একজন সুন্দর কইরা লোক আইছিল। এই যে খামডা নেও।”
স্নিগ্ধা খামটি হাতে নিয়ে দেখল তাতে একটি চিঠি আর একটি আদালত হলফনামা এবং কিছু ব্যাংকের কাগজপত্র। সে হলফনামাটি মন দিয়ে পড়ল। তাতে লেখা আছে ধীমান তার পাঁচ মাস বয়সী কন্যা সন্তানটিকে চিরদিনের জন্য আইনসঙ্গতভাবে স্নিগ্ধাকে দিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে গেল। সে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করল--“ও কোথায় ? বাচ্চাটি কোথায় খালা ?”
খালা তাকে চোখ ইশারা করে ঘরের ভিতরে দেখিয়ে দিল। স্নিগ্ধা দৌঁড়ে ঘরের ভিতরে গেল। খাটের উপর থেকে ঘুমন্ত ফুটফুটে শিশুটিকে কোলে তুলে নিল। তার চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগল। শিশুটিকে নিয়ে সে উঠোনে নামল। মুগ্ধ হয়ে দেখল। বলল- “কি সুন্দর !” স্নিগ্ধার জীবন যেন হঠাৎ পরিপূর্ণ হয়ে গেল, আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার চারিদিক।
যদিও বড় একটি ব্রিফকেসে শিশুটির প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র ধীমান দিয়ে গেছে তবু ওইদিন বিকেল পর্যন্ত স্নিগ্ধা ব্যস্ত রইল শিশুটির আরও যা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তা যোগাড় করতে। তার ঘরের খালা তাকে যা যা বলল তা সবই সে যোগাড় করল। বিকেলে শিশুটিকে ঘুম পাড়িয়ে ধীমানের চিঠিটি খুলল সে। তাতে লেখা আছে--
প্রিয় স্নিগ্ধা,
তোমায় অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম যে, চল দূরের কোন দেশে পালিয়ে যাই, ঘর বাধি। এদেশ, এসমাজ তোমায় আমায় বোঝেনা, বুঝবেনা। বলতে পারিনি। তুমিও সাহস দাওনি। তোমারত অনেক সাহস। আমাকে ভীতু বানিয়ে রেখে তোমার কি লাভ হল ?
বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তুমি বলতে- ভালবাসার মধ্য দিয়ে প্রতিটি শিশুর জন্ম হওয়া উচিত, আর ভালবাসার মাঝে তার বেড়ে ওঠা উচিত। ওর জন্ম ভালবাসার মধ্যে হয়নি। কিন্তু ওর বড় হওয়া যেন ভালবাসার মধ্যে হয় তাই ওকে তোমাকে দিয়ে গেলাম। ওর এখনও কোন নাম রাখা হয়নি। ওর জন্মের দিনই ওর মায়ের মৃত্যু হয়েছে। আমি ছাড়া ওকে তোমার কাছে দাবী করার মত কেউ নেই। তুমি ওর মা হওয়ার চেষ্টা কর। আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি, একা।
ধীমান
এরপর স্নিগ্ধা দু’একমাসের মধ্যে ধীমানের সাথে যোগাযোগ করতে পারলনা। পরে অনেক কষ্টে তার ঠিকানা যোগাড় করে তাকে একটি চিঠি পাঠাল। তাতে লিখল-
প্রিয় ধীমান,
আমাদের মেয়ের নাম রেখেছি অঞ্জলি। অঞ্জলি আর ওর মা- অঞ্জলির বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের এভাবে অপূর্ণ করে রেখনা। আমাকে ক্ষমা কর।
তোমার স্নিগ্ধা


সমাপ্ত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.