রানা প্লাজায় কনক্রিটে চাপা পড়া রক্তমাখা চিঠি....

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১১:৪২

মাগো

ক্যামন আছো তুমরা? দুই মাস হলো তুমাগে কাছে কুনো চিঠি লিখি না। লেখবো কেমনে? হাতে ট্যাকা পয়সা নাই, দুই মাসে ভালো মতো বেতনও পাই নাই। যা পাইসি তা দিয়ে ঘর ভাড়া দিসি, আর নিজেও ঠিক মতো খাইতে পারি নাই। তুমাগে কাছে চিঠি লিখতে হলে কয়ডা ট্যাকাও পাঠাইতে হয়, ট্যাকাও জুগাড় করতে পারিনাই চিঠিও লিখি নাই। কাল রাতে ভালো মতো ঘুমাইতে পারি নাই, খারাপ স্বপ্ন দ্যাইখ্যা বার বার ঘুম ভাইঙ্গ্যা গেসে। ভোরের আলো ফুটবার আগেই তুমারে চিঠিডা লিখতে বসলাম।

মাগো, এই গার্মেন্টেসে আর কাম করতে মন চায় না, পড়ালেখা করি নাই বলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোমড় ভাঙ্গা খাটুনি করতে হয়। মাস শেষে যে কয়ডা ট্যাকা পাই তা দিয়ে নিজের পেট চলে না, তারপরও তা থেইক্যা তুমাগেও কিছু পাঠাই। আমরা যে দালানে কাম করি সেই দালানের পিলার গুলো কেমন জানি ভাইঙ্গা যাইতেছে, এখানে কাম করতে আমাগো ডর করে। আমরা একলগে যারা কাম করি সবাই মিলে মালিকরে কইছি- আমরা এখানে কাম করুম না, আমাগো কিছু হইলে আমাগো পরিবাররে দ্যাখনের কেউ নাই।

মাগো আমি ট্যাকা পাঠাইতে না পারলেও বকুলের পড়া-লেখাডা বন্ধ কইরো না, তারে আমার মতো কইরা গার্মেন্টেসে ঢুকাইয়্যো না। বকুল এইবার ম্যাট্রিক পাস করলেই আমি ঢাকা নিয়ে আইস্যা ভালো একটা কলেজে ভর্তি কইরা দিমু। ওরে অনেক বড় করান দরকার, অনেক শিক্ষিত হওনের দরকার আছে।

মাগো আমি একটা সমিতিতে ট্যাকা জমাইতেছি, পরের বছর এক লগে অনেক গুলো ট্যাকা পামু। গেরামে আইস্যা সেই ট্যাকা দিয়ে আব্বারে একটা ছুডো মুদির দুকান বানায় দিমুনে। তুমার তখন আর পরের বাড়ি কাম করা লাগবে না। কয়ডা দিন অপেক্ষা করো খুব তাড়াতাড়ি আমাগে সুখের দিন আইবো।

মাগো আমার জন্য দোয়া কইরো। মজিদ কাকা সন্ধ্যার গাড়িতে বাড়িত যাবে। আমি দুপুরে খাইতে যাওনের সময় কাকারে চিঠিটা দিয়ে যামুনে। আর সামনের মাসে বেতন পাইলে তুমারে কয়ডা ট্যাকা পাঠাবো। ভালো থাইকো।



তুমাগে

শিরিন





চিঠিটা সম্পূর্ন কাল্পনিক। তবে গতকাল এইরকম অসংখ্য চিঠি চাপা পড়েছে কনক্রিটের নিচে। শুধু চাপা পড়েনি চিঠি, শুধু চাপা পড়েনি লাশের পর লাশ, চাপা পড়েছে অল্প অল্প করে বুনন করা হাজারো স্বপ্ন।

বাংলাদেশে অনেক সৌভাগ্যবানদের মধ্যে মনে হয় আমি একজন, কারণ আমার ঘরে কোন টেলিভিশন নেই। আমাকে দেখতে হয় না বিডিআর দের নৃশংস হত্যা, তাজরিন ফ্যাশন অথবা নিমতলির মতো ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। আমাকে দেখতে হয় না সাভারে বিল্ডিং ধসে মানুষগুলোর মর্মান্তিক মৃত্যু!

কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি, একটু পরপর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। শুধু মনে হয়েছে তাদের কথা যারা চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে, আর যারা লড়াই করছে মৃত্যুর সাথে! কি দোষ ছিল এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর!

তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা কি? তারা রক্তে মাংসে মানুষ আর আমরাও তাই। শুধু তারা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ আর আমরা দু'কলম বেশি জানা শিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ। তাহলে কি আজ আমাদের জীবনের মূল্য সবকিছুর মূল্য থেকে অনেক কম?

১ টি +২/-০