নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসীম সোবাহানের ভাবনা

ওয়াসীম সোবাহান চৌধুরী

ওয়াসীম সোবাহান চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

মধ্যাহ্ন ও দেয়াল

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫৬

যখন মধ্যাহ্ন উপন্যাসে পড়ি যে কাঠমিস্ত্রি সুলেমানের রূপবতী স্ত্রী জুলেখা তালাকের পর আশ্রয় নেয় বেশ্যাপল্লীতে এবং পরে কলকাতায় গিয়েসুকণ্ঠি গায়িকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে তখন জানতে ইচ্ছে হয় এই চরিত্র কি বাস্তবে ছিল নাকি লেখকের কল্পনা থেকে এসেছে। ধন্ধে পড়ি কারন উপন্যাসে এক সময় এসে হাজির হন জোড়াসাঁকোর জমিদার পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি গান লেখেন, সুর দেন! উপন্যাসে আরও হাজির আছেন নেত্রকোনার উকিল মুন্সী যাকে ১৯৯৪ সালে 'যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ' উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ; ২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিনে সিনেমাতেও বারী সিদ্দীকীর কন্ঠে হুমায়ুন আহমেদ ব্যবহার করেছিলেন উকিল মুন্সীর তিনটি গান। অন্য এক জায়গায় উপস্থিত হন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিহাস থেকে উঠে আসা চরিত্রগুলো চমৎকার ভাবে মিশে যায়।

হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসেও অহরহ উঠে আসে পরিচিত চরিত্র - বঙ্গবন্ধু; তার খুনী ফারুক, রশিদ; জিয়াউর রহমান, খালেদ মশাররফ, তাহের। মধ্যাহ্ন উপন্যাস প্রথম পর্যায়ে আবর্ত হয়েছে ব্যবসায়ী হরিচরণ সাহাকে নিয়ে যিনি এক মুসলমান বালককে আদর করার দোষে সমাজচ্যুত হন এবং পরবর্তীতে ঋষিসুলভ জীবন বেছে নেন। এটি সেই অর্থে ঐতিহাসিক উপন্যাস নয় কারন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়নি যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বর্ণনা এসেছে। বরং এখানে উঠে এসেছে বিংশ শতাব্দীর বাংলা। অপরদিকে দেয়াল উপন্যাসে উঠে এসেছে একটা নির্দিষ্ট সময় / বিষয় - মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। মধ্যাহ্ন উপন্যাসে ধারাবাহিকতা রয়েছে কিন্তু দেয়াল একটু ছন্নছাড়া।



দুইটি উপন্যাসেই পাঠকের মনোরঞ্জনই গল্পকারের প্রধান লক্ষ্য, এবং তিনি দুর্দান্ত ভাবে সফল। তবে মধ্যাহ্ন উপন্যাসে দেখি কিছু অতিলৌকিক ও আধিভৌতিক ঘটনা এসেছে যার কোনটাই অবাস্তব লাগে না; দেয়াল উপন্যাসে সবই লৌকিক কিন্তু তাও কিছু কিছু দৃশ্য বাস্তব লাগে না। মধ্যাহ্ন উপন্যাসে একটা বিশাল পরিসরে লেখক ধর্ম, বর্ণ ও জাতের বিভেদ তুলে ধরেছেন বিশদ ভাবে; দেয়াল উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু হত্যা, কারাগারে চার নেতা হত্যা, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতার বিপ্লব, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাগ্রহণ এবং তাহেরের ফাঁসি তুলে ধরেছেন অল্প পরিসরে।

দেয়াল উপন্যাসে প্রথমদিকে হুমায়ূন আহমেদ গল্পকার হয়ে প্রথমপুরুষে কাহিনী বলেছেন। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ নিজের মন্তব্য দিয়ে বসেছেন এমন ভাবে - আমি ব্যক্তিগতভাবে এই খেলা বুঝার আশায় দিয়েছি জলাঞ্জলি। ১৫ আগস্টের কাহিনী চলার সময় তিনি লিখে বসেন - আমার বাবর রোডের বাসার কথা বলি। তারা, এরা, শফিক, অবন্তীদের গল্পে হঠাৎ তার নিজের ব্যক্তিগত মন্তব্য পড়ে আমার ধাক্কা লেগেছে। ধাক্কা লেগেছে কিছু কিছু জায়গায় কাহিনী বলা থামিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন খবরের কাগজের বিবরনের মতো।

হুমায়ুন আহমেদ দেয়াল উপন্যাসের শেষে গ্রন্থপুঞ্জি দিয়েছেন যেখানে ৩০টি বইয়ের নাম দেয়া আছে। তারপরও উপন্যাসটিতে বেশ কিছু তথ্যগত অসামঞ্জস্য রয়েছে। উপন্যাসের এক জায়গায় হুমায়ূন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বেশ বড় একটা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই ফারুক সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সবসময়ই সে বাইরে কাটায়। ভারতে ঢোকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষদিকে। দিল্লিতে কিছুদিন থাকে সে, তারপর ভারত প্রশাসন তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেয়। ফোর্ট উইলিয়ামে কিছুদিন থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সে বাংলাদেশে ঢুকে। দেশ স্বাধীন হয় ১৬ তারিখ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল আর্মি অফিসারকে দু'বছরের জ্যেষ্ঠতা প্রদান করেছিল; ফারুক জ্যেষ্ঠতা পায়নি। আবার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের কথা বর্ণনা করার সময় এক জায়গায় হুমায়ুন আহমেদ লেখেন যে খালেদ মোশাররফ ৩ তারিখ বিকাল তিনটায় জেলহত্যার খবর পেলেন। তিনি আরো লেখেন যে সময় ফারুক-রশীদ-ডালিমদেরকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট ব্যাংককের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ঠিক সেই সময় খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে ঢোকেন প্রেসিডেন্টে খন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করবার জন্য। গ্রন্থপুঞ্জিতে উল্লেখিত ত্রিশটি রেফারেন্সের কোথাও এই তথ্যগুলো এভাবে বলা হয়নি। প্রকৃতভাবে খালেদ মোশাররফ বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন যখন ফারুক-রশীদ-ডালিমদের নিয়ে বিমানটি উড়ে যায় ব্যংককের উদ্দেশ্যে। খুনিদের দেশত্যাগ নিশ্চিত করেই খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে যান আর জেল হত্যার ব্যাপারে তিনি জানতে পারেন পরের দিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর সকালে। হুমায়ুন আহমেদ কোন তাগিদে এই তথ্যগুলো এমন ভাবে পরিবেশন করলেন তা বোধগম্য নয়। আর একটি ভুল বিষয় চোখে লাগে তা হলো নভেম্বরের খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের সময়কার কাহিনীতে তিনি ফারুক ও রশিদ দুইজনকেই 'মেজর' বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু তারা দুইজনই তখন লেফট্যানেন্ট কর্ণেল।

তথ্যত্রুটি ও ধারাবাহিকতার অভাবকে পাশে সরিয়ে রাখলে দেয়াল উপন্যাসটিও হয়ে উঠে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বই। অন্যদিকে মধ্যাহ্ন বইটির ঘটনাপ্রবাহের ওপর হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ নিয়ন্ত্রন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে পুরোটা সময়। বোধকরি এখানে হুমায়ুন আহমেদ তার লেখনীর জাদু ফোটানোর সুযোগ ও স্বাধীনতা পেয়েছেন বেশী। চরিত্রগুলোর কথোপকথনে ও সংলাপে, হোক না সে ইতিহাস থেকে উঠে আসা কেউ, চমৎকার করে কথা বসিয়েছেন। সংলাপ গুলোই অনেক সময় উপন্যাসগুলোর মূল আকর্ষণ হয়ে উঠে, অতি সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠে মনোহর।

পার্থক্য থাকলেও দুইটি উপন্যাসই সুখপাঠ্য।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:১০

ফারদীন নিশ্চিন্ত বলেছেন: হুমায়ূন স্যারের যেকোনো লেখাই আমার কাঝে সুখপাঠ্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.