নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

How the Universe formed

উপলব্দি প্রকাশ করি নির্ভয়ে

ড. মোস্তাফিজুর রহমান

I love to write. I like to enjoy fact and knowledge.

ড. মোস্তাফিজুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুমুসলিম জীবনে রমযান

১১ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:২০

দুনিয়া জুড়ে রমযানের প্রস্ততি চলছে। তাকওয়া অনুশীলনের মাসব্যাপী কর্মশালা শুরু হবে। মুসলমানদের জীবনে এই রমযান তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। চন্দ্রমাসের বা ইসলামীক ক্যালেন্ডারের নবম মাস রামাযান। এ মাসে মুসলমানদেও জীবনকে পূণর্মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে। রোজা ফরয হয় হিজরতের তর ১৮ মাস পরে, কিবলা পরিবর্তনের ১০ দিন পরে ২য় হিজরীতে, নবুয়তের ৫ম বছর। রামাযান আরবী শব্দ যা রমজ ধাতু হতে উৎপন্ন। এর অর্থ হচ্ছে ঝলসানোকারী বা প্রজ্জ্বলনকারী। আবার রোজা শব্দটি ফারসী ভাষা হতে এসেছে যার অর্থ পুড়িয়ে দেয়া। মোফাচ্ছেরীনগন বলেন এ মাসটিকে রামাযান বলার কারন হচ্ছে এ মাসে আল্লাহপাক তার সীমাহীন রহমত ও অনুগ্রহে বান্দাদের পাপ সমূহ পুড়িয়ে দেন, রোজার মাধ্যমে বান্দার সমস্ত কালীমা, পশুত্ব ভস্মীভুত হয়ে যায়। অন্যদিকে সাওম একটি আরবী শব্দ যার অর্থ বিরত থাকা বা আত্মসংযম করা। এটি আরবী সিয়াম শব্দের সমার্থক। তাওরাতে রোজাকে হাত্ব শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যার অর্থ পাপ মোচন করা। যবুরে রোজাকে ক্বোরবাত বলা হয়েছে যার অর্থ নৈকট্য লাভ করা বা নিকটবর্তী হওয়া। ইঞ্জিলে একে ত্বাব বলা হয়েছে যার অর্থ পবিত্র হওয়া বা নির্মল হওয়া। সার্বিক ভাবে রোজার ফলাফল তাকওয়ার দিকেই যায়। আল্লাহপাক সেকথাই পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলেন : ‘হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে’।

রোযার উদ্দেশ্যঃ

১. রোযা ধৈয্য ও সংযম শেখায়। আত্ম নিয়ন্ত্রন শক্তির উন্নয়ন ঘটায়। রসুল স. বলেছেনঃ ‘রমযান হল সবরের মাস, আর সবরের পুরস্কার হল জান্নাত’। রোযা আমাদের পরিবেশ দিয়ে সাহায্য করে যাতে করে আমরা অসৎ ইচ্ছা, খারাপ অভ্যাস প্রতিরোধ করতে পারি এবং শযতানের মোকাবেলায় ঢাল অর্জন করি। এতে নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। এজন্যই রোযাকে ঢাল স্বরূপ।

২. আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়ক।রোযা ইবাদতের সুযোগ ও তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। হযরত সালমান (রাযিঃ) বলেন, নবী করীম (সঃ) শাবান মাসের শেষ তারিখে আমাদিগকে নসীহত করেছেন যে তোমাদের উপর এমন একটি মাস আসছে, যা অত্যন্ত মর্যাদাশীল ও বরকত ময়।এই মাসে এমন একটি রাত্র রয়েছে,যা হাজার মাস থেকে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা এই মাসে রোযা রাখাকে ফরয করেছেন এবং এই মাসের রাত্রিগুলোতে (তারাবীহ) পড়াকে ছওয়াবের কাজ করেছেন।যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এই মাসে কোন নফল ইবাদত করল, সে যেন রমযানের বাইরে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এই মাসে কোন ফরজ আদায় করল সে যেন রমযানের বাইরে সত্তরটি ফরয আদায় করল। এটা ছবরের মাস আর ছবরের বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা জান্নাত রেখেছেন । মূল মাহাত্ম হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মানা। যখন যা করতে বলেছেন ঠিক তখন তা করা। যখন যা নিষেদ করেছেন তা না করা।

৩. অন্যের সম্পদ বা অধিকার হরণ থেকে বিরত রাখা।বৈধ জিনিষও সে সময় না করা মানে অবৈধ জিনিষের প্রশ্নই আসেনা। এভাবেই তাকওয়া ও আনুগত্যের অনুশীলন হয়ে যায়।

৪. আমরা দিতে শিখব, নিতে নয়। এ মাসে বেশী বেশী দান খয়রাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাছাড়া উপবাসের মাধ্যমে গরীবদেও সাথে একাত্মতা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়।

৫. পাপ মোচন করে। হাদীসে এসেছে ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আর এক জুমা এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান, এগুলো দুয়ের মাঝখানে যে পাপ হয় তা মুচে দেয় যদি কবিরা গুনাহ এড়িয়ে চলে। ইয়াহইয়া ইবনে বুকাইর রহৃৃৃআবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রমযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমযানের ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমযান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের (আত্মপর্যালোচনা/নিষ্ঠা/সাওযাব লাভের উদ্দেশ্যে ) সাথে রোযা রাখে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেযা হয”। বুখারী-মুসলিম।



৬. নিয়মানুবর্তীতা শেখায়। রোযা কঠিন ভাবে নিয়ম ও সময় মেনে চলে। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে ইফতার করা যাবেনা এক মিনিট পওে সেহরী খাওয়া যাবেনা।

৭. নাযাত ও মাগফিরাতের সুবর্ণ সুযোগ আনে। সাহল ইবনে সাআদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়ান। কিয়ামত দিবসে সেখান দিয়ে সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে। সে দরজা দিয়ে অন্য কেহ প্রবেশ করবে না। বলা হবে: সিয়াম পলনকারী কোথায়? তারা দাঁড়াবে, তারা ছাড়া আর কেহ প্রবেশ করবে না। তারা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কেহ সে স্থান দিয়ে প্রবেশ করবে না। (বুখারী মুসলিম)।

৮. দ্বীনের জন্য ত্যাগ-কোরবানীর স্বাক্ষ বহন করে এই মাহে রমযান। ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এই মাসেই।

৯. রিয়ামুক্ত ইবাদত করার প্রশিক্ষণ দেয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, রোযাদার বান্দা আমার জন্যই খাদ্য-পাণীয ও প্রবৃত্তি বর্জন করেছে। রোজা আমারই জন্য। আমিই এর প্রতিদান দেব বা আমি নিজেই এর প্রতিদান।



রমযানের গুরুত্বঃ রোযা ফরজ ও ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নর-নারী যাদের কোন শরয়ী ওযর নেই তাদের উপর রমযানের রোযা পালন করা ফরয। কেউ যদি বিনা ওযরে রোযা না রাখে সে এমন গুনাহ করলো যে, সারাজীবন রোযা রেখেও তার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে না। রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ‘কেউ যদি ওযর ছাড়া রমযানের একটি রোযা না রাখে তবে সারাজীবন রোযা রাখলেও এর ক্ষতিপূরণ হবে না’। (মিশকাতুল মাসাবীহ) হাদিস শরিফে এসেছে-‘যখন রমযান মাস শুরু হয় তখন আকাশের রহমাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শিকলে আবদ্ধ করে দেয়া হয়’। (বুখারী)



১. কুরআনের মাস: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদাযাতস্বরূপ এবং হিদাযাতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে” (বাকারাহ:১৮৫)।

আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন,

“আল্লাহ অন্যান্য মাসের মধ্যে সিযাম মাসের বিশেষ মর্যাদা তুলে ধরছেন। কারণ এ মাসকেই তিনি কুরআন নাযিল করার জন্য পছন্দ করেছেন”।

২. রমাযান জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস:

হযরত জাবির বিন সামুরা (রা.) রাসূল (স.) থেকে বর্ণনা করেন, “আমার কাছে একদা জিব্রাইল আগমন করলেন। বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা কাউকে জীবিত পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রমাদান মাস পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তির সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হলো, কিন্তু আপনার উপর দরুদ পডল না, অতঃপর মৃত্যু বারণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন”।

রাসূল (স.) ইরশাদ করেন:

“রমাযানের প্রতিটি দিন-রাতে আল্লাহ অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। তাদের প্রত্যেকের দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন”।

৩. সমাজ জীবনে সবার সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করা:

শাবান রমাযানের প্রস্তুতির মাস। এ মাসের একটি অন্যতম পবিত্র রজনী হচ্ছে ১৫তম রজনী। এ রাত সম্পর্ক হাদীসে রয়েছে,

“এ রাতে আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি তাকান। অতঃপর মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষপোষষকারী) ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন”। হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে রমাযানকে বরণ করা এ হাদীসের একটি অন্যতম দাবী। কারণ, মুশরিক শিরক করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আর মুশাহিন বিদ্বেষের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ক্রমান্বয়ে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে আল্লাহ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায। তাই রমাযান থেকে কোন প্রকার সুফল লাভ করতে পারেনা।

তাই রমাযানকে বরণ করে নেযার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, মানবীয পর্যায়ের সকল সম্পর্ককে সুসংহত ও উন্নত করা। যেমন, মানুষকে মাফ করে দেযা, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, আত্মীয-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায রাখা, মনকে হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা-পরশ্রীকতরতা থেকে পবিত্র করা। এতে মন পবিত্র হয। পবিত্র মন আসমানী শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হয। আল্লাহর রহমান ও মাগফিরাতের যোগ্য হয।

৪. রমযান লাইলাতুল কদরের মাস। রমযান মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত সালমান ফারসী ( রাদিযাল্লাহু তাআলা আনহু ) থেকে বর্ণিত, রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সাল্লাম ) শাবান মাসের শেষ দিন আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের নিকট এক মহান ও বরকতময মাস সমাগত। সে মাসে একটি রাত আছে, যা এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা এ মাসের তোমাদের উপর ফরজ করে দিযেেছন এবং ( তারাবীহ ইত্যাদির জন্য ) রাত জাগরণ করা সওযাবের বিষয করে দিযেেছন। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আদায করবে, সে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায়ের ফজীলত লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদাযরে সমান সওযাবের অধিকারী হবে।..

৫. তাকওয়ার সমাজ সৃষ্টি তাকওয়ার প্রথম দাবী। রোযার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু বান্দার তাকওয়া অর্জন তাই বান্দা তাকওয়ার দাবী পূরণে এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক।

৬. জীবনের সীমানা নির্ধারনি মাস হচ্ছে রমযান। হযরত আবুবকর রা. এর সময় প্রধান বিচারক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন হযরত উমর রা.। এক বছর পার হওয়ার পর তিনি খলীফাতুর মুসলিমিন হযরত আবুবকর রা. এর নিকট গিয়ে বললেন আমীরুল মু’মিনীন আমার তো কোন কাজ নেই। কেউ বিচার নিয়ে আমার কাছে আসেনা। খলীফা জিজ্ঞেস করলেন কেন? লোকজন কি আপনাকে ভয় পায়?। হযরত উমর রা. জবাব দিলেন আমার মনে হয় তা নয়। আমার বিশ্বাস এ অর্ধ দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ তাদেও জীবনের সীমানা চেনে। যখনি তারা সীমানায় চলে আসে থেমে যায়। সীমা লঙ্গন করেনা। সেজন্য অপরাধ হয়না। মানুষও আমার কাছে আসেনা।

রমযানের প্রস্তুতি

১. সিযামের বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রয়োযজনীয জ্ঞান অর্জন করা:

এজন্য ইরশাদ হয়েছে: তোমরা যদি না জানো, তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর” (আন-নাহল:৪৩)।

মূলত যারা ধর্মীয জ্ঞানে গভীরতা অর্জন করে, তারাই প্রকৃত ভাগ্যবান, তারাই শ্রেষ্ঠ। রাসূল (স.) বলেন,

ِدআল্লাহ যার কল্যাণ সাধন করতে চান, তাকে ধর্মের গভীর জ্ঞান দান করেন” (বুখারী-মুসলিম)।

২. বিশেষ বিশেষ কাজের অভ্যাস গড়ে তোলা:

ক. শাবানের সিযাম: এ কারণেই রাসূল শাবানের রোযা রাখতেন। ফলে রমাদানের রোজা আসার আগেই দেহ-মন রোজায অভ্যস্ত হয়ে যেত।

খ. রাত্রি জেগে নামায পডা: রমাদানে দুটি কিযামুল লাইল আছে। একটি তাবারীহ। অন্যটি তাহাজ্জুদ। রামাদান যেহেতু জীবনের মহাসুযোগ। তাই রমাদানের আগে থেকেই রাতজেগে নামায পডার কিছু কিছু অভ্যাস গডতে পারলে রহমাতের মৌসুমে তা সহাযক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

গ. কুরআন তিলাওযাতের অভ্যাস:

রমাদান কুরআনের মাস। কুরআনের কারণেই রমাদানের মহাসম্মান। ইবনে রজব আল-হাম্বলী বলেন,

“শাবান যেহেতু, রমাদানের ভূমিকাস্বরূপ, তাই রমাদানে যা কিছু শরীযতসিদ্ধ, শাবানেও তা-ই শরীযতসিদ্ধ। যেমন, সিযাম, কুরআন তিলাওযাত। যাতে রমাদানকে গ্রহণ করে নেযার প্রস্তুতি অর্জিত হয। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি নাফস বশীভূত হয। সালামাহ বিন কুহাইল “শাবানকে বলা হতো, কারীদের (কুরআন তিলাওযাত ও চর্চাকারীদের) মাস”।

ঘ. বদঅভ্যাসসমূহ পরিত্যাগ করা এবং সদাভ্যাস ধারণ করা:

মানুষ অভ্যাসের দাস নয; বরং অভ্যাসই মানুষের দাস। এ কথা সিয়াম সাধনার দ্বারা প্রমাণিত হয। তবে সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় আগেভাগেই। তাই সিয়াম সড়কে আমাদের যাত্রা শুরু হোক সকল বদাভ্যাস মুক্ত হয়ে সদাভ্যাসের শুভ্র পোশাকে অলংকৃত হয়ে।

৩. মুহাসাবতুন নাফস বা আত্ম পর্যালোচনা:

জবাবদিহিতাশুন্য, বলগাহীন, যথেচ্ছ জীবন যাপন করা মুমিনের পরিচয নয। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহিতা করার পূর্বেই মুমিন নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করে। আল্লাহ বলেন:

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত” (সূরা আল-হাশর:১৮) ।

এ জন্য রমাদান আসার আগেই প্রত্যেক মুমিনের উচিত আত্মসমালোচনা করা।

৪. সওয়াবের মওকা:

রমযান মাসে মুমিনের ইবাদতের সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয় বহুগুণে। হাদিসের ভাষায়ঃ ‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ হতে সত্তরগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়’। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এই নয়টি হরফের শব্দটি একবার উচ্চারণ করে ১০ নেকী হিসাবে ৯০ নেকী পাবে। ওযুসহ পড়লে ২১৫ নেকী, বসা নামাযে পড়লে ৪৫০ নেকী, নামাযে দাঁড়িয়ে পড়লে ৯০০ নেকী আর রমযানে পড়লে ৭০ গুণ হিসাবে ৬৩০০০ নেকী পাওয়া যাবে। তাই এ মাসে বেশি বেশি করে নেক আমল করা দরকার।

৫. খাবার অভ্যাস স্বাভাবিক ভাবেই রমযানে পরিবর্তন করতে হয়। সন্ধ্যায় মাগরিবের পর ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খান। কোন ভাবেই অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক হবেনা। সন্ধ্যায় চা, কপি, সোডা জাতীয় খাবার পরিহার করুন। তরল ও পানি বেশি খান। ফল খাওয়া যেতে পারে। ভাজা পোড়া ও মসলা জাতীয় খাবার কম গ্রহন করুন। প্রচুর পরিমানে মিসওয়াক করুন।

আসুন রমযানের কদর করিঃ

মাহে রমযানের এত বেশি গুরুত্ব মূলত পবিত্র কুরআনের কারণে। এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। তাই এ মাসে কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে, কুরআন নাযিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করে সে অনুযায়ী আত্মগঠন করতে হবে। মনকে ইবাদতের মাঝে নিবিষ্ট করার জন্য অর্থ বুঝে নামাযে কুরআন পড়তে হবে। রমযানে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব সমধিক। হাদিসে এসেছেঃ ‘রোযা ও কুরআন রোযাদার ব্যক্তির জন্য শাফাআত করবে। রোযা বলবে হে আল্লাহ! আমি অমুক ব্যক্তিকে দিনের বেলা পানাহার ও কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি, তার পক্ষে আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সুপারিশ গ্রহণ করবেন। এভাবে কুরআন সুপারিশ করবে এই বলে যে, হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে রাত্রের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন, আল্লাহ তার সুপারিশ গ্রহণ করবেন।(বায়হাকী)। ব‘ত মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কুরআন নাযিলের ঘটনা। কুরআনের আলোকেই মানব জীবনকে সাজাতে হবে, ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কুরআন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সূর্যবিহীন সৌরজগৎ যেমন নিষ্প্রভ ও তিমিরাচ্ছন্ন তেমনি কুরআনবিহীন মানব সমাজ নিরর্থক ও অকল্পনীয়। মাহে রমযান থেকে এ শিক্ষা নেয়া জরুরি।

রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ‘রোযা রেখে যে মিথ্যা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার ত্যাগ করার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই (বুখারী, মুসলিম)। অন্য হাদিসে আছে ‘কিছুসংখ্যক রোযাদার রোযার ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্টভোগ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না। আবার কিছুসংখ্যক রাতজাগা লোকের রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না’। তাকওয়া এমন একটি মহৎ গুণ যার মাধ্যমে রিযিকের ফায়সালা হয় এবং বরকতের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেনঃ ‘যদি লোকালয়ের লোকেরা ঈমান আনে তাকওয়া অবলম্বন করে, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও জমিনের বরকতসমূহের দরজা খুবে দেব (সুরা আরাফঃ ৯৬)।

তাই আমাদের সামর্থের সকল প্রচেষ্টা দিয়ে রমযানের ইবাদতে ব্রতী হওয়া জরুরি। ঈমানী চেতনাকে শানিত করতে রমযান মহাসুযোগও বটে। আসুন আমাদের ইমানকে উজ্জিবীত ও তাজা করি।

সলিম জীবনে রমযান

দুনিয়া জুড়ে রমযানের প্রস্ততি চলছে। তাকওয়া অনুশীলনের মাসব্যাপী কর্মশালা শুরু হবে। মুসলমানদের জীবনে এই রমযান তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। চন্দ্রমাসের বা ইসলামীক ক্যালেন্ডারের নবম মাস রামাযান। এ মাসে মুসলমানদেও জীবনকে পূণর্মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে। রোজা ফরয হয় হিজরতের তর ১৮ মাস পরে, কিবলা পরিবর্তনের ১০ দিন পরে ২য় হিজরীতে, নবুয়তের ৫ম বছর। রামাযান আরবী শব্দ যা রমজ ধাতু হতে উৎপন্ন। এর অর্থ হচ্ছে ঝলসানোকারী বা প্রজ্জ্বলনকারী। আবার রোজা শব্দটি ফারসী ভাষা হতে এসেছে যার অর্থ পুড়িয়ে দেয়া। মোফাচ্ছেরীনগন বলেন এ মাসটিকে রামাযান বলার কারন হচ্ছে এ মাসে আল্লাহপাক তার সীমাহীন রহমত ও অনুগ্রহে বান্দাদের পাপ সমূহ পুড়িয়ে দেন, রোজার মাধ্যমে বান্দার সমস্ত কালীমা, পশুত্ব ভস্মীভুত হয়ে যায়। অন্যদিকে সাওম একটি আরবী শব্দ যার অর্থ বিরত থাকা বা আত্মসংযম করা। এটি আরবী সিয়াম শব্দের সমার্থক। তাওরাতে রোজাকে হাত্ব শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যার অর্থ পাপ মোচন করা। যবুরে রোজাকে ক্বোরবাত বলা হয়েছে যার অর্থ নৈকট্য লাভ করা বা নিকটবর্তী হওয়া। ইঞ্জিলে একে ত্বাব বলা হয়েছে যার অর্থ পবিত্র হওয়া বা নির্মল হওয়া। সার্বিক ভাবে রোজার ফলাফল তাকওয়ার দিকেই যায়। আল্লাহপাক সেকথাই পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলেন : ‘হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে’।

রোযার উদ্দেশ্যঃ

১. রোযা ধৈয্য ও সংযম শেখায়। আত্ম নিয়ন্ত্রন শক্তির উন্নয়ন ঘটায়। রসুল স. বলেছেনঃ ‘রমযান হল সবরের মাস, আর সবরের পুরস্কার হল জান্নাত’। রোযা আমাদের পরিবেশ দিয়ে সাহায্য করে যাতে করে আমরা অসৎ ইচ্ছা, খারাপ অভ্যাস প্রতিরোধ করতে পারি এবং শযতানের মোকাবেলায় ঢাল অর্জন করি। এতে নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। এজন্যই রোযাকে ঢাল স্বরূপ।

২. আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়ক।রোযা ইবাদতের সুযোগ ও তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। হযরত সালমান (রাযিঃ) বলেন, নবী করীম (সঃ) শাবান মাসের শেষ তারিখে আমাদিগকে নসীহত করেছেন যে তোমাদের উপর এমন একটি মাস আসছে, যা অত্যন্ত মর্যাদাশীল ও বরকত ময়।এই মাসে এমন একটি রাত্র রয়েছে,যা হাজার মাস থেকে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা এই মাসে রোযা রাখাকে ফরয করেছেন এবং এই মাসের রাত্রিগুলোতে (তারাবীহ) পড়াকে ছওয়াবের কাজ করেছেন।যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এই মাসে কোন নফল ইবাদত করল, সে যেন রমযানের বাইরে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এই মাসে কোন ফরজ আদায় করল সে যেন রমযানের বাইরে সত্তরটি ফরয আদায় করল। এটা ছবরের মাস আর ছবরের বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা জান্নাত রেখেছেন । মূল মাহাত্ম হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মানা। যখন যা করতে বলেছেন ঠিক তখন তা করা। যখন যা নিষেদ করেছেন তা না করা।

৩. অন্যের সম্পদ বা অধিকার হরণ থেকে বিরত রাখা।বৈধ জিনিষও সে সময় না করা মানে অবৈধ জিনিষের প্রশ্নই আসেনা। এভাবেই তাকওয়া ও আনুগত্যের অনুশীলন হয়ে যায়।

৪. আমরা দিতে শিখব, নিতে নয়। এ মাসে বেশী বেশী দান খয়রাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাছাড়া উপবাসের মাধ্যমে গরীবদেও সাথে একাত্মতা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়।

৫. পাপ মোচন করে। হাদীসে এসেছে ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আর এক জুমা এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান, এগুলো দুয়ের মাঝখানে যে পাপ হয় তা মুচে দেয় যদি কবিরা গুনাহ এড়িয়ে চলে। ইয়াহইয়া ইবনে বুকাইর রহৃৃৃআবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রমযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমযানের ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমযান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের (আত্মপর্যালোচনা/নিষ্ঠা/সাওযাব লাভের উদ্দেশ্যে ) সাথে রোযা রাখে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেযা হয”। বুখারী-মুসলিম।



৬. নিয়মানুবর্তীতা শেখায়। রোযা কঠিন ভাবে নিয়ম ও সময় মেনে চলে। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে ইফতার করা যাবেনা এক মিনিট পওে সেহরী খাওয়া যাবেনা।

৭. নাযাত ও মাগফিরাতের সুবর্ণ সুযোগ আনে। সাহল ইবনে সাআদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়ান। কিয়ামত দিবসে সেখান দিয়ে সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে। সে দরজা দিয়ে অন্য কেহ প্রবেশ করবে না। বলা হবে: সিয়াম পলনকারী কোথায়? তারা দাঁড়াবে, তারা ছাড়া আর কেহ প্রবেশ করবে না। তারা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কেহ সে স্থান দিয়ে প্রবেশ করবে না। (বুখারী মুসলিম)।

৮. দ্বীনের জন্য ত্যাগ-কোরবানীর স্বাক্ষ বহন করে এই মাহে রমযান। ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এই মাসেই।

৯. রিয়ামুক্ত ইবাদত করার প্রশিক্ষণ দেয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, রোযাদার বান্দা আমার জন্যই খাদ্য-পাণীয ও প্রবৃত্তি বর্জন করেছে। রোজা আমারই জন্য। আমিই এর প্রতিদান দেব বা আমি নিজেই এর প্রতিদান।



রমযানের গুরুত্বঃ রোযা ফরজ ও ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নর-নারী যাদের কোন শরয়ী ওযর নেই তাদের উপর রমযানের রোযা পালন করা ফরয। কেউ যদি বিনা ওযরে রোযা না রাখে সে এমন গুনাহ করলো যে, সারাজীবন রোযা রেখেও তার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে না। রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ‘কেউ যদি ওযর ছাড়া রমযানের একটি রোযা না রাখে তবে সারাজীবন রোযা রাখলেও এর ক্ষতিপূরণ হবে না’। (মিশকাতুল মাসাবীহ) হাদিস শরিফে এসেছে-‘যখন রমযান মাস শুরু হয় তখন আকাশের রহমাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শিকলে আবদ্ধ করে দেয়া হয়’। (বুখারী)



১. কুরআনের মাস: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদাযাতস্বরূপ এবং হিদাযাতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে” (বাকারাহ:১৮৫)।

আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন,

“আল্লাহ অন্যান্য মাসের মধ্যে সিযাম মাসের বিশেষ মর্যাদা তুলে ধরছেন। কারণ এ মাসকেই তিনি কুরআন নাযিল করার জন্য পছন্দ করেছেন”।

২. রমাযান জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস:

হযরত জাবির বিন সামুরা (রা.) রাসূল (স.) থেকে বর্ণনা করেন, “আমার কাছে একদা জিব্রাইল আগমন করলেন। বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা কাউকে জীবিত পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রমাদান মাস পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তির সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হলো, কিন্তু আপনার উপর দরুদ পডল না, অতঃপর মৃত্যু বারণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমাত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন”।

রাসূল (স.) ইরশাদ করেন:

“রমাযানের প্রতিটি দিন-রাতে আল্লাহ অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। তাদের প্রত্যেকের দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন”।

৩. সমাজ জীবনে সবার সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করা:

শাবান রমাযানের প্রস্তুতির মাস। এ মাসের একটি অন্যতম পবিত্র রজনী হচ্ছে ১৫তম রজনী। এ রাত সম্পর্ক হাদীসে রয়েছে,

“এ রাতে আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি তাকান। অতঃপর মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষপোষষকারী) ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন”। হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে রমাযানকে বরণ করা এ হাদীসের একটি অন্যতম দাবী। কারণ, মুশরিক শিরক করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আর মুশাহিন বিদ্বেষের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ক্রমান্বয়ে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে আল্লাহ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায। তাই রমাযান থেকে কোন প্রকার সুফল লাভ করতে পারেনা।

তাই রমাযানকে বরণ করে নেযার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, মানবীয পর্যায়ের সকল সম্পর্ককে সুসংহত ও উন্নত করা। যেমন, মানুষকে মাফ করে দেযা, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, আত্মীয-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায রাখা, মনকে হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা-পরশ্রীকতরতা থেকে পবিত্র করা। এতে মন পবিত্র হয। পবিত্র মন আসমানী শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হয। আল্লাহর রহমান ও মাগফিরাতের যোগ্য হয।

৪. রমযান লাইলাতুল কদরের মাস। রমযান মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত সালমান ফারসী ( রাদিযাল্লাহু তাআলা আনহু ) থেকে বর্ণিত, রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সাল্লাম ) শাবান মাসের শেষ দিন আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের নিকট এক মহান ও বরকতময মাস সমাগত। সে মাসে একটি রাত আছে, যা এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা এ মাসের তোমাদের উপর ফরজ করে দিযেেছন এবং ( তারাবীহ ইত্যাদির জন্য ) রাত জাগরণ করা সওযাবের বিষয করে দিযেেছন। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আদায করবে, সে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায়ের ফজীলত লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদাযরে সমান সওযাবের অধিকারী হবে।..

৫. তাকওয়ার সমাজ সৃষ্টি তাকওয়ার প্রথম দাবী। রোযার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু বান্দার তাকওয়া অর্জন তাই বান্দা তাকওয়ার দাবী পূরণে এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক।

৬. জীবনের সীমানা নির্ধারনি মাস হচ্ছে রমযান। হযরত আবুবকর রা. এর সময় প্রধান বিচারক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন হযরত উমর রা.। এক বছর পার হওয়ার পর তিনি খলীফাতুর মুসলিমিন হযরত আবুবকর রা. এর নিকট গিয়ে বললেন আমীরুল মু’মিনীন আমার তো কোন কাজ নেই। কেউ বিচার নিয়ে আমার কাছে আসেনা। খলীফা জিজ্ঞেস করলেন কেন? লোকজন কি আপনাকে ভয় পায়?। হযরত উমর রা. জবাব দিলেন আমার মনে হয় তা নয়। আমার বিশ্বাস এ অর্ধ দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ তাদেও জীবনের সীমানা চেনে। যখনি তারা সীমানায় চলে আসে থেমে যায়। সীমা লঙ্গন করেনা। সেজন্য অপরাধ হয়না। মানুষও আমার কাছে আসেনা।

রমযানের প্রস্তুতি

১. সিযামের বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রয়োযজনীয জ্ঞান অর্জন করা:

এজন্য ইরশাদ হয়েছে: তোমরা যদি না জানো, তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর” (আন-নাহল:৪৩)।

মূলত যারা ধর্মীয জ্ঞানে গভীরতা অর্জন করে, তারাই প্রকৃত ভাগ্যবান, তারাই শ্রেষ্ঠ। রাসূল (স.) বলেন,

ِدআল্লাহ যার কল্যাণ সাধন করতে চান, তাকে ধর্মের গভীর জ্ঞান দান করেন” (বুখারী-মুসলিম)।

২. বিশেষ বিশেষ কাজের অভ্যাস গড়ে তোলা:

ক. শাবানের সিযাম: এ কারণেই রাসূল শাবানের রোযা রাখতেন। ফলে রমাদানের রোজা আসার আগেই দেহ-মন রোজায অভ্যস্ত হয়ে যেত।

খ. রাত্রি জেগে নামায পডা: রমাদানে দুটি কিযামুল লাইল আছে। একটি তাবারীহ। অন্যটি তাহাজ্জুদ। রামাদান যেহেতু জীবনের মহাসুযোগ। তাই রমাদানের আগে থেকেই রাতজেগে নামায পডার কিছু কিছু অভ্যাস গডতে পারলে রহমাতের মৌসুমে তা সহাযক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

গ. কুরআন তিলাওযাতের অভ্যাস:

রমাদান কুরআনের মাস। কুরআনের কারণেই রমাদানের মহাসম্মান। ইবনে রজব আল-হাম্বলী বলেন,

“শাবান যেহেতু, রমাদানের ভূমিকাস্বরূপ, তাই রমাদানে যা কিছু শরীযতসিদ্ধ, শাবানেও তা-ই শরীযতসিদ্ধ। যেমন, সিযাম, কুরআন তিলাওযাত। যাতে রমাদানকে গ্রহণ করে নেযার প্রস্তুতি অর্জিত হয। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি নাফস বশীভূত হয। সালামাহ বিন কুহাইল “শাবানকে বলা হতো, কারীদের (কুরআন তিলাওযাত ও চর্চাকারীদের) মাস”।

ঘ. বদঅভ্যাসসমূহ পরিত্যাগ করা এবং সদাভ্যাস ধারণ করা:

মানুষ অভ্যাসের দাস নয; বরং অভ্যাসই মানুষের দাস। এ কথা সিয়াম সাধনার দ্বারা প্রমাণিত হয। তবে সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় আগেভাগেই। তাই সিয়াম সড়কে আমাদের যাত্রা শুরু হোক সকল বদাভ্যাস মুক্ত হয়ে সদাভ্যাসের শুভ্র পোশাকে অলংকৃত হয়ে।

৩. মুহাসাবতুন নাফস বা আত্ম পর্যালোচনা:

জবাবদিহিতাশুন্য, বলগাহীন, যথেচ্ছ জীবন যাপন করা মুমিনের পরিচয নয। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহিতা করার পূর্বেই মুমিন নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করে। আল্লাহ বলেন:

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত” (সূরা আল-হাশর:১৮) ।

এ জন্য রমাদান আসার আগেই প্রত্যেক মুমিনের উচিত আত্মসমালোচনা করা।

৪. সওয়াবের মওকা:

রমযান মাসে মুমিনের ইবাদতের সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয় বহুগুণে। হাদিসের ভাষায়ঃ ‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ হতে সত্তরগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়’। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এই নয়টি হরফের শব্দটি একবার উচ্চারণ করে ১০ নেকী হিসাবে ৯০ নেকী পাবে। ওযুসহ পড়লে ২১৫ নেকী, বসা নামাযে পড়লে ৪৫০ নেকী, নামাযে দাঁড়িয়ে পড়লে ৯০০ নেকী আর রমযানে পড়লে ৭০ গুণ হিসাবে ৬৩০০০ নেকী পাওয়া যাবে। তাই এ মাসে বেশি বেশি করে নেক আমল করা দরকার।

৫. খাবার অভ্যাস স্বাভাবিক ভাবেই রমযানে পরিবর্তন করতে হয়। সন্ধ্যায় মাগরিবের পর ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খান। কোন ভাবেই অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক হবেনা। সন্ধ্যায় চা, কপি, সোডা জাতীয় খাবার পরিহার করুন। তরল ও পানি বেশি খান। ফল খাওয়া যেতে পারে। ভাজা পোড়া ও মসলা জাতীয় খাবার কম গ্রহন করুন। প্রচুর পরিমানে মিসওয়াক করুন।

আসুন রমযানের কদর করিঃ

মাহে রমযানের এত বেশি গুরুত্ব মূলত পবিত্র কুরআনের কারণে। এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। তাই এ মাসে কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে, কুরআন নাযিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করে সে অনুযায়ী আত্মগঠন করতে হবে। মনকে ইবাদতের মাঝে নিবিষ্ট করার জন্য অর্থ বুঝে নামাযে কুরআন পড়তে হবে। রমযানে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব সমধিক। হাদিসে এসেছেঃ ‘রোযা ও কুরআন রোযাদার ব্যক্তির জন্য শাফাআত করবে। রোযা বলবে হে আল্লাহ! আমি অমুক ব্যক্তিকে দিনের বেলা পানাহার ও কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি, তার পক্ষে আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সুপারিশ গ্রহণ করবেন। এভাবে কুরআন সুপারিশ করবে এই বলে যে, হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে রাত্রের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন, আল্লাহ তার সুপারিশ গ্রহণ করবেন।(বায়হাকী)। ব‘ত মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কুরআন নাযিলের ঘটনা। কুরআনের আলোকেই মানব জীবনকে সাজাতে হবে, ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কুরআন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সূর্যবিহীন সৌরজগৎ যেমন নিষ্প্রভ ও তিমিরাচ্ছন্ন তেমনি কুরআনবিহীন মানব সমাজ নিরর্থক ও অকল্পনীয়। মাহে রমযান থেকে এ শিক্ষা নেয়া জরুরি।

রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ‘রোযা রেখে যে মিথ্যা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার ত্যাগ করার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই (বুখারী, মুসলিম)। অন্য হাদিসে আছে ‘কিছুসংখ্যক রোযাদার রোযার ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্টভোগ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না। আবার কিছুসংখ্যক রাতজাগা লোকের রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না’। তাকওয়া এমন একটি মহৎ গুণ যার মাধ্যমে রিযিকের ফায়সালা হয় এবং বরকতের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেনঃ ‘যদি লোকালয়ের লোকেরা ঈমান আনে তাকওয়া অবলম্বন করে, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও জমিনের বরকতসমূহের দরজা খুবে দেব (সুরা আরাফঃ ৯৬)।

তাই আমাদের সামর্থের সকল প্রচেষ্টা দিয়ে রমযানের ইবাদতে ব্রতী হওয়া জরুরি। ঈমানী চেতনাকে শানিত করতে রমযান মহাসুযোগও বটে। আসুন আমাদের ইমানকে উজ্জিবীত ও তাজা করি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.