নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

The only person u should try to be better than, is the person u were yesterday.

ত্রিভকাল

আমি গ্রামের একজন সহজ সরল প্রথমশ্রেণীর আবুল, যে কিনা ছিঁড়া লেপের তলায় শুয়ে কোটিপতি হবার স্বপ্ন দেখতে ভীষণ ভালোবাসে। কৃপণ, কাইষ্টা মানুষের নাকি অনেক টাকা পয়সা হয়, সে হিসাব অনুযায়ী আমি অক্সফোর্ড কোটিপতি হবো। নিজের টাকা নিজেই খাইয়ম .... ফেইসবুক লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/Sabbirahmed069 ওয়েবসাইট লিন্ক : http://bkadda.blogspot.com http://www.trivokal.com http://www.votku.com htttp://www.likilose.com http://trivokal.wordpress.com/ http://www.vokalab.com

ত্রিভকাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ত্রিভকালের প্রান্তরে; চ্যাপ্টার ৩: কাইষ্টা

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৯

প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসছি। সন ২০০৭। আসলে ঠিক প্রথমবার আসছি বললে ভুল হবে। বলতে হবে দীর্ঘিদিন থাকার জন্য প্রথমবারের মতো ঢাকা আসছি। আমি আর আমার বাবা। লঞ্চে করে আসার সময় আমার বাবা একটু পর পর উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। আমিও তাঁর কথার প্রতিউত্তরে ‘জ্বী আব্বু’, ‘আচ্ছা আব্বু’, ‘ঠিক আছে আব্বু’ বলে যাচ্ছি



- বাবা কারো সাথে কখনো গণ্ডগোল করবা না।

- আচ্ছা আব্বু।

- যদি কারো কথা ভালো না লাগে চুপ করে থাকবা।

- জ্বী আব্বু।

- যখন যা প্রয়োজন লাগবে আমাকে বলবা, বা তোমার আম্মুকে ফোন করে বলবা।

- ঠিক আছে আব্বু।



‘ঠিক আছে আব্বু’ বললেও আমি আমার প্রয়োজনের কথা কাউকে কখনো বলতে পারি না। ছোট বেলায় কিছু লাগলে মায়ের পিঠ এর উপর নিজের পিঠ লাগিয়ে ঠেসে দাড়িয়ে থাকতাম। দুই হাতের চার আঙ্গুলে থাকতো দুইটা পিঁপড়া। মা হয়তো রান্না বান্নার জিনিসপত্র গোছগাছ করতেছে, আমি যেয়ে মায়ের উপর শরীরের সব ভর দিয়ে অব্যক্ত মনে নিজের মতো করে খেলছি। মা বুঝতে পারতো আমার কিছু দরকার, কিন্তু আমি মুখ ফুটে বলতে পারছি না। মা অনেকবার জিজ্ঞাসা করলেও আমি বলতে চাইতাম না। গলার কাছে এসে আটকিয়ে থাকতো। তারপর একসময় ছুটে যেয়ে গাছের গুড়িতে বসে নিজের মতো করে খেলতে থাকতাম পিঁপড়া নিয়ে।



আবার ধরেন আমি প্রাইভেট টিউটর এর কাছে পড়ছি, আমার প্রচন্ড বাথরুম ধরেছে। কিন্তু আমি বলতে পারতাম না ‘টিচার আমি টয়লেটে যাবো’। ‘টয়লেটে যাবো’ এই কথাটি বলতে আমার চরম লজ্জা লাগতো। একজন মানুষ কিভাবে বলে ‘আমি টয়লেটে যাবো!’ এটা ভাবতে ভাবতে আমি প্যান্ট ভরে হেগে দিতাম। একদিন দুইদিন না, অনেকদিন হেগেছি প্যান্ট ভরে। স্কুলে ক্লাস চলছে, অঙ্কের স্যার হয়তো মূলদ-অমূলদ সংখ্যা বুজাচ্ছে আর আমি এদিকে প্যান্ট ভরে হাগছি। টিউটরের বাসায় বসে পড়ছি, টিচার হয়তো পড়ার ফাকে ফাকে বাসার টুক টাক খবর জিজ্ঞাসা করছে, আমি আস্তে আস্তে সেসব কথার উত্তর দিচ্ছি আর হেগে যাচ্ছি নিজের মতো করে প্যান্ট ভরে। বাসায় এসে হুজুর পড়াচ্ছে আম পাড়া, আমিও পড়ে যাচ্ছি মাথা দুলিয়ে, বাথরুম দেখতে পাচ্ছি আড় চোখ দিয়ে, সমান তালে হেগে যাচ্ছি প্যান্ট ভরে। আর প্রতিবার হাগার সময় একই ধরণের অনুভূতি কাজ করতো, চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়তো। একবার এক ম্যাডামের এর বাসায় যেয়ে পড়ছি, কাদতেছি, আর হাগতেছি। ম্যাডাম দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,



“কি সাগর বাবা, তোমার তোমাদের হারানো কুকুরটার জন্য মায়া লাগছে খুব, তাই না”



আমি কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম তাঁর কথাটাই চিরন্তন সত্য। এর উপর আর কোনো সত্য হতে পারে না। এটাই ইউনিভার্সাল ট্রুথ যে আমি আমাদের হারিয়ে যাওয়া কুকুরটার জন্য মন খারাপ করে কাঁদছি আপন মনে। আহা কত সুন্দর ছিলো আমাদের কুকুরটা...



এতোটাই লজ্জাতুর ছিলাম আমি যে ‘ম্যাডাম হাইজ্ঞাম’ এই সহজ দুটি ওয়ার্ড আমি মুখে ফুটে বলতে পারতাম না। তবে বাসায় আসা মাত্র আমার মা আমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারতো আমার প্যান্টের ভিতরের খবর। আর বুঝা মাত্রই আমাদের বাসার কাজের মেয়েটাকে হাকতো

- রিনা... এই রি...না...

- জ্বী খালাম্মা আইতেছি...

- ওই রিনাআআআ

- আইতেছি খালাম্মা...



আমি বুকের উপর বই হাতে নিয়ে দেখতাম আমাদের কাজের মেয়ে ‘রিনা’ ছুটতে ছুটতে মায়ের কাছে আসছে।



- যা টিচারের বাসায় যাইয়া দেখ সাগরের গু কোথাও কোথাও পরছে

- আইজকাও হাইজ্ঞা দিছে !!

- যাওয়ার সময় ভিজা তেনা নিয়া যাইছ, আর ম্যাডাম যদি টের না পায় তাইলে বলবি ‘সাগর ভাইয়া পেন্সিল ফালায়া গেছে, তা খুঁজতে আসছি’।

- আইচ্ছা



আমি কাউকে আমার মনের কথা বলতে না পারলেও, আমার কোনো বন্ধু না থাকলেও, আর আমি পিঁপড়া নিয়ে সারাটা দিন খেলা করলেও আমার শৈশব অন্য দশটা ছেলেমেয়ের থেকে দূর্দান্ত ছিলো। আমাদের বাসা ছিলো রাঙ্গামাটির পাহাড়ের চূড়ায়। আশে পাশে বিশাল জায়গা নিয়ে বাউন্ডারি দেওয়া বাসাতে যদিও আমার সমবয়সী কাউকে নিয়ে খেলতে পারেনি কখনো কিন্তু সেই জায়গাটাই ছিল আমার অভয়অরণ্য। আমি পেয়ারা গাছে ঝুলতাম, পিঁপড়া নিয়ে খেলতাম, ১৯৯৮ এর কালবৈশাখী ঝড়ে হেলে পড়া জামগাছের উপর উঠে শুয়ে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা আর তাকিয়ে থাকতাম দূরের কোনো পাহাড়ে...



লঞ্চে করে আসার সময় বাবার কথায় ফিরে আসলাম আবার ২০০৭ সনে।

- বাবা টাকা নিয়ে কখনোই কার্পন্য করবা বা না। যখন যা লাগবে আমাকে বলবা।

- আচ্ছা আব্বু, বলবো আমি।

- না খেয়ে টাকা বাঁচাবে না কখনো।



আমি জানি আমার বাবা এই কথা কেনো বলছে। ছোট বেলা থেকেই আমি ভীষণ রকমের কৃপন। ‘কিপটা’ বলতে পারেন। অবশ্য আমার হাতেও সেরকম টাকা পয়সা দিতো না আমার মা। আমার মায়ের দৃড় বিশ্বাস ছিলো, টাকা পয়সা হচ্ছে পোলাপান নষ্ট করার মূল উপকরণ। তাই টাকার ভ্যালু কি তা আমার আমাকে কখনো বুঝতে দিতে চাইনি। ঈদের সালামি পাওয়ার পর তা পুড়োটা তুলে দিতাম মায়ের হাতে। আমার মা ও আমাকে সেলামি দিতো। কিন্তু দিনের শেষে সব টাকা এক করে (মায়ের দেওয়া সেলামী সহ) ফেরত দিতে হতো তাঁকে। দীর্ঘদিন টাকা জমিয়ে জমিয়ে মাটির ব্যাংক ভরে ফেলেছি, ভেঙ্গে ফেলে সে পয়সা আর টাকা আলাদা করে গুণতাম আমরা ঠিকই কিন্তু গোনা শেষে তা তুলে দিতে হতো মা কে। আর এটা ভালোবাসা থেকে দিতাম না, দিতাম কারণ এটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছে। আপনি একটি এলাকায় থাকেন আর সেই এলাকার গডফাদার কে চান্দা দিতে হয় কি হয় না, এটা কাউকে বলে দিতে হয় না। এটা সবাই যেমন জানে, সেরকম আমরাও জানতাম, আমাদের বাসার গডফাদার, পুলিশ কমিশনার, ডিসি, জজ-ব্যারিষ্টার, ত্রাতা-দাতা, মাতা মাত্র একজনই ছিল। আর সে হচ্ছে আমাদের ‘মা’। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে একদিন ঈদের সেলামি আমাকে আমার মা দিলো একশ টাকা। আমাকে বলল, “কি করবা এই টাকা দিয়ে ?” আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম না কি করবো এই টাকা দিয়ে। সারাদিন পকেটে টাকাটা নিয়ে ঘুড়ি, আর একটু পর পর প্যান্টের পকেট থেকে সাবধানে বের করে দেখি ঠিক আছে কিনা। রোদের মধ্যে একটু নাড়াচাড়া করলেই চক চক করে উঠতো পুড়ো নোটটি। তারপর আবার তা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিতাম। ৮ বছরের একটি ছেলের প্রথম বড় নোট পকেটে নিয়ে ঘুড়ে বেড়ানোর অনুভূতি যে কিরকম ছিলো তা হয়তো আপনারা কখনো বুঝার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারবেন না।



চকচকে টাকাটা রোদে নিয়ে দেখার সময়ই হয়তো দেখেছিলাম বাবা বাসায় ঢুকছে। আর পিছনে আমাদের কাজের মেয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঢুকছে। চট করেই আমার মাথায় এসেছিল আমি এই ১০০ টাকা দিয়ে কি করতে পারি। চাকুরীর কারণে বাবা আমাকে সারাদিন সময় দিতে পারতো না। তবে ছুটির দিনে বাবা আমাকে প্রতি সপ্তাহে একদিনের জন্য বাজারে নিয়ে যেত। বাজারের নাম ছিলো ‘রাঙ্গামাটি তবলছড়ি বাজার’। রাঙ্গামাটিতে রিকশা চলে না বলে প্রায় আড়াই কিলোর রাস্তা আমরা হেঁটে হেঁটে যেতাম। বাবার শক্ত সমর্থ হাতটা আমি শক্ত করে ধরে রেখে হেটে হেটে যেতাম আর ভাবতাম আমার বাবার মতো শক্তিশালী পুরুষ আর আছে কিনা। বাবা বাজার করতো আমি দেখতাম। আর কেনা কাটি শেষে তা ব্যাগে ভরতো আমাদের কাজের মেয়েটা।



আমি মা কে যেয়ে বললাম আমি ১০০ টাকা দিয়ে কাজের মেয়েকে নিয়ে বাসার জন্য বাজার করতে চাই। মা এই কথা শুনে ঢোল বাজাতে বাজাতে তা ছড়িয়ে দিলো আমাদের পরিচিত সবার কাছে। বাজার করবো এই উপলক্ষ্যে আমার বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার ফুটপাত থেকে আমার জন্য একটা ম্যানিব্যাগ কিনে দিল। পকেটে ম্যানিব্যাগ আর ম্যানিব্যাগের ভিতর ১০০ টাকার চকচকে নোট। ম্যানিব্যাগটা দিয়েছে বাবা, আর চক চকে নোটটা দিয়েছে মা, সেই বয়সে সুখী হওয়ার জন্য মনে হয় এতোটুকুই যথেষ্ঠ ছিল।

অবশেষে এলো সেই শুভদিন। টান টান উত্তেজনা নিয়ে আমি হাটছি একা একা। আজ আর আমার পাশে আমার শক্ত সামর্থ্য বাবা নেই। পিছন পিছন আমাদের কাজের মেয়ে আসছে। বাঁজারে আসতেই দেখলাম মাছ, সবজী আরো কত কিছু। কাজের মেয়ের নাম ছিলো ‘হোজী’ (অদ্ভুত নাম হলেও এই নামই ছিল, কাজের মেয়ে এবং আমাদের বাসার পরিস্থিতি নিয়ে চ্যাপ্টার ১৭ তে লিখেছি। এখন আপাততো এই নামেই থাকুক)। হোজিকে বললাম



- বলতো কি কি নেওয়া যায়।

- ছোড মাছ নিতে পারেন। খালাম্মা ছোড মাছ ভালা পায়।

- আচ্ছা তাহলে ছোট মাছ নে।



মাছওলা মাছ পলিথিন এ ভরেছে, আর আমিও আমার ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা বের করেছি। নোট টা বের করার পর বুকের ভিতর একটা কামড় দিয়ে উঠলো। এই নোট আমি কিভাবে মাছওলা কে দেই !! সে এটা তার ঐ ভেজা হাত দিয়ে আমার মায়ের দেওয়া নোট লুঙ্গির ভাঁজে গুঁজে রাখবে এখন।



- হোজি আম্মু তো মাছ খায় না।

- কি কন ভাইয়া!! খালাম্মা যেই পছন্দ এই মাছ।

- তুই আমার থেকে বেশী জানোস ? আম্মু কালকে মাংস দিয়ে ভাত খাইছে মাছ দিয়া না।



তারপর গেলাম সবজী কিনতে। যথারীতি অনুধাবণ করতে পারলাম আমার মা সবজীও খুব একটা পছন্দ করে না।

গতকাল মাংস দিয়ে খেলেও আজ কি খাবে ? ডেইলি ডেইলি এক আইটেম খায় কিভাবে মানুষ !!

বাসায় চাল, ডাল সব কিছুই আছে...

সুতরাং কোনো কিছু নেওয়ার মানে হয় না। হোজি তার সাথে করে নিয়ে আসা বাজারের ব্যাগ ভাঁজ করে আমার পিছন পিছন আসছে। আর ওদিকে বাসার সবাই আমাদের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে...



লঞ্চে করে আসছিলাম আর ভাবছিলাম সেদিনের কথা... আমার বাবা এখনো তা মনে রেখে আমাকে বলছে টাকা পয়সা নিয়ে কখনো কৃপণতা না করার জন্য। আমার বাবার কাছে আমি তখনো সেই রাঙ্গামাটিতে হাত ধরে দুলতে দুলতে যাওয়া সাগর রয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি যে কখন অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিলাম তা হয়তো আমার বাবা টের পায়নি সময়ের স্রোতে। ভাবছিলাম ঠিক এভাবেই তো ছোটবেলায় যেতাম একসাথে বাঁজারে। ঠিক এভাবেই তো একদিন সাহস করেছিলাম একা একা বাজার করে সবাইকে চমকে দেওয়ার... আর ঠিক তার পরপরই মনে হলো আমাকে না আবার খালি হাতে ঢাকা থেকে ফিরে আসতে হয় ছোটবেলার শখের বাজার করার মতো করে...

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৮

মামুন রশিদ বলেছেন: হাহাহা, মজা পেয়েছি আপনার ছোটবেলার কাইষ্টামি পড়ে ;)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.