নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তারা বলে সম্ভব না, আমি বলি সম্ভাবনা

অাল অামীন

ভেজা মেঘ হয়ে শুধু নীল আকাশে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করে.........

অাল অামীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ড. জামাল নজরুর ইসলাম - সংবেদনশীল এক মানুষের মহাপ্রয়াণ

১৮ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:৫৯

প্রকৃতির নিয়মেই একসময় সব মানুষকেই চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে। কিন্তু কারো চলে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়, কষ্ট হয়, হাহাকার উঠে, সৃষ্টি হয় এক ভয়ঙ্কর শূন্যতার। চীনা দার্শনিকের কথায় ‘কারো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারি, আবার কারো মৃত্যু বেলে হাসের পালকের চেয়ে হালকা’।

যারা মানুষের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করে তাদের মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারি। মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম আর মানব সভ্যতা অনন্তকাল তাদের স্মৃতি ও কর্মকে বয়ে বেড়ায়। এসব মানুষদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানী, শিক্ষক, চিন্তাবিদ ও এক পরম সংবেদনশীল মানুষ প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম।

এত শীঘ্র, এত অগোচরে, সবাইকে অনেকটা না জানিয়ে তিনি চলে যাবেন কেউ ভাবতে পারেনি। তার গুণগ্রাহী সুহৃদ কিংবা আপনজনরা তাকে আরো বহুদিন পাবে বলে আশা করেছিল। তবু তিনি চলে গেলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভৌতবিজ্ঞানী ও প্রফেসর ইমিরেটাস ড. জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বিশ্ববরেণ্য এ শিক্ষাবিদ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক। তার তিরোধানে চট্টগ্রামের মানুষ তাদের এক প্রিয় অভিভাবককে হারাল। রাজনৈতিক দলবাজিতার এ নষ্ট সময়ে তিনি কোন দলের অথবা গোষ্ঠীর করে নিজেকে বিক্রি করেননি। তবে সাধারণ মানুষ, দলিত মানুষ, অভিভাবকহীন মানুষের তিনি ছিলেন অভিভাবক।

শিশুর মত সরল ছিলেন তিনি। আকাশের মত উদার ছিল তার মন। বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞানভান্ডারে তার ছিল স্বভাবসিদ্ধ যাতায়াত। তার চিন্তা ও জানার জগৎ ছিল বিশাল ক্যানভাসের। যে কেউ যে কোন সভায় ডাকলে তাকে পেতেন নি:খরচায় বিনা অজুহাতে। সময়মত অনুষ্ঠানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। মিট মিট করে হাসতেন শিশুদের মত। হাতে সব সময় থাকত বই সাথে বন্ধুর মত ছায়ার মত প্রায়শই থাকতেন তার স্ত্রী। বক্তব্য দিতে উঠলে মনে হত অনেক কথা বলার আকুতি তার মধ্যে। পুঁজিবাদি দেশগুলোর শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্র আমাদের মত দেশগুলো কিভাবে শোষণের নিগড়ে আষ্টপৃষ্ঠে বাধা তার চিত্র আঁকতে চাইতেন শ্রোতা দর্শকদের সামনে। তাগিদ দিতেন নিজেদের সম্পদের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষার। বিদেশি সাহায্য নির্ভরতাকে তিনি সমাজের যাবতীয় অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে প্রতিটি বক্তব্য বিবৃতিতে উল্লেখ করতেন। শোষণহীন, সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন তিনি।

মানুষের উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল মহান এই শিক্ষাবিদের। জনগণের শক্তির উত্থান চাইতেন সব সময়। যেখানেই মানুষের স্বার্থের কথা সেখানে তিনি চলে যেতেন একজন সাধারণ মানুষের মত। কারো ডাকার অপেক্ষা করতেন না তিনি। তবে কখনই যেতেন না প্রতারক, প্রবঞ্চক ও মানুষের স্বার্থ বিরোধীদের আহ্বানে। দুনিয়ার সর্বশেষ আবিষ্কার আর মানুষের সংগ্রামের খবর রাখতেন তিনি। বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক জগৎ থেকে আরেক জগতে চলে যেতেন। এতে অনেকে হয়ত বিরক্তও হতেন কখনও কখনও। তবু নিজের মধ্যে থাকা অনেক কিছুকে ব্যক্ত করতেন তিনি মানুষের লড়াইকে শানিত করতে।

রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত থেকে শুরু করে সেক্সপিয়ার মিল্টন সবাইকে তিনি উদ্ধৃত করতেন অহরহ। বলার চেষ্টা করতেন সকলের অন্তর্গত আকাঙক্ষা ছিল মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করা। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। সারা জীবন কাজ করেছেন অংক শাস্ত্র ও পদার্থ বিজ্ঞানের মতমৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে । নিজে ভাল গান গাইতেন। শুনেছি অনেক সময় বাসায় সঙ্গীতের আসর বসাতেন। অনেক অনুষ্ঠানে গানও করেছেন তিনি। এক কথায় একজন সমগ্র মানুষ হওয়ার জন্য যতগুলো মহৎ গুণাবলী থাকা দরকার তার বেশিরভাগই ছিল এ মানুষটির মধ্যে।

১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ড. জামাল নজরুল ইসলাম ঝিনাইদহ সদরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা তখন এই শহরের মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য) ছিলেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তাঁর বাবা কলকাতায় বদলি হন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস ছিলেন। বিশিষ্ট এ বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।

ড. জামাল নজরুল গণিত এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন। বেশকিছু গাণিতিক সূত্র এবং জটিল গাণিতিক তত্ত্বের সহজ পন্থার উদ্ভাবক জামাল নজরুল মহাকাশের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন। তাঁর লেখা বেশকিছু বই অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি একাধারে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ,জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ। তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। ড. জামাল নজরুল প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনের পাশাপাশি পরিবেশসহ বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।

ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অধ্যাপক জামাল নজরুল কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজে ১৯৬৮,১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে ড. জামাল নজরুল বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

ব্যক্তি জীবনে এত ধরনের সাফল্যের অনেক কিছুই অনেকের জানা ছিল না। তিনি ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ, এক অতি নির্লোভ সহজ সরল মানুষ। চট্টগ্রামের রিকশা চালক, সাম্পানের মাঝি,কারখানা শ্রমিক এমনকি মাঠের কৃষক সবার কাছে তিনি ছিলেন স্যার। তাঁর সরলতায় ও মহত্মতায় মানুষ মুগ্ধ হতো। কোন দলের পরিচয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ দেননি এই মানুষটি। মানবতার জন্য, মানুষের জন্য সংবেদনশীল এ মানুষটিকে হারিয়ে কেবল চট্টগ্রামের মানুষ নয় সব মানুষ যারা তাকে চিনতেন তারা বেদনাবিদ্ধ। তাঁর অনুপস্থিতি সবাইকে বার বার তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

লেখক: আমাদের আলী হায়দার ভাই। ব্যুরো চীফ, বণিক বার্তা, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.