নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেমন তা বলতে পারব না, তবে আম্মু বলে আমি নাকি অনেক ভাল পুলা!

রাফাত সাগর

তুমিহীনা আমি ছন্নছাড়া!!

রাফাত সাগর › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন বাবার স্বপ্ন পূরণের গল্প

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:২৩

-রাফাত কি খাবি বল? কফি নাকি চা।
-উফ্ বাবা তুমি আসলে কি? বাসায় আসতে না আসতেই খাওয়া নিয়ে উঠেপড়ে লাগলে কেন? একটু ফ্রেশ হতে দিবে না আমাকে?
-এজন্যই বলছি। তুই ফ্রেশ হতে হতে এদিক দিয়ে আমিও একটা কিছু করে ফেলি। তারপর দুইজনে ছাদে বসে জমিয়ে গল্প করব। তাছাড়া অনেকদিন হয়ে হয়ে গেল তোর সাথে বসে কফি খাওয়া হয় না। তাই বলছিলাম।
`
শেষ কথাটা বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল। আমার বুঝতে বাকি নেই বাবার মন খারাপ হয়ে গেছে। আমারও একটু খারাপ লাগল। অাসলে অনেকদিন পর অাজ বাড়ি আসলাম। যদিও বেশি দিন না মাত্র ৩ মাস। তারপরেও অনেক। এর আগে কখনো এত দিন পর বাড়ি আসি নি। বাড়িতে বাবা একা থাকেন। ছোটবেলা যখন মাকে হারিয়েছি তারপর থেকে মায়ের অভাবটা বাবা কখনোই বুঝতে দেয় নি। আমাকে নিয়েই তার জীবন চলা। মাঝে মাঝে দু' একদিনের জন্য বাড়ি আসি আর এই সময়টা আমাকে পেয়ে বাবা যেন অমাবস্যার চাঁদ হাতে পান। ইদানিং লেখাপড়ার চাপ কেবল বেড়েই চলছে। এসাইনমেন্ট, সাপ্তাহিক আর মাসিক পরীক্ষা দিতে দিতে কখন যে মাসটাই শেষ হয়ে যায় বুঝতেই পারি না। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে নিজেকে অনেক কিছু থেকেই বিসর্জন দিতে হচ্ছে। তারপরেও এত কষ্টের পর যদি বাবার মুখে একটু খানি সুখের হাসি দেখি তখন এসব কষ্টের কথা আর মনে থাকে না। আমি বাবাকে বললাম।
`
- বাবা এক কাজ কর গরম কফি বানাও। এই শীতের মধ্যে গরম কফিই ভাল হবে। কি বল তুমি?
-হ্যা, একদম ঠিক বলেছিস। আমিও সেটাই ভাবছিলাম। তাহলে তুই চট করে তৈরি হয়ে নে।
`
আমার কথা শুনে বাবা মুচকি হাসলেন। এটুকুতেই বাবা অনেক খুশি হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি। আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
`
-তারপর, লেখাপড়া কেমন চলছে? কোন সমস্যা হচ্ছে না ত? চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করিস না। দিন দিন এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন?
`
বাবা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল। আমি বাবার কথা শুনে একটু চমকে উঠলাম। মাসকয়েক যাবত লেখাপড়া নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে নিজের চেহারাটাও আয়না দেখার কথা মনে থাকে না। আর রাত জেগে লেখাপড়া করা আবার সকালে উঠেই কলেজের দিকে দৌড় এটা যেন প্রতিদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। অন্যকিছু খেয়ালই থাকে না। আমি বাবার কাছ থেকে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলাম আর বললাম।
`
-কোথায়! কি বল! আমি ঠিক আছি। আর খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতই হচ্ছে।
-দেখ রাফাত লুকানোর চেষ্টা করবি না। তুই আমার ঘরে জন্মেছিস নাকি আমি তোর ঘরে জন্মেছি? ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করবি বলে দিলাম। আর ক্লাস কেমন চলছে?
`
বাবার এমন কথায় আমি একটু লজ্জা পেলাম। রাত জেগে লেখাপড়া করার কারণে চোখ, মুখ আর শরীরে কিছুটা অবনতি হয়েছে সেটা যে কেউ একবার তাকালেই বলে দিতে পারবে। আমি বললাম।
`
-ক্লাসের কথা আর বল না। ১ম, ২য়বর্ষ ভালই লাগছিল। কিন্তু ৩য় বর্ষে এসে পড়ার চাপ যেভাবে বেড়ে চলছে সেটা সামলানো একটু কষ্টই হচ্ছে।
-শুন রাফাত, জীবনে কিছু অর্জন করতে হলে কষ্ট করতে হয়। আর ভাল ডাক্তার হতে হলে কষ্ট করতে হবেই। তাছাড়া এই সময়টাই হচ্ছে নিজেকে গড়ে তুলবার সময়। আর সেই মূল্যবান সময়টায় যদি লেখাপড়া না করিস পরিশ্রম না করিস তাহলে যে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে বাস্তবে প্রতিফলিত হবে না। অার তখন আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। স্বপ্নের পিছে নিজেকে সপে দেয়। দেখবি সফলতা আসবেই। তোর পাশে সবসময় আমাকে পাবি। তোর আম্মু সবসময় বলত তার সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার হবে। মানুষের জীবন বাঁচাবে।
-না বাবা তুমি একদম চিন্তা কর না। তোমাকে যখন কথা দিয়েছি সেটা আমি পালন করবই। যদি শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিতে হয় তবুও পিছপা হবো না। তুমি ভরসা রাখতে পার।
আমার কথা শুনে বাবা মনে হয় গর্বিত হল। আর বলল
-আমি তোর উপর আস্তা রাখি। সবসময়ই রাখি! আমি এটাও বিশ্বাস করি যে তুই পারবি। তোকে পারতে হবেই। এটা যে তোর স্বর্গগামী মায়ের শেষ ইচ্ছে।
-তুমি শুধু দোঁয়া কর আমি যেন তোমাদের স্বপ্নটা সত্যি করতে পারি।
-সেটা সবসময়ই করি। তা এবার কলেজ ছুটি পেলি কতদিনের।
-এইত দু'দিন আছি। তারপর দিনই চলে যেতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। মিস দেওয়া যাবে না।
-এতদিন পর আসলি তাও মাত্র দু'দিনের জন্য?
-আরে ছোট সাহবে কখন এলেন? এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল?
`
আমি পিছনে তাকালাম দেখলাম রহমান চাচা হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। বাবার খুব বিস্বস্ত লোক। আমাদের বাড়ি দেখাশুনার জন্য বাবাই ওনাকে তার কাছে রেখেছে। বাবারও বয়স বেড়ে গেছে আর আমিও বাড়িতে থাকি না তাই কথা বলার জন্যই একজন বিশ্বস্ত আর কাছের লোক রাখা।
-আসসালামু আলাইকুম। রহমান চাচা! কেমন আছেন আপনি?
-ওয়ালাইকুম আসসালাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। তুমি কেমন?
-জ্বী চাচা ভাল।
`
দুইটা দিন কখন যে পার হল টেরই পেলাম না। আসলেই প্রিয় মানুষগুলোর সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো খুব তারাতাড়িই পার হয়। আজকে ডিএমসিতে চলে যাব। বাবার সকাল থেকেই মন খারাপ। সবসময়ই এটা হয়। চলে যাবার দিন বাবা কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে যায়। নিষেধ করা সত্ত্বেও আমাকে এগিয়ে দিতে বাস স্ট্যান্ড আসল। বাবাকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠে গেলাম। জানালা দিয়ে তাকালাম দেখলাম বাবা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে একটু হাসলো কেবল। আর বলল পৌঁছে জানাতে। আমি জানি হোস্টেলে পৌঁছে বাবাকে ফোন দিলেই বাবার মন ভাল হয়ে যাবে।
`
সেদিনটা আজো মনে আছে ছোটবেলা বাবার হাত ধরে প্রথম যেদিন স্কুলে গেলাম। সর্বপ্রথমে বাবা আমাকে টিচার্সদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তখন কিছুই বুঝতাম না কিছু অপরিচিত লোকের সাথে পরিচিত হলাম। আমার কাছে খুব ভালই লাগছিল। সেই থেকে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। ধীরে ধীরে স্কুল লাইফ ছেড়ে উচ্চ মাধ্যমিকে অবতরণ করলাম। তারপর সেখান থেকেও সাফল্যময় ফলাফল। আমার সেদিনটি স্পষ্টই মনে অাছে যেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পাওয়ার খবর আসল। বাবা সেদিন খুশিতে বাচ্চাদের মত হেসেছিল। আমি বাবার সেই হাসির দিকে তাকিয়ে ছিলাম অপলক চোখে। আমি বুঝতে পারছিলাম বাবা আমার চাইতেও বেশি অানন্দিত হয়েছিল। আমার সাফল্য দেখে বাবা সেদিন বলেছিল- এগিয়ে যাও স্বপ্ন পুরনের লক্ষ্যে। কখনও যদি হোঁচট খাও আবার উঠে দাঁড়িয়ে শুরু করো তোমার পথ চলা। কখনও থেমে যেও না আমার ছেলে কখনও হারতে পারেনা। যদি কখনও পুরো পৃথিবী তোমায় সমর্থন না করে যদি কখনও মনে হয় তুমি একা হয়ে গেছো একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখো আমায় সবসময় পাবে তোমার সাথে তোমার পাশে।
বাবার এমন কথায় আমি অনুপ্রাণিত হতাম। সবসময়ই হতাম। নতুন করে স্বপ্নের পথে চলার উৎসাহ খোঁজে পেতাম। বাবার কথা শুনলে মনে হত মন থেকে চাইলে সবকিছুই যেন সম্ভব! আর এমন একজন বাবার ছায়াতলে থাকলে সবাই সফল হবে। নিশ্চই হবে। হতে হবেই।
`
দেখতে দেখতে আরো একটা বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। ফাইন্যাল পরীক্ষাটা নিকটেই। লেখাপড়া নিয়ে খুব ব্যস্তই বলা চলে। বাবার সাথে দিনে দু'একবার কথা হয় তাও আবার অল্প সময়ের জন্য। বাবাও চাইত যে কয়দিন আছে ঐ সময়টা শুধু লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত থাকি। তাছাড়া সবসময় ভাল ফলাফল করার কারণে আমার প্রতি স্যারদের একটা আলাদা নজর ছিল। কিভাবে কি করতে হবে সেটা নিয়ে ওনারা গাইড লাইন দিত। তাদের এমন সহযোগীতায় আমার প্রস্তুতিটা খুব ভালই এগুচ্ছিল। এরই ফাঁকে পরীক্ষার টাকার জন্য একদিন বাড়ি গেলাম। আমি দেখলাম বাবার শরীর ততটা সুবিধের ছিল না। সময়ের স্বল্পতার কারণে সেদিন বিকেলে চলে আসতে হয়। কিন্তু আমার কেন জানি বাবাকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। আমার কেবল মনে হচ্ছিল বাবার সাথে আরো কিছুক্ষণ থাকি। আরো কয়েকটা কথা বলি। বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। আমাকে এমন করতে দেখে বাবা বলল পাগল ছেলে! যাও আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি ভাল থাকব। পরীক্ষার নিয়ে ভাব। অনিচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও ঢাকা চলে আসলাম। পরদিন ক্লাস শেষে লাঞ্চ করতে বেরুব এমন সময় ফোন বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি রহমান চাচার ফোন। আমি খুব অবাক হলাম কারণ চাচা কখনো আমার কাছে ফোন করে না বা ফোন করার দরকার হয় না। আমার কাছে কেমন সন্দেহ হতে লাগল। আমি কাপা হাতে রিসিভ বাটনে চাপ দিলাম। তখনই চাচার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
-রাফাত, শর্বনাশ হয়ে গেছে ভাইজানের শরীর ভাল না তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি আস। এখনি চলে আস।
`
হঠাৎ চাচার মুখে এমন কথা শুনে আমার শরীরে শীতল একটা প্রবাহ বয়ে গেল। আমার পুরো পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। কিছুক্ষণ কিছুই বলতে পারলাম না। বাবার শরীর খারাপ! তাহলে কি হয়েছে বাবার? কি হয়েছে?
-এসব কি বলছেন কাকা? হঠাৎ কি হল বাবার?
-একটু আগে ব্রেইন স্টোক হয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভাল না। আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি এখনি বাড়ি চলে আস।
-আচ্ছা আমি আসছি।
`
কিভাব যে পথটা পারি দিলাম সেটা কেলব আল্লাহই জানে। বাড়িতে যখন পা রাখলাম তখন লক্ষ্য করলাম চারদিকে কেমন একটা গুমট ভাব বিরাজ করছে। বাড়িতে অনেক মানুষ। মনে হচ্ছিল সবাই আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। সবার এমন চেহারা দেখে আমার অস্থির লাগতে লাগল। হৃদপিন্ডের স্পন্দন খুব দ্রুত প্রসারিত হতে থাকল। আমি চাচাকে দেখলাম একপাশে বসে কাঁদছে। চাচাকে কাঁদতে দেখে আমার কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। আমি চিৎকার করে বললাম।
-চাচা, বাবা কোথায়?
চাচার কান্নাটা আমার দিকে তাকিয়ে আরো বেড়ে বাড়ে গেল। আমার ভয় হতে লাগল। বাবার কিছু হল না ত? আমি আবার বললাম
-কি হল কথা বলছেন না কেন? বলুন বাবা কোথায়? তারাতারি বলুন আমি বাবাকে দেখব। বাবার শরীর কেমন এখন?
-ভাইজান ঐ ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তুমি গিয়ে দেখ।
`
আমি দৌড়ে বাবার ঘরের দিকে ছুটলাম কিন্তু গিয়ে এমন দেখব কল্পনাও করি নি। বাবাকে মেঝেতে শুইয়ে রাখা আছে উপরে একটা সাদা চাদরে ঢেকে দেওয়া। মাথার কাছে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে আর সেখান দিয়ে বাবার হাসিমাখা মুখটা আমি দেখতে পেলাম। কিন্তু বাবাকে এখানে এভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছে কেন? বাবার যে ঠান্ডা লেগে যাবে। এই বোকা লোকগুলো কি সেটা বুঝে না। চাচাকে ইচ্ছামত বকে দিতে হবে। আমি বাবার মুখ থেকে আস্তে করে চাদরটা সরালাম। বাবা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। মনে হয় কতকাল যেন ঘুমায় নি। বাবা যে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে সেটা বুঝতে এতটুকু দেরি হল না। আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম আর বাবাকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু না! বাবা বোধহয় আমার উপর রাগ করছে সেজন্য আমার একটা ডাকেও সারা দিচ্ছে না। কি এমন করলাম রে বাবা যার জন্য কিছু না বলেই চলে গেলে। একবারও কি ভাবলে না আমি কিভাবে থাকব? কার সাথে গল্প করব। কাকে দেখে হাসব। কার স্বপ্নপূরনের জন্য দিনরাত কেবল কষ্ট করব। আমাকে কে উৎসাহিত করবে? কে আমাকে চলতে শেখাবে?
আমি কাধে কারো স্পর্শ পেলাম। তাকিয়ে দেখি চাচা। আমি চাচাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।
-এটা কিভাবে হল চাচা। তুমি কি পারলে না বাবাকে বাঁচাতে?
-ভাইজানকে আমরা যখন হাসপাতালে নিয়ে গেলাম তখন কর্তব্যরত ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রহমান সাহেব আর কোন হোপ নেই। আফজাল সাহেব আর নেই আমাদের মাঝে। চলে গেছেন দূর দেশের বাসিন্দা হয়ে। বিশ্বাস কর ডাক্তারের কাছ থেকে এমন কথা শুনে আমার কেবল তোমার কথাই মনে পড়ছিল। কিভাবে বলব তোমার কাছে। কি বলার আছে?
`
বাবাকে হারিয়ে আমার পুরো দুনিয়াটাই উল্টে গেল। সব স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে জীবন্ত লাশ হয়ে যাচ্ছিলাম। চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখতে লাগলাম। চাচা মাঝে মাঝে এসে শান্তনা দিত। তারপরেও আমি অসহায় হয়ে পড়লাম। হঠাৎ একদিন রাতে বাবাকে স্বপ্ন দেখলাম। বাবা বলল- উঠে দাঁড়াও, অনেক হয়েছে আমিতো আমার ছেলেকে এটা শেখাইনি, আমার ছেলে কখনও হেরে যাবে না, হারতে পারেনা। তোমাকে স্বপ্ন পুরন করতে হবে। তোমার স্বপ্ন আমার স্বপ্ন আমাদের স্বপ্ন। আমি লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু বাবাকে দেখতে পেলাম না। আমি বাবার কথাগুলো ভাবতে থাকলাম।আমি কখনো হারি নি। হারব না। আমাকে এগিয়ে যেতে হবে স্বপ্নপূরণের পথে। আমি নতুন করে সবকিছু শুরু করলাম। দিগুন উৎসাহে এগিয়ে যেতে থাকলাম। তবে একটা জিনিস সবসময় অনুভব করতাম বাবা আমার পাশে আছে। আমাকে দেখছে।
`
পরিশিষ্টঃ
-স্যার ২২১ নাম্বার বেডের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। একটু দেখতেন যদি।
- শিউর, তুমি যাও আমি আসছি।
জামিল সাহেব। লোকটাকে দেখলে কেমন মায়া হয়। মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় একজন অসহায় বৃদ্ধলোক। দেখাশুনা করার মত তেমন কেউ নেই। ওনার এক ছেলে ছিল এখন নাকি বাবার কোন খোজখবর নেয় না। শুনেছি কিছুদিন বৃদ্ধাশ্রমে ছিল। সেখানে অসুস্থ হয়ে যাবার পর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় আমাদের হাসপাতালে এনে ভর্তি করিয়ে দেয়। তারপর ঐ লোকেরও কোন খবর নেই। প্রথম যেদিন ওনাকে অপারেশন করতে গেলাম ওনাকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ে গেল। বাবার বয়সি হবে। সেদিন লোকটার প্রতি কৌতুহল জন্মেছিল। আমি নিজ দায়িত্বে আর নিজ হাতেই ওনার অপারেশন করলাম। পরে ওনার বিষয়ে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম সবকিছু। তারপর থেকে লোকটার সব ট্রিটমেন্ট হতে শুরু করে যাবতীয় সবকিছু আমিই দেখছি। নার্সিংহোমেও বলেদিলাম ওনার একটু খেয়াল রাখতে। নার্সগুলোও যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে। অপারেশন করার দুইদিন পর আজকে জ্ঞান ফিরল। আমি ওনার বেডে গেলাম।
-আংকেল এখন কেমন ফিল করছেন? ব্যাথাটা কি আছে?
-জ্বী বাবা এখন একটু ভাল লাগছে। অার ব্যাথাটাও কিছুটা কমেছে মনে হয়।
-টেনশস নিয়েন না। আল্লাহ'র উপর ভরসা রাখুন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যা মিস তিথী?
-জ্বী স্যার।
-আপনি এক কাজ করুন ওনাকে আপাতত ইনজেকশন দেওয়ার দরকার নেই আমি রাতে চেকআপ করে বলব। আর ওনার খাবার ব্যবস্থা করুন।
-আচ্ছা।
`
বাবার স্বপ্নটা আমি পূরণ করতে পেরেছিলাম ঠিকই কিন্তু আফসোস একটাই থেকে গেল বাবা সেটা দেখে যেতে পারলেন না। হয়ত ভাগ্যে ছিল না তাই এমনটা হয়েছে। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকত অার জামিল সাহেবের কথা শুনত তাহলে অনেক খুশি হত। নিশ্চই হত! যদি জানত যে আমি নিজ দ্বায়িত্বে ওনার চিকিৎসা করছি, ওনার পাশে দাড়িয়েছি। তখন অনেক গর্ববোধ করতেন। আর বলতেন আমার ছেলে আমার ছেলে আমার মতই হয়েছে আমার আদর্শেই বড় হয়েছে। নিরীহ মানুষগুলোর পাশে দাড়িয়েছে।
`
বাবা মারা গেলেন আজ পাঁচটা বছর হয়ে গেল। চোখের পলকেই যেন দিনগুলো কেটে গেল। ব্যস্ততার কারনে বাড়িতে যাওয়া হয় না। শেষ মনে হয় দু'বছর আগে একবার গিয়েছিলাম। তারপর আর সময় করতে পারি নি। না যাওয়ারও একটা কারণ আছে। বাড়ি গেলে বাবার কথা খুব মনে পড়ে। বাবার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে। তখন চারিদিকে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করে। বাবা নেই এই কথাটা নিজেকে বুঝাতে পারি না। যখন দেখি বাবার সেই আরামের চেয়ারটা আর বসে গল্প করার জায়গাগুলো খালি পড়ে থাকতে তখন ইচ্ছে হয় বাবাকে চিৎকার করে ডাকি বাবা কোথায় তুমি? আমাকে ছেড়ে তুমি কিভাবে থাক? তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না তোমার ছেলে বাড়ি এসেছে। অামার কাছে মনে হয় বাবা আগের মতই বলে রাফাত, তোর সাথে অনেকদিন কফি খাওয়া হয় না গল্প করা হয় না আয় একটু গল্প করি। কিন্তু না! বাবা আসে না। যখনই ভাবি যে বাবা পাশে নেই নিজেকে শুন্য মনে হয়। মনে হয় কিছু যেন নেই আমার। বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করি। উৎস খুজে পাইনা আমি। মাঝে মাঝে রহমান চাচার সাথে কথা হয়। বাবা মারা যাবার পর রহমান চাচাই আমাদের বাড়ির দেখাশুনা করছেন। তিনি সবসময়ই বলে একবার গিয়ে ঘুরে আসতে। বাড়িটা দেখে আসতে। আমি কিছু বলি না। আসলে আমার অবস্থাটাও চাচা বুঝতে পারে তাই তিনিও বেশি কিছু বলে না। কিছুদিন থেকে রিনিতাও বলছে একবার গিয়ে ঘুরে আসার কথা। বিয়ের পর ওকে নিয়ে যাওয়া হয় নি। আর যদি না নিয়ে যাই মেয়েটা আবার রাগ করতে পারে। একবার গিয়ে ঘুরে আসা দরকার। বাবার কবরটাও দেখে আসব। ভাবছি বাবার নামে গ্রামে একটা হাসপাতাল করব। আর সেটার নাম দেব 'আফজাল আহম্মেদ মেডিকেল হসপিটাল'। সেখানে গ্রামের অসহায় মানুষের বিনা পয়সায় চিকিৎসা হবে। যারা সামান্য টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারে না। শুধু কষ্টই পেয়ে যায়। এরকম কিছু মানুষের পাশে দাড়াব। তাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হব।
`
সবশেষে এটুকুই বলব, আমরা স্বপ্ন দেখি সবসময়ই দেখব। হউক সেটা বাস্তব কিংবা কাল্পনিক। স্বপ্নইত আমাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা জাগায় আর এটাকে আকড়ে ধরেই আমরা বেঁচে থাকি। সাফল্য আসলে কোনো ডেস্টিনি নয়, এটা একটা জার্নি। সেই জার্নিটাই বাবা পরম মমতায় আমাকে শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন। তার শিক্ষা, দোয়া, মমতা আমার সাথে ছিল বলেই আমি তাদের স্বপ্নটা পূরণ করতে পেরেছি। পেরেছি একজন স্বর্গগামী মায়ের কথা রাখতে। বিধাতার কাছে আজ কোন চাওয়া নেই। শুধু এটুকুই বলতে চাই জীবনের এই বাকি সময়টা যেন এরকম নিরীহ কিছু বাবাদের পাশে দাড়াতে পারি। তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাতে পারি। যারা স্বপ্ন দেখেছে কিন্তু সেই স্বপ্নটা বাস্তবিকতার স্পর্শ পায় নি। স্বপ্ন নিয়েই সে মানুষগুলো আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.